ঘুরতে ভাল লাগে, দেখতে ভাল লাগে, জানতে ভাল লাগে। কিন্তু ঠিক কি দেখতে চায় আমরা নতুন কোন জায়গায় গেলে? সেটা একেক মানুষের ক্ষেত্রে একেক রকম। আমার নিজের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভাল লাগে অবারিত প্রকৃতি, সেখানে বুনো পশু, পাখি থাকলে আর কিছুই দরকার নেই। এরপর আসে ঐতিহাসিক স্থাপনা, বিশেষত যেখানে জ্ঞানের সাথে মিশে থাকে জানা-অজানা রহস্য। সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা, বিশেষ করে সেখানের লোকসংস্কৃতি যদি হয় অনেক অনেক প্রজন্মের পুরনো। আসে রঙ ও সঙ্গীতের কথা, রঙ বলতে স্থানীয়দের ঘর-দোর , যানবাহন বা পোশাক-আশাক। আর সঙ্গীতের পাগলতো আমরা সবাই। পুরনো বইয়ের দোকানের কথা উল্লেখের দরকার আছে বলে মনে হচ্ছে না! এমন তালিকা বাড়তেই থাকে, এর অনেক পরের দিকে আসে খাবার ( ব্যক্তিগত ভাবে আমি ভোজনরসিক না হলেও নিত্যনতুন খাবার চেখে দেখতে কোন আপত্তি করবার কারণ খুঁজে পাই না)।
অনেক স্থানেই উপরের তালিকার একাধিক জিনিস মিলে যায়, তখন ভাল লাগে, ভ্রমণটা আরো বর্ণময় হয়ে ওঠে বহুমাত্রিকতার ছটায়। কিন্তু এর সবই যে একজায়গায় মিলতে পারে তার অভিজ্ঞতা প্রথমবারের মত হল এই মাসে মেক্সিকোর চিআপাঁস রাজ্যের প্রাচীন মায়া নগরী পালেঙ্কেতে যেয়ে। মায়া সভ্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই নিদর্শন , একেবারে ঘন চির সবুজ বৃষ্টিঅরণ্যের মাঝে শত শত বছর আগে হারিয়ে যাওয়া এই নগরী এখনো ঘেরা অজানা সব রহস্যে। যাবেন না কি পালেঙ্কে! প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি অপার মুগ্ধতার!
পুয়েবলা রাজ্যের ভেরাক্রুজ শহর হতে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল, মেক্সিকান বন্ধু ইসায়আ সেরণার বাবা দয়াপরবেশ হয়ে তার গাড়ীটি আমাদের ব্যবহার করতে দিলেন বিনা শর্তে, সেখানে সওয়ার হল আরো দুই মেক্সিকান বন্ধু হুয়ান ভিদাল এবং সিজার সোসা চিকো, একুনে আমরা চারমূর্তি। গাড়ী চলল তীর বেগে সবুজ শ্যামলা দেশটির বুক চিরে (আজ্ঞে, মেক্সিকো অতি সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা দেশ, হলিউডি চলচ্চিত্রের মত রুক্ষ লাল মাটির অন্তহীন প্রান্তর নয়, যেখানে কেবল সমব্রেরো আর ক্যাকটাসের রাজত্ব, এই নিয়ে পরবর্তীতে লেখা আসিতেছে ) , প্রায় এগার ঘণ্টা পড়ে সাঁঝের আঁধারকে সাথী করে আমাদের প্রবেশ চিআপাঁসের ঘন অরণ্যে, তারপর সোজাসুজি পালেঙ্কেতে।
এককালের সরগরম মায়া মহানগরী আধুনিক পালেঙ্কে থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে, আঁধার ঠেলে অচেনা জায়গায় হোটেল বের করতেই বেশ একটা ঝক্কি গেল। তারপর পেটপূজার জন্য যাওয়া হল শহরকেন্দ্রে, সেখানে সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে জুড়িহীন মিচেলাদো ( মিচেলাদো জিনিসটা মেক্সিকোর নিজস্ব আবিস্কার, তারা কেবল গ্লাসে সোনালী তরল ঢেলেই ক্ষান্ত হয় না, বরং দক্ষ শিল্পীর মত সেই গ্লাসের মুখের চারধারে মরিচের গুঁড়ো, লবণ ইত্যাদি সুচারু ভাবে মাখিয়ে দেয়। ফলাফল, তরল আর সেইসব মশলা মিলে ক্যাপ্টেন হ্যাডকের অমৃতসম ক্লান্তি দূরকরা পানীয়) আর পাররিয়াদা ( এক দুর্দান্ত মাংসের ডিশ, যেখানে নানা ধরনের সব্জির সাথে গরু, মুরগী, বরাহ, ভেড়া, খরগোশ- প্রায় সবকিছুর মাংসই বর্তমান)
