পাখির পৃথিবী-১০, বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগামী প্রাণী কোনটি?

তারেক অণু এর ছবি
লিখেছেন তারেক অণু (তারিখ: রবি, ২৫/১১/২০১২ - ৫:৩০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

Pergrine 2

পেরেগ্রিন শাহিন মানব সমাজে সবচেয়ে বিখ্যাত, আদরণীয় এবং জনপ্রিয় পাখিদের একটি, এর অবিশ্বাস্য গতি ও শিকার করার অসাধারণ দক্ষতা একে পাখির রাজ্যে পরিণত করেছে কিংবদন্তীতে এবং সেই সাথে ছোটখাট গড়নের পাখিটি জল- স্থল- বায়ু মিলিয়ে আমাদের জগতের দ্রুততম প্রাণীর রেকর্ডধারী।

পেরেগ্রিন শাহিনের শিকার ধরার মুহূর্তটি জীবজগতের অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয় বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে, যে পদ্ধতিতে ব্যবহার করে পাখিটি শিকার করে তাকে বলা হয় Stoop, এর অর্থ নির্দিষ্ট উচ্চতা থেকে পাখিটি নিচের দিকে লাফ দেয় ( মুক্ত ভাবে পড়তে থাকে), মাধ্যাকর্ষণকে কাজে লাগিয়ে গতিবৃদ্ধির জন্য শিকারি পাখি ডানা দুটো যতদূর সম্ভব দেহের সাথে লেপটে রাখে। এই পতনের সময়ই পেরেগ্রিন শাহিন সহজেই ঘণ্টায় ১৮০ কিলোমিটার ( ১১২ মাইল) পাড়ি দিতে পারে। যদিও এর ঘণ্টায় ৩২২ কিলোমিটার ( ২০০ মাইল) বেগে চলার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ডেভিড অ্যাটেনবোরোর ধারাবর্ণনায় লাইফ অফ বার্ডস সিরিজের Meat Eaters পর্বেরএই ক্লিপটি দেখলে এমন একটি উড়াল এবং শিকারদৃশ্য দেখতে পাবেন।

শিকার করার সময় এতই অতি মৃদু নড়াচড়া করে চোখের নিমিষে দিক পরিবর্তন করতে পারে, এবং অনায়াসে ২ কিলোমিটার দূর থেকে কবুতরের মত ছোটখাট শিকারের দিকেও সোজা ধাবিত হতে পারে, সাধারণত শিকারকে বধ করতে এরা ধারালো নখর ব্যবহার করে, কিন্তু যে তীব্র গতিবেগে শিকারি পাখিটি অসহায় শিকারের উপরে নেমে আসে তাতেই নখরের সংস্পর্শে এসে শিকারের ঘাড় সাথে সাথেই মটকে যায়! এই অতিসফল Death-stoop পদ্ধতি পেরেগ্রিন শাহিনকে সফলতার সাথে সারা বিশ্বে রাজত্ব করার ক্ষমতা দিয়েছে, তাই প্রায় সব মহাদেশেই এদের দেখা যায়। হিসেব মতে দেখা গেছে প্রায় হাজারখানেক প্রজাতির পাখি এদের শিকারে পরিণত হয় বিশ্ব জুড়ে।

Peregrine 1

বাংলা নাম – পেরেগ্রিন শাহিন

ইংরেজি নাম- Peregrine Falcon

বৈজ্ঞানিক নাম- Falco peregrinus

বর্ণনা- পেরেগ্রিন শাহিন পৃথিবীর দ্রুততম প্রাণী হিসেবে খ্যাত শিকারি পাখি ( দৈর্ঘ্য ৪২ সেমি, ডানা ২৮ সেমি, ঠোঁট ২.৬ সেমি, পা ৪.৯ সেমি, লেজ ১৪.৫ সেমি), ছেলের চেয়ে মেয়েপাখি বড় কিন্তু রঙে কোন পার্থক্য নেই। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির পিঠের দিক কালচে ধূসর, দেহের নিচের দিক লালচে, মাথার আবরণ কালো, গুম্ফ-ডোরা স্পষ্ট, পেট ও রানে কালো ডোরা, স্লেট-নীল ঠোঁটের আগা কালচে, মাঝে মাঝে গোঁড়া হলদে হয়, ঝিলি, চক্ষুগহ্বর ও মুখের সঙ্গমস্থল উজ্জল হলুদ, চোখ গাঢ় বাদামি, এবং পা ও পায়ের পাতা হলুদ। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির পিঠ তুলনামূলক ভাবে কালচে বাদামি-কালো ও ফিকে দেহতলে স্পষ্ট লম্বালম্বি দাগ থাকে। তরুণপাখির পিঠ অতি বাদামি-কালো ও দেহতল মরচে রঙের। ১৮ টি উপপ্রজাতির মধ্যে F.p.peregrinator বাংলাদেশে রয়েছে।

স্বভাব- পেরেগ্রিন শাহিন নদী, হ্রদ, খাড়া পাহাড়, জলাভুমি,লেগুন, প্যারাবন, অর্ধ-মরুভূমি ও পাথুরে প্রান্তরে বিচরণ করে। ডালে অথবা মাটিতে বসে কিংবা বৃত্তাকারে আকাশে উড়ে এরা শিকার খোঁজে। খাদ্যতালিকার মধ্যে আছে ভূচর পাখি, সৈকত পাখি, জলচর পাখি, পোষা পাখি এবং বাদুড়। ঊষা ও গোধূলিতে এরা খুব কর্মচঞ্চল থাকে এবং অত্যন্ত দ্রুত বেগে শিকারের উপর ঝাপিয়ে পড়ার দক্ষতা আছে। মার্চ – মে মাসে প্রজননকালে এরা জোড়া বেঁধে আকাশে উড়ে সুনিপুণ মহড়া দেখায় ও মেকি লড়াই করে। মেয়েপাখি বাসার জন্য নির্ধারিত স্থানে বসে ডাকে – চির-র-র-র…..। খাড়া পর্বতের গায়ে এবং কখনও গাছে ডালপালা, ঘাস ও পশম দিয়ে মাচার মত বাসা বানিয়ে এরা ৩-৪টি ডিম পাড়ে। ডিমের মাপ ৫.২x৪.১ সেমি, ২৫-২৭ দিনে ডিম ফোটে। মেয়েপাখি একা ডিমে তা দেয়।

বিস্তৃতি- পেরেগ্রিন শাহিন বাংলাদেশের বিরল পরিযায়ী পাখি, শীতে সব বিভাগে পাওয়া যায়। উত্তর ও দক্ষিণে আমেরিকা, ইউরেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং পুরো ভারত উপমহাদেশ, চীন ও ইন্দোনেশিয়াসহ এশিয়ায় এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে।

অবস্থা- পেরেগ্রিন শাহিন বিশ্বে বিপদমুক্ত বলে বিবেচিত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতি সংরক্ষিত।
বিবিধ- পেরেগ্রিন শাহিনের বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ অচেনা শাহিন ( ল্যাতিন falco =শাহিন, peregrinus= অচেনা)

তথ্যসূত্র- Extreme Birds
বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ, পাখি খণ্ড।

আলোকচিত্র ২টি পাখি বিশেষজ্ঞ, আলোকচিত্রগ্রাহক, অভিযাত্রী ইনাম আল হকের তোলা। তার অনুমতিক্রমে সচলায়তনে ব্যবহার করা হল।

সিরিজের বাকি পর্বগুলো পাবেন এইখানে

পালকাবৃত বন্ধুদের নিয়ে লেখা এই সিরিজটি সেইসব মানুষদের জন্য, এই গ্রহের প্রতিটি বুনো পাখির পালকে আমি যাদের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই--

ডেভিড অ্যাটেনবোরো
জেরাল্ড ডারেল
কনরাড লোরেঞ্জ
ইনাম আল হক
সালিম আলী
জেমস অডুবন
রজার টোরে পিটারসন


মন্তব্য

রংতুলি এর ছবি

ছবি দেখেই বুঝছিলাম এটা স্টুয়ার্ট লিটলের সেই বদ ফেলকন। উপর থেকে খাড়াভাবে নিচে নেমে শিকার ধরার পদ্ধতি পড়ে শিওর হলাম।

তারেক অণু এর ছবি

মোটেও বদ নহে অ্যাঁ

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

কি মায়া! হাসি

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

তারেক অণু এর ছবি

মায়া, সবই মায়া শয়তানী হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার পোস্টগুলো সব সময়ই অসাধারণ হয়ে থাকে।

শুভকামনা রইল।

তুহিন সরকার

তারেক অণু এর ছবি

ধন্যবাদ

অতিথি লেখক এর ছবি

খুব মেজাজ খারাপ নিয়ে আপনার পোস্ট টা পড়তে বসেছিলাম। এবং ছবি দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল। হাসি

কাদম্বরী

তারেক অণু এর ছবি

মন ভাল থাকুক সবসময় !

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আমার তো মনে হয় পাখটারে দেখেছি আমি
কিন্তু শাহিন পোদ্দারিন নামে তো কোনো পাখির নাম শুনি নাই

আর কোনো বাংলা নাম নাই?

তারেক অণু এর ছবি

শাহিন হচ্ছে এই পাখির পরিবারের (গোত্র) নাম, সেই হিসেবে দেওয়া। পাখির বাংলা নাম একাধিক জন কিছু কিছু দিয়েছিলেন কিন্তু সুনির্দিষ্ট নিয়ম না মেলে , কাব্যিক নাম! মানুষ ভুলে গেছে, আসলে বৈশিষ্ট্য এবং গোত্র হিসেব লরে নাম রাখাটা ভীষণ জরুরী।

মাধুকরী এর ছবি

ধন্যবাদ অনু।
কি অসাধারণ এই সব পাখির চোখের দৃষ্টি, তাই না? শিকারের জন্য তারা কতটা ভয়াবহ !

