পড়া শুরু করার আগে অনুগ্রহ করে উপরের আলোকচিত্রটিতে আরেকবারের জন্য দৃষ্টিপাত করুন। বহু বছর ধরে খুলনা নিবাসী আমার মহৎ হৃদয় অস্ট্রেলিয়ান চিত্রকর বন্ধু আশি ছুই ছুই ম্যালকম আর্নল্ড এই ছবিটি সম্পর্কে বলেছিল- Magic, Its Pure Magic !
কান পাতলেই যেন শুনতে পারবেন এখন আন্দেজের সুমহান নির্জনতায় বেজে ওঠা ইনকাদের প্যানপাইপের বাদ্যযন্ত্রের মোহময় সুর, যা হারিয়ে যায় না, বাতাসে ঝুলে থাকে দীর্ঘক্ষণ। আমাদের আবিষ্ট করে, বিস্ময়ে ঘিরে ধরে, কৃতজ্ঞতায় নতজানু করে ফেলে অন্য পৃথিবীর এই সৃষ্টি।
জীবনকে সুন্দর মনে হয়, পড়ে থাকা পথের ধুলোকেও অনেক আপন মনে হয়, মনে হয় এই ধুলোতে পা রেখেই আরো অনেক পথ এগোনো যায় সামনের দিনগুলোতে। এই সেই জাদু, সুন্দরকে অন্বেষণের আহ্বান, জীবনকে উপভোগের আহ্বান, কন্ডরের বিশাল পাখায় চেপে পাখির চোখে আমাদের গ্রহকে দেখার আমন্ত্রণ।
অদ্ভুত কিছু স্থান টিকে আছে এখনো যন্ত্রসভ্যতার নীল বিষে জর্জরিত আমাদের এই বুড়ো পৃথিবীতে, যেখান বাতাস বয় অন্য ভাবে, সূর্যের আলো আজো সতেজ, বৃষ্টির ধারা আজো নির্মল, প্রকৃতি আজো সজীব রাসায়নিক সারের স্পর্শ ছাড়াই। এমন এক জনপদ আন্দেজের কোলে লুকিয়ে থাকা ভিলকানোতা নামের পাহাড়ি নদী ছুঁয়ে চলা একরত্তি ইনকা গ্রাম রাখচি, যেখানে জীবনের ও জীবনধারার পরিবর্তন এমন কিছু ঘটেনি গত হাজার বছরে। যাবেন সেখানে?
ইনকা রাজার গুপ্তধনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি না, পায়রার ডিমের মত বড় বড় সবুজ পান্না, রক্ত লাল রুবি, জ্বলজ্বলে হীরে, চোখ ঝলসানো সোনার পিণ্ডের স্তূপ কোথায় লুকিয়ে আছে আমার জানা নেই, জানতে খুব একটা আগ্রহও বোধ করি না, কারণ, এইগুলো আসল গুপ্তধন নয়!
আসল গুপ্তধন হল আনন্দময় স্মৃতি, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিখাঁদ তৃপ্তি জুগিয়ে যায়, সেই সর্বক্ষণের সঙ্গী। এক পর্যায়ে হীরা ভর্তি উপত্যকা, বা বিশাল সোনার খনিও অর্থহীন হয়ে যায় জীবনে সুখস্মৃতি না থাকলে। এমন মনের ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা অজস্র মুহূর্ত আপনাকে উপহার দেবে এই গ্রাম ও তার সন্তানেরা। চলুন, যাত্রা শুরু করা যাক—
গ্রামের মূল ফটকে প্রবেশ করার আগেই চোখ পড়ল পাথরের প্রাচীর ঘেরা শস্যক্ষেত্র, শুনলাম সেগুলো ৫০০ বছর আগে নির্মিত! অথচ এখনো ফসলের হাসি উৎপাদনে সক্ষম। কুশলী কৃষক ইনকারা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পাথুরে বন্ধুর জমিকেই নতুন ভাবে সাজিয়ে উর্বর করে তুলত, সেই সাথে ছিল পাথরের দেয়াল দিয়ে ভূমিক্ষয় ও ভূমিধ্বস রোধের ব্যবস্থা। তাদের বংশধররাও বলবৎ রেখেছে পরিবেশবান্ধব কৃষিকাজের ধারাটি।
মূল ফটক পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই বেশ খোলা মেলা চত্বর, তার এক কোণে মহাবিশ্বের জানা-অজানা সমস্ত রঙ নিয়ে বসেছে স্থানীয় ইনকাদের বাজার, এমনিতেই ইনকারা বিশ্বের সবচেয়ে রঙ ঝলমলে পোশাক ব্যবহারকারীদের অন্যতম জাতি, মেক্সিকান ইয়াইয়াস সেরণাও বলল মায়া বা অ্যাজটেকদের পোশাক এতটা রঙদার ছিলনা কখনোই। যেন বিশাল ম্যাকাও পাখির মেলা বসেছে বিকেলের পঞ্চো গায়ে গাঁয়ের সবার জমায়েতে।
নানা ধরনের পণ্য সম্ভার, বিশেষ করে ইনকা সভ্যতার স্মারকের চাহিদা খুব বেশী। সমানে চলছে বিকিকিনি, ইনকা পুরোহিত নরবলি দেবার কুঠারটির প্রতিলিপিই রয়েছে কয়েক হাজার ধরনের।
দোকানীদের এড়িয়ে আপাতত চললাম গাঁয়ের অন্য প্রান্তে, যেখানে রয়েছে এই অঞ্চলের মূল আকর্ষণ। কিন্তু বাজারের পাশেই পাঁশুটে রঙের গির্জাটি ঠিকই স্মরণ করিয়ে দিল এই মাটির সন্তানদের উপর ইউরোপিয়ান উপনিবেশিকদের শারীরিক, মানসিক অকথ্য অত্যাচারের কালো অধ্যায়কে, যা আজও বর্তমান। গাঁয়ের মূল চত্বর থেকে সামান্য দূরেই নলখাগড়া ভর্তি এক জলা, তার পাড়েই সেই মহা আকর্ষক স্থাপত্য- দেবতা ভিরাকোচার মন্দির।
ভিরাকোচা ইনকা পুরাণ এবং প্রাক-ইনকা সভ্যতাগুলোর প্রধানতম দেবতা, তিনিই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টিকর্তা,( তার আরেক নাম কনটিকি! ), সূর্য, চাঁদ, গ্রহ, নক্ষত্র, আকাশ প্রভৃতি সৃষ্টির পরে আবার তিনি অসীম ক্ষমতাবলে তাদের নিয়ন্ত্রণও করে থাকেন। তারই সন্মানে ইনকা সম্রাট এই বিশাল মন্দিরটি নির্মাণ করেন।
যদিও আজ সেই কাঠামোর সামান্যই অবশিষ্ট আছে, কিন্তু তাতে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় এক কালে কি বিশাল কর্মযজ্ঞে মেতেছিল মন্দিরের নির্মাতারা। মাঝের মূল দেয়ালটি আজও দাড়িয়ে আছে তাবৎ ভূমিকম্পকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে। সেটির ভিত্তি বিশেষ ধরনের পাথর দিয়ে তৈরি হলেও সামান্য উপর থেকেই বাকি অংশটুকু অত্যন্ত টেকসই পদ্ধতিতে কাদা ও নানা শস্যের খড় মিশিয়ে তৈরি করা হয়েছে।
দেয়ালটির দুই ধারেই সমান দূরত্বে বেশ কিছু পাথরের কুয়ো মত, কৌতূহলের তাড়নায় উঁকি দিয়ে জানা গেল জলের কুয়ো নয়, এগুলো ছিল এককালে এই মন্দিরের স্তম্ভ, যাদের উপর ভর করে দাড়িয়ে ছিল মাঝের দেয়ালের দুই ধারে বিস্তৃত এক বিশাল ছাদ, সত্যি কথা বলতে ইনকা সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় ছাদ। এর দৈর্ঘ্য ছিল ৩২০ ফুট আর প্রস্থ ৮৪ ফিট! সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ঈশ্বর বলে কথা!
