(ইগন্যাসিও র্যামোনেতের শত ঘণ্টা ব্যাপী নেওয়া ফিদেল কাস্ত্রোর সাক্ষাৎকারের সংকলন গ্রন্থ MY LIFE এর একটি অনুবাদ প্রচেষ্টা চালাচ্ছি, আপনাদের সকলের মতামত কাম্য। মূল বইয়ের লেখক এবং প্রকাশকের অনুমতি ছাড়া লেখাটি কোন রকম বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা নিষিদ্ধ, আর বাণিজ্যিক কারণ ছাড়া অনুবাদটি ব্যবহার করতে চাইলে অবশ্যই অনুবাদকের সম্মতি লাগবে। সত্যিকার অর্থে এই প্রথম অনুবাদ করছি, বানান ভুল ছাড়াও অন্য অনেক আড়ষ্টতা থাকার কথা, আশা রাখছি আপনাদের সহযোগিতায় সেগুলো আস্তে আস্তে কাটিয়ে উঠব।)
আপনার বেড়ে ওঠার দিনগুলোতে কালো ছায়া ফেলেছিল দুটি অধ্যায়- বাতিস্তার স্বৈরশাসন এবং বিশ্বযুদ্ধ।
অবশ্যই এইগুলোর ব্যপক প্রভাব পড়েছিল আমার লেখাপড়া এবং বড় হবার উপরে, আসলে সারা বিশ্ব জুড়েই রাজনৈতিক এবং বৈপ্লবিক ঘটনারগুলোর উপরে বিস্তর প্রভাব পড়েছিল এই কারণে, যথা সময়ে সেগুলো নিয়ে কথা বলব।
সেই শিক্ষকের বাড়ীতে শিক্ষাব্যবস্থা কেমন ধাঁচের ছিল?
কিছুই না ! তারা আমাকে একটা জিনিসও শিখায় নি! বিদ্যালয়েও পাঠায় নি। আমি স্রেফ সেখান ছিলাম! সেই বাড়ীতে কোন রেডিও-ও ছিল না, যে একটি মাত্র জিনিস শুনতে পেতাম তা হল পিয়ানো- ডো, রে, মি, ফা, সো, লা, টি, ব্যাং ব্যাং ব্যাং। কল্পনা করতে পারেন দিনে দুই ঘণ্টা সেই জিনিস শুনতে বাধ্য ছিলাম! অবাক লাগে যে শেষ পর্যন্ত আমি একজন সঙ্গীতজ্ঞে পরিণত হলাম না !
সেই শিক্ষিকার বোন, পিয়ানোবাদিকা, আমাকে প্রাথমিক স্কুলের পড়াগুলো দেখিয়ে দেবার দায়িত্বে ছিলেন, কিন্তু কপালে কিছুই জুটল না! আহ, সেই অবিশ্বাস্য ঘটনাপ্রবাহের কথা শুরু করলে শেষ হবে না! কেবল বলি, আমি নিজে নিজে যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ শিখেছিলাম। লাল মলাটের এক স্কুল বইয়ের পেছনে ছাপা ছক থেকে একা একা সারাদিন বসে বসে পাটিগণিতের জগতে যাত্রা শুরু হয়েছিল আমার। কিন্তু তারা আমাকে কিছুই শেখায় নি। জীবনে দু-দুটি বছর স্রেফ নষ্ট হয়েছিল সেখানে।
এত অল্প বয়সে পরিবারের অভাবে নিশ্চয়ই খুব অনুভূত হত?
এমন একটা জায়গায় ছিলাম যেখানে শেখার ছিল না কিছু, আর পরিবেশ ছিল বন্ধুর। ক্ষুধা কি সেটা না বুঝেও মহা ক্ষুধার্ত থাকতাম মনে করতাম সেটি হল খাবারের প্রতি রুচি!।
অবিশ্বাস্য!
