যথাসময়ে লামু ছাড়লাম আমরা-
এই ছিল প্রথম লাইন, মাথার কোষে কোষে গেঁথে গেল একেবারে, এখনো অন্ধকারে সামান্য আলোকপাতে স্তূপকৃত মণিমাণিক্য যেভাবে জ্বলজ্বল করে ওঠে, তেমনি এই শব্দমালা মুহূর্তের মাঝে ফিরিয়ে নিয়ে যায় আলো ঝলমলে শৈশবে। পাশের বাড়ী থেকে ধার করে আনা আধা ছেঁড়া ইয়া মোটা এক নিউজপ্রিন্টের বই, এমনই বাজে ভাবে ছিঁড়েছে যে প্রথম অধ্যায়ই নেই!
২য় অধ্যায়ের শুরুতেই সেই বিটকেলে প্রাণঘাতী শব্দগুলো-
যথাসময়ে লামু ছাড়লাম আমরা! লামু কোথায়? আর কোথায়, আফ্রিকার কোন এক অজানা কোণে! মাউন্ট লেকাকিসেরার ওপারের অজানা অঞ্চলে। এলাকার নামগুলো পড়তে পড়তেই রোমাঞ্চের স্রোত বয়ে যায় রক্তের ভিতর, বুকের ভেতরের ঘুমিয়ে থাকা যাযাবরটা দুদ্দাড় শুরু করে অদ্ভুত নাম বইটার, অ্যালান কোয়াটারমেইন। মূল লেখক স্যার হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড, সেবা প্রকাশনী থেকে খসরু চৌধুরীর অনুবাদে বের হওয়া। আসলে নাম দেখেই আগ্রহটা তৈরি হয়ে ছিল। তারপর থেকেই অ্যালান আমার সবসময়ের সঙ্গী। এমনকি বছর দুই আগে তার বাড়ী যে শহরে, দক্ষিণ আফ্রিকার সেই ডারবান শহরে পর্যন্ত গেছি, যদিও একসাথে অভিযান চালানো হয় নি সেযাত্রা।
অ্যালান কোয়াটারমেইন এক অদ্ভুত চরিত্র, আফ্রিকার অন্যতম বিখ্যাত শিকারি, কিন্তু শিকারের চেয়ে অন্য অ্যাডভেঞ্চার বিশেষ করে অভিযান তাকে টানে পুরোমাত্রায়। জুলুরা তাকে শ্রদ্ধা ভরে ডাকে মাকুমাজন বলে, যার অর্থ যে ঘুমায় না, সদা জাগ্রত!
রকিব হাসানের অনুবাদে সলোমনের গুপ্তধন নামের এক দুধর্ষ অ্যাডভেঞ্চারের বই পড়ার সময় তার সাথে আবার দেখা হল, সেখানেও ছিল হেনরি কার্টিস, ক্যাপ্টেন গুড- বন্ধুঅন্তপ্রাণ তারা। সাথে ছিল আমবোপা নামের এক আফ্রিকান যুবা, তার সাথে জঙ্গল, প্রান্তর, দুস্তর মরুভূমি পেরিয়ে, দুর্লঙ্ঘ্য পাহাড় ডিঙ্গিয়ে সবাই চললাম বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ হীরার খনির সন্ধানে এবং কুকুয়ানাল্যান্ডে যেয়ে সোজা পড়লাম বজ্জাত রাজা টুয়ালা আর ডাইনী গাগুলের খপ্পরে। জানলাম আফ্রিকার গাঁ ছমছম করা সব রহস্যের কথা, দেখলাম কী করে সেখানের প্রাচীন রাজাদের মৃতদেহ স্ট্যালাগমাইট আর স্ট্যালাকটাইটের মাঝে স্থাপন করে চুনাপাথরের অক্ষয় স্তম্ভে পরিণত করা হয়। সলোমনের গুপ্তধনই আফ্রিকার পটভূমিতে লেখা ইংরেজি প্রথম অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস। আমবোপা নামের সেই যোদ্ধা স্বরূপে দেখা দেয় স্বদেশে, সেই কুকুয়ানাল্যান্ডের রাজা হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়, আর গাগুলের চক্রান্তে হীরের সন্ধানে যেয়ে খনি ধ্বসে পড়লে মৃত্যুর মুখ থেকে চুলচেরা ব্যবধানে ফিরে আসি আমরা, বন্ধু অ্যালানের পকেট ভর্তি তখন উৎকৃষ্ট হীরেতে।