শাহিন নামটা শুনে কেন যেন শাহিন নামের মানুষ গুলোর কথা মনে পড়ল ।

তারেক অণু এর ছবি

অসাধারণ দৃষ্টিশক্তি।

অতিথি লেখক এর ছবি

শিকার করার সময় এতই অতি মৃদু নড়াচড়া করে চোখের নিমিষে দিক পরিবর্তন করতে পারে, এবং অনায়াসে ২ কিলোমিটার দূর থেকে কবুতরের মত ছোটখাট শিকারের দিকেও সোজা ধাবিত হতে পারে, সাধারণত শিকারকে বধ করতে এরা ধারালো নখর ব্যবহার করে, কিন্তু যে তীব্র গতিবেগে শিকারি পাখিটি অসহায় শিকারের উপরে নেমে আসে তাতেই নখরের সংস্পর্শে এসে শিকারের ঘাড় সাথে সাথেই মটকে যায়! এই অতিসফল Death-stoop পদ্ধতি পেরেগ্রিন শাহিনকে সফলতার সাথে সারা বিশ্বে রাজত্ব করার ক্ষমতা দিয়েছে, তাই প্রায় সব মহাদেশেই এদের দেখা যায়।

#দুর্দান্ত এক শিকারী, যে লম্বা লম্বা নখর, একবার যদি কেউ খামচি খায় তাহলে ইহজীবনে আর ভুলবেনা। আপনার ছবির মহাশয়কে না দেখলেও এর কাজিনদেরকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি, ভাগ্য ভালো মাত্র ২ কিলোমিটারের উপরের মধ্যেই খাড়াভাবে নীচে নেমে আসতে পারে আরো উপরে উঠে নাই- চাল্লু

#শুভেচ্ছা আপনাকে তারেক অণু ভাই উত্তম জাঝা!

আশরাফুল কবীর

তারেক অণু এর ছবি

কোন কাজিন?

সাফিনাজ আরজু  এর ছবি

আমার ছোট বোনের নাম শাহিন।
হে হে হে, আজ থেকে ওরে খ্যাপানোর নতুন কিছু পাওয়া গেল।

অনেক কিছু জানলাম অনুদা। খুব চমৎকার পোস্ট বরাবরের মতই। আপনার লেখাতে কমেন্ট করতে এসে আর কোন কথা খুঁজে পাইনা। লেখা, ছবি, বিষয়বস্তু সব এত অসাধারন হয়!!! হাততালি

শুভেচ্ছা রইল।

তারেক অণু এর ছবি

ধন্যবাদ। বাংলাদেশে বেশ কয়েক ধরনের শাহিন আছে কিন্তু!

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

পড়ছি এবং জানছি। চলুক

তারেক অণু এর ছবি
রু এর ছবি

একেবারে রাজকীয় পাখি! লেখায় ছবি একটু কম মনে হলো।
মেয়ে পাখি একটা ডিমে তা দেয় মানে কী? বাকি ডিমগুলোর কী হয়?

তারেক অণু এর ছবি

টাইপো! হবে একা ডিমে তা দেয়-

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

শাহিন নামটা আসলেই মানুষ মানুষ লাগে। এর চেহারার সাথে নামটা যায় না। খাইছে
দ্বিতীয় ছবিটাতে কি অহংকারী ভঙ্গি! চলুক

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

তারেক অণু এর ছবি

শাহিন সেই পরিবারের নাম।

কড়িকাঠুরে এর ছবি

চলুক

বৃত্তাকারে উড়ে এমন পাখি তো দেখেছিই। অনেক উঁচুতে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে উড়ে। ওরা কী শাহিন- চিন্তিত

তারেক অণু এর ছবি

অনেক অনেক শিকারি পাখি বিশেষ করে যারা থারমাল বাতাসের সুবিধে গ্রহণ করে, তারা সবাইই চক্রাকারে ঘুরে! শকুনেরাও।

অমি_বন্যা এর ছবি

পেরেগ্রিন শাহিন সম্বন্ধে জানা ছিল না। তাছাড়া পাখির নাম শাহিন হয় তাও জানা হল। লেখা ও ছবি দুটোতেই উত্তম জাঝা! । ভালো থাকবেন অনু দা।

তারেক অণু এর ছবি
কৌস্তুভ এর ছবি

ফ্যালকনের বাংলা কি শাহিন? নাকি বাজ?

তারেক অণু এর ছবি

শুধু ফ্যালকন হলেই হবে? হক, গসহক, মারলিন এদের কি হবে!!!!

সবার পরিবার হিসেব করে যে নামটা নেয়া হয়েছে পাখি খন্ডে সেখান থেকে নিয়েছি না,

আপনি কোথায়?

কৌস্তুভ এর ছবি

চিন্তিত

তারেক অণু এর ছবি

FALCONIDAE পরিবারের নাম দেয়া হয়েছে শাহিন, এ পরিবারে সারা বিশ্বে ১০ গণে ৬৩ প্রজাতি।

নিলয় নন্দী এর ছবি

সব শাহিনরা আপনার উপর ক্ষেপব কইলাম !
খাইছে

তারেক অণু এর ছবি

এত অসাধারণ প্রাণীর নাম নিজের নামের সাথে থাকলে গর্ববোধই করার কথা। দেঁতো হাসি

বনি এর ছবি

অসাধারণ অসাধারণ অসাধারণ
চলুক চলুক চলুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।