কিন্তু মন্দিরটির বিগ্রহের কোন হদিস পাওয়া সম্ভব হয় নি, হয়ত লোভী স্প্যানিয়ার্ডরা গলিয়ে ফেলেছিল সমস্ত মূল্যবান ধাতু, লুট করেছিল সমস্ত অলংকরণ।
কিন্তু ইতিহাস ভুলে নি সেই ইনকাদের, বর্তমান কালেও যাদের প্রতি আমাদের বিস্ময় বাড়তেই থাকা ক্রমাগত নব নব আবিষ্কারের ফলে। মন্দিরের পরে আবার শুরু হয়েছে গ্রাম, সেখানে প্রাচীন কিছু কক্ষে ছিল পুরোহিত এবং সেবকদের থাকার ব্যবস্থা। সেই সাথে বিশেষ ভাবে নির্মিত গোলাকৃতি পাথরের ঘরের দেখা মিলল, এগুলো ছিল মূলত শস্যাগার, ভুট্টা এবং অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় শস্য সংরক্ষণ করে রাখা হত এমন ঘরে, এই অঞ্চলে জানা যায় শখানেক শস্যাগার ছিল এক কালে।
গাঁয়ের সীমানার বাহিরেই পাহাড়ের শরীর একেবেকে চলা পাথরের স্থাপনা চোখে পড়ল, গাইড জানাল এগুলো ইনকাদের তৈরি গ্রাম সুরক্ষা প্রাচীর!
যেন বহিঃশত্রুরা নিঃশব্দে অতর্কিতে ঢুঁকে না পড়তে পারে আক্রমণে উদ্দেশ্যে তাই পাহাড়ি গ্রামগুলোতে এই ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হত, তখন কি আর তারা জানতেন দখলদারি শত্রুরা পাহাড় ডিঙ্গিয়ে নয়, আসছে মহাসাগর পাড়ি দিয়ে।
স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে দেখা হল থেকে থেকেই, পশুচারণরত এক মহিলাতো পর্যটকদের দেখে মহা খুশী হয়ে হ্যাট হ্যাট বলে ভেড়া তাড়াতে লাগলেন, পরবর্তীতে অবশ্য এর বিনিময়ে সামান্য নগদ নারায়ণও দাবী করে বসলেন!
আর দেখা মিলল টিনটিনের! ল্যাতিন আমেরিকায় এক অভিযান চালানোর সময় এই বালকটির মতই বেশভূষা ছিল তার।
কাঠকুড়োনী এক দাদীমা ফোকলা হেঁসে দেখছিলেন বেকুব বিদেশীদের কাজকারবার, পাথর কুঁদে তৈরি তার মুখমণ্ডলে প্রবল পরিশ্রম, অর্থনৈতিক অভাব ও গ্রাম্য সরল জীবনের সুখের ছাপ একই সাথে স্পষ্ট।
সময়ের সল্পতা বিধায় আবার তাড়া খেয়ে সেই ইনকা বাজারে ফিরতে হল, ঢোকার অন্য পথে দেখি গ্রামের নামটি লেখা আছে লাল মাটির দেয়ালের গায়ে, এর প্রতিটি বর্ণ যেন জ্বলজ্বলে জীবন কাহিনী।
বাজারে হরেক দোকানীর সাথে ভাব বিনিময় করে কিছু কেনা হল, জিজ্ঞাস্য প্রশ্নের উত্তর জানা গেল কিছু কিছু, তাঁতের বয়ন ব্যবস্থা দেখলাম অভিভূত হয়ে।
ইসাইয়াস কিছুক্ষণের জন্য উধাও হয়ে গিয়েছিল না বলেই, এর মানে অবশ্য ধরে নেয়া যায় প্রকৃতির অমোঘ আহবানে সে ব্যস্ত, কিন্তু না! খানিকপরেই এক কুঁড়ে থেকে বের হয়ে ফিসফিস করে বলল, দেখ কি পেলাম! এক ইনকা ওঝা ( শামান) কোঁকা পাতা থেকে তৈরি বিশেষ ধরনের পানীয় দিল ( অবশ্যই অ্যালকোহল), এটি দেহযন্ত্রের ভিতরে গেলে নাকি আর এই উঁচু পর্বতের পাৎলা অক্সিজেনের বাতাসে আমাদের আর খাবি খেতে হবে না ডাঙ্গায় তোলা মাছের মত! বিশ্বাস না হলেও, চেষ্টা করতে দোষ কি !