অ্যালান একজন হাতির দাঁত শিকারি, কিন্তু দেখা গেছে বুনো জন্তুদের প্রতি আছে তার অপরিসীম দরদও, অনেক ক্ষেত্রেই বিশাল দাঁতওয়ালা হাতিদের দেখেও ছেড়ে দিয়েছে সে, আবার মাইওয়ার প্রতিশোধে ( ইসমাইল আরমানের অনুবাদ) মাটুকু জাতির রাজা ওয়াম্বেকে নিকেশ করে তার হাতির দাঁতের তৈরি আস্তানাপ্রাচীর খুলে নিয়ে এসেছে এবং বিনা দ্বিধায় সেই সম্পদ সমান ভাগ করে নিয়েছে ওয়াম্বের হাতে অনেক বছর ধরে বন্দী থাকা বন্ধু জন এভরির সাথে। যে অ্যালানের বন্ধুক থেকে তপ্ত সীসা ছোটে হিংস্র মানুষ আর আক্রমণরত জন্তুর উদ্দেশ্যে সেই অ্যালানই প্রেমিকার প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে, স্থানীয় মানুষের প্রতি ভালবাসা থেকে নিজের জীবনের প্রতি ঝুঁকি নেন অকাতরে। ছোট্ট মেয়ে ফ্লসিকে মাসাইদের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনার জন্য নিজেকে বলি দিতে সবার আগে রাজী হয়েছিলেন, এমনকি বন্ধু ক্যাপ্টেন গুডের জীবন বাঁচানোর জন্য তার উপরে নেমে আসা শত্রুর তরবারি শরীরে ধারণ করে মৃত্যুবরণ করেন, মরার আগেও তার মন জুড়ে ছিল নিসর্গ এবং জীবনের সৌন্দর্য, বলেছিলেন- এতদিন ধরে বেঁচে থাকায় আনন্দিত। এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার বহু উপকরণ আছে। নারীর ভালবাসা, খাঁটি বন্ধুত্ব, শিশুর হাসি, সূর্য, চাঁদ, তারা- এর প্রত্যেকটি আনন্দের। তাছাড়া, আনন্দ পেয়েছি কপালে লবণাক্ত সাগরের চুমু অনুভব করে, আনন্দ পেয়েছি চন্দ্রালোকে বন্যপ্রাণীকে পানি খেতে দেখে।
একাধিক চলচ্চিত্র এবং টিভি সিরিজ নির্মিত হয়েছে অ্যালান কোয়াটারমেইন কে নিয়ে, প্রায় সবই রদ্দি, একমাত্র দ্য লিগ অফ এক্সট্রা অর্ডিনারি জেন্টলমেন চলচ্চিত্রে অ্যালান কোয়াটারমেইনের ভূমিকায় সিন কনারিকে দেখে মনে হয়েছিল এতদিনের পাওয়া গেল রক্ত মাংসের অ্যালানকে কিন্তু অদ্ভুতুড়ে কাহিনীর কারণে সিনেমাটি খুব একটা সাড়া ফেলতে সক্ষম না হওয়ায় কনারিকে নিয়ে আর অ্যালানের সিনেমা করা হয় নি। কিন্তু একটা সংলাপ মনে আছে যেখান অ্যালানের ভূমিকায় কনারি বলছেন- আমি দুইজন স্ত্রী এবং অসংখ্য প্রেমিকাকে নিজ হাতে কবর দিয়েছি, দুর্ভাগা বেচারা! কিন্তু দুই স্ত্রী এলো কোথা থেকে? স্ত্রী নিয়ে রচিত স্টেলা বইটি পড়েছি একাধিকবার, কিন্তু আরেকজন কোথায়? অনেক পড়ে হাতে পেলাম সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত সায়েম সোলায়মানের অনুবাদে মেরি নামের বইখানা। অ্যালানের প্রথম স্ত্রী ছিলেন