কাঁধের ভারী বোঁচকাগুলো নিয়েই ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়তে দৌড়তে কোনমতে ওয়্যানটাইটামবোর বিশ্বখ্যাত ট্রেনষ্টেশনে পড়িমড়ি করে ঢুকতে না ঢুকতেই প্লাটফর্মে কু ঝিক ঝিক করতে করতে এসে থামল ষ্টেশনটির বিখ্যাত হবার পিছনের মূল কারণটি- একটি ট্রেন!
নিশ্চয়ই ভুরু কুঁচকে ভাবছেন- ডেঁপো ছোকরা, ষ্টেশনে ট্রেন আসবে না তো কি হাতি আসবে? এমন কথা শুনেছে কেউ কোন দিন?
জি না, কেউ শুনে নাই, এইখানে শোনাও সম্ভব না, বলছি আকাশ ছোঁয়া আন্দেজের কোল থেকে, হ্যানিবালের হস্তি বাহিনীর পক্ষেও সম্ভব হত না এত উঁচুতে সদর্পে আসা, আর ছোট্ট একটা কথা- এই মহাদেশে কোন হাতি নেই!
ট্রেনের কথায় ফিরে আসি আবার, ছবির মত পর্বতের বুক চেরা উপত্যকায় এসেছে দাঁড়াল সে, শরীরে লেখা- ইনকা রেল!
এই সেই বিশ্বখ্যাত ট্রেন যা যাত্রীদের নিয়ে যায় বিশ্বের বিস্ময় ইনকা সভ্যতার পাহাড়ি শহর মাচু পিচুতে! সে ট্রেনে পা দেবার ভাগ্য অর্জন করাও বলা চলে দস্তুরমত সৌভাগ্য। অনেক ঝামেলা করে আমাদের তিনজনের টিকিট জোগাড় করতে পেরেছি, ট্রেন মিস হলে আমতো যাবেই , বাগানও যাবে।
প্ল্যাটফর্মে রীতিমত নাম ডেকে, সীট নাম্বার মিলিয়ে, পাসপোর্ট চেক করে তবেই উঠার অনুমতি পাওয়া গেল। কিন্তু বড় ব্যাগ মানে ব্যাকপ্যাক সাথে রাখার অনুমতি নেই, সবার বড় বড় ছালাগুলোই আমাদের বগির একপাশে স্তুপ করে রাখা হল, এখন জায়গা মত পৌঁছে যার যার তা সহজে পেলেই হয়!
সবার জন্য আলাদা আলাদা বসার ব্যবস্থা, একেক চামড়া মোড়া আসনে ২ জন আর মুখোমুখি ২জন, এক হালি মানব সন্তান। মাঝে সরু ফালি বেঞ্চ। তবে বেশ ঝক ঝকে তক তকে, চারিদিকে কেমন একটা সাহেবসুবো ভাব। এত দাম যে নিয়েছে কেবল ট্রেন টিকিটের জন্য তা মনে হয় পুরোপুরি বৃথা যায় নি।
একদম ঘড়ির কাটার সাথে সময় মিলিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিল বদর বদর বলে, শুরু হল আমাদের ঝাকাঝাকি। খানিক পরেই শহর, নগর, সভ্যতা চোখের আড়ালে পড়ে গেল, দুইপাশেই সবুজ পাহাড়ের আড়াল আর অপরূপ নিসর্গ।
এর মাঝেই পানীয় নিয়ে এল রেল কোম্পানির সুবেশী পরিচারিকা, তাদের সংগ্রহে আছে কোঁকা চা, কফি, সুপেয় জল, লেমোনেড।
পেরুর আসার পর থেকেই সমানে কোঁকা চা গলাধঃকরণ করে চলেছি দলেবলে এই অল্প অক্সিজেনের বাতাসে দ্রুত খাপ খাইয়ে নেবার জন্য, এই ক্ষেত্রেও তার ব্যতয় হল না। চায়ের কাপে আবার লেখা A Mystic Experience.
টেবিলের উপর কাপ রেখে বাহিরের চলমান সবুজ সুন্দরে লেন্স ফোকাস করেছি কি করিনি, একজন এসে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলল- চায়ের কাপটি টেবিলের মাঝামাঝি রাখলেই ভাল হয় !
