মেক্সিকো উপসাগরে কচ্ছপ, পাখি, ডলফিনের খোঁজে

তারেক অণু এর ছবি
লিখেছেন তারেক অণু (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৩/০২/২০১২ - ৮:০৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

380913_10151171516315497_608590496_22789571_1669935631_n

যে জিনিসটি সর্বগ্রাসী কৌতূহলে আমার শৈশবকে মাতিয়ে তুলেছিল তা মায়ের অফিসে পাওয়া একটা লাল-হলুদ রঙা বই, উপরে লেখা ডাইনোসর! লেখকের নাম মনে পড়ে না কিন্তু মনে আছে ধবধবে সাদা পৃষ্ঠার উপরে নীল কালিতে আঁকা নানা প্রজাতির অদ্ভুত সব ডাইনোসর। জলে, স্থলে, শূন্যে চরে বেড়ানো বিশাল সব সরীসৃপ, প্রায় সবই ভয়াল দর্শন। আজ জানি, সেই বইয়ের অনেক ডাইনোসর প্রজাতিই ছিল মন গড়া, সঠিক তথ্যের অভাব ছিল প্রকট, তারপরও এক শিশুর মনোজগতে স্থায়ী আসন করে নিয়েছিল সেই সব সরীসৃপেরা। সেই সাথে বইটির শেষ পর্যায়ে লেখা ছিল- এক বিশাল উল্কার পতনের ফলে ডাইনোসররা বিলুপ্ত হয়ে যায়, উল্কাপিণ্ডটি পতনের ফলে সেই জায়গায় এক বিশাল গর্তের তৈরি হয় যা বর্তমানের মেক্সিকো উপসাগর। ব্যস, মাথার ভিতরে গেঁথে গেল নামটি! পণ করে ফেললাম, আমার প্রিয় ডাইনোসরদের মৃত্যুর জন্য দায়ী এই গর্ত একদিন দেখতে যেতেই হবে!

400290_10151253821740497_608590496_23062197_1322381972_n

এরপর সেই সরীসৃপদের নিয়ে সুযোগ পেলেই নানা বই পড়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি, দেখেছি অনেক তথ্যচিত্র, তাদের বিলুপ্তির কারণ আজও অজানাই থেকে গেছে, এমনকি সেই উল্কাপিণ্ড নিয়ে বলা হচ্ছে সেখানে একাধিক উল্কা ছিল! জানা গেছে তাদের বিলুপ্তির পিছনে আরো অনেক অনেক কারণ, কিন্তু কিছুই আমার বাচ্চাবেলার প্রতিজ্ঞাকে টলাতে পারে না, মন চায় একবারের জন্য হলেও মেক্সিকো উপসাগরের সেই গর্তে একবার পা ডোবাতে!

430696_10151288217995497_608590496_23163566_1494000246_n

গত মাসে বিশাল মেক্সিকোর নানা প্রান্তে অবিরাম ছুটে চলার মাঝেও থেকে থেকেই মনের গহনে ঝিকিয়ে উঠছিল সেই ভাবনা, বন্ধুদের বলতে তারাও রাজি হয়ে গেল, কদিন ধরেই নানা পুরাকীর্তি, স্থাপত্য, বন- জঙ্গল দাপানো হয়েছে, এখন চলুক সাগরের লোনা হাওয়ার সাথে দোস্তি।

প্রথমেই মেক্সিকোর বিখ্যাত সৈকত এলাকা ক্যেন-তা-নারোর তুলুমের দিকে যাওয়া হল, সেখান থেকে ৩০ মাইল এবড়ো থেবড়ো পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছানো হবে পুনতা অ্যালেন নামের এক জেলে গ্রামে, এটিই এই অন্তরীপের শেষ সীমানা, আর পরপরই নীল-সবুজ সাগরের রাজত্ব।
পুরো এলাকাটিই সিয়াম- কান নামে সংরক্ষিত রামসার সাইটের অন্তর্গত। আছে ঘন ম্যানগ্রোভ বন, সেখানে বাস করে নানা বিরল প্রাণী , কুমির থেকে শুরু করে ম্যানাটি!