মেরি, ডাচ বংশদ্ভুত তরুণীকে বিয়ে করার জন্য অনেক অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন তরুণ অ্যালান কিন্তু তার জীবন বাঁচানোর জন্য নিজেকে মৃত্যুর হাতে সপে দেন নবপরিণীতা স্ত্রী! জানতে পারি তার প্রথম স্ত্রী বিয়োগের রহস্য, সেই সাথে মেরি বইতে এক জায়গায় স্বীকার করেছেন অ্যালান নিজে ইংরেজ মিশনারির ছেলে হলেও, অভিযানের অসংখ্য জায়গাতে ঈশ্বর নিয়ে কথা বললেও ধর্মতে কোন বিশ্বাস নেই তার, সেটা পালন করা বা অস্বীকার করা মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার। একইভাবে শত প্রতিকূলতা স্বত্বেও ইংরেজ জাতীয়তাবাদের উপরে মানবিক সম্পর্ককে স্থান দিয়ে বিয়ে করেছিলেন ডাচ তরুণীকে।
আবার অন্য এক অ্যালানকে আবিস্কার করি অ্যালান অ্যান্ড দ্য আইস গডস বইতে যা খসরু চৌধুরীর অনবদ্য রূপান্তরে প্রকাশিত হয়েছিল নেশা নামে। তাদুকি নামের এক জাদু শেকড়ের নেশাতে হাজার হাজার বছর আগের হিমযুগের সময়কার একজন মানুষ ওয়াইতে পরিণত হল অ্যালান, নিজ গোত্রকে মুক্ত করল অত্যাচারি সর্দার হেঙ্গার হাত থেকে, বীরের মত রক্ষা করে মারল মানুষখেকো তলোয়ারদেঁতো বাঘ, জঙ্গলের দানব ষাঁড় ওরোকস, নেকড়ের পাল কে। কিন্তু সুখ পেল কি ওয়াই? সেখানে তার ছায়াসঙ্গী জ্ঞানী নাস্তিক নেকড়েমানব বামন প্যাগ, যে সরাসরি বলে পূজারীর বিশ্বাসেই দেবতা বেঁচে থাকে। অসাধারণ কাহিনী বিন্যাসে আমরাও জড়িয়ে পড়ি সেই প্রাচীন জীবনযাত্রায়- হিমবাহ গলে যাচ্ছে, শিকার মিলছে না, ওয়াই রূপী অ্যালান কি আগের প্রজন্মের লালন করা কুসংস্কার বরফ দেবতার কাছের ফিরে যাবে সাহায্যের জন্য, নাকি নিজের বুদ্ধি-অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নব নব জ্ঞান দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে মানবজাতির জয়যাত্রা? উত্তর আমাদের জানা, ক্ষুরধার মস্তিস্কের সৎ মানুষ অ্যালান আমাদের নিরাশ করবে না!
আবার তরুণকালের অভিজ্ঞতা নিয়ে বলা অ্যালান অ্যান্ড দ্য হলি ফ্লাওয়ার-এ আমরা আবিস্কার করি ভিন্ন এক মানুষকে, যে বরাবরের মতই অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী এবং সাহায্য করতে একপায়ে খাড়া, সেই সাথে ভীষণ বিপদপ্রিয়। কিংবা চাইল্ড অফ দ্য স্টর্মে। আবার সামান্য টাকা মজুরীর বিনিময়ে সে নানা অভিযানে অংশ নিলেও একাধিক বার কোটি টাকা পেয়েও উদার চিত্তে ফিরিয়ে দিয়েছে সে, লেডী র্যাগনালের কাছ থেকে পাওয়া সম্পত্তি বিলিয়ে দিয়েছে দাতব্য সংগঠনগুলোর মাঝে। বোঝা যায় অর্থের চেয়েও অনেক বেশী উপভোগ্য কিছুর প্রতি দুরন্ত আকর্ষণ ছিল তার।
জীবনে অনেক বিচ্ছেদ বেদনা সয়েছেন অ্যালান, কিন্তু ