বড় খোঁপাডুবুরি, Great Crested Grebe (Podiceps cristatus), পরিবারের জনক-জননী যখন তাদের ছানাদের আপন শরীরের পালক তুলে তুলে খাওয়াতে থাকে, তখন মনে হয় নিশ্চয়ই পাখিগুলো কোন একটা ভুল করছে। ঐ বিস্বাদ, খসখসে পালকে অন্তত আর যাই থাকুক কোন পুষ্টি থাকবে না। সে জিনিস কেউ খায় নাকি!
কিন্তু একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে এটি তারা করছে অভ্যাস অনুযায়ীই এবং মানব শিশু যেমন আইসক্রিম দেখলে খুশীতে ডগমগ হয়ে হাত বাড়িয়ে দেয়, বড় খোঁপাডুবুরির বাচ্চারাও তেমনই আনন্দ নিয়েই আপনা পিতা-মাতার পালক গলাধকরণ করেই যাচ্ছে। মূলত বাবা-মা এদের পেটের এবং ডানার পার্শ্বদেশের পালক খাইয়ে থাকে, এই পালকই ছানাদের খাবারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ দখল করে আছে।
কিন্তু কেন একটি পাখি পালক খেতে যাবে? গবেষণায় মনে হচ্ছে এর সাথে পাখিটির নানা অন্ত্রের কাজের সম্পর্ক আছে। খেয়ে ফেলা পালকেরা পাকস্থলীর ভিতরে ভেঙ্গে-গলে একধরনের সবুজ গলিত পদার্থে ( লেই) পরিণত হয়, যা কিনা অনেক সময়ই পাকস্থলীর অর্ধেক অংশ জুড়ে থাকে। এই লেই জাতীয় জিনিসটিই কিছু বিশেষ বিশেষ নালীর প্রবেশ মুখে আপনা থেকেই স্থাপিত হয়ে যায় এবং সেই নালীগুলোর ভিতরে মাছের কাঁটা জাতীয় ধারাল পদার্থ প্রবেশে বাঁধা দেয়। এমনই হতে পারে যে কোন ধরনের ধারালো পদার্থ থেকে এটি পাকস্থলীর দেয়ালকেও রক্ষা করে।
সেই সাথে এই পালকগুলো বড় খোঁপাডুবুরিকে পেলেট ( pellet, বলা যায় চিবানো খাদ্যপিণ্ড) তৈরিতে সাহায্য করে, যা তারা গলা দিয়ে উগরে ফেলে দেয়। দেখা গেছে পালক খাবার পরপরই এরা বেশ খানিকটা জলপান করে থাকে, এবং নিশ্চিতভাবেই সেই উগরে ফেলা বর্জ্য পিণ্ডের সাথে পাকস্থলীর কিছু কিছু অনাকাঙ্খিত বস্ত বাহির হয়ে আসে, যাদের মাঝে বিভিন্ন ধরনের পরজীবী এবং ফিতাকৃমি থাকে। এই শ্রেণীর পাখিদের মাঝে পরজীবী এবং ফিতাকৃমির সংক্রমণ খুবই সাধারণ ঘটনা।
বর্ণনা- বড় খোঁপাডুবুরি কালচে বাদামি পিঠ ও সবুজ পায়ের জলচর পাখি ( দৈর্ঘ্য ৫০ সেমি, ডানা ২০ সেমি, ঠোঁট ৪,৩ সেমি, পা ৫,৮ সেমি) , প্রজননকাল ছাড়া প্রাপ্তবয়স্ক পাখির পিঠের দিক কালচে ধূসরাভ বাদামি, দেহের নিচের দিকটা সাদাটে, মাথার চারিদিক কালো এবং মাথার উপরে এক জোড়া খাড়া, পিছনমুখী কালচে কানঝুটি রয়েছে, এবং ওড়ার সময় ডানার স্পষ্ট সাদা পট্টি দেখা যায়।