পরের কয়েক মিনিট সেই জাদুগ্রামের অধিবাসীদের স্মৃতি ধরে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে গেলাম ক্রমাগত ক্যামেরার শাটার টিপে, কারণ আসল জাদু কোনসময়ই স্থান, কাল, পাত্রে বন্দী করা যায় না। যায় কেবলমাত্র অনুভব করা।
মন্তব্য
জানলাম
facebook
আপনার মতো ঘুরতে পারলে একটা দারুণ জিনিস সংগ্রহ করতাম আমি
বিভিন্ন দেশের স্থানীয় পানীয়। হোমিওপ্যাথির ছোট শিশির মধ্যে
ওদের বয়নযন্ত্রটা দেখে মুগ্ধ হলাম না, আমাদের লোকজ বয়নযন্ত্র অনেক বেশি সুন্দর
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
দি আইডিয়া নজু ভাই ! তয়লে কাজে লেগে পড়ি! তবে দেশ থেকে শুরু করলেও দারুণ হবে
facebook
ক্যান !
facebook
এইসব ইনকা ফিনকা বাজে কথা। সাউথ আমেরিকা বইলা আবার কিছু আছে নাকি ? ওইসব তো বইয়ের কল্পনা। আপনিও আমেরিকা যেমন চাঁদের স্টেজ বানায়া নীল আর্মস্ট্রংরে দিয়া অভিনয় করাইসে, তেমন কিছুই করছেন বইলা সন্দেহ করি।
এইসব সাউথ আমেরিকা বাদ্দিয়া দেশে আসেন, এখনো আপনার কোঞ্চিপার আড্ডা দেখা বাকি আছে। ওইটা না দেখলে সাউথ আমেরিকার বেইল নাই
অফটপিক- ছবিগুলা মারাত্মক হইসে
অলমিতি বিস্তারেণ
হায় কোঞ্চিপা
আসিতেছি !
facebook
শুনলাম কোকার বোতলের ভিতরেই নাকি ইঙ্কারা এল-ডোরাডো লুকিয়ে রেখেছিল ?!!
****************************************
আমি আগে শুনি নাই !
কি দারুণ ব্যাপার, হতেও পারে
কলম্বিয়ার বোগোতার বিমান বন্দরের নাম ছিল এল ডোরাডো !
facebook
বলেন কী, উঁচু পর্বতের পাৎলা অক্সিজেনের বাতাসে খাবি খেতে হয় না যেই এল-ডোরাডোতে খাবি খেলে, সেইটাতে আপনি খাবি খাওয়ার 'চেষ্টা' করেছেন বলছেন বলেই না জিজ্ঞেস করা! এখন আপনিই যদি বলেন - শুনি নাই, হতেও পারে, তাহলে কেমন লাগে !!
কোথায় বিমান বন্দর, কোথায় নিজে উড়া!
যাজ্ঞে রহস্যময় এল ডোরাডোর চূড়া থেকে কণ্ডরের মত উড়াল দেয়ার খবর আপনি দিবেন না বুঝছি, মৎসভাজাঘূর্ণন-অপটিয়সী মার্জার হিসাবে থাকতেই আপনার পছন্দ। ঠিক হ্যায়!
****************************************
কিছু কিছু জিনিস উহ্যই থাক না !
facebook
এবারের ছবিগুলা ছবির মতন হইছে। লেখা এখনও পড়িনাই।
...........................
Every Picture Tells a Story
একটু সময় করে পড়ে জানিয়েন মুস্তাফিজ ভাই।
আর ছবি, বোঝেনই তো সব মাত্র ৩৫ মিনিটে তোলা-
facebook
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
ইমো পাইলেন কই!
facebook
আপনে কী সাড়া পৃথিবী ঘুইরা ফালাইবেন? এতো ট্যাকা পান কই?
বরাবরের মতোই অসাধারণ।
চেষ্টা করতেছি, হচ্ছে না । কিন্তু চেষ্টা করতে ক্ষতি কি!
টাকা কই দেখলেন, সবই তো খরচ!
facebook
facebook
ঠিক কি না, বলেন !
facebook
মামুর বুটা বৃষ্টির মত পুস্টাচ্ছে গো!
বইলছি কী, ছবিগুলো দেখে মন ভইরে গেলো
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
লিয়ে লাও! কাখে লাড়তে কাখে লাড়েছ মামুর বুটা!
facebook
আগের মতোই মন্তব্য করলাম। এবার মনে মনে।
facebook
(গুড়)
facebook
এতো অদ্ভুত সুন্দর বর্ণনা! মনে হল আমি যেন ইনকাদের গুহার ছায়ায় আপনার সাথেই ছিলাম--
হ্যাটস অফফ --------
-------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ--
হুম্ম, শুনে সুখী হলাম, কিন্তু গুহা পাইলেন কই!
facebook
বরাবরের মতই চমৎকার বর্ণনা।
অনেক ধন্যবাদ, দেরিতে হলেও
facebook
নতুন মন্তব্য করুন