(ইগন্যাসিও র্যামোনেতের শত ঘণ্টা ব্যাপী নেওয়া ফিদেল কাস্ত্রোর সাক্ষাৎকারের সংকলন গ্রন্থ MY LIFE এর একটি অনুবাদ প্রচেষ্টা চালাচ্ছি, আপনাদের সকলের মতামত কাম্য। মূল বইয়ের লেখক এবং প্রকাশকের অনুমতি ছাড়া লেখাটি কোন রকম বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা নিষিদ্ধ, আর বাণিজ্যিক কারণ ছাড়া অনুবাদটি ব্যবহার করতে চাইলে অবশ্যই অনুবাদকের সম্মতি লাগবে। সত্যিকার অর্থে এই প্রথম অনুবাদ করছি, বানান ভুল ছাড়াও অন্য অনেক আড়ষ্টতা থাকার কথা, আশা রাখছি আপনাদের সহযোগিতায় সেগুলো আস্তে আস্তে কাটিয়ে উঠব।)
ঐতিহাসিক পটভূমি সবসময়ই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, সেই জন্য আমি আপনার কাছে প্রশ্ন রাখব- আপনার জন্ম তুলনামূলক ভাবে সচ্ছল পরিবারে, পড়েছেন ধনীদের জন্য নির্মিত গোঁড়া ধার্মিক স্কুলে, পরবর্তীতে আইনশাস্ত্র অধ্যয়ন করেছেন। এই সব মিলিয়েই আপনার পক্ষে একজন রক্ষণশীল নেতা হিসেবেই আবির্ভূত হবার কথা ছিল, তাই নয় কি?
হয়ত হতেও পারত, কিন্তু মানুষ তাদের ভাগ্যের একশ ভাগ নিয়ন্ত্রক নয়। একজন মানুষ তার পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলীর, কাঠিন্যের, সংগ্রামের ফসল। জীবনে উদ্ভূত নানা সমস্যা তাকে বিভিন্ন ভাবে গঠন করে, যেমন ভাবে লেদমেশিনে ধাতুকে খোদাই করে নানা রূপ দেওয়া হয়। আমি বলতে পারি মানুষ জন্মমাত্রই বিপ্লবী নয়।
তাহলে কি ভাবে আপনার বিপ্লবের পথযাত্রা শুরু হল?
আমি নিজেই নিজেই বিপ্লবীতে পরিণত করেছি। জীবনের নানা সময়ে বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এগুলো হয়েছে। তবে সবকিছুর শুরু হয়েছে সেই গ্রাম্য এলাকাতে, যা আমার জন্মভূমি।
আপনার জন্মস্থান সম্বন্ধে কী মনে আছে?
আমার জন্ম হয়েছিল একটি খামারবাড়ীতে। ওরিয়েন্তে রাজ্যের উত্তরে, নিপে উপসাগরের কাছে, ইক্ষুর ফলনের জন্য বিখ্যাত মাকার্নের নিকটে। খামারটির নাম ছিল বিরান। এটি কোন শহর না, আসলে কোন গ্রামও নয়, কেবল বিচ্ছিন্ন ভাবে দাড়িয়ে থাকা গোটাকয়েক বাড়ী। আমার পরিবারের বাসভবন সেখানেই ছিল, বুড়ো ক্যামিনো নামের সেই ধুলাময় কর্দমাক্ত পথটির ধারে, যা কিনা রাজধানী থেকে শুরু হয়ে পৌরসভা ছুয়ে দক্ষিণে যাত্রা অব্যাহত রেখেছিল। সেই সময়ের রাস্তাগুলো আসলে ছিল স্রেফ বিশাল কাদাময় পথ। মানুষের চলাচলের বাহ্ন ছিল ঘোড়া এবং গরুর গাড়ী। তখন যান্ত্রিক গাড়ীর, এমনকি বৈদ্যুতিক বাতির আবির্ভাবও ঘটেনি। আমার ছোট বেলায় মোমবাতি ও কেরোসিনের প্রদীপেই বাড়ী আলোকিত রাখা হত।
সেই বাড়ী নিয়ে কোন স্মৃতি মনে পড়ে কি?
সেটি ছিল স্প্যানিশ রীতি অনুসারে নির্মিত, আরো বিস্তারিত বললে গালিসিয়ান স্টাইলে। আমার বাবা ছিলে স্পেনের লোক, ল্যুগো রাজ্যের লাঙ্কারা গ্রাম থেকে উঠে আসা একজন গ্যালিসিয়ান। গালিসিয়াতে সেই ধরনের বাসগৃহ নির্মাণের রীতি ছিল যার নিচে গবাদিপশুদের থাকার স্থান থাকে। আমাদের বাড়ীটি গালিসিয় রীতি মত করা হয়েছিল কারন এটি ছিল কাঠের পিলারের, স্তম্ভের উপর নির্মিত। তিন বা চার বছর বয়সের স্মৃতি হাতড়ে দেখেছি, বাড়ীটির নিচে গরুরা ঘুমাত। তারা গোধূলিবেলায় বাড়ী ফিরে আসত এবং সেই নির্দিষ্ট জায়গাতেই ঘুমাত। সেখানেই খুঁটার সাথে বেধে তাদের দুগ্ধদোহন পর্বও চলত। গালিসিয়ার অন্যান্য আর সব বাড়ীর মতই আমাদের বাসগৃহের নিচে বিশেষ স্থান বরাদ্দ ছিল শুয়োর এবং নানা জাতের গৃহপালিত পাখির পালার জন্য যেখানে থাকত হাঁস, মুরগি, তিতির, টার্কি এমনকি রাজহাঁসও।
বিরানে গিয়েছিলাম আমি, যে বাড়ীতে আপনার জন্ম সেটিও দেখেছি, সেটি আপনি যেমন বললেন তেমনি এক সাধারন আটপৌরে স্থাপত্য।
সেটি ছিল কাঠের বাড়ী। পিলারগুলো খুবই মজবুত Caguairan কাঠের, তাদের উপরে পাটাতন বিছিয়ে মেঝে তৈরি করা হয়েছিল। যতদূর মনে পড়ে বাড়ীটি ছিল বর্গাকৃতির। পরবর্তীতে কিছু অংশ বর্ধিত করে অফিস করা হয়েছিল। আরো পরে সেখানে স্নানাগার, খাদ্য সংরক্ষণের জায়গা, খাবার ঘর ও রান্না ঘর নির্মাণ করা হয়েছিল। আর বাড়ীর মূল বর্গাকৃতির কাঠামোর উপরে ছোট আকৃতির একটি দ্বিতীয়তলা ছিল যার নাম বলা হত মিরাদোর। এবং প্রচলিত কাহিনীমতে ১৯২৬ সালের ১৩ আগস্ট, ভোর ২টায় সেখানেই আমার জন্ম হয়।
চারপাশের থেকে গ্রামের গাছ, ইক্ষু ক্ষেত, পাখি আর পতঙ্গময় সেই পরিবেশের মাঝেই খুব ছোট্টকাল থেকে বেড়ে উঠেছি আমি।
বিরানে গেলেই যে জিনিসটা সবাই প্রায় সাথে সাথেই অনুভব করতে পারে তা আপনার বাবা ডন অ্যাঞ্জেলের দৃঢ় চরিত্রের কথা-
বাবা ছিলেন প্রবল ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন একজন পুরুষ। অনেক প্রচেষ্টার পর নিজে নিজেই পড়তে এবং লিখতে শিখেছিলেন। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড ধরনের কর্মঠ ধরনের মানুষ যে কিনা সব সময় কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, আসলে কোন কিছু সমন্বয়ের জন্য তার ছিল প্রকৃতি প্রদত্ত ক্ষমতা।
উনি কেন কিউবাতে এসেছিলেন?
তিনি ছিলে ক্যাম্পেনসিনোসদের সন্তান, প্রবল দারিদ্রের মাঝেই তাদের জীবন চলমান। ১৯৯২ সালে গালিসিয়া ভ্রমণের সময় আমি লানকারা যায়, যে শহরে উনি বাস করতেন, এবং সেই তিরিশ ফুট দৈর্ঘ্যের ও ১৮ ফুট প্রস্থের ছোট্ট বাড়িটিও দেখি যেখানে তার জন্ম হয়েছিল। এটি মাঠে পাওয়া শিলা দিয়ে তৈরি, যা কিনা সেই অঞ্চলে পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যেত, ক্যাম্পেনসিনোসরা এই ভাবেই থাকার আশ্রয় গড়ে নিত আপন আলয়ে। সেই ক্ষুদের কাঠামোটিতেই সব পরিবার তাদের গৃহপালিত প্রাণীদের নিয়ে বাস করত। শোবার ঘর এবং রান্না ঘর ছিল একসাথেই। একহাত পরিমাণ উদ্বৃত্ত জমিও ছিল না। পরিবারগুলো সারা গ্রাম জুড়ে বিচ্ছিন্ন খণ্ড খণ্ড জমিতে কৃষিকাজ চালাতো।
ষোল- সতের বছর বয়সে বাবা স্পেনের সেনাবাহিনীতে যোগ দেন, কিন্তু কিউবাতে যখন ১৮৯৫ সালে সংঘটিত ২য় স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আসেন, তার বয়স বিশ ছাড়িয়েছে। আসলে আমাদের কারোরই জানা নেয় ঠিক কি কারণে এবং কি ভাবে তিনি কিউবা এসেছিলেন। বড় হবার পরও বাবার সাথে এই ব্যাপারে আমার কোন কথা বলা হয় নি। মাঝে মাঝেই তিনি নানা গল্প বলতেন বিশেষ করে নৈশভোজের সময় বা বন্ধুদের সাথে। কিন্তু আমার বড় বোন অ্যাঞ্জেলিতা এবং বড় ভাই র্যামন, যারা এখনো জীবিত হয়ত এই ব্যাপারে আলোকপাত করতে পারবে, অন্তত তারা বাবার সাথে আমার চেয়ে বেশী কথা বলত। তবে পরের দিকে যখন আমি যখন হাভানায় বিপ্লবের সাথে জড়িয়ে পড়ি, মোনকাদা আক্রমণে নেতৃত্ব দেবার ফলে কারাবরণ করি এবং পরে গ্রানমা করে কিউবাতে ফিরে আসি তখন কিছু কিছু পর্যায়ে আমার ছোট ভাই এবং বোন বিশেষ করে রাউল, এমা এবং হুয়ানার সাথে বাবার অনেক অনেক বিষয়ে কথা হয়েছিল, যদিও সেগুলো শোনার জন্য নিজে উপস্থিত ছিলাম না।
তবে তাদের মুখ শুনে আমার যা মনে হয়েছে বাবা গালিসিয়ার এক দরিদ্র তরুণ, যিনি বিত্তবান কোন লোকের বদলে সামরিক বাহিনীতে গিয়েছিলেন অর্থের বিনিময়ে। আর এটা সত্য যে বাবা ক্যাম্পেসিনোসদের একজন ছিলেন, যারা যুদ্ধে এইভাবে অংশগ্রহণ করত। সেই যুদ্ধ যে কি ছিল তা সকলেরই জানা।
যুদ্ধে অংশ গ্রহণের ব্যাপারটা তো লটারির মাধ্যমে হবার কথা, কিন্তু দেখা যাচ্ছে ধনীরা অর্থের মাধ্যমে অন্য কাউকে তাদের জায়গায় মিলিটারিতে যাওয়া তো বটেই এমনকি যুদ্ধে পর্যন্ত পাঠাতে পারত?
এমনতো কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘটেছিলই, দেখা গেল চরম দারিদ্রের সাথে ঝুযতে থাকা কাউকে ধনশালী কোন ব্যক্তি বেশ মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে ঘটনাটা ঘটাত।
বাবা একজন স্প্যানিশ সৈনিক হিসেবেই কিউবায় পদার্পণ করেছিলেন, এবং তিনি হুকারো ও মোরোনের মধ্যবর্তী অঞ্চলে বন পরিষ্কারের কাজে নিয়োজিত ছিলেন যেখানে পরবর্তীতে সেনাঘাটি গড়ে তোলা হয় , যা কিনা কিউবান বিপ্লবীরা মাসিও এবং মাক্সিমো গোমেজের নেতৃত্বে দখল করে হোসে মার্তির মৃত্যুর পরে।
সেই বিশাল জঙ্গল সাফ করে ঘাটি স্থাপন করা ছিল মহাকঠিন এক মিশন, যা ছিল বেশ কয়েক মাইল লম্বা। আমি এতটুকুই জানি বাবার কাজের দায়িত্ব সেখানে ছিল, তবে মাসিওর দখলের সময় মনে হয় বাবা সেখানে ছিলেন না। আমার এর বেশী কিছু জানা নেই, হয়ত অন্য ভাই-বোনদের জানা থাকতে পারে।
বাবার সাথে এই বিষয়ে কোন কথোপকথনের স্মৃতি আপনার মনে পড়ে না?
একবার পিনার দেল মায়ারিতে শ্রমিকদের এক ক্যাম্পে যাবার পথে উনাকে এই নিয়ে কথা বলতে শুনেছিলাম বটে! আসলে আমি বাড়ী ছাড়া সবখানে থাকতেই পছন্দ করতাম, বাড়ী মানেই মনে হত কোন রুদ্ধ গরাদ, যেখানে আমার বিপ্লবী চেতনা আন্দোলিত হতে ভিতর থেকেই।
তাহলে শিশুকাল থেকে আপনি একজন বিপ্লবী?
এটি হবার পিছনে একাধিক কারণ ছিল। বিশেষ করে স্প্যানিশদের কতৃত্বের নিচে বাস করার সময়, বিশেষ করে তাদের হুকুম দেবার প্রবণতায়- আমি এই কাজগুলো অপছন্দ করতাম, সেই সময়ও অনেক ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা ছিল যেমন মাথায় আঘাত করা কিংবা বেল্ট দিতে পিটানো, এইসব নিয়েই সবসময় চলতে হত আমাদের, যদিও ধীরে ধীরে শিখে গিয়েছিলাম কি করে নিজেদের রক্ষা করে চলতে হয়।
আপনার বাবা বেশ কতৃত্বপরায়ণ ছিলেন বলা চলে?
একটু মেজাজি লোকতো ছিলেনই। কিন্তু সেটি ছাড়া তিনি কোনদিনই নিজেকে গড়ে তুলতে পারতেন না, সেই কৈশোর থেকেই প্রথমে পরিবার ও স্বদেশ থেকে এত দূরে থেকে যুদ্ধ, পরবর্তীতে একটি পয়সা ছাড়াও নিজের চেষ্টায় তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন সচ্ছলতা, ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় পরিবারের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে পড়তে এবং লিখতে শিখেছিলেন, কারোই সাহায্য পাননি জীবনের বন্ধুর দিনগুলোতে, মনে হয় খুব শক্ত চরিত্রের অধিকারি না হলে এই কাজগুলো কেউ করতে পারে না।
বাবা একজন গালিসিয়ান ইমিগ্রান্ট হিসেবে বিনয়ী এবং কর্মঠ ছিলেন সেই সাথে ছিলেন দৃঢ় চরিত্রের এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষের অধিকারী। কিন্তু তিনি কখনই অবিচার করতেন না। তার আছে আসা সাহায্যপ্রার্থীদের কখনোই না বলতেন না। সবসময়ই সবার কথা শুনতেন মনোযোগ দিয়ে এবং সুযোগ পেলেই অন্যদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। জীবনের বেড়ে ওঠার সময়টিতে তার অনেক অভাব ও প্রয়োজন ছিল। আমি জানি মাত্র এগার বছর বয়সে মা হারিয়ে তিনি অনাথে পরিণত হন। তার বাবা আবার বিয়ে করেন, এবং সেই বালকের শৈশব ছিল যথেষ্টই অত্যাচারিত এবং বিব্রতকর। কিন্তু গালিসিয়ান ইমিগ্রান্টদের স্বভাবজাত গুণাবলী ছিলই তার মাঝে- দয়া, বিনয়, অতিথিপরায়ণতা।
তার অতিথিপরায়ণতা নিয়ে অনেক গল্প চালু আছে, এমনকি দয়া নিয়েও। খাঁটি হৃদয়ের একজন মানুষ সবসময়ই তার বন্ধু, শ্রমিক এবং চারপাশের মানুষের কঠিন সময়ে আপনা থেকেই এগিয়ে আসে। হয়ত কোন সময়ে তিনি মৃদু অভিযোগ করতেন, বিরক্তও হতেন, কিন্তু কখনোই সমাধান ছাড়া সমস্যাগ্রস্ত কাউকে ফিরিয়ে দিতেন না। ফসল তোলার পরে যখন মানুষের হাতে উপার্জনের উপায় থাকে না বললেই চলে, তখন প্রায়শই তার কাছে মানুষেরা আসত, যারা অনাহার পীড়িত পরিবারের কথা, কাজের অভাবের কথা তুলে ধরত। বাবা সবসময়ই নিজের কিছু জমি যা পরিষ্কার করা বা নিড়ানো আবশ্যক ছিল না, তা তাদের কাজ দেবার ছলে পরিষ্কার করিয়ে নিয়ে অর্থ সাহায্য করতেন, যদিও তা আমাদের পরিবারের জন্য অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভজনক ছিল না। বয়স কিছুটা বাড়ার পর স্কুলের অবসরে তার অফিসের কাজে সাহায্য করতে যেয়ে জিনিসটি আমি বুঝতে পারি, সেখানে কাজের জন্য ডাকা হয় নি এমন শ্রমিকদেরও কর্ম সংস্থান করে দিতে হত যেন তারা ব্যবহার্য সামগ্রি কেনার টাকা আয় করতে পারে। তিনি ছিলেন একজন মহৎ এবং দয়ালু মানুষ।
১৮৯৮ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর আপনার বাবা কিউবায় থেকে যেতে মনস্থির করেন?
না না, ১৮৯৮ সালে যুদ্ধের পরপরই তিনি স্পেনে ফিরে যান, কিন্তু কিউবা তার এটি ভাল লেগেছিল যে পরের বছরই অন্য অনেক গ্যালিসিয়ান ইমিগ্রান্টের সাথে ফেরত এসেছিলেন এইখানে। হাভানা বন্দরের পুরনো নথি ঘেঁটে জানা গেছে ১৮৯৯ সালের ডিসেম্বরে তিনি পদার্পণ করেন দ্বীপদেশটিতে। কপর্দকহীন এবং একা অবস্থায় প্রথমেই তিনি শ্রমজীবন শুরু করেন। ঠিক জানা নেই কেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইস্টার্ন প্রভিন্সে তিনি খানিকটে থিতু হন, ঠিক সেই সময়েই আমেরিকান প্ল্যান্টেশন কোম্পানিগুলো বিভিন্ন জায়গার বন উজাড় করে জ্বালানী এবং নির্মাণ কাজে ব্যবহার করা শুরু করেছিল, অন্য অনেক বিখ্যাত ভবন এবং জাহাজের মতই সেই সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং বৃহৎ যুদ্ধজাহাজ সান্তিসমা ত্রিনিদাদ এই কাঠ দিয়েই তৈরি হয়, এর মূল নির্মাণস্থান ছিল হাভানা এবং ১৮০৫ সালে ইংরেজদের ট্রাফালগারে যুদ্ধের উদ্দেস্য ভাসানোর পরে এক সমুদ্রঝড়ে সলিল সমাধি ঘটে।
যাই হোক, মার্কিনরা গাছ কাটার এবং ইক্ষু ক্ষেত প্রস্তুতের জন্য সবসময়ই লোক ভাড়া করছিল। কোথাও বন থাকলে সেই জমি খুবই উর্বর হয়, তাই প্রথম দিকে ফলন হয়েছিল দুর্দান্ত।
আপনার বাবা মার্কিনীদের জন্য কাজ করতেন?
বাবা একজন সাধারণ শ্রমিক হিসেবে সেই সময়কার কর্ম জীবন শুরু করেছিলেন ওরিয়েন্তে প্রভিন্সে, বিখ্যাত ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির জন্য, যাদের সেই প্রভিন্সে প্ল্যানটেশন ছিল। পরবর্তীতে তিনি একটি শ্রমিকদল গঠন করেন এবং তাদের নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ভাড়া খাটতে যেতেন। শুনেছি, এক পর্যায়ে তার দলে ৩০০ শ্রমিক ছিল, যার ফলে একপর্যায়ে আর্থিক লাভের মুখও দেখেছিলেন। অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতা থাকলেও তিনি ছিলেন নিরক্ষর, তাই ধীরে ধীরে নিজে নিজেই লেখা এবং পড়া আয়ত্ত করেন, যা ছিল নিঃসন্দেহে কঠিন একটা কাজ। পরে একটি জ্বালানী কাঠের জোগান দেবার বা বন কেটে পরিষ্কার করবার জন্য একটি ছোটখাট ব্যবসা শুরু করেন। এখান থেকেই একজন সংগঠক হিসেবে তার ব্যবসা লাভজনক হতে থাকে। তার দলের অধিকাংশ শ্রমিকই ছিলেন স্পেন থেকে আসা অভিবাসী, সেই সাথে অল্প কয়েকজন ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের অন্যান্য দ্বীপের, বিশেষ করে জ্যামাইকার এবং হাইতির।
আপনার বাবা শেষ পর্যন্ত কতখানি জমির মালিক হয়েছিলেন?
শেষ পর্যন্ত তিনি ৯০০ হেক্টর ( ২০০০ একরের মত) জমি কিনতে সক্ষম হন এবং আরো কয়েক হাজার হেক্টর জমি লিজ হিসেবে কিউবার স্বাধীনতা যুদ্ধের সৈনিক দুইজন কিউবান জেনারেলের কাছ থেকে নেন। সেগুলো ছিল পাইনের বিশাল প্রান্তর, কুমারী অরণ্য। সত্যিকারের প্রাকৃতিক বন, পর্বত- উপত্যকা- মালভূমি ডিঙ্গিয়ে ১৮০০ ফুট উচ্চতাতেও ছিল গাছের রাজত্ব। বাবা মায়ারি এলাকার গাছ কাটার তদারক করতেন। প্রতিদিন পাইনের কাঠ ভর্তি ১৭টি ট্রাক সেখান থেকে আসত। গবাদিপশু এবং ইক্ষু থেকেও একটা মোটা উপার্জন আসছিল, কারণ উনার মালিকানায় নানা ধরনের কাজের উপযোগী জমি ছিল। সব মিলিয়ে হয়ত ১০,০০০ হেক্টর ( ২৫,০০০ একর) ছিল মোট জমি।
সে তো বিশাল সম্পত্তি।
তার নিজের অর্জন এবং লিজ নেয়া অংশগুলো এক করলে তিনি প্রায় ১১,০০০ হেক্টর জমির নিয়ন্ত্রণ করতেন।
বেশ সচ্ছল অবস্থা বলা চলে-
তা তো বটেই। বলতেই হবে আমি যে পরিবারে বড় হচ্ছিলাম তা সাধারণ দশটা পরিবারের চেয়ে আর্থিক ভাবে সচ্ছল ছিল। এটি নিয়ে আমার গর্ব করার কিছু নেই, কিন্তু সঠিক চিত্র দেবার জন্যই পুরোটা বললাম।
আপনি তাহলে ছিলেন একজন কোটিপতির সন্তান?
আসলে ঠিক তা নয়। কেউই কখনো বলে নি বাবা একজন কোটিপতি ছিলেন। সে যুগে কোটিপতি বলতে যে পরিমাণ অর্থের মালিক বোঝানো হত তা ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। ধরা যাক একজন শ্রমিকের সারা দিনের হাড় ভাঙ্গা খাটুনির মূল্য ছিল এক ডলার, তাহলে তার মজুরির কয়েক লক্ষ গুণ টাকা বেশী থাকলেই কেবল কোটিপতি হওয়া সম্ভব, যা বাবার কোনদিনই ছিল না। তবে তার মোটা আর্থিক উপার্জন ছিল। সেই সমাজে একজন ধনী মানুষের সন্তান হিসেবে আমরা বেশ খাতির পেতাম। মনে পড়ে, অনেকে কেবল মাত্র তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য আমাদের সাথে মধুর ব্যবহার করত, যদিও আমরা সেগুলো বুঝে উঠতে পারি নি।
বিরানে আপনার বাবা কেবলমাত্র একটি বাড়ী দিয়ে শুরু করলেও, ধীরে ধীরে সেখানে অন্যান্য ভবন, রুটির দোকান, পানশালা, বিদ্যালয়, হাইতিয়ান শ্রমিকদের জন্য বাসস্থান- সব মিলিয়ে একটা ছোটখাট শহরই তৈরি হয়ে গিয়েছিল!
আসলে সেখানে ছিল স্রেফ কিছু বাড়ী! শহর হিসেবে বিরানকে কল্পনা করা মুশকিল। শৈশবে বাড়ীর নিচেই দুধের খামার ছিল, পরবর্তীতে বাড়ী থেকে ৪০ গজ দূরে সেটি নির্মাণ করা হয়, রাস্তার ওপারেই ছিল কামারের দোকান। তারকাছেই একরত্তি কসাইখানা। তার থেকে আরও চল্লিশ গজ দূরে, উল্টো দিকে ছিল রুটির দোকান আর নিকটেই বিদ্যালয়। আরও ছিল এক মুদির দোকানে, মনে হয় জগতের এমন কিছু নেয় যা সেখানে মিলত না, তার সাথে সাথে ডাকঘর ও টেলিগ্রাফের অফিস। সেই আস্তানা থেকে সামান্য দূরেই ছিল হাইতি থেকে আসা শ্রমিকদের জন্য হতশ্রী কিছু কোন মতে দাড় করানো কাঠামো,নোংরা মেঝে আর তালপাতার ছাউনি। তারা মূলত শস্য কাটার সময়ে আসত , যা ছিল সারা মৌসুমে খামারের ব্যস্ততম সময়। বাবা নিজ উদ্যোগে একটি বিশাল কমলার বাগান গড়ে তুলেছিলেন বেশ ক একর জায়গা জুড়ে, সেখানে কলা, পেঁপে, নারকেলসহ নানাবিধ ফলের গাছ ছিল। আমি এখনো চোখ বন্ধ করে সেই কমলা বাগানের ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে পারব, সেখানের প্রতিটি গাছ আমার চিরচেনা। সুযোগ পেলেই হাতেই কমলা ছাড়িয়ে খেতাম তারিয়ে তারিয়ে। পুরোটা গরমের এবং ক্রিসমাসের ছুটি আমার সেখানেই কাটত। আমার চেয়ে বেশী কমলাখোর পুরো তল্লাটে কেউ ছিল না।
সেখানে তো মোরগলড়াই দারুণ জনপ্রিয় ছিল, মোরগ লড়ুয়েরাও ছিল নাকি?
হ্যাঁ, বাড়ী থেকে শ খানেক গজ দূরেই রাস্তার ধারে ছিলে সেই লড়াইয়ের স্থান। ফসলের মৌসুমে প্রতি রোববারে, এছাড়া বছরের বিশেষ কিছু ছুটির দিনে মোরগ লড়াই চলত। গ্রাম্যজীবনে এইটিই ছিল বিনোদন।
মানে বলতে চাচ্ছেন স্থানীয় বিনোদন-
তাই হবে, সেখানে তো বিনোদনের কোন আলাদা উৎস ছিল না। অনেকেই ডমিনো আর তাস খেলত। সৈনিক জীবনে বাবা তাস খেলতে খুব পছন্দ করতেন, তিনি অবশ্য খেলাটিতে দারুণ নৈপুণ্যও অর্জন করেছিলেন একসময়ে। আমার তিন বছর বয়সে বাড়ীতে একটি ফনোগ্রাফ এসেছিল, গান বাজানোর জন্য। সারা তল্লাটে কারো রেডিও ছিল না। মনে হয় আমার সাত বা আট বছর বয়সে বাবা রেডিও নিয়ে আসেন। না না, ততদিনে আমি নিশ্চয়ই দশ অথবা বারো, কারণ ১৯৩৬ বা ১৯৩৭ সাল ছিল সেটা, কারণ রেডিও এবং ক্ষুদে একটি জেনারেটর যা কিনা ঘণ্টা দুই চলতে পারত, হাতে পাবার আগেই স্পেনের গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। জেনারেটরটি প্রতিদিনই কয়েক ব্যাটারির চার্জে ব্যবহৃত হত, তাই বলা যায় প্রতিদিনই আমরা অল্প বৃষ্টির জল ঢেলে এটিকে সচল রাখতাম।
এবং এই সব কিছুর মালিক আপনার বাবাই ছিলেন?
ডাকঘর এবং স্কুল বাদে প্রায় সবকিছুরই, সেগুলো ছিল সবার সম্পদ। ১৯২৬ সালের আমার জন্মের সময় বাবা ধনসম্পদ অর্জনের দিক থেকে বেশ ভাল অবস্থানে ছিলেন। অন্যরা তাকে ডন অ্যাঞ্জেল ( ডন অ্যাঞ্জেল কাস্ত্রো) বলে সম্বোধন করত। সেখানে ডন মানেই তখন সর্বসাধারণের কাছে শ্রদ্ধা পাত্র এবং ক্ষমতাশালী কাউকে বোঝানো হত। সেই জন্যই আমি প্রথমেই বলেছিলাম আমি আসলেই এক অবারিত ভূসম্পদের মালিক এমন পরিবারের সন্তান, আর বাবা প্রতি বছরই অল্প অল্প করে জমি কিনে সেই সম্পদ বৃদ্ধি অব্যাহত রেখেছিলেন।
আমাদের আপনার মায়ের সম্পর্কে বলুন-
উনার নাম লিনা। কিউবার পশ্চিমাঞ্চলের পিনার দেল রিওর মেয়ে। তার পূর্বপুরুষেরা অবশ্য ক্যানারি দ্বীপ থেকে এসেছিল। তিনিও সেই ক্যাম্পেসিনোদেরই বংশধর এবং তার পরিবার ছিল অতীব দরিদ্র। আমার নানা ছিলেন একজন গরুর গাড়ী চালক, তিনি সেই গাড়ীতে করে ইক্ষু পরিবহন করতেন। তারা বাড়ী ছেড়ে সপরিবারে ভাগ্য পরীক্ষার উদ্দেস্যে সেই গরুর গাড়ী চেপে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে বিরানে পৌঁছান, মায়ের বয়স তখন তের বা চোদ্দ।
বাবার মত মা-ও প্রথম দিকে নিরক্ষর ছিলেন, এবং নিজের প্রবল চেষ্টাতেই লিখতে এবং পড়তে শিখেন। তিনি কোনদিন স্কুলের চৌকাঠ মাড়িয়ে ছিলেন বলে শুনি নি। অসম্ভব ধরনের পরিশ্রমী একজন মানুষ যার নজর এড়িয়ে যেত পারত না কোনকিছুই। তিনি ছিলেন আমাদের ডাক্তার, বাবুর্চি, সবকিছুরই যোগানদার, আমাদের প্রয়োজনীয় সবকিছুর মা-র কাছ থেকে আসত, কোন সমস্যায় পড়লে সবার জন্যই বিষাদে কাঁদার আশ্রয় ছিল তার কাঁধ। তিনি আমাদের বখে যেতে দেন নি, অত্যন্ত কড়া ভাবে আদেশ, সঞ্চয় এবং পরিষ্কার থাকার তালিম পালন করিয়ে নিতেন। এককথায় বলা চলে তিনি ছিলেন বাড়ীর অন্দরের এবং বাহিরের সকল কাজের সফল তদারককারী, এবং সেই সাথে পরিবারের অর্থনীতিবিদ। কারোই জানা ছিল এই বিপুল কাজ ও দায়িত্ব পালনের শক্তি এবং সময় তিনি কোথা থেকে পেতেন! আমি তাকে কখনোই সারা দিনের মাঝে এক মুহূর্তের জন্যেও বসা অবস্থায় দেখি নি, তিনি কখনোই বসতেন না !
সাত-সাতজন সন্তানের জন্মদান করেছিলেন তিনি ঐ বাড়ীতেই। নতুন শিশুর ভূমিষ্ঠ হবার সময়টুকু একজা দাই আসত বটে কিন্তু সেই পোড়া বিবর্জিত দেশে ডাক্তার আসার কোন সম্ভাবনা ছিল না।
নিজ সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাবার জন্য তার মত পরিশ্রম মনে হয় আর কেউই করত না, তার নিজের জীবনের বঞ্চনা যেন আমাদের কাছে না আসে সেই জন্য তার চেষ্টার অন্ত ছিল না। নিজের কথাই বলি- আমি সবসময়ই পড়তে খুবই পছন্দ করি- মায়ের সাহায্য ছাড়া আজো আমি এক মূর্খই থেকে যেতাম। মা সবসময়ই এই ব্যাপারে কথা না বললেও বোঝা যেতে তিনি সন্তানদের অত্যন্ত স্নেহ করেন। দৃঢ় চেতা, সাহসী এবং ত্যাগী একজন মানুষ ছিলেন মা। আমাদের অনিচ্ছাকৃত সৃষ্ট যে কোন অঘটন তিনি সাহসের সামনে আগ বাড়িয়ে মোকাবেলা করতেন। যে জমি তিনি এত ভালবাসতেন , পরবর্তীতে সেগুলো পুনঃবণ্টন করা হলে তিনি কোন তিক্ততা পোষণ করেন নি।
মা ছিলেন অতিমাত্রায় ধার্মিক, বিশ্বাস এবং নীতিতে, যা আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি। একজন জননী হবার কষ্টের মাঝেও তিনি শান্তি খুঁজে নিয়েছিলেন এবং বিপ্লবের সময়ে তার ভূমিকায় মা অনেক অনেক সহজাত ভাবেই মানিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে, যিনি ছিলেন একজন দরিদ্র কিন্তু বিনয়ী ক্যাম্পেসিনা, যার পক্ষে মানব জাতির ইতিহাস এবং তার অবস্থার জন্য দায়ী জটিল কারণগুলো জানা কোন সময়ই সম্ভব ছিল না।
১৯৬৩ সালের ৬ আগস্ট মা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, বিপ্লবের ঠিক সাড়ে তিন বছর পরে।
আপনার বাবা কতদিন বেঁচে ছিলেন?
আরও আগে। তিনি মায়ের চেয়ে বেশ বয়স্ক ছিলেন। ১৯৫৬ সালের ২১ অক্টোবর তিনি চলে যান। আমার তিরিশতম জন্মদিনের দুই মাস পরে এবং গ্রান মা করে মেক্সিকো থেকে আমাদের যাত্রা শুরুর ঠিক দুই মাস আগে।
আপনার বাবা কি গালিসিয়ান ভাষা জানতেন?
অবশ্যই, কিন্তু সেটা কখনোই ব্যবহার করতেন না।
আপনি কখনো তাকে সেটি বলতে শুনেছেন?
মাঝে মাঝে শুনেছি। সেখানে আরো কয়েকজন গালিসিয়ান থাকতেন, তাদের সাথেই বাবা সেই ভাষাতে কথা বলতেন হয়ত। কিন্তু সেখানে স্পেনের অন্য এলাকার যেমন আন্দালুসিয়ার মানুষেরা ছিল যারা ভাষাটি বুঝত না একেবারেই। পরবর্তীতে নানা কারণে, মূলত কাজের প্রয়োজনেই সবাই স্প্যানিশ শিখে ফেলে, বিশেষ করে কিউবানরাও গালিসিয়ান জানত না, কাজেই সর্বক্ষেত্রে এমনকি বাড়ীতে স্ত্রী বা প্রেমিকার সাথেও তাদের স্প্যানিশেই কথা বলতে হত। সেই জন্যই আমি তাকে প্রায় কখনোই গালিসিয়ান বলতে শুনি নি।
স্পেনের গৃহযুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন সম্ভবত আপনার বয়স কেবল দশ?
তখনো ঠিক দশ হয় নি, আমার জন্ম হয়েছিল ১৯২৬ সালের ১৩ আগস্ট আর গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯৩৬ সালের ১৮ জুলাই, কাজেই আমার বয়স ছিল নয় বছর এগার মাস, তার মধ্যেই আমি লিখতে এবং পড়তে পারতাম।
আপনার মনে পড়ে কি স্পেনের গৃহযুদ্ধের ফলে আপনার বাবা কোন কারণে উদ্বিগ্ন ছিলেন কি না?
বিরানে বারো থেকে চোদ্দ জন স্প্যানিয়ার্ড ছিলেন। তার মধ্যেও যুদ্ধের কারণে বিভেদ ঘটে দুটি দল হয়ে গিয়েছিল।
মানে সেই স্প্যানিয়ার্ডরা যারা আপনাদের বাড়ীতে আসত?
যারা বিভিন্ন সময়ে তার সহকর্মী বা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন তারাই। তাদের একজন উচ্চ শিক্ষিত হিসাবরক্ষক ছিলেন। উনি বলতেন সাত সাতটি ভাষা তার জানা ছিল এবং সম্ভবত কথাটি সত্য! বাড়ীর রেডিওতে ইংরেজি বা জার্মানে কিছু সম্প্রচারিত হলে তিনি অনুবাদ করে দিতেন। খুব ভাল ল্যাতিন লিখতে পারতেন। ছোটখাট গড়নের মানুষটির মত জ্ঞানী আমাদের অত্র এলাকাতে ছিল না। গ্রীস সম্পর্কে সম্যক ধারণা ছিল তার, উনার কাছেই প্রথমবারের মত ডেমোস্থেনিসের কথা শুনি। এমন অনেক কিছু নিয়ে তার কাছে জানতাম মুগ্ধ বিস্ময়ে।
এরাই সবাই আসত, এর বাহিরে বিদ্রোহীরা আসত, মানে যারা প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছিল তাদের বিদ্রোহী বলে সম্বোধন করা হত।
মানে ফ্রাঙ্কোর সমর্থকরা?
ঠিক ধরেছেন । আর ছিল প্রজাতন্ত্রের সমর্থনের অন্যদলটি। তারা ছিল খামারের শ্রমিক, সম্পূর্ণভাবে নিরক্ষর। ভালেরো নামের এক কিউবান যে কিনা ডাকঘর এবং টেলিগ্রাফ অফিসের দায়িত্বে ছিল, সে ছিল তাদের দলে। আর একজন বাবুর্চিও ছিলেন, তার নাম ছিল গার্সিয়া, পেশাগত ভাবে রান্না শেখা হয় নি তার, কোন অজ্ঞাত অসুখে অন্য কায়িক শ্রমের কাজ করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না, তাই সবাই মিলে তাকে রান্নার কাজে নিয়োগ দিয়েছিল। তার সাথে চমৎকার এক সম্পর্ক দাড়িয়ে গিয়েছিল আমার, যদিও একজন পাচক হিসেবে খুব একটা সফলতা অর্জন সম্ভব হয় মানুষটার পক্ষে, অন্তত আমাদের বাড়ীতে প্রায়ই তারা রান্না নিয়ে অভিযোগ আসত। কিন্তু আমি তাকে খুবই পছন্দ করতাম। গার্সিয়া ছিলেন নিরক্ষর।
নিরক্ষর?
আমার শৈশবে বিরানের সমস্ত বাসিন্দাদের মাঝে শতকরা ২০ ভাগ মানুষও লেখাপড়া জানতেন না। সেই সময়ের অভিজ্ঞতাই আমাকে আজ বুঝতে শিখিয়েছে অশিক্ষিত একজন মানুষ জীবনে কত বঞ্চনার শিকার হয়।
নিরক্ষর একজন মানুষ কে? সেই মানুষটি যার অবস্থান আমাদের সমাজের সবচেয়ে নিচু স্তরে, যার প্রেমিকার কাছে চিঠি লেখার জন্য একজন বন্ধুর সাহায্য নিতে হয়। বিরানের যারা লেখাপড়া জানত না, অন্যদের সাহায্য নিয়ে প্রেমপত্র পাঠাত। তারা সেই পত্রলেখকের সামনে যেয়ে এইতাও বলত না, লেখ- আমি কাল রাতে তাকে স্বপ্নে দেখেছি, তার জন্য ক্ষুধা-তৃষ্ণা উবে গেছে, মানে যে কথাগুলো তারা বলতে চায়ত, বরং তার বদলে পত্রলেখককে বলত, তোমার যেমন মনে হয় তেমন কিছু লিখে দাও, যাতে সে আমার প্রেমে পড়ে!
আমি বাড়িয়ে বলছি না! সেই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ এমনই ছিল।
আপনার কি সেই সময়ে স্পেনের গৃহযুদ্ধ নিয়ে কোন তর্ক-বিতর্ক মনে পড়ে?
১৯৩৬ সালে যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন আমি আবাসিক ছাত্র হিসেবে সান্তিয়াগো দ্য ক্যুবার এক স্কুলে ছিলাম, বয়স হয়ত তখনো দশ ছোঁয় নি, গরমের ছুটিতে বাড়ী আসতাম-
এমনই একসময়ে যখন ছুটিতে বিরানে ছিলাম, লেখতে পড়তে শিখে গেছি ততদিনে, গার্সিয়া নামের সেই পাচক বন্ধু আমাকে খবরের কাগজ পড়ে শোনাতে বলে, যে কিনা ছিলা প্রজাতান্ত্রিকদের পাড় সমর্থক। আমি বোঝার চেষ্টা করতাম কেন সে একপক্ষকে এমন পাগলের মত ভালবাসে। আসলে তাকে খবরের কাগজ পড়ে শোনাতে শোনাতেই দশ বছরে পা দেবার আগেই স্পেনের যুদ্ধ সম্পর্কে আমার কিছুটা জানা হয়ে যায়। প্রতিদিনই বেশ কটা খবরের কাগজ পর হত তার জন্য, তাদের নাম ছিল ইনফরমাশিওঁন, এল মুন্ডো, এল পাইস্ এল দিয়ারিও দ্য ক্যুবা, যদিও প্রধান খবরের কাগজ ছিল দিয়ারিও দে ল্য মারিনা।
হাভানা থেকে আসত দিয়ারিও দে ল্য মারিনা ?
সেটি আসলে গোটা দেশে চলত, স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং বিপ্লবের কারণে এটি ছিল স্প্যানিশ বিরোধী, রবিবারে এর বিশেষ সংখ্যা আসত, যা ছিল বেশ জনপ্রিয়, মোটাসোটা, বিজ্ঞাপনে ভরা। ম্যানুয়েল গার্সিয়ার কাঠের বাড়ীতে সেটি পৌঁছানোর পরপরই আমি আগা থেকে গোঁড়া পড়ে শোনাতাম। বিদ্রোহীদের সেখানে যদিও কেবল ছাপার অক্ষরে বিদ্রোহীই বলা হত, কিন্তু সেটি ছিল প্রশংসারই নামান্তর।
ফ্রাঙ্কোর পক্ষে যারা ছিল তাদের কি বলা হত?
জাতীয়তাবাদী। আর অন্যদের বলা হত রেড, লিটল রেড ইত্যাদি। তাদের প্রজাতন্ত্রী নামেও লেখা হত। এটিই ছিল বিরানে আসা সবচেয়ে ওজনদার খবরের কাগজ, যা আমাকে প্রায়ই গার্সিয়াকে পড়ে শোনাতে হত, যদিও অন্যান্য কাগজও আসত কিন্তু এটিতেই স্পেনের খবর সবচেয়ে বেশী থাকত।
যুদ্ধের শুরু থেকেই সেই কারণে আমার মনে আছে, যেমন প্রজাতন্ত্রীদের হাতে তেরুয়েলের পতন!
আর ইবরো রণাঙ্গনের কথা?
সেটা ছিল প্রায় শেষের দিকে।
মাদ্রিদের যুদ্ধ?
মাদ্রিদের দখল নিয়ে মনে পড়ে। প্রজাতন্ত্রীরা গুয়াদালাখারাতে মুসোলিনির সৈন্যদের বেশ একহাত নিয়েছিল। পরে তারা তেরুয়েল দখল করে নেয়। আরও নানা সব রণাঙ্গনের খবর। সেই দুর্গটার নামে যেন কি ছিল যেখানে ফ্রাঙ্কোর সেনারা আটক ছিল?
টলেডোর আলকাজার দুর্গ।
আলকাজার যুদ্ধের সব ঘটনা গার্সিয়াকে পড়ে শোনাতাম, এবং আসলে আমি তার পক্ষে চলে গেছিলাম, তাকে উৎফুল্ল রাখার জন্য নানা জায়গার টুকরো টুকরো খবর জোড়া লাগিয়ে পরিবেশন করতাম যা ছিল প্রজাতন্ত্রীদের জন্য ভালো খবর! এইভাবেই বিরান চলছিল স্পেনের যুদ্ধ নিয়ে।
আপনার বাবা কি সেই যুদ্ধ নিয়ে কোন আগ্রহ দেখাতেন না নির্লিপ্ত ছিলেন?
বাবা প্রজাতন্ত্রের বিপক্ষে ছিলেন।
বিপক্ষে?
হ্যাঁ, এমন অনেকেই ছিল সেখানে। আসলে বিরানের স্প্যানিয়ার্ডের মাঝে অধিকাংশই প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু সেখানে অন্য দলটাও ছিল যারা শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত প্রজাতন্ত্রী ছিলেন। মাঝে মাঝেই এই দুই দলের মাঝে ডমিনো খেলা চলত, এক আদর্শের বিরুদ্ধে আরেক আদর্শ।
ডমিনোর যুদ্ধ?
এভাবেই দুই পক্ষের মানুষগুলো একসাথে কিছু সময় কাটাত। অনেকটা গুয়ারেসচির বিখ্যাত উপন্যাস ডন ক্যামিলোর মত, যেখানে দুই পক্ষ ছিল পাদ্রী আর কম্যুনিস্টরা।
তবে আমি জানতে পারি নি স্কুলে থাকার সময় গার্সিয়াকে কে খবর পড়ে শোনাত। তার তো কোন রেডিও ছিল না।
তাহলে আপনার স্পেনের গৃহযুদ্ধ নিয়ে সম্যক ধারণার জন্য ম্যানুয়েল গার্সিয়াকেই আমাদের ধন্যবাদ জানানো উচিত-
হ্যাঁ। এভাবেই সেই গৃহযুদ্ধের স্মৃতি আমার মাঝে এত তাজা, এর পরে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও যখন প্রজাতন্ত্র এবং পশ্চিমাদের গণতন্ত্রের ( এই গণতন্ত্রের পাশে অবশ্য আমি একটি বিশেষ জিজ্ঞাসাবোধক চিহ্ন রাখব) তত্ত্ব নাৎসিদের হত্যা-দমন- দখলের মুখোমুখি হল।
স্পেনে আসলে কি ঘটেছিল এবং কেন স্প্যানিশ প্রজাতন্ত্রের পতন ঘটেছিল, পশ্চিমারা আসলে কি কারণে এখানে কোন রকম উদ্যোগই নিল না? এবং হিটলার- মুসোলিনির যৌথ মহড়া চলল যুদ্ধের প্রায় শুরু থেকেই, এই জিনিসগুলির অর্থ কি? এই জিনিসগুলিও বিশ্বযুদ্ধ ঘটাতে ভূমিকা রেখেছে।
প্রথম দিকে যুদ্ধ ঘটেছে স্পেনে, সেখানে ছিল ডান ( হিটলার এবং মুসোলিনির মদদপুষ্ট জাতীয়তাবাদীরা) এবং বামেরা, যার ছিল কিছুটা গণতন্ত্রঘেষা। স্পেন তখনো সত্যিকার অর্থে শিল্পসম্পদে সমৃদ্ধ হয় নি, উপনিবেশের টাকা দিয়েই তারা চলেছে যুগের পর যুগ। সেই সময়ে বামদের ঐ ধারণাই ছিল তাদের সেই সমাজের পক্ষে বিশাল অগ্রসর কিছু, যা হয়েছিল বেশ জনপ্রিয়। স্প্যানিশরা খুবই সংগ্রামশীল এক জাতি।
যুদ্ধে দুই পক্ষেরই ব্যপক রক্তপাত ঘটতে লাগল, এমনকি তারা পাদ্রীদেরও খুন করেছিল। সেই সময়ে আমার স্কুলের স্প্যানিশ শিক্ষকেরা যুদ্ধ নিয়ে বয়ান দিত, তারা ছিল জাতীয়তাবাদী, বা আরো শুদ্ধ করে বলে ফ্রাঙ্কোর সমর্থক। তারা আমাদের কানে ঘণ্টা বাজানোর মত বলে যেত যুদ্ধে প্রজাতন্ত্রীদের তাণ্ডব, নৃশংসতা। কিন্তু তারা ফ্রাঙ্কোর সৈন্যদের গণহত্যা সম্পর্কে কিছু বলত না। আর স্পেনের গৃহযুদ্ধ ছিল ইতিহাসের এক রক্তাক্ত অধ্যায়, দুই পক্ষই শত্রুর শেষ দেখে নেওয়ার শপথ নিয়েছিল।
যুদ্ধ শেষের পর আমার এক শিক্ষক কত মানুষ যে ফ্রাঙ্কোর সেনাদের হাতে খুন হয়েছে তার বিশাল ফিরিস্তি দিতেন। যুদ্ধের সময় তিনি হাসপাতালের সাথে যুক্ত ছিলেন। তার কাজ ছিল ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মারা হাজার হাজার মানুষের ( কত হাজার কারো জানা নেই) দেহ পুঁতে ফেলার পূর্বে তারা জীবিত না মৃত তা পরখ করে দেখা। এই কাজ তাকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে ফেলেছিল।
এখন পর্যন্ত আমি কেবল স্মৃতি ঘেঁটে কথা বলছি, পরে অবশ্য এই বিষয়টি নিয়ে অনেক পড়েছি কিন্তু এখানে বলছি সেই কৈশোরে আমি কি জানতাম ।
১৯৩৮ সালে এব্রোর যুদ্ধের পরপরই সব শেষ হয়ে যায়, সেই ঘটনা নিয়ে অনেক চলচ্চিত্র হয়েছে, লেখা হয়েছে অসংখ্য বই। কিন্তু খবরের কাগজ ১০ বছরের এক বালককে তখন দেখিয়েছিল কি করে যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল।
আপনার কি মনে হয়, সেই ছোট্টকালে স্পেনের গৃহযুদ্ধ নিয়ে জানার আগ্রহ পরবর্তী জীবনে প্রভাব ফেলেছে?
অবশ্যই! আন্তর্জাতিক বিষয়ের একটা আলাদা গুরুত্ব থেকেই যায়। আর সব বালকই যুদ্ধ পছন্দ করে। আমিও সবার মতই সিনেমা বিশেষ করে ওয়েস্টার্ন এবং অন্যান্যগুলোতে মজে ছিলাম।
সেই সময়ে তারা তো ব্যপক বর্ণবাদী ছিল, বিশেষত রেড ইন্ডিয়ানদের ক্ষেত্রে?
আমরা তখন কাউবয়দের সমস্ত কিছুই মুগ্ধ হয়ে গিলতাম। যদিও খানিকতে বড় হবার পর সেই এক জিনিসকেই হাসির খোরাক হিসেবে দেখেছি- তাদের একজনের আরেকজনকে কাঁধের উপর দিয়ে ছুড়ে ফেলা, লাল হুইস্কির বোতল! সবকিছু আমার খুব মনে পড়ে, রিভলভারের গুলী কখনোই শেষ হত না, যদি না গল্পের প্রয়োজনে তা শেষ হবার দরকার হয়। সেই আমলে মেশিনগান না থাকলেও গোলাগুলির অভাব হত না আর ঘোড়ায় চড়ে পালানর সময় কারো বুলেট শেষ হয়ে গেলে সে একটা গাছে ডাল ঠিকই পাকড়িয়ে ফেলত।
সব বালকেরাই এই সিনেমাগুলো দেখত। ছেলেরা জন্মের পরপরই হিংস্রতা দেখার জন্য হয়ত প্রস্তত থাকে। যাই হোক, যুদ্ধ সম্পর্কে এত এত খবর পড়ার পর সেই জানা জগত যেন পাল্টে গেল।
এর পরপরই শুরু হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
আমার মনে আছে ঠিক কোন দিন যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর। তখন হয়ত আমি তের ছুয়ে ফেলেছি, এই নিয়ে অনেক পড়তাম। রুওরের দখল, অস্ট্রিয়ার সীমানা বাড়ানো, সুডেটেনল্যান্ডে জবরদখল, মলোটভ-রিবেনট্রপ চুক্তি, পোল্যান্ড আক্রমণ ইত্যাদি নিয়ে পড়লেও সবটা বুঝতাম না। যদিও সময়ের সাথে সাথে জেনেছিলাম প্রায় সবকিছুই।
মূল যুদ্ধসহ ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত কি কি ঘটেছিল তার প্রায় সবই মনে আছে, বিশেষ করে যখন জাপানে আণবিক বোমা ফেলা হল। এই বিষয় নিয়ে অনেক অনেক কথা বলতে পারি কারণ আমার আগ্রহ রয়েই গেছে সেই অধ্যায় নিয়ে। কিন্তু তারও আগে যখন কেবল স্কুলে যাওয়া শুরু করেছি তখন শুরু হয়েছিল ইথিওপিয়ার যুদ্ধ।
ইথিওপিয়ার যুদ্ধের কথাও আপনার খেয়াল আছে?
আছে, সেই সময়ে ছোট ছোট বিস্কিট কিনলে পাওয়া যেত যুদ্ধের বিশেষ কার্ড, সেগুলোর নাম ছিল আবিসিনিয়ায় ইতালিয়ানরা!
তাহলে সেটিকে বলা হত আবিসিনিয়ার যুদ্ধ?
সেই সময়ে তাই বলা হত। বিস্কিটগুলো কিনলে নানা ধরনের কার্ডের একটা সংগ্রহ গড়ে উঠত, যদিও কয়েক ধরনের কার্ডের দেখা প্রায় পাওয়ায় যেত না। আমার মনে হয়, কিছু কখনোই প্রিন্ট করা হয় নি, যাতে সেগুলো পাওয়ার লোভে বিস্কিট কিনতে কিনতে শিশুরা তাদের বাবা-মাকে ফকির বানিয়ে ফেলতে পারে!
সেই সমস্ত কার্ড সংগ্রহ করে তাদের নিয়ে খেলতে খেলতে বলা যায় আবিসিনিয়ার যুদ্ধ নিয়ে আমি ছোটখাট বিশেষজ্ঞ বনে গেছিলাম।
সান্তিয়াগো দ্য ক্যুবাতে থাকার সময়ে আমাদের সেই কার্ডের খেলা জমে উঠেছিল, জমা করা কার্ডের স্তুপ থেকে একটা আরেকটার উপর উড়িয়ে নিয়ে ফেলতে পারলে সেই কার্ডটির মালিক বনা যেত। কার্ডের চিহ্ন, বাতাসের গতি পরীক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে নিজস্ব কিছু কৌশল বাহির ক্রেছিলেম ফলে লাগাতার জিতেই যেতাম। কত কার্ড যে জিতেছিলাম তার লেখাজোখা ছিল না।
এখনো খুব স্পষ্ট মনে করতে পারি সেই কার্ডের রঙ এবং তাদের গায়ে ছাপানো চরিত্রগুলোর চেহারা, সব বালকেরাই সেই সেট সম্পূর্ণ করার জন্য চেষ্টা করেই যেত কিন্তু তা কোনদিন সম্ভব হয় নি।
সবসময়ই কিছু কার্ড বাকী থেকে যেত?
কিছু কিছু কার্ড কোনদিনই হয়ত ছাপা হত না, যাতে মানুষ সবসময়ই বেশী করে বিস্কুট কিনে যায় সেই বিশেষ কার্ড পাবার জন্য! ক্যাপিটালিজম! আমার নিজেরও কোন সম্পূর্ণ সেট ছিল না।
একদিন এক বালক এসে তার নেপোলিয়ান বোনাপার্টের চমৎকার একটা অ্যালবাম দেখায়, সেই বিস্কুটের কার্ডের মত পাতলা কার্ডবোর্ডে ছাপা নয়, অনেক দামী বিশেষ ধরনের কাগজে, ফলে সেগুলকে দেখতে অনেকটা আলোকচিত্রের মতই লাগে এবং তার সংগ্রহে ছিল সম্পূর্ণ সেট! সে আমার সাথে সেই অ্যালবামটি বিনিময় করতে চাইল, বদলে নিবে আমার সংগ্রহে সেই কয়েকশত কার্ড। সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলাম, নেপোলিয়নের সেও অ্যালবাম ছিল অনেকটা গুপ্তসম্পদের মতই! সেটি আমার সংগ্রহে এখনো আছে, এইতো কদিন আগেই ইয়সেবিও লিয়েল (ঐতিহাসিক) সেগুলো দেখে গেলেন।
তাহলে যুদ্ধ নিয়ে আপনি আসলেই উৎসাহী ছিলেন?
বাইবেলে কিন্তু বেশ কবার এমন নাটকীয় যুদ্ধ, নাটকীয় ঘটনার বর্ণনা রয়েছে। স্কুল জীবনের শুরু থেকেই সেই তথাকথিত পবিত্র ইতিহাসের কাহিনী ক্লাসে পড়ানো হত- ব্যবিলনের শাস্তি, ইহুদীদের দাসত্ববরণ, লোহিত সাগর অতিক্রম, জশুয়ার জেরিকোর দেয়াল ভাঙ্গা, স্যামসনের আসুরিক শক্তি, টেন কমান্ডমেন্ট, সোনার বৃষমূর্তিকে দেবতা রূপে পূজা করা--- আমার মোনকাদা ব্যারাকে আক্রমণের জন্য বিচারে বলেছিলাম History will Absolve me , সেটি ছিল আসলে এক সোশ্যালিস্ট দর্শনের রূপক, ের মাধ্যমে আমি বলতে চেয়েছিলাম আমরা সোনার বৃষমূর্তিতে বিশ্বাস করি না। তবে সেই বিচার ছিল ১৯৫৩ সালের ঘটনা, আর আমরা এখন কথা বলছি ১৯৩৬ নিয়ে যখন আমার বয়স হয়ত ১০!
কিন্তু আবিসিনিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়েছিল স্পেনের যুদ্ধেরও আগে, তার মানে আপনার বয়স আরও কম ছিল?
ঠিকই, আবিসিনিয়ার যুদ্ধ খানিকটা আগেই শুরু হয়েছিল, তখন আমি সেকেন্ড গ্রেডে পড়তাম, বয়স ছিল মনে হয় ৯। আমি তো খানিক আগেই বললাম যুদ্ধ নিয়ে আগ্রহের কারণেই নেপোলিয়নের সেই অসাধারণ অ্যালবাম আমার সংগ্রহে এসে ছিল। সেগুলোর ছবি আমি বারংবার দেখতাম , বিশেষ করে আর্কোল যুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহুতে যখন নেপোলিয়ন স্বয়ং পতাকা নিয়ে সেতু অতিক্রম করে সৈনিকদের উদ্দেশ্য আহ্বান করলেন- তোমাদের জেনারেলকে অনুসরণ কর! তা বিশ্বের যে কোন বালককে অভিভূত করবে। সেখানে অন্যান্য যুদ্ধসহ নেপেলিয়নের জীবনের মূল ঘটনাগুলো প্রায় সবই ছিল, ছবির মাধ্যমে। সেটি ছিল এক অনন্য বিনোদন আর কয়েকজন নেতার আমি অন্ধভক্ত ছিলাম বিশেষ করে হানিবাল এবং আলেক্সান্ডারের ও সেইসব ব্যক্তিত্বের যাদের কথা স্কুলের ইতিহাসের বইতে লেখা থাকত।
বারাবার মনে করতাম হানিবাল রোম জিতে নিলে বেশ হত, কিন্তু কেন এই সমর্থন তা বোঝা হয়ে ওঠে নি, হয়ত তার হাতির পিঠে চেপে আল্পস পর্বত অতিক্রমের কাহিনী ভাল লাগত, হয়ত উনি আন্ডারডগ ছিলেন তাই! স্পার্টানদের মাত্র ৩০০জন নিয়ে যুদ্ধের কাহিনীও খুব পছন্দ করতাম। বলতেই হবে, আমি এখন মনে করি সেই নেপোলিয়নের অ্যালবাম যে কোন ওয়াইল্ড ওয়েস্ট চলচ্চিত্রের চেয়ে অনেক অনেক গুণ ভাল ছিল।
আপনি যোদ্ধা ও সেনাপতিদের পছন্দ করতেন?
সব ছেলেরাই করে! এটি শুরু হয় ধর্মের ইতিহাস দিয়ে। ওল্ড টেস্টামেন্টে এমন জিনিসে ভরা- নূহের নৌকা, বন্যা, ৪০ দিনের একটানা বৃষ্টি, এবং জেনেসিসে বলা হয়েছে বন্যার পরে নূহ আঙ্গুরের বাগান তৈরি করে, আঙ্গুর থেকে ওয়াইন তৈরি করে একদিন মাত্রাতিরিক্ত পান করে মাতলামি করায় তার এক বংশধর তাকে উপহাস করেছিল। এত নূহ ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ দেয়, ফলে সে দাসে পরিণত হয় এবং গায়ের চামড়া হয়ে যায় ঘোর কৃষ্ণবর্ণের।
বাইবেলের এইখানে আমার মনে হয় চার্চের সংশোধন আনতে হবে, কারণ এই ঘটনায় মনে হচ্ছে কালো হওয়া ঈশ্বরের পক্ষ থেকে এক ধরনের অভিশাপ! যেমন নারী হওয়াও অভিশাপ এবং শাস্তি।
আপনি ক্যাথলিক চার্চকে এই ব্যাপারে বাইবেল সংশোধন করতে বলছেন?
আমি বলছিনা চার্চকে এই বিশ্বাসের ব্যাপারে বইয়ের কথা পরিবর্তন করতে হবে কিন্তু পোপ ২য় জন পল অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে বলে গিয়েছিলেন বিবর্তনের তত্ত্ব কিন্তু সৃষ্টিতত্ত্বের শত্রু নয়।
আমি অনেক সময়ে বিশপ এবং কার্ডিন্যালদের সাথে কথা বলেছি এই ব্যাপারে। এইখানে মূল বিষয় দুই টা, আমি বিশ্বাস করি যে সংগঠন ২০০০ বছর ধরে তাদের কর্ম এবং প্রচার চালিয়ে আসছে তারা অবশ্যই নারীদের সমতা দিবে, নারীদের সমস্ত পাপকাজের হোতা হিসেবে অপরাধী বলে মনে করবে না। এবং কালো হওয়া যে অভিশপ্ত এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসবে।
আপনিও নিজেও প্রথম বিদ্রোহ বাবার সাথেই করেছিলেন তাই না?
আমি আসলে বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করি নি, তার মত একজন সহৃদয় মানুষের সাথে এটি করা সম্ভবও ছিল না। আমি কতৃপক্ষ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়েছিলাম।
আপনার কতৃত্বপরায়ণতা ভাল লাগে না?
এটির পিছনে অবশ্যই ইতিহাস আছে। এমনি এমনিই দশ-বারো বছর বয়সে এটি হঠাৎ করে আসে নি, কারণ এর অনেক বছর আগেই হয়ত ছয় অথবা সাত বছরেই সেই প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল।
আপনার শৈশবের আর কোন স্মৃতি বেশী দোলা দেয়?
অনেক কিছুই মনে পড়ে, তাদের মাঝে কিছু কিছু ঘটনা অবশ্যই আমার মানসিক গড়নের পিছনে বড় ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু আমার শৈশবে মৃত্যু কোন কালো আঁচড় রেখে যায় নি, যদিও আমার এক খালা, আন্তোনিয়া, সন্তান প্রসবের সময় মারা যান, তখন আমার বয়স তিনও হয় নি কিন্তু পরিবারের সবার মাঝে সেই গাঢ় বিষাদ মনে পড়ে। তিনি মায়ের বোন ছিলেন এবং তার স্বামী, সোতো, বাবার সাথে বিরানে কাজ করতেন। বাড়ীতে ঢোকার আগ পর্যন্ত সেই ছোট নোংরা রাস্তা ধরে মহিলাদের কান্নাকে সঙ্গী করে হাঁটার কথা মনে পড়ে, কিন্তু এর মূল কারণ ধরতে না পারায় সেই ঘটনা আমার ওপর এমন কোন প্রভাব ফেলে নি, মৃত্যু সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিল না।
প্রথমবারের মত বাস্পশকট দেখার কথাও খুব মনে পড়ে। এর বিশাল চাকা, প্রচণ্ড গর্জন, প্রবল শক্তি, তীক্ষ হুইসেল- সব মিলিয়ে ছিল দর্শনীয় এক জিনিস। তারা আঁখ তোলার জন্য আসত, আর আমি ভেবেছিলাম বিশালাকার দৈত্যসব!
৭ বা ৮ বছর বয়সে প্রাইমারী স্কুলে পড়ার সময় অনেককে বারবেরান এবং কোল্লারের ফ্লাইট নিয়ে কথা বলতে শুনি। তারা ছিলেন দুজন স্প্যানিশ বৈমানিক যারা আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে মেক্সিকোর দিকে যাচ্ছিল। স্থানীয়রা বলত, তারা নিশ্চয়ই বিরানের উপর দিয়ে উড়ে গেছে। যদিও বিমানযাত্রা শেষে তাদের কোন খবর পাওয়া যায় নি, আজো মানুষেরা তর্ক করে তাদের সাগরে পতিত হবার সম্ভাব্য স্থান নিয়ে। কিন্তু এই অসমসাহসী দুইজন মানুষ, যারা একরত্তি বিমানে চড়ে মহাসাগর অতিক্রমের সাহস দেখিয়েছিল, তাদের আর কোন চিহ্নই মিলে নি। সেই ছোট্ট আকাশযানে তারা কয় ট্যাঙ্ক জ্বালানী নিয়েছিল তা আমার কল্পনায় ধরে না, কারণ সেই যুগে জ্বালানী নেবার একটা উপায়ই ছিল। তার স্পেন থেকে রওনা দিয়ে আটলান্টিককে পরাভূত করে কিউবায় অবতরণ করে। এবং কিউবা থেকে মেক্সিকোর উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করে এবং উধাও হয়ে যায়।
শিশুকাল থেকেই হারিকেন, সাইক্লোনের সাথে বড় হয়েছি, চার-পাঁচ বছর বয়সের এক প্রবল ভূমিকম্পের স্মৃতি মনে খুব দাগ কেটে গেছিল, আমাদের সারা বাড়ী পেকে যাচ্ছিল তাতে, ভিতরের সবগুলো প্রাণীসহ! প্রকৃতির এই জিনিসগুলো নিঃসন্দেহে আমার ভিতরে কোন না কোন চিহ্ন রেখে গেছে।
আর কি কি জিনিস আপনার ব্যক্তিত্ব গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে?
একটি বিশেষ সুবিধা এবং এক টুকরো ভাগ্য। আমি একজন জমিদার স্থানীয় লোকের পুত্র হিসেবে জন্ম নিয়েছিলাম, নাতি হিসেবে নয়! যদি একটি ধনী পরিবারের নাতি হিসেবে জন্মাতাম তাহলে সোনার চামচ মুখ থাকত প্রথম থেকেই, আনার বন্ধু, বেড়ে ওঠা সব কিছুর মাঝেই অন্যদের চেয়ে বড় এই জিনিসটা থাকত। কিন্ত আমি জন্ম নিয়েছিলাম সেই ক্ষণে এবং স্থানে যেখানে সবাই ছিল দরিদ্র, খামারের শ্রমিকরা । কিংবা আমার নিজের পরিবার, মায়ের দিক থেকে ছিল অতি দরিদ্র, বাবার চাচাতো ভাইয়েরা, যারা গালিসিয়া থেকে এসেছিল ছিলেন দরিদ্র, এবং বাবার দেশের পরিবারও ছিল দারিদ্র জর্জরিত।
কোন সন্দেহ নেই যে জন্মস্থানটিই আমার উপরে সবচেয়ে বেশী ভূমিকা রেখেছে, যেখানে আমি বড় হয়েছিলাম সমাজের সবচেয়ে নিচু স্তরের চমৎকার মানুষগুলোর সাথে। সেই বেকার নিরক্ষর লোকটার কথা মনে পড়ে যে আঁখ ক্ষেতের ধারে কাজের সন্ধানে দীর্ঘ লাইনে দাড়িয়ে থাকত, খর তাপে তার জন্য এক গ্লাস জল বা মাথার উপরে একটু ছায়ার ব্যবস্থা কেউ করত না, মিলত না নাস্তা, দুপুরের খাবার বা কোন পরিবহন।
সেই নগ্ন পায়ের বাচ্চাদের কথা কিছুতেই ভুলতে পারি না যারা ছিল আমার খেলার সাথী। যাদের সাথে আমি বেড়ে উঠেছি তাদের সবাইই ছিল দারিদ্রের সন্তান। মাঝে মাঝে আমি পরিবারের উদ্বৃত্ত খাবার একটা বড় পাত্রে করে সবার জন্য নিয়ে যেতাম। নদীর তীরে ঘুরতাম আমরা, পায়ে থেতে বা ঘোড়ার পিঠে, সাথে কুকুর ছিল, সবখানেই ঘুরতাম, খামোখায় পাথর ছুড়তাম, পাখি শিকার করতাম ( খুবই জঘন্য একটা কাজ ছিল যা কিনা গুলতির মাধ্যমে করা হত)।
কিন্তু পরবর্তীকালে সান্তিয়াগোতে এবং হাভানাতে আমি বিশেষ ধরনের স্কুলে পড়ার সুবিধা পায় যা সাধারণত ধনীদের জন্যই বরাদ্দ ছিল।
তাহলে তাদের সাথে বাসও করতেন?
তারা সকলেই ছিল ধনী মানুষের সন্তান। তারা আমার স্কুল বন্ধু ছিল, আমরা একসাথে খেলতাম কিন্তু সত্যিকার ভাবে কোন অভিজাত এলাকায় তাদের সাথে বসবাসের অভিজ্ঞতা আমার ছিল না।
স্কুলে আমাদের কাজই হয় খেলা, না হয় পড়া, আর ঘোরাঘুরির বাহিরে কিছু ছিল না। আমি নানা ধরনের খেলায় উৎসাহী ছিলাম আর সেই সাথে পর্বতারোহণ করতাম, চমৎকার শখ এগুলো।
সমুদ্র সৈকতে কাছে এক জায়গায় সাঁতারের জন্য নানা পাম গাছ ও অন্যান্য জিনিস দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছিল হাঙরের ভয়ে! হাঙর খুবই বিপদজনক ছিল তবে অতটা নয়, মানুষ যতটা ভাবে। আর সেখানেই ছিল ঝাঁপ দেবার জন্য ডাইভিং বোর্ড, তিনটা! আমার হয়ত একজন ডাইভার হতে পারতাম, কারণ মনে পড়ে প্রথমবার সেখানে গিয়ে খানিকটা অন্যদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবার জন্যই তরতর করে সবচেয়ে উঁচু বোর্ডটিতে যেতে দিলাম এক ঝাঁপ! তাও ভাল, ঝাঁপ দেবার সময়ে পা নিচের দিকে রেখেছিলাম, মাথা নয়! বোর্ডটি আসলেই বেশী উঁচুতে ছিল আর আমি বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে ঝাঁপিয়ে পড়লাম!
সাঁতার জানা ছিল?
বিরানের যাদের সাথে সারাদিন টো টো করে বেড়াতাম তাদের সাথেই সেখানের পুকুরে আর নদীতে সাঁতার শেখা হয়ে গিয়েছিল, যদিও নিচের বয়স তখন কত তা আর মনে নেই।
আপনার সেই বন্ধুরা, দারিদ্রের সন্তানেরা?
হ্যাঁ, আমার বন্ধুরা, আমার খেলার সাথীরা। আসলে বুর্জোয়া সংস্কৃতি আমার ভিতরে আসে নি, কারণ বাবা ছিলেন অত্যন্ত বিচ্ছিন্ন একজন জমিদার। তারা প্রায় কোন সময়ই অন্যদের বাড়ীতে বেড়াতে যেত না, এবং আমাদের বাড়ীতেও অতিথি ছিল বেশ বিরল। ধনিক শ্রেণীর রীতিনীতি বা সংস্কৃতি তাদের মাঝে ছিল না। কাজের মাঝেই ডুবে থাকতেন সবসময়। আর আমাদের মেলামেশা ছিল সেই মানুষগুলোর সাথেই যারা বিরানের বাসিন্দা।
আপনার খেলার সাথীদের মাঝে কোন কৃষ্ণাঙ্গ বালক ছিল?
আমাদের পরিবারে কোন সময়ই বলা হয় নি- ঐ ছেলের সাথে খেলা যাবে না, বা ওর সাথে মিশবে না। কখনোই না।
আমি প্রায়ই সেই কুঁড়ে ঘর আর সবচেয়ে হতদরিদ্র ছাউনিগুলোর দিকে যেতাম যেখানে হাইতিয়ানরা বাস করত। তবে এইজন্য পরে আমাকে শাসনের মুখোমুখি হতে হয়, না সামাজিক কারণে নয়, স্বাস্থ্যগত কারণে, কারণ আমি তাদের ওখানে সেদ্ধ ভুট্টা খেতে যেতাম! বাবা-মা আমাকে বলেন এমন করতে থাকলে তারা আমাকে সংশোধনাগারে পাঠাবেন।
বিদ্রোহের জন্য?
বাবা-মা শুধু বলতেন- তুমি যদি হাইতিয়ানদের ঐখানে সেদ্ধ ভুট্টা খাও তাহলে সংশোধনাগারে পাঠানো হবে। এছাড়াও অন্যান্য কারনেও আমাকে একাধিকবার সেই হুমকি দেয়া হয়েছিল।
যখন আমি বিশ্ব সম্পর্কে জানতে-বুঝতে শুরু করি, তখন থেকেই জানি গ্রামের সেই শৈশবই ছিল আমার সেরা স্কুল। সেই অঞ্চল ছিল স্বাধীন।
তবে পরে, একজন ধনীর ছেলে হিসেবে শোষণেরও শিকার হয়েছিলাম।
কি রকম?
বিরানের সেই স্কুলে আমার শিক্ষা জীবন শুরু হয়, যেখানে আমার এক বড় বোন এবং বড় ভাই, অ্যাঞ্জেলিতা ও র্যামন, পড়ত। যদিও আমার তখনো উপযুক্ত বয়স হয় নি কিন্তু তারা আমাকে সাথে নিয়ে যেয়ে সবচেয়ে সামনের বেঞ্চে বসিয়ে দিত। সেখানে ২৫ জনের মত ছাত্র ছিল, প্রায় সবাইই অতি দরিদ্র ঘরের। আমার ঠিক জানা নেই কি করে লিখতে শিখলাম, তবে সম্ভবত অন্য বাচ্চাদের দেখে দেখে, যেহেতু আমাকে প্রথম সারিতে বসতে বাধ্য করা হত। মনে হয় সেটা ছিল ১৯৩০ সাল
আপনার বয়স তখন ৪ বছর?
চার বছর বয়স! আমি অন্যদের দেখে ততদিনে পড়তে এবং অল্প বানান করতে শিখেছি, শিক্ষক যখন বোর্ডের চক দিয়ে কিছু বোঝাতেন দেখা গেল আমি খেলাতে মগ্ন, জমিদারনন্দন যেমন হয় আর কি! শিক্ষক সবসময়ই আমাদের বাড়ীতে আসতেন কারণ তার খাবার ব্যবস্থা ছিল আমাদের সাথেই। আর স্কুলে ছিল সাজার ব্যবস্থা। মাঝে মাঝেই বেতের আঘাত, মেঝেত নীলডাউন হয়ে থাকা, এর সাথে সাথেই সেই খানেই পয়সা বা ভুট্টার দানা ছিটিয়ে দিত।
তার উপরে উবু হবার জন্য?
তাইই তো! স্কুলের সেই শারীরিক অত্যাচারের কথা খুব মনে আছে, যদিও তা প্রতিদিন হত না, এগুলো আসলে ছিল আমাদের ভয় দেখানোর একটি রাস্তা।
শারীরিক অত্যাচার?
সেই সময়ে আমি মারাত্নক প্রতিবাদী হয়ে উঠেছি, এটার পিছনে অবশ্য বিশদ কারণ আছে। আপনি চাইলে সেগুলো পরে বলে যাবে, তবে সেই জিনিসগুলোই আমাকে একজন বিপ্লবী হিসেবে গড়ে তুলেছে। খুব কম বয়সেই আমাকে নিজের সমস্যার সমাধান করতে হয়েছে, যার জন্য অন্যায় ও অবিচারের বোধ বুঝতে পেরেছি তখন থেকেই। কিন্তু এই ব্যাপারে আমার এখন কথা বলছি নি, আর এই নিয়ে আপনি আগ্রহীও হবেন না।
আমি খুবই আগ্রহী!
পরে হয়ত সেরকম কিছু ঘটনা বলতে পারব। কিন্তু যে ঘটনা নিয়ে আমরা কথা বলছি তা হচ্ছে কি কারণে আমি একজন বিপ্লবীতে পরিণত হলাম? একজন ধনী লোকের পুত্র হওয়া সত্ত্বেও কোন কোন জিনিস আমার জীবনে প্রভাব বিস্তার করল? এবং সেটি এই বিষয় বাদে যে বাচ্চারা কিন্তু আত্নকেন্দ্রিক, বাচ্চারা নিরর্থকও এবং তারা সামাজিক অবস্থান বুঝতে পারে?
বিরানের সেই ক্ষুদে স্কুলে আপনিই ছিলেন এক ধনী মানুষের সন্তান?