খুব বাজে কিছু ঘটনা ঘটেছিল, সেখানেই প্রথম বিদ্রোহ শুরু হয়, আমার বয়স হয়ত সবে আট ছুয়েছে। যদিও আমি সেই পড়বার জায়গাতে আর থাকতাম না, এই গল্পে আবার দুটি শাখা আছে-
এই অভিজ্ঞতা কি বাবা-মার উপরে আপনাকে ক্ষুদ্ধ করে তুলেছিল?
না না, আমি তাদের ভালবাসতাম, অন্তত শ্রদ্ধা করতাম। তবে মা-র জন্য বেশী খারাপ লাগত, এটাই অবশ্য স্বাভাবিক যেহেতু সে ছিল সবচেয়ে কাছের মানুষ।
সান্তিয়াগোর সেই বোর্ডিং স্কুলের অভিজ্ঞতার পরেও?
বোর্ডিং স্কুল? সেটা কোন স্কুল ছিল না ! আমি যেন নির্বাসনে ছিলাম। এত বেশী ক্ষুধার্ত ছিলাম যে অনাহার এবং খিদা লাগার পার্থক্য ভুলে গেছিলাম।
সেই অবস্থার জন্য কাকে দায়ী করেন?
সত্যিকার অর্থে কাউকেই না। আমি জানতাম না কি ঘটছে, সেই অবস্থাটা বোঝার ক্ষমতাও আমার ছিল না। শুধু বুঝেছিলাম চেনা জগতের, আমার প্রিয় বাড়ী, খামার সকলের কাছ থেকে দূরে এক জায়গায় আমাকে পাঠানো হয়েছিল। এবং সেখানের অনাত্মীয় মানুষগুলোর দ্বারা যথেষ্টই নির্যাতিত হয়েছিলাম।
খেলার কোন সঙ্গী ছিল?
গ্যাব্রিয়েতো নামের এক বালক। গ্যাব্রিয়েতো পালাউ। তার বাবা-মা প্লাজার কাছের এক বাড়ীতে থাকত, অর্থনৈতিক দিক দিয়েও স্বচ্ছলতর ছিল। সেখানেই আমরা কয়েকজন মিলে খেলতাম। সে সেখানে অনেক দিনই ছিল, বিপ্লবের পরে সে টেলিভিশনে যোগ দেয়, এখনো সেখানেই আছে। অনেকদিন অবশ্য তার সম্পর্কে কিছু শুনি নি।
কিন্তু সেই সময়টুকু বাদে সেখান বাস করা আসলেই কঠিন ছিল। সেই বাড়ী, পরিবার, তাদের জীবন এবং বিশ্রী আইনগুলোর উপর বীতস্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। সেটি ছিল একটি ক্ষুদে প্রাণীর উপর অন্যায্য ব্যবহারের প্রতিক্রিয়ার মত।
কি আইন?
তাদের পূর্বপুরুষ ছিল ফরাসী। তারা নিখুঁত ফ্রেঞ্চে কথা বলত। এমনিতে খুবই শিক্ষিত ছিল তারা, আর সেই আইনগুলো ছিল সবই জমিদার ঘরানার- খুব নম্র ভঙ্গীতে কথা বলতে হবে, জোরে কথা বলা যাবে না, কটু শব্দ ব্যবহার করা নিষেধ। মাঝে মধ্যে শাসনের জন্য তারা গায়েও হাত তুলত। এবং কথা না শুনলে তারা আমাকে স্কুলে পাঠানোর হুমকি দিত, সেই Colegio de La Salle তে, যেখানে আমি প্রথম গ্রেডে পড়া শুরু করেছিলাম। সেই বাড়ীতে দুই-দুইটি বছর আমার নষ্ট হয়েছিল। একই বয়সে এখনকার কিউবান শিশুরা ৩য় গ্রেডে পড়ে।
এক কথা বলা চলে- আপনি ছিলেন নির্যাতিত এক শিশু?