এটা আবার কি ধরনের কথা, আমার চায়ের কাপ, টেবিলে মাঝে রাখি আর নিচেই রাখি –ব্যাটা, সমস্যা কি ! কাপ উল্টে ট্রেন নোংরা না করলেই তো হল ! আর চার চারটে কাপই বা কোন হিসেবে সারি সারি বেঁধে টেবিলের উপর রাখব! কি আব্দার!
কিন্তু তার দূরদর্শিতার প্রমাণ পেলাম পরক্ষনেই হাতে নাতে, পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তায় চলতে চলতে যে ঝাকুনি দেয়া শুরু করল, তাতে টেবিলের মাঝে রাখা জিনিসও হালকা নৃত্যের তালে তালে কিনারের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল আত্মহত্যার জন্য, আর কিনারে এতক্ষণ থাকলে- পুরোই ঝপাং !
মাঝে মাঝে রেললাইনের পাশ ঘেঁষেই হেঁটে চলা স্থানীয় কৃষক, কাঠুরেদের দেখা যাচ্ছিল, সেই সাথে সপ্তবর্ণা জীর্ণ পোশাক পরিহিতা মহিলাদের, তারা এই বিস্ময়কর বাহনের প্রতি বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে হতক্লান্ত জীবনের একটি অপস্রিয়মাণ সন্ধ্যার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ছোট ছোট পদক্ষেপে। ফাঁকা মাঠ মত এক জায়গায় মনে হল মেলা বসেছে, অনেক মানুষের সমাহার, সকলের গায়েই পনচো, ব্যাপার ঠিক বুঝে ওঠার আগেই সেই জমায়েৎ ট্রেনের গতির সাথে অসম পাল্লায় হেরে কেবলই স্মৃতি হয়েই রয়ল।
গোটা কয়েক আঁধার সুরঙ্গও পাড়ি দিলাম সবাই, তার পরপরই রেললাইনের পাশেই দেখা মিলল সেই বুনো পাগলীর।
নাম তার উরুবামবা! নিঃসন্দেহে বিশ্বের সবচেয়ে খ্যাতিমান জলধারাদের একটি আন্দেজের বুক চিরে, মাচু পিচুর পা ছুয়ে চলে যাওয়া এই লাল রঙের স্রোতস্বিনী। উরুবামবা! উরুবামবা! নামের মাঝেই যেন শোনা যায় রণডমরু, বোঝা যায় নেহাৎ শান্ত শীর্ণ কোমল নদী নয় সে, যুদ্ধংদেহী, বিদ্রোহী, তেজি, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর এক ভাগ্যবিধাতা।
নামের ব্যাপারে কিছু ছেলেমানুষি আছে আমার, কিছু কিছু নাম কারণে-অকারনেই কানে লেগে থাকে, সাত সমুদ্দুর পার হয়ে উদাত্ত আহ্বান জানায় তাদের জানতে, বুঝতে, দেখতে। যে কারণে সিডনী, নিউইয়র্ক, টরেন্টোর চেয়েও আমাকে বহুগুণে আকৃষ্ট করে হন্ডুরাসের এক মায়ান শহর যার নাম লুবানটুম, এই পেরুরই পর্বতে লুকিয়ে থাকা ইনকাদের পাহাড়ি রাজধানী ভিলকাবামবা, চীনের কাশগড়, মালির টিমবাকটুঁ । এর পিছনে কোন জানা যুক্তি নেই, কেবলই অন্য ধরনের এক ভাল লাগা কাজ করে, তেমনই এক উজ্জল নাম উরুবামবা।
প্রথম যখন নামটা পড়েছিলাম কিশোর পত্রিকার পাতায়, কর্ণকুহরে ভীম গর্জনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল সে, এসো আমার রহস্য উদ্ধারে কোন দিন, অবগাহন কর খরস্রোতা সলীলে, দেখবে কত রহস্য, কত অজানা গুপ্তধন আমি লুকিয়ে রেখেছি লোভী মানুষদের হাত থেকে তোমার মত রোমাঞ্চপ্রিয় কিশোরদের জন্য।
অবশেষে প্রতীক্ষার পালা শেষ হল, দেখা হল টগবগ করে সমস্ত বাঁধা দলে ছুটে চলা নদীটির সাথে, যার নামের মতই সে রণহুংকারে মত্ত। এখন পৃথিবীর এই গোলার্ধে গ্রীষ্ম বলেই কি না জানি না, স্রোতের বেগ অত্যন্ত বেশী বোধ হল, সেই জল বেশী ধরনের লাল, হয়ত পরাস্ত ভূমির জন্যই!