401405_10151203424805497_608590496_22903018_1058123715_n407934_10151243691785497_608590496_23036136_1951457909_n

এক জায়গায় এমন বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়তেই সদল বলে চড়াও হলাম সেই জলচর স্তন্যপায়ী আত্মীয়দের দেখার আশায়, যদিও সেখানে উপস্থিত বনরক্ষক আমাদের উত্তেজনা দেখে কেবল মৃদু হেসে জানালেন এই ভর দুপুরে ম্যানাটিরাও বিশ্রাম নেয়, বরং সন্ধ্যার আগে বিশেষ জাহাজে চেপে সমুদ্র বিহারে গেলে জলমগ্ন মায়া সভ্যতার স্থাপত্য দর্শনের সাথে সাথে ম্যানাটিদের সাথে মোলাকাত হতেও পারে! অধিক উৎসাহে আগ বাড়িয়ে সেই বিহারের দর্শনী জানতে চেয়েই বুঝলাম কি বিশাল ভুল তা হয়েছে! সাধারণের চেয়ে ৩গুণ ভাড়া হেকে বসল সমব্রেরো মাথায় আয়েশ করতে থাকা পোড় খাওয়া বনরক্ষী।

আড়ালে নিয়ে বাকী তিনজন আমাকে ধুয়ে ফেলে বলল- ব্যাটা, যখন তখন পাবলো নেরুদা না হয় গার্সিয়া লোরকার প্রেমের কবিতার কয়েক ছত্র ভাঙা স্প্যানিশে বলে আমাদের তরুণী সমাজে তো ভালই আসন করেছ, কিন্তু এইখানে খবরদার আমাদের আগে কথা বলতে যেয়েও না, তোমার বদনখানি দেখলে সমস্যা নেই, কিন্তু সে-খানা খুললেই সবকিছুর মূল্য ঝপ করে আকাশচুম্বী হবে।

আর কি, সে যাত্রা পা হেঁটেই বাদাবনের খানিকটা অংশ পেরিয়ে সবুজ সমুদ্রের তীরে পৌঁছালাম সেখানের প্রকৃতি উপভোগের সাথে সাথে ম্যানাটির খোঁজে। এখন বলি কেন ম্যানাটি নিয়ে এত মাথা ব্যাথা আমার! ছোট্ট বেলায় জানা যে রহস্যগুলো মাঝে মাঝেই স্বপ্নের মাঝে এসে দুষ্টুমি ভরা উঁকি দিয়ে যায়, তার মধ্যে একটা মৎস্যকন্যা, অর্ধেক মাছ, অর্ধেক মানুষ এই কল্পনার জীবটির অবস্থান কিন্তু সারা বিশ্বের প্রায় সকল জনপদে, আর জলসংলগ্ন এলাকা হলে তো কিছুই বলার নেই- সেখানের লোকগীতি থেকে শুরু করে জেলেদের বাস্তব অভিজ্ঞতা সব কিছুতেই পাবেন এই রহস্যময় আধাখেঁচড়া জীবের উপস্থিতি। কেন? এক সময়ে মনে হত, সারা জীবন এই এক বিষয় নিয়ে গবেষণা করে কাটিয়ে দিলে মন্দ হয় না, উপরি হিসেবে অনেকগুলো দেশ ঘোরা হয়ে যেত, বিশেষ করে দ্য লিটল মারমেইডের জনক হ্যান্স অ্যান্ডারসনের দেশ ডেনমার্ক থেকেই শুরু করার ইচ্ছে ছিল সেই অনুসন্ধান।

এখনো ইচ্ছেটাতে খুব যে মরচে পড়েছে তা নয়, কিন্তু জেনে গেছি অনেক মানুষ রহস্য সৃষ্টির জন্য, অপরের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য, এমনকি স্রেফ দুটো পয়সা উপার্জনের জন্য অবলীলায় মিথ্যা বলতে পারে। মাসের পর মাস দুরন্ত সমুদ্রে কাটিয়ে বন্দরে ফেরা নাবিকেরা শুঁড়িখানার আড্ডায় স্রেফ কথার খাতিরেই হয়ত হলফ করে বলত- মৎস্যকন্যা দেখেছি। কিন্তু সব কিংবদন্তীর পেছনেই যেমন একটা সরল ক্ষুদে ভিত্তি থাকে, হয়ত সাত সাগরের এই মৎস্যকন্যাদের পিছনেও ছিল এমন এক সত্য যা সেই নাবিকদের চোখ এড়িয়ে যেত।

সেই সত্য হচ্ছে ম্যানাটি। জলজ স্তন্যপায়ী এই গোত্রের প্রাণীদের ( ডুগং, সাগর গাভী) বাচ্চাদের দুধ খাওয়াতে দেখলেই হয়ত মাসের পর মাস নারী সংসর্গ বিচ্ছিন্ন মাতাল নাবিক কল্পনার চোখে এক ঝলক নারীর আদল দেখতে পেত, কিন্তু জাহাজ কাছে যাওয়া মাত্রই যখন শক্তিশালী লেজের ঝাঁপটা মেরে ম্যানাটি জলের গহনে আশ্রয় নিত, তখন বিমূঢ় নাবিক দেখত কেবল সেই অপরূপা তরুণীর ছিল মাছের মত লেজ ! সেইখান থেকেই শুরু, আজো চলছে মৎস্যকন্যার খোঁজে আমাদের সমুদ্র মন্থন।

যাই হোক, মানগ্রোভ বনের কিছুটা পাড়ি দিতেই চোখে পড়ল স্নিগ্ধ সবুজ সাগর, ঢেউ নেই, আলোড়ন নেই, চলে গেছে সে দূরের বাদাবন পর্যন্ত। যেন মখমলের কার্পেট বিছিয়ে রেখেছে কেউ সারা ভুবন জুড়ে,

403309_10151218772745497_608590496_22955161_550047787_n

এর ফাঁকে কাছের গাছটাতে দেখি দুটি বাদামী গগনবেড় মনের সুখে দিবানিদ্রা দিচ্ছে, বা বলা চলে আয়েশ করে মৃদুমন্দ সমীর উপভোগের সাথে সাথে মেক্সিকোর সূর্যের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করছে গাছের ডালে দুলে দুলে।

423668_10151218773130497_608590496_22955164_620030489_n

তাদের শান্তিতে থাকতে দিয়ে ফেরার পথেই দেখা হল দুই খেচরের সাথে, প্রথম জন ট্রপিক্যাল কিং বার্ড ( বাংলা নামকরণ এখনো হয় নি বলে ইংরেজিটাই ব্যবহার করতে হল)

400312_10151218772900497_608590496_22955162_209234892_n

পরের জন অতি বিখ্যাত মকিং বার্ড, ( হারপার লির উপন্যাস টু কিল এ মকিং বার্ডের জন্য নয়, এদের মূল খ্যাতি গ্যালোপাগোস দ্বীপপুঞ্জে এই পাখি দেখেই বিবর্তনের চিন্তা ডারউইনের মনে বিষদ ভাবে দোলা দেয়, যদিও জনপ্রিয় বিশ্বাস, নানা প্রজাতির ফিঞ্চ পাখিদের দেখেই ডারউইন বিবর্তন তত্ত্বের চর্চায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন)।

408959_10151316412925497_608590496_23237629_1547405761_n

এবার মহা সাবধানে এগোবার পালা, কেবল যে এবড়ো থেবড়ো মাটির রাস্তা তা নয়, তীক্ষ বাক একে করে তুলেছে মহা ঝুঁকিপূর্ণ। অল্পখানি রাস্তা বেশ সময় লাগিয়ে পার হয়ে সেই জেলেপল্লীতে পৌঁছালো আমাদের চারমূর্তি। এর পরপরই দরাদরিতে সিদ্ধ হস্ত চিকো স্থানীয় এক মাঝির সাথে নৌকায় করে ম্যানগ্রোভ বন, খোলা সাগরে ঘুরতে যাবার সাথে সাথে সাগরের স্নরকেলিং-এর মহা সুব্যবস্থা করে ফেলল।

বেশ চমৎকার গ্রামটি, উপকূলের সব বসতির মতো নারকেল গাছে ঘেরা, বিচ্ছিন্ন কিছু পানশালা, রঙচটা গির্জা আর অগুনতি মাছ ধরার নৌকার সমাহার।

400892_10151186663730497_608590496_22850774_715993069_n

422178_10151288218300497_608590496_23163567_1781810366_n

166954_10151274821485497_608590496_23129891_716852080_n

সেখানে আবার পানকৌড়ি, পানচিল, গাঙচিল নানা সামুদ্রিক পাখির সমাহার।

417424_10151272659845497_608590496_23125283_834158635_n

429569_10151243692110497_608590496_23036139_934095908_n

395241_10151274821360497_608590496_23129889_921549793_n

থেকে থেকেই দেখা মিলল অপূর্ব ফ্রিগেট পাখি, প্রাপ্তবয়স্ক এবং তরুণ উভয়েরই।

419260_10151274821140497_608590496_23129888_699736579_n

অবশেষে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় চেপে সিনর মিগুয়েল হারনান্দেজের সাথে আমাদের যাত্রা শুরু, ঘন ম্যানগ্রোভের সবুজ বেষ্টিত খালগুলো পার হয়ে অবশেষে দেখা মিলল স্বপ্নের মেক্সিকো উপসাগরের, হায়, এই উপসাগরের অস্তিত্বের জন্যই হয়ত প্রাণ দিতে হয়েছে কোটি কোটি ডাইনোসরদের !

422268_10151248975060497_608590496_23050511_1599016009_n

যদিও ইসাইয়াস ফোঁড়ন কাটার চেষ্টা করল এই বলে যে, আমাদের সামনের বিপুল জলসীমাকে মেক্সিকো উপসাগর না বলে বরং ক্যারিবীয় সাগর বলা যেতে পারে! এক ধমকে থামিয়ে দিয়ে ব্যাটাকে বললাম, একই তো জিনিস প্রায়ই, এত কচলানোর আছে তা কি ! বিশ্বে কি আসলেই সাত মহাদেশ, পাঁচ মহাসাগর! এতো মানুষের হিসেবের সুবিধের জন্য নামকরণ করা হয়েছে, আসলে সাগর তো মাত্র একটা, বিশ্বসাগর!

391869_10151175165515497_608590496_22805062_769915923_n

এইসময় কাপ্তান হারনান্দেজ জানালেন আমরা বিশেষ কিছু এলাকায় সাগরের বিশালাকার কচ্ছপের খোঁজে তল্লাশি চালাব! কি চমক লাগানো প্রস্তাব! কোটি কোটি বছর আমাদের গ্রহতে টিকে থাকা এই অসাধারণ উভচর প্রাণীগুলোর অস্তিত্ব আর হুমকির মুখে কেবলমাত্র মানবজাতির মাত্রাতিরিক্ত লোভের কারণে ( তাদের মেরে তো খাচ্ছেই মানুষ, আবার মাছ ধরার জালে আঁটকে মারা যাচ্ছে অসহায় কচ্ছপেরা), তাদের শেষ বংশধরদের সাথে নিজ আবাসে দেখা করতে পারাও চরম সৌভাগ্যের ব্যাপার।

কাপ্তান কিছু কিছু জায়গায় যেয়ে ইঞ্জিন বন্ধে করে ভেসে বাতাসের টানে ভেসে যাবার সাথে সাথে টরটুগা, টরটুগা ( স্প্যানিশে কচ্ছপ) বলে গান ধরল, মনে পড়ল নিউজিল্যান্ডের মাওরিরা নাকি এভাবেই তিমি দেবতার উদ্দেশ্যে উদাত্ত কণ্ঠে গান ধরে। সাগরের ঈষৎ সবুজ বর্ণ জল বেশ স্বচ্ছ, তলদেশ পর্যন্ত সহজেই দেখা যায়, সেখানে প্রবালের রাজ্য, মাছেদেরও দেখা মিলল, কিন্তু কচ্ছপ বাবাজীরা দূর অস্ত।

421413_10151272659970497_608590496_23125284_1759187017_n

আর তখনই দিগন্ত থেকে ভীম গতিতে কাপ্তানের গানের টানেই সাগর ফুঁড়ে উঠে এল কালো চকচকে টর্পেডোর মত এক লম্বাটে শরীর, বুঝে ওঠার আগেই সাগরে মিলিয়ে গেল, কেবল চোখে পড়ল তিন কোণা পাখনা!