সেটি ছিল দুঃস্বপ্ন! প্রথম কয়েক মাসে আমাকে নিজের জুতা তৈরি করতে হত। একদিন সুই ভেঙ্গে ফেলার জন্য অকথ্য অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিলাম, তাও চামড়া ফোঁড়ার সুই না, কাপড় সেলাইয়ের সুই। মাঝে মাঝেই জুতা ছিঁড়ে ফেড়ে খুলে যেত রাস্তার মাঝেই। তাই সেটা মেরামতের চেষ্টা করতাম কোনমতে। সাধারণত সেলাইয়ের কাজ ভালই রপ্ত করেছিলাম, কিন্তু সেই একবার সব গণ্ডগোল হয়ে গেল। জীবনে কখনোই খালি পায়ে হাঁটতে হয় নি, কাজেই তাদের কাছে মাথা নিচু করে দোষ স্বীকার করলাম। সেটার ফলাফল এখন মনে পড়ছে না, কিন্তু কোনভাবে মেরামত সারা হয়েছিল।
তবে বাড়িয়ে বলতে চাই না, সেটি কোন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ছিল না। আর সেই পরিবারটি ছিল খুবই দরিদ্র। সবাই শিক্ষকের বেতনের উপর নির্ভর করত। সেই সরকারের আমলে অনেক সময়ই শিক্ষকদের তাদের বেতনের জন্য তিন মাসও অপেক্ষা করতে হয়েছে। যা ছিল ভীষণ অনিশ্চয়তা পূর্ণ জীবিকা। প্রতিটি পাইপয়সা গুণে গুণে তাদের খরচ করতে হত, এটার উপরই পরিবারটির অস্তিত্ব নির্ভর করত।
এবং আপনি সেখানে প্রায়ই ক্ষুধার্ত থাকতেন?
হ্যাঁ। বিরানে বাবা-মা সবসময়ই আমাকে জোর করে খাওয়াত আর সান্তিয়াগোতে আমি খাওয়াকে খুবই পছন্দ করতাম। হঠাৎ করেই আবিস্কার করলাম ভাত কেন যেন খুব সুস্বাদু লাগছে, তারা মাঝে মাঝে মিষ্টি আলু আব্র Picadilloর সাথে ভাত দিত, কোন রুটির বালাই ছিল না। মূল সমস্যা হচ্ছে সেই অল্প পরিমাণ খাবার দিয়েই ৬-৭ জন মানুষের দুপুরের এবং রাতের খাবার সারতে হত। দুপুর বেলায় খাবার চলে আসত। শিক্ষিকার এক কাজিনের বাড়ী থেকে খাবার আসত, যাকে তারা কোসিতা বলে ডাকত, এর মানে ক্ষুদের বা ছোট্ট জিনিস। তিনি ছিলেন এক বিশালবপু মহিলা। জানি না কেন থাকে সবাই ক্ষুদে বলে ডাকত, মনে হত সমস্ত খাবার সেই গলাধকরণ করে ফেলত। রান্না তার বাড়ীতেই হত, সেই সাথে মারসিয়াল নামের আরেক কাজিনও ছিল- যে তার সাথে করে নিয়ে আসত সামান্য ভাত, শিম, মিষ্টি আলু, কাঁচা কলা, Picadillo, যা ছিল কালেভদ্রে, এবং সব ভাগ করে দেওয়া হত। মনে পড়ে প্রায়ই থালা থেকে কাঁটাচামচ দিয়ে শেষ ভাতটি মুখে তোলার চেষ্টা করছি।
অবস্থা যদি এতই খারাপ হয়, তাহলে কি করে আপনার বড় ভাই র্যামনকেও সেখানে পাঠানো হয়েছিল?
কারণ একবার র্যাখমন সান্তিয়াগো এসেছিল, ঠিক মনে পড়ছে না কেন, কন্তু তার সাথে একটা পয়সা রাখার থলে ছিল। সেই ছোট চামড়ার থলের মাঝে বেশ কিছু সিকি ও দশ পয়সা ছিল। সেই সময়ে একটি Popsicleর দাম ছিল এক পয়সা, নারকেল-বাদামি চিনির মিষ্টির দাম ছিল এক পয়সা। প্রতিবেশী শিশুরা, যারা বেশ দরিদ্র হওয়া স্বত্বেও ২-৩ পয়সার মালিক ছিল, তারা সেগুলো খেতে নিজেরা নিজেরা। কিন্তু আমি যে পরিবারের তত্ত্বাবধানে ছিলাম তাদের নিয়ম অনুযায়ী কারো কাছে কিছু চাওয়া ছিল মারাত্নক অভদ্রতা। তাই কোন বাচ্চার কাছে এক কামড় কিছু চাইলেও তারা দৌড়ের আমার নামে নালিশ দিত।
একদিন শিক্ষিকার বোনকে একটি পয়সা দিতে বলেছিলাম, তিনি ছিলেন খুবই ভাল একজন মানুষে, কিন্তু ভয়ানক দরিদ্র। কখনোই ভুলতে পারি না, আমার সেই এক পয়সার দাবী তাকে কতখানি আহত করেছিল, উনি খুবই বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন- তোমাকে আমি এখন পর্যন্ত ২৮ পয়সা দিয়েছি! সত্যই উনি দিয়েছিলেন কিন্তু আর দিতে পারতেন না হয়ত। আমি আর কোনদিন তার কাছে পয়সা চাই নি।
কয়েক মাস পর র্যা মন তার পয়সার থলি নিয়ে বেড়াতে এলে চোখের সামনে যেন সেই পয়সাগুলোকে আইসক্রিমে পরিণত হতে দেখলাম, তাকে থাকে রাজি করালাম বটে কিন্তু মোটের উপর দারিদ্রকে আরও চাপিয়ে নিলাম! কারণ, তখন থেকে একই পরিমাণের খাবারে বাড়তি একটি মুখ জুটে গেল।
পরে আমি বুঝতে পারি সেখানে দারিদ্রতা কিরকম ভয়াবহ ছিল, মন হয় বছর খানেক পরে কারণ বাবা-মার সেখানের সত্যিকার চালচিত্র ধরতে পেরেছিলেন।
তারা বুঝতে পারেনি নি সেখানে কি ঘটছিল?
বাবা একদিন এসেছিলেন, তখন হাম বা এই জাতীয় কোন এক অসুখে ভুগছিলাম, চুল বেশ লম্বা ছিল কারণে তারা আমাদের চুল পর্যন্ত কাটত না। আর আমি ছিলাম মইয়ের মত চিকন! কিন্তু তারা বাবাকে বলল হামে ভোগার কারণে আমার এই অবস্থা!
আরেকদিন মা এসে উপস্থিত হলেন, ততদিনে শিক্ষিকা, তার বাবা এবং বোন একটা ভাল বাড়ীতে উঠতে সক্ষম হয়েছিল, আমাদের ৩জনের জন্য তারা প্রতিমাসে ১২০ পেসো পাচ্ছিল, কিন্তু মা আবিস্কার করলেন তার তিন সন্তানকেই অত্যন্ত রুগ্ন এবং অধঃভুক্ত অবস্থায়। সেদিনই মা আমাদের শহরের সেরা ক্যাফে La Nuviolaতে নিয়ে গেলেন, আমরা আইসক্রিমের প্রতিটি ফোঁটা চেটেপুটে খেলাম। তখন আমের মৌসুম ছিল, আম ছোট এক বাক্স আমও কিনলেন, খুবই চমৎকার স্বাদের টলেডো আম। সেই আম দশ মিনিটও টিকল না! মা পরের দিনই আমাদের বিরানে ফেরত নিয়ে গেলেন।
কিছুদিন আগে আমার বড় বোন অ্যাঞ্জেলিকাকে এই ব্যাপারে খানিকটা দোষারোপ করেছিলাম এই বলে যে সে লিখতে এবং পড়তে পারত, কেন সে বাবা-মাকে চিঠি লিখে সেই অবস্থার কথা জানায় নি? সেখানের অনেক কিছু আমি বুঝে উঠতে পারিনি, কিন্তু গেছিলাম গ্রামের খামারবাড়ী থেকে যেখানে আমাদের সবসময়ই পেট পুরে খাওয়ানো হত, বাড়ীতে হোক বা দোকানে। তার সেই অভিজ্ঞতার কথা অবশ্যই বাবা-মাকে জানানো উচিত ছিল। কিন্তু সে আমাকে পরে বলেছিল কেন সে চিঠি লিখতে পারেনি – কারণ শিক্ষকের পরিবার তাকে চিঠি পাঠাতে দিত না!