আনা হল, সেগুলোর সদব্যবহার করতে করতে সেই মুখরিত প্রাঙ্গণের চলমান মেলার উপরে মনে হলে ধূসর একটা অবয়ব কেমন ভুতুড়ে ভঙ্গীতে চক্কর দিয়ে শূন্যে নেই হয়ে গেল! খানিক পরেই মেক্সিকোর তারা জ্বলা রাতে সেই অবয়বটি আবার ডানা মেলে আমাকে জীবনানন্দ মনে করিয়ে দিল--
ভেবে ভেবে ব্যথা পাব, -মনে হবে, পৃথিবীর পথে যদি থাকতাম বেঁচে
দেখিতাম সেই লক্ষ্মীপেঁচাটির মুখ যারে কোনোদিন ভাল করে দেখি
নাই আমি—
এমনই লাজুক পাখি, - ধূসর ডানা কি তার কুয়াশার ঢেউয়ে ওঠে নেচে,
ততক্ষণে হুয়ানের চোখে পড়েছে প্যাঁচাটি , সে তো স্প্যানিশে বুয়ও বুয়ও (মানে প্যাঁচা) করে বলল তা জীবনে দেখা প্রথম বুনো লক্ষ্মী প্যাঁচা! রাতে হোটেল ফিরে তারবিহীন নেট ব্যবহার করতে পেরে আনন্দের চেয়েও অনেক বেশী ঘিরে ধরল নিখাঁদ বিস্ময়, এই গহন অরণ্যের মাঝে নেটের মাধ্যমে সারা বিশ্বের সাথে যোগাযোগ প্রতিস্থাপন করতে পারলে বিস্ময়াভূত হব না!
পরদিন বেশ সকাল সকালই উঠে অন্যদের প্রস্তত হতে বলে বরাবরের সঙ্গী ক্যামেরা হাতে একটু ঘোরাঘুরি করতে বেরোলাম, যদি ফ্রেমে সারাজীবন বাঁধিয়ে রাখার মত কিছু মিলে যায়, মিলেও গেল, এক না একাধিক! প্রথমটি এক হামিংবার্ড, কোন প্রজাতির সেটা ঠাহর করার আগেই উনি সেকেন্ডে কমপক্ষে ৫০বার ডানা ঝাপটে পগার পার হলেন, পরেরটি মায়া রমণীদের একটি ক্ষুদে দল, এরা এই সময়েই রওনা দিচ্ছে সেই প্রাচীন শহরের দিকে, নানা মনোহারী দ্রব্য তাদের সঙ্গী, বিকিকিনির জন্য।
এখনো চির রহস্যে মোড়া মায়ানদের পরিচয়। কারা ছিল তারা? কোথা থেকে এসে গড়েছিল এত উন্নত সভ্যতা? কিভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল মহাকালের প্রান্তরে? কিছুই সঠিক ভাবে জানা নেই আমাদের। এমনকি বর্তমানে যারা নিজেদের মায়ান বংশধর বলে দাবী করে তারাও যে আসলেই সেই সুমহান সভ্যতার গোড়াপত্তনকারীদের ডিএনএ বহনকারী এটিও অকাট্য ভাবে প্রমাণিত নয়। তবে এটুকু বোঝা যায় ল্যাতিন আমেরিকায় হাজার হাজার বছর ধরে বসবাসকারী শত শত গোত্রের মাঝে মায়াদের মুখাবয়ব এবং দেহের আকৃতি একেবারেই আলাদা ধরনের, সেই এশীয় চিহ্ন আছে বটে সাইবেরিয়া থেকে আসার জন্য কিন্তু বেশ মোটা মুখমণ্ডল, ভরাট গাল, খর্বাকৃতির দেহ অন্য যে কোন গোত্রের চেয়ে আলাদা। যে কারণে অ্যাজটেক, ইনকা, টোলটেকদের উৎস এবং নিশ্চিহ্ন হবার কারণ আমাদের প্রায় সবটুকুই জানা থাকলেও মায়াদের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থা এখনো অন্ধকারে হাতড়ানোর মতই। (তাদের এক বর্ষপঞ্জিকাই যেভাবে কোটি কোটি মানুষের ঘুম কেড়ে নিয়েছে ২০১২র ডিসেম্বরে এই গ্রহ ধ্বংস হয়ে যাবে বলে!!)