উরুবামবা কিছু বাসিন্দা বিশেষ করে পানকৌড়ি আর হাঁসেদের থেকে দূর থেকেই দেখা হল, শখ্য গড়ার সময় আর হল না এই যাত্রা। তারপর ছবি তোলাও ছিল বেজায় মুশকিল, তাই মাথা খাটিয়ে আর সব বাদ রেখে বাহিরের দৃশ্য উপভোগে মন প্রাণ ঢেলে দিলাম, জানালা ছাড়াও ট্রেনের ছাদের প্লাস্টিক ঢাকা অংশ দিয়েও বাহির বেশ দেখা যায়। এর ফাঁকেই সন্ধ্যের ঠিক আগমুহূর্তে পৌঁছে গেলাম আমাদের গন্তব্য- আগুয়াস কালিয়েন্তেস।
এখন সময় থিতু হয়ে আগামী সকালের গন্তব্যের জনা পরিকল্পনা করা, সেই গন্তব্য কোথায় সেটা যদি আপনারা না বুঝতে পারেন তাহলে বৃথাই লিখে চলেছি এতদিন ধরে----
মন্তব্য
আপনি ভাই পারেনও।
আপনি পোস্ট দেন আর আমরা ইশশ্ বলে হা-হুতোশ করি।
পোস্টে পাঁচতারা।
লেখা চলতে থাকুক।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
এইটা একটা কথা বললেন রাজা ভাই !
facebook
উরুবামবাতে কি রাফটিং হয়? হলে গ্রেড কত জানেন?
...........................
Every Picture Tells a Story
বলতে পারছি না, আমাদের চোখে পড়ে নি কিন্তু!
facebook
আম্মো---
facebook
ইমো কাজ করছে না ---
facebook
বড়ই শৈল্পিক এবং বিমূর্ত ম্যাসেজ। যাদের বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে, তাদের জন্য এই লিংক।
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
হে হে, মুড়কির ব্যবস্থাও রাইখেন, সাথে সন্দেশ।
facebook
ছবিগুলি দারুন। তবে বাইরের দৃশ্যের আরো ছবি আশা করেছিলাম, তাই একটু হতাশও হলাম। আর হ্যাঁ, আপনার ভাষার সৌন্দর্য তো দিন দিন বাড়ছে দেখছি। চমৎকার লাগল পড়তে!
****************************************
হুমম, বাহিরের ছবি সে যাত্রা তুলতে পারি নি, কিন্তু পেরু নিয়ে অন্য পোস্টে আসবে।
facebook
পাঁচ শব্দের তিন লাইনের একটা হুমকি ছড়া লিখে যাই। এর ভাব সম্প্রসারণের দায়িত্ব তারেকাণুর।
উরুবামবা!
গুরু, থামবা?
পুরু খাম্বা!
জট্টীল!
facebook
হাহাপগে
আমার ইমো হচ্ছে কেউ স্যাবোটাজ করছে, বাইচ্যা গেলেন।
facebook
হাহ! কত ট্রেনে চড়ছি, তা নিয়ে কি কখনো ব্লগ ফেঁদে বসছি?
একটু থিতু হয়ে নেই, সামনের বছর ঠিক সাউথ অ্যামেরিকা যাচ্ছি।
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
অবশ্যই !
facebook
উফফ!! শেষের ছবিটা মনকাড়া!