সেই সময়ে, জনপ্রতি ৪০ পেসো হারে তিন জন ছাত্র, নিশ্চয়ই লাভজনক ব্যবসা ছিল?
অবশ্যই তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার বেশ উন্নতি ঘটেছিল। আমাদের পরিবারেরই ছিল তিন জন, মানে ১২০ পেসো। এখনকার হিসেবে যেকোন তৃতীয় বিশ্বের দেশে তিন হাজার ডলারের অনেক বেশী। পরে হাইতির কনসাল আমাদের শিক্ষিকার বোন সেই পিয়ানো শিক্ষিকাকে বিয়ে করেন। কাজেই, বেশ অগ্রগতি বলতেই হবে।
পয়সা জমিয়ে সেই শিক্ষিকা এর পরে একবার যুক্তরাষ্ট্রে বেড়াতে গেলেন, মূলত নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখতে। এবং ফিরে এসে সেই প্রপাতের গল্প এত বেশী করতেন যে আমি সম্ভবত ঘৃণা করতে শুরু করেছিলাম সেই একঘেয়ে বিরক্তিকর গল্পগুলোকে। উনি সেই ভ্রমণের সাথে সাথে আসবাবপত্রও কিনেছিলেন, সবই ছিল আমাদের ক্ষুধার ফসল।
সম্পূর্ণ সৎ ভাবে সেই ঘটনা বললাম। পরবর্তীতে সেখানেই আমাদের বিদ্রোহ জন্ম নিল।
সেই শিক্ষিকার বিরুদ্ধে আপনি বিদ্রোহ করলেন?
মা আমাদের উদ্ধার করে নিয়ে বিরানে ফেরৎ নিয়ে যাবার পরেই আসলে আমরা সেই অপরাধের মাত্রা বুঝতে পারি। যে বাড়ীতে ফেরার জন্য আমরা এতটাই ব্যকুল ছিলাম, সেখানের প্রত্যেকেই স্পষ্ট বুঝতে পারল আমরা আসলেই অনাহারে ছিলাম।
এরপর আমরা সেই শিক্ষিকার অপেক্ষায় ছিলাম, এত কিছুর পরও যিনি আমাদের বাড়ীতে কেহতে আসতেন এবং বেছে বেছে সবচেয়ে সরেস মুরগীর টুকরোটি পাতে তুলে নিতেন। আমি এবং র্যা মন প্রথমবারের মত তার বিরুদ্ধে কিছু করার পরিকল্পনা করি।
বিদ্রোহ?
তা ঠিক না, বরং বলা চলে প্রতিশোধ। পেয়ারার ডালের গুলতি দিয়ে আমরা সন্ধ্যার পরে প্রায়শই আধা ঘণ্টাব্যপী স্কুল ভবনের ধাতব ছাদের উপরে নানা কিছু ছুড়তাম, অনেকটা এক নাগাড়ে বোমাবাজির মত। শিক্ষিকা যে সেই ছাদের নিচেই আছেন এবং আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে চেচাচ্ছেন এমন কিছু কল্পনা করে শিশুতোষ আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠতাম সবাই। যদিও তার চিৎকার কোনদিন শুনিনি আমরা! একেকটা সাচ্চা ক্ষুদে শয়তান হয়ে গেছিলাম সবাই।
কিন্তু যেটা আমাদের কল্পনাতেও আসে নি সেটাই ঘটল! আমি সেই শিক্ষিকার সাথে আবার সান্তিয়াগো ফিরে গেলাম। হাঁপানি দেখা দেওয়ায় র্যামন বেঁচে গেল এযাত্রা।
এইটা কি করে সম্ভব?
সেইটাই হল! তবে এবার আর অনাহারে থাকতে হয় নি, কারণ আগের বারের অভিজ্ঞতা খুব বড় স্ক্যান্ডাল তৈরি করে ছিল, কিন্তু তারপরও সেখানে কেবলই সময়ের অপচয়ই হচ্ছিল, নিজে নিজে গুণ করা শিখা আর ঘোরাঘুরি করা ছাড়া আর কিছুই হচ্ছিল না। সেই জানুয়ারিতে তারা আমাকে স্কুলে পাঠায়। জীবনের প্রথম বারের মত সত্যিকারের ক্লাসে যাওয়া শুরু হল।
ততদিনে বাতিস্তার ঘটনা ঘটা শুরু হয়েছে। কেবল ১৯৩৫ সালের মার্চের হরতালের কথা মনে পড়ে। বাড়ীর পিছনেই মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল, যা কিনা তখন ছিল সেনাবাহিনীর দখলে, কত অকথ্য ঘটনা যে সেখানে দেখেছি আমরা! ২১ বছর পরে ২৬ জুলাইয়ের সাথীরা আমাদের ১৯৫৬এর ৩০ নভেম্বর মেক্সিকো থেকে ল্য কলরাডোসে প্রত্যাবর্তন করার পরিকল্পনা মোতাবেক আক্রমণে যায়।
একই বিদ্যালয়ে?
একই ভবনে। যদিও সেটি ততদিনে আর স্কুল হিসেবে ব্যবহৃত হত না। বাতিস্তা ক্ষমতায় আসার পরে সেটিকে আর্মি ব্যারাক বা পুলিশ ফাঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করা হত। ভবনটিকে প্রথমবারের মত যখন মিলিটারি ব্যবহার করা শুরু করে, তখনো আমি সেই শিক্ষিকার বাড়ীতেই ছিলাম।
১৯৫৬এর ৩০ নভেম্বর ওরিয়েন্তে রাজ্যের ফ্রাঙ্ক পাইসের নেতৃত্বে ২৬ জুলাই বিল্পবের সাথীরা সেখানে আক্রমণ করে বসে, তারা অনেক দিনক্ষণ হিসেব করে দেখেছিল আমরাও সেদিনই উপকূলে পা রাখব। কিন্তু সাগর স্রোত, নৌকার সমস্যাসহ নানাবিধ কারণে আমাদের ৪৮ ঘণ্টা দেরী হয়ে যায়। আমি চেয়েছিলাম আমাদের জাহাজ যেন আগে কিউবা পৌছায়, কিন্তু সেটি হয় নি।
সেই সময়ের আর কিছু স্মৃতি মনে পড়ে কি?
আমার শিক্ষিকার বোন সেই পিয়ানোবাদিকার সাথে হাইতির কনসালের মন দেয়া-নেয়া শুরু হয়। এমনিতে তারা চমৎকার মানুষ ছিল। লুই হিলবার্ট ছিল তার নাম। এর পরপরই পরিবারটি আমাদের নিয়ে আরেকটু ভাল বাসাতে স্থানান্তরিত হল, যেখানের ছাদে ফুটো ছিল না, ক্ষুধার প্রকোপ কম ছিল, হয়ত উপার্জনও কিছুটা বেড়ে ছিল। মনে হয় শিক্ষিকা বেতন পাওয়া শুরু করেছিলেন, হাইতির কনসালটির নিজস্ব আয় ছিল, কাজেই সব মিলিয়ে বেশ ভালই চলছিল।
তারাই আমাকে সান্তিয়াগোর গির্জায় ব্যাপ্টাইজ করার জন্য নিয়ে যায়, সেই সময়ে আমাকে বলা হত ইহুদী! আসলে যাদের ব্যাপ্টাইজ করা হয় নি তাদের সকল কেই ইহুদী বলা হত। যদিও আমার মনে হয় এইরূপ সম্বোধনের মাঝেই ধর্মের নামে হেয় করার একটা চল ছিল।
তখনো আপনার ব্যাপ্টিজম হয় নি?
না, ৮ বছরে পা দেবার পর সেটি সম্পন্ন হয়। আমরা আসলে বাবার একজন কোটিপতি বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম, যার কথা ছিল আমার গডফাদার হবার, বছরের পর বছর গড়িয়ে চলল, আমার ছোট ভাইবোনদেরও ব্যাপ্টিজম হয়ে গেল কিন্তু আমরা অপেক্ষা করছিলাম সেই কোটিপতির, যার নাম ছিল ফিদেল পিনো স্যান্টোস! তার নাম থেকেই আমার নাম নেওয়া হয়েছে, কাজেই এই নিয়ে আমি খুব একটা গর্বিত হতে পারি না। আমার জন্ম হয়েছিল ১৩ আগস্ট এবং সেইন্ট ফিদেল ডে ছিল ২৪ এপ্রিল। তার সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছিলাম প্রবরতিতে।কিন্তু আমার নাম দেয়া হয়েছিল সেই খুব বেশী ধরনের ধনী মানুষটির নামে, যে আমাদের বিরানের বাড়ীতে প্রায়ই আসত।
তাহলে হাইতির কনসালই ছিলেন আপনার প্রকৃত গডফাদার?
হ্যাঁ। উনি এবং উনার স্ত্রী ছিলেন আমার গডফাদার এবং গডমাদার। গডফাদার একদিন আমাকে La Salle নামের জাহাজ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখানে টিনজাত মাছের মত শত শত হাইতিয়ান গায়ে গা লাগিয়ে ছিল রুদ্ধ পরিবেশে, তাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছিল। সেই হাইতিয়ানদের কথা মনে হচ্ছিল যাদের সাথে আমি বসে ভুট্টা খেতাম। তাদের কষ্টকর জীবনকে আরো কঠিনতর করা হচ্ছিল কিউবা থেকে হাইতিতে ফেরত পাঠিয়ে, যে দেশটা কিউবার চেয়েও গরীব।
তাদের কিউবা থেকে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছিল?
হ্যাঁ। চিনির বাম্পার উৎপাদনের সময় হাজার হাজার হাইতিয়ান কিউবাতে আসত কাজের আশায়, তারা ছিল প্রচন পরিশ্রমী কিন্তু বেতন ছিল খুবই কম। সোজা কথায় তাদের দাস হিসেবে ব্যবহার করা হত। পশুপালের মালিক তার জন্তুদের খেতে দিত, রোগ হলে সেবা করত, যত্ন নিত। কিন্তু পুঁজিবাদী মালিকেরা শ্রমিকদের নিয়ে কোনরকম মাথা ঘামাতো না।
১৯৩৩ এর তথাকথিত বিপ্লবের পড়ে অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটা শুরু হল, বিশেষ করে শ্রমবাজারকে সম্পূর্ণভাবে জাতীয়করণ করা হল, ফলে কিউবান স্বার্থ সবার আগে নিশ্চিত করে হাজার হাজার হাইতিয়ান শ্রমিককে জাহাজে করে দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছিল সম্পূর্ণ অমানবিক উপায়ে। তাদের অনেকেই হয়ত কুড়ি বছর ধরে কিউবাতে বাস করছিল! সেই নিষ্ঠুর ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয়েছিলাম আমি, যদিও তখন অবশ্যই বুঝতে পারি নি এই পৃথিবীকে বুঝতে সেই অভিজ্ঞতা কতখানি মূল্যবান বলে প্রমাণিত হবে।
চলবে----
মন্তব্য
এত্ত দেরী কইরা এই পর্ব ছাড়লেন ক্যান?