মায়া রমণীদের দলটির গোটা কয়েক ছবি তুলতে না তুলতেই ইসাইয়ার বাবার গাড়ীর ভেঁপু শোনা গেল, রওনা হলাম আমরা পালেঙ্কের উদ্দেশ্যে। আরো ঘন বনের মাঝে উঁচু পাহাড়ের মাথায় সেই শহর, বেশ সর্পিল রাস্তা বেয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ী রেখে বেশ খানিকটা হেঁটে মূল ফটকের সামনে যাওয়া হল, জায়গাটিতে বেশ রমরমা একটা বাজার বসে গেছে ইতিমধ্যেই, তারমধ্যে ইতস্তত ঘোরাঘুরি করছেন মায়াদের রঙিন সাজপোশাক পরা তরুণীরা আর ধবধবে সাদা ফতুয়া জাতীয় পোশাক পরিহিত বালকের দল। সূর্যদেব ইতিমধ্যেই বেশ কিছুটা উপরে উঠে গেছেন তাই প্রথমেই খাদ্য অন্বেষণ করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে হল।
সবার আগে মিলল ঝালমুড়ি! কেউ কি বিশ্বাস করবে! ঠিক মুড়ি নয়, নানা ধরনের শিম বিচি, ভুট্টার দানা, সূর্যমুখীর বিচি এমনকি ছোট্ট ছোট্ট শুটকি মাছ পর্যন্ত সেই ঝালমুড়ির আস্তানায় মিলল, কার সাথে কি চায় বলতেই চাল্লু ছোকরা সব মিশিয়ে আমাদের দেশের মতন ইচ্ছেমত খানিকক্ষণ ঝাকিয়ে বেশ খানিকটা টাটকা লেবুর নির্যাস দিয়ে প্যাকেট করে দিল , আর ঝাল! মেক্সিকোতে ঝাল ছাড়া কোন খাবার হয় না !!
বেশ তৃপ্তি হল বটে সেই মুড়ি বিহীন ঝালমুড়ি খেয়ে, কিন্তু খানিক পরেই গোটা শহর চষে বেড়াতে হবে, মায়ান পিরামিডের উপরে চড়তে হবে, তাই জম্পেস একটা খাবারের জন্য মায়ান রেস্তোরাঁয় বসা হল। বসেই উদাত্ত গলায় বলে বসলাম যস্মিন দেশে যদাচার, মায়া মুলুকের যখন এসেছিই খাঁটি মায়ান খাবার আস্বাদন করেই তবে যাব। মিলে কলা পাতায় মোড়ানো তামাল, আসলে ভুট্টার দানা মিহি করে গুঁড়ো করা, তার মধ্যে চাহিদা মত মাংসের কিমা মেশানো। উপরে ইচ্ছে মত ঝাল বা লেবুর সস ঢালা যায়। তামাল একেবারে মায়ানদের খাবার বলেই ধারনা করা হয়, প্রায় তিন হাজার বছর আগের রেসিপি মোতাবেক প্রস্তত এক সুখাদ্য খাচ্ছি তা ভাবতেই রসনার চেয়ে মস্তিষ্কই বেশী আনমনা হয়ে উঠল।
এরপরে গাছ পাকা সোনালি বর্ণের আমের দামদর করছি ( মেক্সিকোতে বছরের ১২ মাসই আম মিলে, কত্ত বড় অবিচার!) এই সময় দুতিনটে ছেলে চিৎকার করে উঠল মনো মনো বলে। মনো মানে বাঁদর। দেখি উঁচু গাছের আড়ালে ৪-৫টি বেশ মিশমিশে কালো বাঁদরের দল তাদের লাঙ্গুল দেখিয়েই নাই হয়ে গেল। বাহ, বেশ তো জায়গাটি, ইতিহাস অনুভব করতে এসে বুনো স্বাধীন প্রাণীর দেখা মিলল!