420328_10151248975170497_608590496_23050512_337049682_n

খানিক দূরে যেয়ে সাবলীল বাঁক নিয়ে আবার ফিরে এল আমাদের কাছে, বন্ধুত্বের প্রত্যাশা নিয়ে। না যার কথা ভাবছেন সেই হাঙর না, সে ছিল আমাদের আদি ও অকৃত্রিম বন্ধু ডলফিন। খুব খোশ মেজাজে ছিল সে, কত যে কৌতুককর ভঙ্গীতে আসা-যাওয়া করল নৌকার কাছ দিয়ে, গড়ান দিয়ে ডিগবাজি দিল খামোখায় আমাদের নির্মল আনন্দ দেবার জন্য! তার লেজের সৌন্দর্য দেখে মনে পড়ল হারম্যান মেলভিলের বিশ্বখ্যাত উপন্যাস মবি ডিকের এক জায়গায় লেখকের তিমির লেজের বর্ণনার কথা, যেখানে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন এটি পৃথিবীর সবচেয়ে জাদুময় দৃশ্যগুলোর একটি।

408663_10151175166080497_608590496_22805066_1273558149_n

এক পর্যায়ে বিদায় নিল মায়ার বাঁধনে জড়ানো নতুন বন্ধুটি, তখন আবার কচ্ছপের খোঁজে উপসাগরের অন্যপ্রান্তে রওনা হল আমাদের নৌকা। মাঝেই মাঝেই পথে পড়ছে ম্যানগ্রোভ বনের শাখাপ্রশাখা, তার মাঝেই প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট খালে এঁকে বেঁকে ঠিকই পৌঁছে যাচ্ছি আমরা অপর পাশে মাঝির মুন্সিয়ানার জন্য।

418392_10151288218370497_608590496_23163568_599018017_n

404376_10151175165795497_608590496_22805064_1770511062_n

এক জায়গায় দেখা হল বিশ্বের সেরা মাছশিকারি পাখি মাছমুরাল( অসপ্রে)- এর সাথে, সে দেখি বিশাল বাসাতে সতর্ক ভঙ্গীতে বসে আগুনঝরা দৃষ্টি নিয়ে চেয়েই র‍য়ল আমাদের দিকে।

420376_10151316413165497_608590496_23237630_1551275975_n

আরামে নিজের পালকে ঠোঁট ঢেকে ঘাড়টা ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে বেশ একটা জম্পেশ ঘুমানোর প্রস্তুতিতে ছিল বাদামী গগনবেড়,

386506_10151172261180497_608590496_22792158_1097837135_n

কিন্তু বেশী নৈকট্যের ফলে মানবজাতির বিদঘুটে গন্ধপছন্দ না হওয়ায় ডানা মেলে চলে গেল দৃষ্টিসীমার আড়ালে।

426857_10151230495890497_608590496_22991650_1269846072_n

ঘণ্টাখানেক এই নয়নাভিরাম স্থানটিতে নৌকা চালানোর পর এক জায়গায় নোঙর ফেলে কাপ্তান জানালেন সময় হয়েছে সাগরে অবগাহনের! এবার আর উপর থেকে নয়, একবারে জলে ডুব দিয়ে ভাব করার চেষ্টা করব জলজ প্রাণীদের সঙ্গে। পায়ে ফ্লিপার আর চোখে স্নরকেলিং-এর গ্লাস এটে ঝাপিয়ে পড়লাম সবাই মেক্সিকো উপসাগরে,

427999_10151253821315497_608590496_23062194_387497301_n

তবে সমুদ্র তখন উথাল পাথাল,

405735_10151203425015497_608590496_22903020_691261927_n

জলও খুব স্বচ্ছ মনে হল না, তাই কিউবায় যে রঙ ঝলমলে অভিজ্ঞতা হয়েছিল তার তুলনায় এখানের সমুদ্রের নিচের জগৎ বেশ ফিকে মনে হল। এর মাঝেই চিকো সাগরের তলদেশ থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এল বেশ বড় আকারের এক জীবন্ত শঙ্খ।