আমার ভাইবোন বাদ দিলে আমি একাই। সেখানে আর কেউই ছিলনা যার অপেক্ষাকৃত ধনী ছিল বা একটি দোকানের মালিক ছিল। অন্য স্কুল সাথীদের বাবা-মা ছিলেন শ্রমিক, হয়তবা কেউ কেউ খুবই অল্প পরিমাণ জমিও মালিক ছিলেন। কিন্তু সেই সন্তানেরা ছিল দারিদ্রসীমার সবচেয়ে নিচে বাস করা ভয়াবহ দরিদ্র ঘরের ছেলেমেয়ে।
আপনাকে সান্তিয়াগো পাঠানোর সিদ্ধান্ত কি বাবা-মা নিয়েছিল যাতে অন্য ধরনের সমাজের সাথে ওঠাবসা শুরু হয়?
না, এমন চিন্তা মনে হয় তাদের মনে ঠাই পায় নি। ছয় বছর বয়সে তারা মাকে সান্তিয়াগো পাঠিয়ে দেন কারণ স্কুল শিক্ষক তাদের বলেছিলেন আমি খুবই ভাল একজন ছাত্র। সেই সাথে বিরানের সেই শিক্ষিকা যার নাম ছিল ইউফ্রেসিয়া ফেলিউ, তার সান্তিয়াগোর বাড়ীতে আমার বোন অ্যাঞ্জেলিকা ( যে ছিল আমার ৩ বছর ৪ মাসের বড়) থাকবে। যদি আমার বয়স ছয় হয়ে থাকে তার বয়স হয়ত দশ ছুঁই ছুঁই। তার সাথে সাথে আমাকেও সেই শহরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হল। প্রথমে এই খবর শুনে কৌতূহলের আতিশয্যে মাথা ঘুরতে থাকল, মহাআনন্দের সাথে চলে গেলাম সান্তিয়াগো।
খামারবাড়ি থেকে সরাসরি সান্তিয়াগোর মত শহর দর্শনের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
বর্তমান সময়ের তুলনায় তখনো সান্তিয়াগো ছিল খুই ছোট্ট এক শহর, যদিও আমার মনের উপরে এর প্রভাব ছিল বিশাল। মনে হয়ে ছিল বিশাল এক মহানগরীতে আসলাম, অনেকটা একই অনুভূতির সাথ এপ্রিচিত হয়েছিলাম ষোল বছর বয়সে প্রথমবারের মত হাভানা যেয়ে। রাজধানী হাভানা চার-পাঁচ তলা ভবনগুলো নিজের কাছে দানবীয় মনে হত। সেই তুলনায় সান্তিয়াগোর প্রায় সবই বাসভবনই ছিল এক তলা। তাই হাভানা দর্শনও মনের উপরে গভীর মুগ্ধতার ছাপ ফেলেছিল। যদিও ছয় বছর বয়সে সান্তিয়াগোতে আমি প্রথম বারের মত খোলা বিস্তৃত দিগন্তছোঁয়া সমুদ্র দেখি। সারাজীবন পাহাড়ি এলাকার গ্রামে কাটিয়ে সেই অসীম সমুদ্রের রূপ আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল।
সান্তিয়াগোতে শিক্ষকের বাড়ি কেমন ছিল?
তিভলি এলাকায় অবস্থিত এক কাঠের বাড়ি। দরিদ্র এলাকায় সরু, স্যাঁতস্যাঁতে, আঁধারে ঢাকা খুবই ছোট এক বাসভবন যেখানে ছিল ক্ষুদে বসার ঘরে একটি পিয়ানো, দুটি শোবার ঘর, একটি স্নানের ঘর এবং সিয়েরা মায়েস্ত্রা পর্বতের অপূর্ব দৃশ্য দেখা যায় এমন এক বারান্দা। উপসাগরটি ছিল বাড়ীর বেশ কাছে।
কাঠের দেয়ালের এবং ভাঙ্গাচোরা টালির ছাদের বাড়িটার সামনে ছিল ধুলোময় এক প্লাজা, গাছের অস্তিত্ব চোখ পড়ত না। প্রতিবেশী বাড়ীগুলো সবই ছিল এক কামরার। পাশের ব্লকে একটি দোকানে নারকেলের মিষ্টি পাওয়া যেত, যা আসলে বাদামি চিনির তৈরি। সেইখানের বেশ বড় একটি বাড়ীর কথা মনে পড়ে যার মালিক ছিল ধনী ইদি, লোকে বলত ইদি দ্য মুর। সেই বাড়ীর পিছনেই স্কুল। সেখানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এখনো মনে দাগ কেটে আছে। এক সময় সৈন্যরা সারা স্কুল দখল করে রেখেছিল কারণ স্কুলের বস ছাত্ররা ছিল মাচেদোর ( কিউবার স্বৈরাচারী শাসক) বিরুদ্ধে। সেই দখল সময় সৈনিকদের রাইফেলের বাট দিয়ে এক পথচারীকে পিটাতে দেখি, মনে হয় সে সৈন্যদের উদ্দেশ্যে কিছু বলেছিল। সেখানে বাস করার সুবাদে ঘটনাগুলো চাক্ষুষ দেখা হয়েছিল।
তখনকার বাতাসে কেমন যেন একটা উৎকণ্ঠা ঘুরে বেড়াত, সৈন্যরা ইচ্ছামত পথচারীদের দার করিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করত। অ্যান্তোনিও নামের বিরানের একজন মেকানিককে গ্রেফতার করা হয়। শুনেছিলাম সে নিজেকে কম্যুনিস্ট বলে দাবী করার কারণে এই গ্রেফতার পর্বটি ঘটে। তার স্ত্রী কারাগারে স্বামীকে দেখতে যাবার সময় আমাকেও সাথে নিয়ে যেত। অ্যালামেদা এলাকার শেষ প্রান্তে ছিল সেই ধূসর, অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গা, অকল্পনীয় নোংরা ছিল তার ক্ষয়ে যাওয়া দেয়ালগুলো। সেখানকার জেলার, গরাদ, বন্দীদের চেহারা মনে হলে বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে।
সান্তিয়াগোর সেই ক্ষুদের বাড়ীতে বৃষ্টি হলেও ছাদ দিয়ে জল ঢুঁকে সবাইকে ভিজিয়ে ছাড়ত, এক হিসেবে বাহিরের চেয়ে ভিতরেই বৃষ্টির বেশী তান্ডব অনুভব হত। ছাদের ছিদ্রগুলোর নিচে তারা বালতি দিয়ে রাখত জল ধরার জন্য। ক্লেদময় জায়গাটিই ছিল আমাদের নতুন বাসস্থান। তারই এক ছোট কামরায় বেঁকে যাওয়া পুরনো খাটে থাকতেন শিক্ষিকার বাবা , নেস্টর। পাশের কক্ষে তার আরেক বোন, বেলেন, থাকতেন। বেলেন ছিলেন পিয়ানিস্ট এবং সহৃদয় একজন মানুষ, কোন তার কোন ছাত্র ছিল না।
সেখানে কি বিদ্যুৎ ছিল?
ছিল কিন্তু ব্যবহার করা হত খুব কম। তেলের বাতিরই প্রচলন ছিল মূলত, যেহেতু তাতে খরচ কম পড়ত।
কতজন বাসিন্দা ছিল বাড়িটিতে?
প্রথমে সেখানে ছিল তিন বোন, তাদের বাবা-মা ছিল হাইতির, অবশ্য তারা স্কুল ফ্রান্সে না হাইতিতে ছিল তা আমার জানা নেই। তাদের একজন হলেন স্কুলের শিক্ষিকা, একজন পিয়ানর শিক্ষক , শেষের জন্য ডাক্তার, আমরা সেখানে যাবার কিছুদিন পূর্বে তার মৃত্যু হয়। মা ছিল না, বাবার সাথে উনারা দুই বোনই থাকতেন। সেই সাথে আমি এবং অ্যাঞ্জেলিকা, সব মিলিয়ে পাঁচ জন। বিরানের শিক্ষিকাও ছুটিতে বাড়ি আসতেন। পরে তারা গৃহস্থালির কাজকর্ম করার জন্য এসমেরিদাকে নিয়ে আসে, যদিও তাকে এক পয়সাও বেতন দেওয়া হত না, এই নিয়ে ছিলাম ছয় জন। পরে র্যা মন বেড়াতে আসলে আমি তাকে থাকত রাজি করাই, তাহলে শিক্ষিকা বাড়ীতে আসলে আমরা মোটমাট সাত জন ছিলাম। এক পাত্র থেকেই আমরা সেই পাঁচ বা ছয় বা সাত জন মানুষ খেতাম।
কোন সময়ের কথা এইগুলো?
ম্যাচাদোর শাসনের সময়ের কথা, সারা দেশে তখন দুর্ভিক্ষের ছোঁয়া। আসলে অন্যসব কারণ বাদেও ম্যাচাদোর পতন মানুষে ক্ষুধার কারণেই হয়েছিল। আরকিন যুক্তরাষ্ট্র কিউবার জন্মলগ্ন থেকেই তেমন ব্যবস্থা চালু করেছিল যাতে দ্বীপদেশটি পণ্য উৎপাদনে স্বাবলম্বী না হয়ে তাদের কাছ থেকে আমদানির উপরে নির্ভর থাকে। তারা কিউবার কাছ থেকে চিনি কিনলেও তা ছিল বাজারদরের সর্ব নিম্ন দামে, আর ১৯২৯ সালে তারা সেই চিনি রপ্তানি উপরেও কোটা আরোপ করে, ফলে উপার্জন কমে যেয়ে অর্থনীতির অবস্থা আরও ভঙ্গুর হয়ে যায়, ক্ষুধার বীভৎস চেহারা দেখা যায় সারা দেশজুড়ে।
সেটি অর্থনৈতিক মন্দা এবং রাজনৈতিক শাসনের কাল ছিল। ম্যাচাদো তার জাতীয়তাবাদী কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে অনেক মানুষের সমর্থন নিয়েই যাত্রা শুরু করেছিল। সে মানুষের জন্য চাকরি ক্ষেত্রে এবং শিল্প কারখানা গড়ে তুলেছিল কিন্ত এত বেশী কতৃত্বপরায়ণ ছিল যে শীঘ্রই দমনের রাজনীতি দেখা দেয় সারা কিউবাতে। বিশেষ করে ছাত্ররা তার বিরুদ্ধে ছিল, হুলিও আন্তোনিও মেইয়া, যিনি মাত্র বিশ-একুশ বছর বয়সে কম্যুনিস্ট পার্টি স্থাপন করেন, ছাত্রদের, খেটে খাওয়ায় শ্রমিকের, সর্বোপরি জনসাধারণের জন্য অফুরান ত্যাগের এবং আদর্শের প্রতীক ছিলেন। তিনি মেক্সিকোতে খুন হয়ে যান ম্যাচাদোর হুকুমে।
মেইয়া ছিলেন একজন অসাধারণ দ্যুতিময় তরুণ, হোসে মার্তির পরে কিউবার ইতিহাসের অন্যতম প্রাণপুরুষ। সেই সময়েই তিনি শ্রমিকদের জন্য একটি বিশ্ব- বিদ্যালয়ের কথা বলেছিলেন। ছাত্ররা ইতিহাসের এবং প্রিয় মানুষদের উপরে তার দেওয়া ভাষণ শুনতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিড় করত। তার আগেই বিখ্যাত বলশেভিক বিপ্লব ঘটেছিল ১৯১৭ সালে, কোন সন্দেহ নেই সেই বিপ্লবের সাফল্য এবং আদর্শ ব্যপক আলোড়িত করেছিল তরুণ মেইয়াকে, আর মার্তি ছিলেন তার আদর্শ। তাই মার্তির মার্ক্সবাদী বন্ধু কার্লোস বালিনিওর সাথে তিনি কিউবার প্রথম কম্যুনিস্ট পার্টি স্থাপন করেন।
১৯৩৩ সালে ম্যাচাদোর পতন ঘটে, তাই না?
১৯৩৩ সালের আগস্তের তার পতন হয়, আর সেপ্টেম্বর থেকেই সার্জেন্ট আপরাইজিং শুরু হয়, আমি কেবল সাতে পা দিয়েছি। সার্জেন্টরা ম্যাচাদোর অফিসারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, সবাই আণ্ডারগ্রাউণ্ড থেকে বেড়ীয়ে আসে, তাদের মাঝে বামপন্থীরা যেমন ছিল, তেমচনি ছিল ডানেরাও, কেউ কেউ আবার মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী ধারণা নিয়েই পরিচালিত হত, আসলে সেখানে সব মতবাদের অল্পসল্প ভাগ ছিল।
বিশ্ব-বিদ্যালয়ের ছাত্ররা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের জন্য একটি সঙ্ঘ গড়ে তোলে, যার সদস্যদের মাঝে অনেক বিখ্যাত প্রফেসরও ছিলেন। তাদের মাঝ থেকেই র্যা্মন গ্রাউ স্যান মার্টিন নামের একজন দেহতত্ত্বের প্রফেসের কিউবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ম্যাচাদোর পতনের তিন সপ্তাহ পরে তার সরকারে অ্যান্তোনিও গুতিয়েরেজকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি ছিলে একজনের সত্যিকারের সাহসী তরুণ, যে বিশাল সাহসের পরিচয় দিয়ে সান লুইয়ের সেনা ব্যারাকের পতন ঘটিয়েছিল। ম্যাচেদোর বিরুদ্ধে স্বশস্ত্র সংগ্রামে তিনি সবসময়ই অনমনীয় ছিলেন।
অ্যান্তোনিও গুতিয়েরেজ?