অবশেষে মূল ফটক পেরিয়ে সিঁড়ি টপকিয়ে আমরা মূল পালেঙ্কে চত্বরে পৌঁছালাম এবং মোহাবিষ্টের মত তাকিয়ে থাকলাম সকল বিশেষণ, ভাষা, ধ্বনি ভুলে অবাক বিস্ময়ে। প্রায় ২১০০ বছর আগে দুর্গম এই অঞ্চলে, শ্বাপদ সংকুল অরণ্যে এই কীর্তি গড়ে ছিল কোন সে স্থপতি! কি অপূর্ব বিস্ময়!
শ্যাওলা ঢাকা কালচে রঙের সিঁড়ি, বেয়ে উঠে যেতে হবে নানা প্রত্নসম্পদ ছুয়ে দেখতে, কোনটা পিরামিড, কোনটা রাজার প্রাসাদ, কোনটা পুরোহিতের মন্দির কোনটা আবার আকাশ পর্যবেক্ষণের কাজে ব্যবহৃত মানমন্দির।
কিন্তু মূল আকর্ষণ এর মাঝে খড়ের চালা দিয়ে ঢেকে রাখা পবিত্র মায়ান সমাধি কক্ষ, এখানেই যে সমাধিত হয়েছিলেন সবচেয়ে বিখ্যাত মায়ান রাজা পাকাল, ইতিহাসে যার নাম অক্ষয় হয়ে আছে পাকাল দ্য গ্রেট নামে।
৬১৫ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে পাকাল রাজা হিসেবে সিংহাসন অলংকৃত করেন, সুদীর্ঘ ৬৮ বছর রাজ্য শাসনের পরে, পালেঙ্কেকে তার ইতিহাসের অন্যতম সমৃদ্ধির স্থানে নিয়ে যাবার পর ৮০ বছর বয়সে তিনি দেহ রক্ষা করেন। পালেঙ্কের উদ্ধারকৃত অনেক দেয়ালের গায়ে খোদাই করা পাকালের দেহাবয়ব দেখা যায়, ধারণা করা যায় প্রাচীন মিশরে ফেরাউন ২য় রামেসিসকে যেমন দ্য গ্রেট ফারাও বলা হয়, তেমনি পাকাল সমসন্মানে ভূষিত ছিলেন মায়ান রাজত্বে।
রাজা পাকাল সম্বন্ধে শৈশবে আগ্রহের জন্ম নেয় তার সমাধির ঢাকনা বা সার্কোফোগাসের ওপর খোদিত চিত্রকর্ম দেখে, যা বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত সার্কোফোগাস। যেখানে দেখা যাচ্ছে পরকালের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছেন মহান রাজা পাকাল, কিন্তু এরিক ফন দানিকেন এবং তার গ্রহান্তরের মানুষ তত্ত্বের সমর্থকরা মনে করল রাজা পাকালের এই ছবি নিখুঁত ভাবে রকেট নিয়ন্ত্রণরত একজন মহাকাশচারীর ছবিকে নির্দেশ করে! যেখানে দেখা যাচ্ছে সামনের মনিটরে চোখ নিবদ্ধ রেখে হাতে ও পায়ে নানা যন্ত্র নিয়ন্ত্রনে ব্যস্ত একজন মহাকাশচারী , এমনকি তার যানের শেষ প্রান্ত দিয়ে বেরোনো ধোঁয়াও আবিস্কার করলেন অনেকে, কিন্তু একমাত্র বিচ্যুতি ছিল পাকালের মাথায় কোন মহাকাশচারীর হেলমেট ছিল না!
আমিও নিজেও একাধিক তথ্যচিত্র দেখেছি যেখানে রাজা পাকালকে অস্বাভাবিক উচ্চতার অধিকারী বর্ণনা করে দাবী করা হয়েছে উনি নিজেই ছিলেন একজন এলিয়েন! যাই হোক, এই সময়ে দানিকেন চর্চা সারা বিশ্বের তুমুল আলোড়ন তুললেও এর পক্ষে কোন শতভাগ প্রমাণ না মেলায় এবং বিকল্প গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যাবার ফলে ইতিহাসবিদরা মাটি খুঁড়ে নতুন তথ্য বা শিলালিপি উদ্ধার করে আসল সত্যের নাগাল পেতে বদ্ধ পরিকর। অনেকেই প্রশ্ন তুলতেন, রাজা পাকালের মাথা কেন এমন অদ্ভুত আকারের? উত্তর, থাকে অতি ছোট অবস্থাতেই বিশেষ হাড়ের তৈরি পাথর সংযুক্ত ভারি মুকুট পরিয়ে রাখা হত, ফলে মাথার খুলি এমন অস্বাভাবিক আকার ধারণ করে।
হাঁটি হাঁটি পা পা করে অবশেষে ঢোকা গেল মূল সমাধি কক্ষের কাছের রাস্তায়, কফিনটি ফাঁকা, সেই অতি বিখ্যাত ঢাকনাটি আর নেই এখন, নেই চির চেনা সেই সবুজ জেড পাথরের মহা মূল্যবান মুখোশ (ডেথ মাস্ক) কিন্তু লালচে রঙের ফাঁকা কফিনটিই যেন উত্তর দিন হাজারও না মেলা প্রশ্নময় কৌতূহলের।
বাহিরে তখন বৃষ্টি হচ্ছে বেশ জোরে, সমাধিকক্ষের দেয়াল ভেদ করে জল চুইয়ে পড়তে থাকল বিন্দু বিন্দু। এমন বন্ধুর আবহাওয়াতেও যে এই স্থাপত্যগুলো টিকে আছে তা বিস্ময়কর। চোখে পড়ল মায়ান স্থাপত্যকলার কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য, বিশেষ করে পিরামিড জাতীয় ছাদ করার সময় কি করে দুই দিকের দেয়াল ক্রমশ কাছে এগিয়ে আনা হত।
সমাধি মন্দির থেকে বেরোতেই জানা গেল নিরাপত্তাজনিত কারণে সবচেয়ে উঁচু পিরামিডে বা মন্দিরে আরোহণ নিষিদ্ধ! কিন্তু আমরা অন্যান্যগুলোতে যেতে পারব।
কাছের বিশাল মন্দিরটিতে চড়া হল সাবধানে, সেখানে চারপাশের বারান্দা ঘিরে উঁচু স্তম্ভগুলোতে রাজা পাকালের অবয়ব খোদাই করা আছে, কিছু বেশ স্পষ্ট, বাকিগুলো কালের ধুলোয় ক্ষয়ে গেছে।
অদূরেই আরো বেশ কয়েকটি মন্দির। ১৮০০ সালের দিকে বিচ্ছিন্ন ভাবে এই জঙ্গলে ঢাকা মহানগরীতে বিচ্ছিন্ন ভাবে প্রত্নতত্ত্ববিদ, অভিযাত্রী, গুপ্তন্ধনসন্ধানীদের আগমন ঘটতে থাকে। তখন পুরো অঞ্চল ছিল অত্যন্ত জনবিরল। আস্তে আস্তে গত শতাব্দীতে জঙ্গল পরিষ্কার করে পালেঙ্কেকে বর্তমান রূপে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তারপরও চারিদিকে ঘিরে আছে সবুজ মহীরুহরা, যেন কিছুদিন সুযোগ পেলেই পুনরুদ্ধার করবে হারানো রাজত্ব।
মন্দিরের নিচে নানা জাতের দ্রব্য নিয়ে বসেছে স্থানীয়রা, সেখানে মায়ান বর্ষপঞ্জী, আদি দেবতা, পবিত্র সবুজ পাখি ক্যেটজাল, রাজা পাকালের মৃত্যু মুখোশ কি নেই!