419746_10151253821490497_608590496_23062196_1852142882_n

খানিকক্ষণ সাগর দাপিয়ে আবার নৌকার নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে খেয়াল করলাম সূর্যদেব পশ্চিম দিগন্তে রাতের যাত্রার তোড়জোড় শুরু করেছেন,

418026_10151248975295497_608590496_23050513_702605089_n

খানিকপরেই তার বদলে দেখা গেল কেবল রেখে যাওয়া স্মৃতির সোনালি চিহ্নগুলো।

430227_10151338096175497_608590496_23309125_1048960108_n

আমাদেরও সময় হয়েছে তীরে ফেরবার, ভেজা শরীর নিয়ে নৌকার সামনে বসে আরামে গান গেয়ে গরম থাকার প্রয়াস চলতে থাকল ।
শেষ চেষ্টা হিসেবে অগভীর এক খাড়ির ভিতরে দিয়ে যাবার সময় আমাদের চোখে পড়ল এক ভুতুড়ে চলমান আবছা অবয়ব, জল কেটে অদ্ভুত ভঙ্গীতে সাঁতরে চলেছে বিপুল আত্নবিশ্বাস নিয়ে। হুররে, টরটুগা! অবশেষে এক সাগর কচ্ছপের দেখা মিলল, কি প্রজাতি বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু অভিজ্ঞ কাপ্তান জানালেন আর কয়েক মিনিটের মাঝে নিঃশ্বাস নিতে উভচর মহাশয় মুখ দেখাবেন, আমরা যেন প্রস্তুত থাকি।

শুরু হল অপেক্ষার প্রহর গোণা, সেই সাথে সহযাত্রীরা কাউন্ট ডাউনের সাথে সাথে বলতে থাকল মজার মজার সব গল্প, শুনলাম জনাকয়েক মার্কিনী এইখানেই কচ্ছপের ভেসে ওঠায় দেরী হওয়ায় অধৈর্য হয়ে বলেছিল, তারা ডুব দিয়ে কচ্ছপটিকে উপরে তুলে কেবল ছবিতুলেই ছেড়ে দিতে পারবে কিনা, কোনরকম ক্ষতি না করে !
কি আব্দার! কাপ্তান কড়া গলায় জানিয়েছিল- এই গোটা এলাকা অভয়ারণ্য হিসেবে বিবেচিত, কেউ কোন কচ্ছপের সাথে এমন আচরণ করলে তারা এর এই অঞ্চলে আসবে না, ফলে হাজার মাথা কুটলেও আর তাদের দর্শন মিলবে না।
মিনিট পনের পরে সারাদিনের সমস্ত অপেক্ষার কষ্টকর মুহূর্তগুলো মুছে দিয়ে মেক্সিকো উপসাগর ঝলমল করে উঠল এক কচ্ছপের রূপে।

388360_10151171515455497_608590496_22789562_644255136_n

আকাশের পানে চেয়ে দেখি বিশাল এক ক্যানভাসে আমাদের সন্মানেই যেন আঁকা হয়েছে বর্ণনার অতীত এক অপরূপ শিল্পকর্ম।

422463_10151338096460497_608590496_23309126_1175587908_n


মন্তব্য

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

খুব ভাল লাগল অণু দা, সকালবেলা উঠেই এই নীলাভ সবুজ জল দেখে মন প্রশান্তি পেল ।
তবে আপনার ছবি আর লেখার 'সাইডেফেক্ট' এড়ানো গেল না ।
তাই প্রশান্তির সাথে আক্ষেপ ফাউ হিসেবে পেলাম ।

যাই হোক, চালিয়ে যান ।
খুব ভাল থাকুন ।
চলুক চলুক

তারেক অণু এর ছবি

ধন্যবাদ।
আরে আক্ষেপ মানেই সময় নষ্ট, বেটা খুব পাজি জিনিস।

চরম উদাস এর ছবি

ইটা রাইখ্যা গেলাম...

রু (অতিথি)  এর ছবি

এতবার ধরা খাওয়ার পরেও আপনার ইট রাখার অভ্যেস গেল না!

চরম উদাস এর ছবি

এতবার করে বললাম তাও লোকে বুঝে না। ইটা কি কমেন্ট করার জন্য রাখছি নাকি? মাথায় মারার জন্য ইটা দেই।

তারেক অণু এর ছবি

বললাম তো ইটার বদলে পাঁথর মারেন, একটা দুর্গ গড়ি!

তারেক অণু এর ছবি
শিশিরকণা এর ছবি

আরও বেশি করে ইটা রাখেন। উষ্টা খাইয়া বেটা ঠ্যাং ভাইঙ্গা পরে থাকুক কয়দিন।

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

তারেক অণু এর ছবি

এমনিতেই পড়ে আছি মন খারাপ

যাযাবর এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম চলুক

তারেক অণু এর ছবি
তাসনীম এর ছবি

যাক এইবার একটু কমন পড়ল। এর একটা অংশ আমাদের পাড়াতেও আছে, অনেকবার দেখেছি। আপনি অবশ্য অন্য সাইডে ছিলেন।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

তারেক অণু এর ছবি

হাসি মাঝে মাঝে মনে হয় দুনিয়াটা আসলেই ছোট।

উদ্ভ্রান্ত পথিক এর ছবি

বস লেন্স আর ক্যামেরার মডেল কি?

---------------------
আমার ফ্লিকার

তারেক অণু এর ছবি

ক্যানন ৭ ডি, লেন্স ভাই পাখিরগুলা ৩০০ এমএম এ তলা,অন্যগুলি ১৮-২০০ এম এম

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি
তারেক অণু এর ছবি

সবুজ সাগরের রাজা, নিক টা কেমুন অয়!

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি
তারেক অণু এর ছবি
কুমার. এর ছবি

তারেক অণুর ইমো চাই।
ইবনে বতুতার মত তারেক অণুর নামও পাঠ্যপুস্তকে চাই।

তারেক অণু এর ছবি
উদ্ভট রাকিব এর ছবি

বিকালের মিড টার্ম পরীক্ষা খারাপ হইলে আপ্নের দোষ। আমি কিস্যু জানি না।

তারেক অণু এর ছবি

আরে না, ভাল মত দিয়েন!

রু (অতিথি)  এর ছবি

ঐ ঐ।

তারেক অণু এর ছবি

হো হো হো সরীসৃপ দিলাম না, তারপরও ঐ!

মরুদ্যান এর ছবি

চলুক

তারেক অণু এর ছবি
অতিথিঃ অতীত এর ছবি

অঅঅঅঅচাম্মম্মম্মম্মম্ম!!!!!!!!! গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু

অতীত

তারেক অণু এর ছবি

শুভেচ্ছা

হিমু এর ছবি

এই পোস্টের অপেক্ষাতেই ছিলাম দেঁতো হাসি ... আইতাছি খ্রান

তারেক অণু এর ছবি

গত ইন হিম্মেল!
খাঁড়ায়েই তো আছি !

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

ডাইনোসর'অলা বইটা কি বিশ্বকোষ ছিলো ?? আমার মনে হচ্ছে ছোটবেলায় ওটা আমিও পড়েছি- নাম মনে পড়ছে না।

মেক্সিকোর বর্ণনা তাইলে মুভিতে যা দেখি ঠিকই আছে মনয়- বনরক্ষীর যে বর্ণোনা দিলেন দেঁতো হাসি

আর ঘণুদা শার্টটা তো সেইরাম লাগাইসেন, পুরাই হাওয়াই বন্ড- হেহে।

তারেক অণু এর ছবি

না না, মুভিতে মেক্সিকোকে খুবই বাজে ভাবে দেখায়, ওখানকার মানুষগুলো যে কি বন্ধুবৎসল আর অমায়িক! রক্ষী ব্যাটা তো ট্যুরিস্ট এলাকার লোক তাই।
বিশ্বকোষ না মনে হয়, একটা আলাদা বই-ই ছিল।
শার্ট , হে হে , রাজশাহী সিল্ক যে !

নিঃসঙ্গ পৃথিবী এর ছবি

চালিয়ে যান ।

তারেক অণু এর ছবি

চেষ্টা করছি-

তদানিন্তন পাঁঠা এর ছবি

ঘেঁয়াও...

তারেক অণু এর ছবি
সৃষ্টিছাড়া এর ছবি

আপনাকে ভাই হিংসা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম শয়তানী হাসি ! গরিব মানুষদের পৃথিবী ভ্রমণের কোনো উপায় নাই? রাজশাহীর আনাচেকানাচে চষে বেড়ানোর কাহিনী কবে দেখাবেন? আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- নেন হাসি

তারেক অণু এর ছবি

অর্থনৈতিক ভাবে গরীবরাই কিন্তু বিশ্ব ভ্রমণ করে যুগে যুগে, এটা প্রমাণিত সত্য, কারণ তারা অর্থের মায়ায় আটকায় না।
রাজশাহীর পদ্মার চরের কাহিনী আসিতেছে।

সৃষ্টিছাড়া এর ছবি

মন খারাপ পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

তারেক অণু এর ছবি
বিবর্ণ এর ছবি

২য় ছবিটা এত বেশি ভাললাগতাছে কেন ??????????
অন্যরকম মিল...

তারেক অণু এর ছবি

আকাশ যে শার্ট হয়ে আছে, তাই হয়ত !

অতিথি এর ছবি

চলুক

তারেক অণু এর ছবি
উচ্ছলা এর ছবি

খুব সুন্দর।

P.S. পৃথিবীর সব রূপ দেখার সৌভাগ্য যার এত ঘন ঘন হয়, তাকে 'গুপ্তহত্যা' করার কন্ট্রাক্ট এখনও কেউ নেয়নি?!

তারেক অণু এর ছবি

করে তো!
কিন্তু আমি বুলেটপ্রফ যে দেঁতো হাসি

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

হাততালি

তারেক অণু এর ছবি
অরফিয়াস এর ছবি

ভূপেন হাজারিকা বেঁচে থাকলে নিঃশ্চিত নিজের গান এর কথা বদলে লিখতেন "তারেক অনু এক যাযাবর, পৃথিবী তাকে করেছে আপন, সে ভুলেছে নিজের ঘর, তারেক অনু এক যাযাবর" চোখ টিপি

----------------------------------------------------------------------------------------------

"একদিন ভোর হবেই"

তারেক অণু এর ছবি

লইজ্জা লাগে যাযাবর হইতে মুঞ্চায়, পারতাছি না

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

হো হো হো

তারেক অণু এর ছবি

সত্য কথা বললাম, আর আরেকজন হাসে ইয়ে, মানে...

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

নীল আকাশ, সবুজ জল! কি অদ্ভুত কম্বিনেশন!
লেখা পড়িনি। ছবিগুলোতেই আটকে গেলাম।
অনেকদিন পর ছবির মতো কিছু ছবি দেখলাম। পাখিদের ছবিগুলো অসাধারণ!

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

তারেক অণু এর ছবি

ধন্যবাদ। আসলেই মেক্সিকো এক জাদুরাজ্য

আশরাফ এর ছবি

পুনর্জন্ম সত্যি হলে বিলস গেটস বা বারাক ওবামা নয়, বরং তারেক অনু হয়ে জন্মাতে চাইতাম চলুক

নিঃসঙ্গ পৃথিবী এর ছবি

ঠিক আমার মনের কথাটাই বলেছেন হাসি

তারেক অণু এর ছবি

হ আর কাজ নাই তো।

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

আম্মো তাই চাই । হাসি

মৃত্যুময় ঈষৎ এর ছবি

চলুক চলুক


_____________________
Give Her Freedom!

তারেক অণু এর ছবি
রামগরুড় এর ছবি

চলুক চলুক চলুক

তারেক অণু এর ছবি
Shamim Khan এর ছবি

খুব ভাল লাগলো। ছবিগুলো খুবই সুন্দর।

তারেক অণু এর ছবি

ধন্যবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।