আপনের লাইগা
লেখা কিন্তু হইছে।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
অনেক বড় পর্বগুলো, ২য়টার মাত্র ২০% দিতে পারলাম এযাত্রা।
facebook
অনেক সুন্দর পোস্টের জন্য ধন্যবাদ তারেক ভাই। চলতে থাকুক এই লেখাজোকা।
ধন্যবাদ, চেষ্টা করব।
facebook
facebook
আপনার সব পোস্ট গুলোয় এত বিষয়ভিত্তিক এবং চমৎকার হয় !!!
খুব ভালো লাগলো দুটো পর্বই ।
চলুক ঘুরাঘুরি, চলুক লেখালেখি।
ধন্যবাদ
facebook
পড়ার আগে ভেবেছিলাম এটা নিরেট শুস্কং কাষ্ঠং টাইপের হবে, পড়ার পরে দেখলাম লেখনীর গুণে বেশ আগ্রহ জাগানিয়া হয়েছে, সুতরাং প্রথম পর্বটিতেও চোখ বুলিয়ে গেলাম দ্রুতলয়ে, পরে আবার ভাল করে পড়তে হবে। এখন বলতে পারি, এই ধ্রুপদী কর্মটি সংগ্রহে রাখা উচিৎ সবারই, লেখাটির জন্য ধন্যবাদ!
আহারে! ক্যাষ্ট্রোর শৈশবটা বোধ হয় আমার মতই কষ্টে কেটেছে!
ধন্যবাদ। উনার বলার ভঙ্গী অসাধারণ, কিন্তু আমার শব্দভাণ্ডার সীমিত বলেই খুব সুবিধের করতে পারছি না।
facebook
চলুক, পড়ছি। পরের পর্বের অপেক্ষায়....
facebook
এত বেশী ক্ষুধার্ত ছিলাম যে অনাহার এবং খিদা লাগার পার্থক্য ভুলে গেছিলাম।
পৃথিবীতে কত শত কোটি মানুষ এই পার্থক্য ভুলে যেতে থাকে কিংবা ভুলে যায়, ভুলে গেছে কত শত-সহস্র বছর!
এই লাইনটা মাথা থেকে তাড়াতে পারছিনা।
facebook
পরের পর্বের অপেক্ষায়
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
facebook
পর্বগুলি নিয়মিত না দিলে কিন্তু একটা গ্যাপ তৈরি হয় পড়ার ক্ষেত্রে। একটা ই-বই করার কথা ভাবা যায় কিন্তু। আর বই হলে তো কথাই নেই
ডাকঘর | ছবিঘর
ই বই না এখন ইঙ্কলপেডিয়া হয়ে যাবে অণুদার -যাই হোক কভার তো এক্টাই হবে
ঠিক!
facebook
হ, জানি তো! বিশাল অধ্যায় যে! কি করি!
facebook
কি আর করবে চোখ বন্ধ করে পোস্টাতে থাক। আমরা পড়তে থাকি
ডাকঘর | ছবিঘর
চোখ বন্ধ থাকলে লিখব কি করে!
facebook
আপনার প্রায় সমস্ত লেখা পড়েই মুগ্ধ হই। আপনাকে খুবই উদারমনা ও মানবতাবাদী বলে মনে হয়। কিন্তু এই এক স্বৈরশাসকের প্রতি আপনার বিপুল দুর্বলতা আপনার চরিত্রের সাথে যায় না। ফিদেলের কি ভাল দিক নেই? অবশ্যই আছে, যেমন আছে যে কোনো স্বৈরশাসকেরই। কিন্তু দিনান্তে একজন স্বৈরশাসক স্বৈরশাসকই।
কিউবার ইতিহাস পড়া আছে নিশ্চয়ই আপনার, আছে না? তাহলে আমার মুগ্ধতার কারণটাও খুব সহজেই বোঝার কথা।
facebook
সামনের দিনগুলাতে চালু থাকবো নি?
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
চেষ্টা করছি-
facebook
। পর্ব চলুক। ভালো থাকবেন অনু দা।
অমি_বন্যা
ধন্যবাদ
facebook
দারুন!
****************************************
মিশরের পর্বটা শেষ করেই দিলেন! অন্যকিছু লিখুন তাহলে-
facebook
নতুন মন্তব্য করুন