উনিই প্রথমবারের মত কিউবাতে কিছু আইনের প্রচলন করেন যা মানুষের চিন্তার বাহিরে ছিল। শ্রমিকদের জন্য দিনে আট ঘণ্টার কাজের নিয়ম ছাড়াও নানা ধরনের ইউনিয়ন, সিণ্ডিকেট এমন কিছু প্রচলনের সাথে সাথে তিনি টেলিফোন কোম্পানিসহ অন্যান্য মার্কিন ব্যবসাকে একই আইনের আওতায় আনেন।
আসলে সেই আইনগুলো প্রণয়নের মাধ্যমে তারা কিউবান শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করছিলেন, যাতে স্প্যানিশ ব্যবসায়ীরা তাদের অন্যায্যভাবে ব্যবহার না করতে পারে, এবং তারা যেমন স্পেন থেকে তাদের আত্মীয়দের যথেচ্ছ নিয়োগ না দিয়ে স্থানীয়দের কর্মসংস্থান করে। যদিও এই আইন জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্যই করা হয়েছিল কিন্তু হাইতিয়ান অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য তা বেশ ক্ষতির কারণ হয়েই দাঁড়িয়েছিল।
রাষ্ট্রপতি প্রফেরস গ্রাউ স্যান মার্টিনের মেয়াদ শুরু আগে মূলত সরকার চলছিল পাঁচ নেতার একটি কমিটির সমন্বয়ে, সেই তিন মাসেই তারা এই সমস্ত আইন প্রণয়নে সক্ষম হয় এবং এর মাঝেই মার্কিনীরা তাদের রাষ্ট্রদূত সুমনের ওয়েলেসের মাধ্যমে বাতিস্তাকে তাদের সুবিধার জন্য ক্ষমতার টোপ দেয়। অথচ তখন ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট ল্যাতিন আমেরিকার জন্য তার বিখ্যাত সহৃদয় প্রতিবেশী নীতি প্রচার করছিলেন!
যদিও ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের পরপরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক বিশাল সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছিল, যা কিনা বিশ্ব জুড়ে চলা অর্থনৈতিক মন্দার শিকার হয়- সেই নীতি ছাড়া আমি মনে করি ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে চমৎকার রাষ্ট্রপতিদের একজন। স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে আমি থাকে খুবই পছন্দ করতাম, তার কাজ খেয়াল করতাম। অসুখে কারণে তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত ছিলেন কিন্তু তার মন মাতানো কণ্ঠে ভাষণগুলো ছিল খুবই আকর্ষণীয়।
রুজভেল্ট হয়ত কিউবার মানুষের আকাঙ্খার মূল্য দিতেন এবং তিনি নিশ্চিতভাবেই ল্যাতিন আমেরিকার সাথে ভাল সম্পর্ক স্থাপনের আগ্রহী ছিলেন। দূরদর্শী এই মানুষটি হিটলারের ক্ষমতায় আগমন দেখেই কিউবার সাথে ভূখণ্ড ব্যবহারের জন্য নতুন চুক্তি করেন, আগের দখলদারি ব্যবস্থা বাতিল করে আইল্যান্ড অফ ইয়ুথ কিউবার কাছে ফিরিয়ে দেন।
সেটি তো মার্কিন মিলিটারিরা ব্যবহার করত?
১৮৯৮ সাল থেকে সেটি তারা দখল করে ছিল ।
তাহলে কিউবার সরকার সেটিকে পরিচালনা করত না?
না। প্ল্যাট অ্যামেন্ডমেন্ট নামের এক দখলদারী নিয়ম করে তারা এটি সম্পূর্ণ দখলে রেখেছিল। সেটা আমরা ফেরত পেলাম কিন্তু গুয়ানতানামো এখন মার্কিনদের দখলেই আছে। সেই নিয়মের ফলে মার্কিনীরা চাইলে কিউবার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে পারে।
প্ল্যাট অ্যামেন্ডমেন্ট সাক্ষরিত হয়েছিল ১৯০২ সালে?
এটি ১৯০১ সালে প্রয়োগ করা হয় এবং ১৯৩৪ পর্যন্ত কার্যকরী ছিল, বাতিলের দিনটি ঠিক মনে নেই।
গুতিয়েরেজ সরকার মাত্র তিন মাস টিকেছিল, এরপর বাতিস্তা ক্ষমতা দখল করে নিল। ১৯৩৫ সালে গুতিয়েরেজ গুপ্তহত্যার শিকার হন, তিনি মেক্সিকোতে যেয়ে একটি বাতিস্তা বিরোধী আন্দোলন গড়ার চিন্তা করছিলেন, মেইয়ার মতই, এবং আমরাও একই কাজ করেছিলাম।
১৯৩৩ সালের সেই সময়ে বেশ কিছু রক্তাক্ত সংঘর্ষ হয়ে ছিল, ম্যাচাদোর কিছু মিলিটারি সমর্থক হাভানার হোটেল ন্যাশনালে আশ্রয় নেয়, যাদের মাঝে কয়েকজন বেশ দক্ষ মার্কসম্যান ছিল। পরে অবশ্য আস্তে আস্তে তাদের সকলকেই খতম করে সার্জেন্টের দল।
এছাড়াও একদল ফ্যাসিবাদী দল ছিল এবিসি নামে পরিচিত, এরা পুলিশ ষ্টেশন দখল করে এবং নানা স্থানে লড়াইতে জড়িয়ে পড়ে। সবকিছুই ছিল প্রগতিবাদী সরকার এবং গুতিয়েরেজের করা আইনের বিপক্ষে।
বাতিস্তা সেনাবাহিনীর মাঝে নিজের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়, একসময়ে এটি তার পোষাবাহিনীতে দাড়িয়ে যায়। পরবর্তীতে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের চাপে সে সরকার পরিবর্তন করে নতুন রাষ্ট্রপ্রধানকে নিয়োগ দেয়। বাতিস্তা কর্নেল খেতাবে ভূষিত হয়, তার সার্জেন্টরা তার মাধ্যমেই লেফটেনেন্ট কর্নেল র্যামঙ্ক পাই, সেখানে কোন জেনারেল ছিল না। বাতিস্তা নিজের খেয়ালখুশী মত অধীনস্থদের ক্যাপ্টেন, লেফটেনেন্ট, লেফটেনেন্ট কর্নেল, কমানদান্তে ইত্যাদি খেতাব দিতে থাকে। সেই সেনাবাহিনীতেকর্নেল ছিল মাত্র একজন- ফুলজেন্সিও বাতিস্তা।
এটি ১৯৩৪ সালের ঘটনা, বাতিস্তা এই ভাবে সাত বছর দেশ শাসন করে, ১৯৪০ সালে ভিন্ন ভাবে সরকার গঠন করে ক্ষমতা নেবার আগে। এই সবটা সময়ই আমি ছিলাম সান্তিয়াগোতে, প্রথমে সেই শিক্ষিকার বাড়ীতে এবং পরে আরও দুই স্থানে। ১৯৪২ সালে বেলেন কলেজে পড়ার জন্য হাভানাযাত্রা শুরু হয়, যা ছিল সারা দেশের সেরা স্কুল। ১৯৪৫ সালে স্কুল পাশ করে বেরোই।
জীবনের প্রথম দিককার বছরগুলো নিয়ে এইই আমার বলার আছে।
( চলবে)
মন্তব্য
রাইখা যাই,
বাইরে যাচ্ছি, আইসা পড়ুম নে।
তাড়া নেই!।
facebook
facebook
হাহ্- শ্যাষ...
ভাল হৈছে তো-
মহান এ মানুষের সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানলাম- ধন্যবাদ
টাইপো ঠিক হয়ে যাবে...
শেষ না কিন্তু, কেবল শুরু। বিশাল মোটা বই!
facebook
ডর দেহান ক্যান্...
ডরাইলেই ডর
facebook
খালি ঢুকি আর বাইর হই page down দিয়ে নিচে নামতেও তো টাইম লাগে..
পরে পরুম এট্টু এট্টু করে .... ওয়েটিং ফর ইফতার
__________________________
বুক পকেটে খুচরো পয়সার মতো কিছু গোলাপের পাঁপড়ি;
আস্তে ধীরে পড়েন।
facebook
অমানুষিক প্রচেষ্টা শুভেচ্ছা থাকল ।।।
চেষ্টা করি, তাতে ক্ষতি নেই। দশ বছর লাগবে ধরে রেখেছি।
facebook
ইনভিক্টাস মুভিটা নিয়ে লিখতে গিয়ে যখন দেখলাম -- হিউম্যান ক্যালকুলেশনকে অনুবাদ করে লিখছেন হৃদয়ের ডাক -- তখন মনে হয়েছিল - আপনাকে দিয়ে যদি কিছু বই অনুবাদ করিয়ে নেয়া যায় তাহলে দারুন হবে।।। লেখা পড়ে ধারণা আরো পোক্ত হল।।।
পরের পর্বগুলোর জন্য অপেক্ষায় থাকব।।। তবে দশ বছরটাকে আর একটু কমিয়ে আনা যায় না
কোথায় লিখেছিলেন? লিঙ্ক দিয়েন।
ইচ্ছা তো আছেই, কাজের ফাঁকে ফাঁকে চেষ্টা করছি, দেখা যাক।
facebook
আপনার লেখা প্রসঙ্গে বলেছি।।। কয়েকদিন আগেই একটা পোস্ট দিয়েছিলেন।।।
মনে পড়েছে।
ইচ্ছা আছে রে ভাই, দেখা যাক।
facebook
ভালো লেগেছে।
আচ্ছা অণু ভাই
কি ী-কার দিয়ে না ি-কার দিয়ে লেখা হয়? আমি নিজেই ভুলে গেছি, শিওর হওয়ার জন্য বলা আর কি!!
মুশকিল , আমি বানান নিয়ে খুব কম জানি, সারাদিনই ভুল করি!
facebook
এখন দুই প্রকারেই লেখা যায়।
facebook
অনুবাদে ১০০ দিলাম
..................................................................
#Banshibir.
এট্টু ফানিফরা দিতেন নি পীরবাবা!
facebook
এই দিলাম ফুঁ!
..................................................................
#Banshibir.
সঠিক ইমো পাইলাম বলে এযাত্রা তালিতেই খুশী থাকতে হচ্ছে
facebook
বিশাল কম্ম যজ্ঞে নামছেন।
চলুক ---
চালানোর চেষ্টা করি, এর বেশী কিছু না-
facebook
একটু বেশী বড় করে ফেলছেন, আর তাড়াহুড়া ও করছেন মনে হ্ টাইপো হয়েছে দেখলাম বেশ, তবে অনুবাদ ঝরঝরে।
ফিদেলকে ও নীলডাউন দিতে হইছে, আমরা ও দিছি :p।
পরের পর্বের জন্য অপেক্ষায় থাকলাম।
আমি বড় করি নাই রে আপু, এমনিতেই এমন বড়! কয়েকশ পাতার বই!
আর কাজের ফাঁকে ফাঁকে করেছি, ব্যপক টাইপো থাকতে পারে, শুধরে নেব আস্তে আস্তে।
facebook
ধীরে সুস্থে করো, ভালো হচ্ছে।
----------------------------------------------------------------------------------------------
"একদিন ভোর হবেই"
হ, আমার ধীরে মানে খবর আছে, হবেই না
facebook
বিষয়টা পছন্দ হইসে। সুযোগ মতন পইড়া নিবুনি।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
facebook
সময় করে পড়তে হবে
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
সময় করে সাজেশনও দিয়েন।
facebook
চলুক, পড়ছি।
ধন্যবাদ।
facebook
বেশ ভাল লাগল ।
facebook
অনু দা , বেশ ভালো একটি উদ্যোগ । চালিয়ে যান । পড়াও চলছে ।
ধন্যবাদ, চেষ্টা করব।
facebook
২য় পর্বের লিঙ্ক থেকে ১ম পর্ব টা পড়লাম। বেশ ভাল লেগেছে, একটানে ১ম পর্ব শেষ করলাম। আপনার লেখা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই, এটি সকলেই জানে। তবে উদ্যোগ টি নিয়ে বলা যায়, খুবই ভাল। বাংলায় লেখা না হলে হয়ত আমার মতো অনেকেরই জানাই হত না।
অসংখ্য ধন্যবাদ, পুরোটা শেষ কেরে উঠুন এবং চলতে থাকুক আপনার কলম অবিরাম (রুপক অর্থে, এখন তো ডিজিটাল যুগ, কলমের বেইল নাই )।
পলক
চেষ্টা করব, দেখা যাক-
facebook
নতুন মন্তব্য করুন