এক পুঁচকে খুব চাল্লু ভঙ্গীতে এসে ফিসফিস করে বলল, অন্যরা এই গলায় ঝুলাবার মায়ান লকেট ১০ পেসোর কমে দিবে না, তোমাদের পছন্দ হয়েছে তাই আমি মাত্র ৩ পেসোতেই দিয়ে দিব! তার প্রত্যুৎপন্নমতিতা দেখে আর গুল দেবার ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়ে কিছু লকেট কিনেই ফেললাম সবাই।
পরের মন্দিরটি অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায়, এখান থেকে সমগ্র শহর যেমন দেখা যায়, তেমন দূরের অরণ্যও চোখে পড়ে। সিঁড়ি বেয়ে উঠানামার নানা পর্যায়ে বিশ্রাম নিয়ে চোখ বুজে উপলব্ধির চেষ্টা করলাম খানিকটা দেড় হাজার বছর আগের এই জাদুময় মন্ত্রমুগ্ধ পরিবেশ।
এর মাঝে বেলা গড়িয়েছে অনেক, আজকেই আবার যাবার কথা সবুজ জলপ্রপাত দর্শনে, সেখান থেকে আরেক সমৃদ্ধ মায়ান নগরী কালাকমুলে। আরও খানিকক্ষণ মুগ্ধ চিত্তে পালেঙ্কেতে অতিবাহিত করে আবার পথে আমরা।
ওহ, আসল কথাই বলা হয় নি, এখন পর্যন্ত পালেঙ্কের যে ছবি দেখলেন , বিশেষজ্ঞদের মতে তা মূল মহানগরীর মাত্র ২ % ( যদিও উইকিতে আছে ১০ % ), যে কারণে এই দুই ভাগেই রাজা পাকালের সমাধি পেয়ে নিজেদের ধন্য মনে করেছিলেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। আসল কথা হচ্ছে, এখনো এই মায়া নগরীর শতকরা ৯৮ ভাগ অপেক্ষা করছে বনের আড়ালে, মাটির নিচে, আবিষ্কৃত হবার অপেক্ষায়, হয়ত আপনারই জন্য !!!
( পাকালের কফিনের ঢাকনা এবং মুখোশের ছবি দুইটি নেট থেকে সংগৃহীত।
এই লেখাটি আমার বন্ধু আশরাফুজ্জামান ইউসূফী শুভর জন্য ( যার বর্তমান পরিচয়গুলোর অন্যতম আর্বোভিরাস'- ব্যান্ডের ভোকাল 'সুফি মেভেরিক'), গায়ক, গীটারবাদক, চিত্রকর এই বন্ধুটির সাথে আমার স্কুল জীবনের অসংখ্য বিকেল, সন্ধ্যা, রাত, দিন কেটেছে মায়া, ইনকা, অ্যাজটেক, এলিয়েন, ভিনগ্রহ, পিরামিড, দানিকেন, ফ্লাইং সসার ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে কথা বলে। আজও যখন উত্তরের শীতের আকাশে ঝিকিমিকি তারা জ্বলে, অণু তার মাঝে স্বপ্নগ্রস্ত হয়ে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে খুঁজতে থাকে রহস্যময় কোন আলো, কোন শব্দ, কোন সঙ্কেত, শুভও নিশ্চয় ঢাকার আকাশে চোখ মেলে থাকে – খোঁজার চেষ্টা করে আমাদের না জানা রহস্যগুলোর সমাধান। ভালো থাকিস, বন্ধু। সবসময়।। )
মন্তব্য
ভাবছিলাম হাচল থেইকা সচল হইলে অন্যদের মতো গায়েব হইয়া যাবেন। কোথায় কি...। এখনো দেখি প্রত্যেকদিন ডিস্টার্ব করতেই আছেন। সব্বাইরে হিংসায় জ্বালায় পুড়ায় মারতাছেন।
লেখা আর ছবি বরাবরের মতোই অসাধারণ।
ক্যান! মাঝখানে ছুটিতে ছিলাম যে কয় দিন!
facebook
স্বপ্ন যেমন মানব মনের শুধুমাত্র অপূর্ণ ইচ্ছা চরিতার্থ করিয়া থাকে, তেমনি সেই ফলশ্রুতিতে অনুভূতি ও মানবিক আকাঙ্খা পরিপূর্ণতা লাভ করিয়া জন্মলয় এক অকৃত্রিম বাস্তব লোক।
আপনার ভ্রমণ কাহিনীর মধ্যে আমি খূঁজিয়া বেড়ায় বাংলার প্রত্যক্ষ জীবনের ছবি। এই ছবি গুলি স্বপ্ন ও বাস্তবের জগতে যেন চিরন্তন ও নিরন্তন ছোটাছুটি করিয়া চলিছে।
আপনি প্রশ্ন করিবেন:
আপনার ভ্রমন কাহিনি স্বপ্ন কেন:
আমি বলিব:
আমি হযতো কোন দিনও আপনার মতো ঐ স্থানে স্বশরীরে উপনিত হইতে পারিব না তাই স্বপ্ন। আর উপনিত হইতে পারিলেও তা আপনার মতন সাবলীল ভাষায় ব্যক্ত করিতে পারিব না, তাই।
তাই, মানব মনের মানসবৃত্তিকে মর্যাদা দিতে গিয়ে চলামান ছাযাছবির মত অজস্র টুকরো টুকরো ছবির জগৎ সংগ্রহ করিয়া আমি পরিতৃপ্ত হই, ও মন্তব্য করিয়া সেই মানব পরিতৃপ্তির বিকাশে পূর্ণতা পাইবার ব্যর্থ পরিচেষ্টা করিয়া থাকি।
ধন্যবাদান্তে
মানব
অনেক অনেক শুভেচ্ছা মানব !
facebook
উদাস হয়লেন নাকি !
facebook
আর কী বলার আছে?
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
বুলেট নয় কবিতা চাই !
facebook
খুবই পছন্দের একটি জায়গার ছবি দেখে ভালো লাগলো... চালিয়ে যান ..
----------------------------------------------------------------------------------------------
"একদিন ভোর হবেই"
ধন্যবাদ!
facebook
facebook
facebook
আমারও যাইতে ইচ্ছা করতেসে
অদ্ভুত জায়গাটি! বললাম যে, সব আছে !
facebook
যথারীতি দারুণ এক ভ্রমন্থন, অণুদা।
বাক্যটা একটু মেরামত করা দরকার।
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
কি !
একটা কি বাদ পড়ে গেছে ! হা হা, ধন্যবাদ!
facebook
চাই হওয়ার কথা না?
হিংসা জানিয়ে গেলাম।
facebook
সুফী ভাইয়ের সাথে আলাপ হয়েছিল একটা কনসার্টে, বেশ হাসাইতে পারেন সবাইকে
ঠিক। কলেজে ওর নামই ছিল জ্যাকসন শুভ।
facebook
পোস্ট পড়বোনা, আশৈশব স্বপ্ন এখানে যাবার, আগেই দেখবোনা। বুকমার্ক করে রাখলাম, যেদিন যাব, দেখে এসে তারপর পড়বো
ঠিক আছে ! আমিও পড়তে চায় আপনার অভিজ্ঞতা।
facebook
চরম আরেকটা পর্ব!!! ইনকা সভ্যতার পর মায়া সভ্যতার নিদর্শনের দেখা মিললো!
মায়ান নারী পুরুষের চেহারার সাথে রেড ইন্ডিয়ানদের কোন কোন গোত্রের চেহারা মিলে আর মিলে অস্ট্রেলিয়া আর প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপসমূহের আদিবাসীদের। এই গোত্রগুলোর মধ্যে কোন একটা গভীর আত্মীয়তা সুত্র অবশ্যই আছে।
সাথে আছি, পরবর্তী বিবরণ আসুক। খানাপিনার ছবি চাই প্রত্যেকটা পর্বে। কোন জায়গায় কিরকম খ্যাদ্যাভাস এটা জানাও জরুরী।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
বিস্তারিত ডি এন এ ম্যাপিং দরকার। যেমন জানা গেল জাপানীদের সবচেয়ে কাছের আত্মীয়রা বাস করে পেরুতে!