প্রজননকালে প্রাপ্তবয়স্ক পাখির মাথার নিচে তামাটে ও কালো পাড়ওয়ালা লম্বা পালক থাকে, তবে ছেলের তুলনায় মেয়ে পাখির পালক বেশি হয়, গাল ও ঘাড়ের উপরের অংশের সাদা রঙ মাথার কালচে চারদিকেও ঘাড়ের নিচের অংশের সাথে পার্থক্য দেখায়, বগল লালচে-কমলা, চোখ গাঢ় লোহিত-লাল, কালচে-বাদামি ঠোঁটের আগা তুলনামূলক ফিকে ও গোঁড়া গাঢ় লাল, পা ও পায়ের পাতা জলপাই সবুজ, পায়ের পাতার চামড়া হলদে এবং নখর নীলচে। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির মাথায় লম্বালম্বি বাদামি দাগ থাকে। ৩টি উপ প্রজাতির মধ্যে P.c.cristatus বাংলাদেশে পাওয়া যায়।
স্বভাব- বড় খোঁপাডুবুরি হাওর, বিল, নদী, হ্রদ, ঝিল, মোহনা ও উপকূলীয় এলাকায় বিচরণ করে, সচরাচর জোড়ায় কিংবা ছোট্ট দলে থাকে। জলে সাঁতার কেটে ও ডুব দিয়ে বল্লমের মত চোখা ঠোঁটের কোপে এরা শিকার করে, খাদ্য তালিকায় রয়েছে মাছ ও ব্যাঙাচি। পূর্বরাগে জোড়ার পাখি উদ্ভিদ মুখে নিয়ে জলের ওপরে ভেসে উঠে গলায় গলা লাগিয়ে মুখোমুখি হয়, কান-ঝুঁটি খাড়া করে ও কর্কশ গলায় ডাকে- ইরগ, ইরগ…, গ্রীষ্মে প্রজননকালে অগভীর জলে ঘাস ও নলের বিশাল ঢিবির বাসা বানিয়ে এরা ডিম পাড়ে। ডিমগুলো সবুজ, সংখ্যায় ৩- ৫ টি, মাপ ৫.৫ x ২.৫ সেমি। ২৮ দিনে ডিম ফোটে, ৭৯-৮০ দিনে ছানারা বাসা ছাড়ে।
বিস্তৃতি- বড় খোঁপাডুবুরি বাংলাদেশের দুর্লভ পরিযায়ী পাখি। শীতে চট্টগ্রাম, ঢাকা, রাজশাহী ও সিলেট বিভাগের হাওর ও নদীতে পাওয়া যায়। আফ্রিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও সমগ্র এশিয়ায় এর বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে, তবে মালদ্বীপে পাওয়া যায় না।
অবস্থা- বড় খোঁপাডুবুরি বিশ্বে বিপদমুক্ত বলে বিবেচিত। বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয় নি। যদিও এককালে ফ্যাশন সচেতন কিন্তু মূর্খ মানুষদের টুপি এবং পোশাকে ব্যবহারের জন্য এদের মাথার চমৎকার পালকের চাহিদার জন্য যুক্তরাজ্যে বড় খোঁপাডুবুরীর অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়ে ছিল, বর্তমানে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে বিপদমুক্ত অবস্থায় পৌঁছেছে।
বিবিধ- বড় খোঁপাডুবুরির বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ ঝুটিয়াল পর্দা পা ( ল্যাতিন podici=বাতাস চলাচলের পথে থাকা পর্দা, pes= পা, crista= ঝুটিয়াল)
((তথ্যসূত্র- Extreme Birds, বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের পাখি খণ্ড,
ব্যবহৃত ছবিগুলি আমারই তোলা, সবই ফিনল্যান্ডে, কাজেই আপনার প্রজননকালীন সময়ের অপূর্ব রূপ দেখতে পাচ্ছেন, কিন্তু পালক খাওয়ানো অবস্থার ছবি এখনো তুলতে পারি নি, পাওয়া মাত্রই হাজির করা হবে!)
সিরিজের বাকি পর্বগুলো পাবেন এইখানে
পালকাবৃত বন্ধুদের নিয়ে লেখা এই সিরিজটি সেইসব মানুষদের জন্য, এই গ্রহের প্রতিটি বুনো পাখির পালকে আমি যাদের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই--
ডেভিড অ্যাটেনবোরো
জেরাল্ড ডারেল
কনরাড লোরেঞ্জ
ইনাম আল হক
সালিম আলী
জেমস অডুবন
রজার টোরে পিটারসন
মন্তব্য
জানা থাকা ভালো।
যদিও, জানার কোনো শেষ নাই
জানার চেষ্টা বৃথা তাই!
জানার কোনো শেষ নাই
জানার চেষ্টা বৃথা তাই! হীরক রাজার দেশে--
facebook
অণুদা,আপনি নেশায় পরিব্রাজক বা পাখি বিশারদ কিন্তু পেশায় কী জানতে ইচ্ছে করে।
বেকার
facebook
আহা! এমন বেকার যদি হতে পারতাম, সারা জীবনেও আর চাকরী খুঁজতাম না।
facebook
--বেচারথেরিয়াম
facebook
অবাক হন ক্যা, খুশি হইতেছিতো।।। উৎসাহ পাইতেছি
--বেচারাথেরিয়াম
facebook
কইয়া দিমু ইতিহাস?
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
দেন---
facebook
তারেক অনু আপনি কি করেন? এমন স্বপ্নের মত জায়গায় ঘুরে বেড়ান, ভীষণ হিংসে হয়।।।
ঘুরে বেড়ানোর চেষ্টা করি, এর বাহিরে বিশেষ কিছু না-
facebook
পড়ছি। জানছি।
facebook
এইটাও ডুবুরীপাখি, আবার ডাইভার (লুন) ও ডুবুরী?
***
গ্রেব আর ফ্লেমিঙগোরা নাকি নিকট আত্মীয়। কেম্নে কি?
লুনের বাংলা নাম মনে হয় এখনো দেওয়া হয় নি, খবর নিচ্ছি।
facebook
হুম !!
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
facebook
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
facebook
জানার কোন শেষ নাই,
তাতে কোন চিন্তা নাই,
আছেন মোদের অনু ভাই।
এটা কি ধরনের মস্করা
facebook
অনু দা কি রাগ করলেন নাকি? আসলে আপনার লেখার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত এত নতুন বিষয় জানছি যে তা বলে শেষ করা যাবে না। আর সে কারনেই আমার উপরের এই কটি লাইন , মস্করা করার জন্য কিন্তু না। আপনি কি বুঝেছেন তা ঠিক বুঝতে পারিনি।
রিলাক্স! আমরা আমরাই তো!
facebook
চলবে---
facebook
বুঝছি। আর কুনো কনফ্যুশন নাই, সব পরিষ্কার।
..................................................................
#Banshibir.
ফকফকা?
facebook
এক্কেবারে। ৯৯% ক্রিস্টাল মেথের মত। (ব্রেকিং ব্যাড দেখেন?)
..................................................................
#Banshibir.
মনে পড়ছে না নামটা, মনে হয় দেখা হয় নি! যাউক ৯৯ % হলেই হবে, পরের পর্বে পরকীয়ায় পটু পাখি নিয়ে লেখা আসতে পারে-
facebook
পরকীয়া পটু পাখিদের মত নমস্য মানুষদের নিয়া পুস্ট আগে আসেনাই কেন কত্তিপক্ক জবাব চাই!
শুনেন, ঐ পুস্টে বৈজ্ঞানিক নামধাম বাদ্দিয়া টিপস অ্যান্ড ট্রিকস এর উপর ফোকাস কৈরা ল্যাখবেন কিন্তু।
..................................................................
#Banshibir.
টিপস অ্যান্ড ট্রিকস নিয়া আমি লিখলে ধু গো দা কি করবে!
facebook
আমি তো শুঞ্ছিলাম ধুগোদাই পরকীয়া পাখি হিসেবে পাখিসমাজে পরিচিত
..................................................................
#Banshibir.
আমিও তাই শুনছি ডয়েচ ভেল রেডিওতে
facebook
লেখা তো পুরাই
চমৎকার একটা পোস্ট দিলেন অণু ভাই।
খালি বাংলা নামটা ঠিক মনমত হয় নাই - বড় খোঁপাডুবুরী (নাকি বড়-খোঁপা ডুবুরী) না হয়ে বড়-ঝুঁটি ডুবুরী হলে মনে হওঁয় বেশি ভাল হত। মাথার উপরের পালকগুলো আকৃতি ঠিক খোঁপার মত নয়।
আমার অন্যতম প্রিয় সিরিজটা চলুক
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
গ্রিবদের সবার নামে একই রাখা হয়েছে, আপনার আপত্তি জায়গা মত জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে-
facebook
facebook
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
পিতা-মাতার পালক গলাধকরণ করানোর ব্যপারটা একটু অদ্ভুত! কিন্তু পাখিগুলো খুবই সুন্দর।
ইমা
আমাদের কাছে তারা অদ্ভুত, তাদের কাছে আমরা।
facebook
হায়রে আজব দুনিয়া!! পালক খাওয়ানোর মতো জিনিশ আগে শুনিনি। আর দেখতে কী সুন্দর!
-রু
চোখগুলো খুনে লাল!
facebook
__________________________
বুক পকেটে খুচরো পয়সার মতো কিছু গোলাপের পাঁপড়ি;
facebook
(ফিনল্যান্ড যাইতে মন চায়।)
চইল্যা আসেন, কিন্তু শীতে আসলে সাবধান।
facebook
আমার এখানেও প্রচুর পাখি দেখি.......... কিন্তু অবাক হই একটা বিষয়ে, সব দেশেই চড়ুই পাখি দেখতে পাই (যে কয়টা দেশ ঘুরেছি তার ভিত্তিতে বলছি)
আমার কাছে চড়ুই বড়ই আশ্চর্যের পাখি।
---- ঠুটা বাইগা
দেখতে আপাত এক মনে হলেও ভিন্ন প্রজাতি হবার সম্ভাবনা বেশী।
খেয়াল করে দেখবেন একটার গালে আবার কালো ফোঁটা আছে সেটা বন চড়ুই
facebook
ঠিকাছে, দেখবক্ষণ।
--- ঠুটা বাইগা
দেখে পোস্ট দেন-
facebook
কিছুই চিনি না- জানি না...
চিনব, জানব
facebook
ঠিকই, পালক খাওয়াও কাজে আসতে পারে।
এইরম একখান ব্যবস্থা থাকলে মানুষেরও আর কৃমি নিয়া চিন্তা ছিল না।
হুম, বলতে পারছি না!
facebook
বেশি পর্তে জান্তে আমার আলসি লাগে, ছবি দেখতে বেবাক ভালু পাই। ছবি নাই ক্যা ?
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
আব্দার, এত তিনটা তুলতেই খবর হয়ে গেছ, যেমন রাঙা চোখ মেলে চিক্কুর দেয়-
facebook
আই ইউ সি এন থেকে বের করা একটা বইতে অনেক পাখির ছবি দেখলাম টাঙ্গুয়ার হাওরের - তার মধ্যে Great Crested Grebe ও আছে - দেখে খুব আপন লাগল - এটা তো অণু ভাই এর পোষা পাখি মানে তার পোস্ট এ আগেই দেখেছি
এহ , পোষা বললেই হল!
পদ্মাতে প্রথম দেখেছিলাম এটিকে, টাঙ্গুয়াতেও
facebook
ইন্টারেস্টিং!
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
আসলেই-
facebook
নতুন মন্তব্য করুন