শুভেচ্ছা।
facebook
হিংসা করে বহু দিন আপনার পোস্ট না পড়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আজকে নীড়পাতায় প্রথম ছবিটা দেখে ক্লিক না করে পারলাম না। দারুণ লাগল ছবি এবং লেখা।
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
facebook
মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেল ছবিগুলো দেখে। আমার স্বপ্নের পথ ধরে কেউ হেটে যাচ্ছে ভাবতেই কিরকম অসাধারণ অনুভুতি।
সচলে পোষ্ট প্রিয়তে নেবার অপশনটা কোথায় গেল?
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
জানি না তো ! আবার হারালো নাকি !
facebook
ট্রেনের যাত্রার আরেকটু বিস্তারিত দিতেন। খরচাপাতি কেমন এসব আরকি।
যাই হোক, আপনার পোস্ট আমার প্লেবুকে পড়লাম। দেখেন স্ক্রীণশট। রিডার মোডে তোলা।
বৃথা হবে কেন? কোন কিছুই বৃথা নয়।
অবশ্যই বৃথা নয় ! কথার কথা আর কি !
বাহ, বেশ লাগছে তো প্লে বুকে ।
facebook
চোক্ষে ভুল দেখতাছি নাতো? নাকি উরুবামবারে 'নদী' বইলা টাইপো করছেন অণু ভাই? এইডা তো আমগো খালের চাইতেও চিকনি চামেলি!!!
অতীত
না হে ভ্রাত, পাহাড়ি নদী বিশ্বের কোথাওই খুব একটা চওড়া হয় না, আমাদের পদ্মা, ব্রহ্মপুত্রও এমনই চিকন উৎসের কাছে, আর স্রোতটা দেখলেন না!
facebook
এ যেন সেই চোখ যার কেউ দেখা পায়নি - - - - - - শুধু একজন ছাড়া।
পুরাই কবিতা
facebook
আহা! কি দেখিলাম। মনটা পুরাই উদাস হইয়া গেলো কখনো যেতে পারবো কি না সেই দুক্ষে
উদাস হইয়েন না, চরম দা চটে যাবে!
facebook
বাহ্! ট্রেনটাতো খুব সুন্দর।
মন্তব্য : পূর্বের ন্যায়!
আসলেই, আর সময় ঠিক রাখে !
facebook
আহ্ পাহাড়!
-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী
আহ নদী।
facebook
এতো সুন্দর!
কত্তো যে সুন্দর !
facebook
ইশ!
যেমন ট্রেন!
তেমনি দু'পাশের রাস্তা!
কবে যে...
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
যেখানে ট্রেন এসে থামে
আম, নিম, ঝাউয়ের জগতে।
facebook
অনু, আপনি কি কখনো ভারতের সিমলা গিয়েছেন? কিন্নর- কৈলাস দেখেছেন?
দীপাবলি।
না , এখনো যেতে পারি নি, দার্জিলিং পর্যন্ত দেখা হয় নি।
কৈলাস দেখার চেষ্টা চালিয়েছিলাম তিব্বতে, কিন্তু রুট অন্য হওয়ায় অনুমতি মিলেনি।
facebook
হাহাহাহাহা।। পেয়েছিইইইইইইইইইইইইইইইইইইইইইইইইইই। অন্তত একটা যায়গা পাইলাম (দার্জিলিং) যেইটা অণুদার আগে আমি গিয়েছি। হেহেহে। কি শান্তি! কি শান্তি। ইশ। এই সময়ই ইমো কাজ করছে না। গরররররররররর।
শুনে ইর্ষা একটু কম হচ্ছে এটা ভেবে যে, এখনো অনুর কিছু স্থান দেখার বাকি আছে। হি হি হি হি।
ইমো কাজ করছে না কেন?????????
দীপাবলি।
সবই বাকি, আমি তো বলি, আপনার বিশ্বাস করেন না
facebook
এবারে আমাকে কিন্তু ছবির চাইতে লেখা বেশি মুগ্ধ করল অণুদা ।
ট্রেন ভ্রমণের প্রথম দিকটায় দু-তিন লাইনে গ্রামের মানুষ আর খেলাটার যে বর্ণনা দিয়েছেন তা দারুণ ।
facebook
প্রদীপ্তদার সাথে একমত। দারুন লেখা হয়েছে। ছবিত বরাবরের মত দূর্দান্ত।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
ধন্যবাদ দোস্ত।
facebook
নতুন মন্তব্য করুন