facebook
এই পুচকে দেখি ঢাকা শহরের ম্যাক্সির হেল্পারগুলোর মতই ট্যাটন
এদিকে আধুনিক মায়ারাও ঝালমুড়ি খায় দেখা যাচ্ছে
-------------------------------------------------
ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
পুরাই ট্যাটন
facebook
আপনার অ্যাজটেক ক্যালেন্ডারের ছবির অরিজিনাল কপিটা কি পেতে পারি ভাই? আর ভাবছি হিমু ভাই কেন এখনও আপনার কুশপুত্তলিকা সাপ্লাইয়ের ব্যবসাটা শুরু করছে না।
অবশ্যই পারেন।
হিম্ভায়ের ব্যাপার জানি না, ইদানীং খালি ভিডিও ভিডিও করে !
facebook
চমৎকার বাছা কিন্তু পিপাসা মেটেনি। নিজের চক্ষু দিয়ে দেখার অপেক্ষা অনেক দিনের। অনু ধন্যবাদ জাগিয়ে দেবার জন্য।
গ্রেগরীয়ান বালক
অবশ্যই দেখবেন। শুভেচ্ছা।
facebook
সুন্দর ... ২০১৬ তে যেন কোথায় যাওয়ার কথা ? আমিও যাব কিন্তু ...
লাদাখ। এই ব্যাপারে সব জানে জ্ঞানী দেবতা ওডিন !
facebook
মচৎকার অণুদা!
তয় মায়ান ক্যালেন্ডার বিষয়টা যদি এট্টু খোলাসা করতেন,ডরটা কমত।
ডরের কিছুই নাই ! যা করছেন করে যান !
facebook
কি হইল !
facebook
আমি কবে যামু???
তাড়াতাড়ি।
facebook
ভাইডি ও ভাইডি ভাইডিরে আপনেতো আমার চাকরির বারোটা বাজায়া দিবেন।।।।।।।।।।।।।।।।
আবার কি করলাম
facebook
যদি যেতে পারতাম দারুন জায়গা ...........
অবশ্যই যাবেন।
facebook
দারুন!
****************************************
facebook
কিছুই বলার নাই। লেখার শুরুতে তোমার এই কথাটা মনে স্থায়ী দাগ কেটে রাখে...
আর এই পোষ্ট এর ব্যাপারে আলাদা করে কিছুই বলার নাইঃ আবারও আরেকটা মাষ্টার পিস হয়ে রইলো...
ভালো থেকো। শুভেচ্ছা। সবসময়
ডাকঘর | ছবিঘর
না রে দাদা, মাষ্টার পিস এটি সহজ! হে হে, তারপরও ধন্যবাদ।
facebook
জানিনা কোনদিন নিজের চোখে দেখতে পারব কিনা ।
তবে আপনার এই লেখা আর ছবিগুলো মনে থাকবে অনেকদিন ।
অসংখ্য ধন্যবাদ ।
অবশ্যই পারবেন। আমার তো এই জায়গা সম্পর্কে জানার পর প্রায় এক যুগ লেগে গেল!
facebook
প্রথম ছবিটাতেই চোখ আটকে গেল। সব ছবিই অসাধারন। খুবই ভাল লাগলো।
ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।
শুভেচ্ছা, আপনার বড় ভাই এখন কোথায় আছেন?
facebook
ভাল লাগল ।
facebook
সবুজ 'ডেথ মাস্ক'টা পরে অমাবস্যা রাতে অণুকে ভয় দেখাতে বড় মজা হবে...
“Peace comes from within. Do not seek it without.” - Gautama Buddha
তুমি তো মহা ফাজিল ডেঁপো !
পরিকল্পনাটা পূর্ণিমায় কর, অমাবস্যায় আমার শিয়রের কাছে জগ ভর্তি জল থাকে মাঝে মাঝে! ঝাউ বাংলোর রহস্য পড়া আছে নিশ্চয়!
facebook
নতুন করে কিছুই বলার নাই, বরাবরের মতই চমৎকার সব ছবি আর লেখা। ধন্যবাদ!
শুভেচ্ছা! মায়ানদের নিয়ে আরো লেখা আসিতেছে---
facebook
যথারীতি নাইস পোস্ট
facebook
(গুড়)
facebook
সবই তো ঠিক ছিলো কোবি, আমের নাম ক্যান নিলেন!
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
facebook
নতুন মন্তব্য করুন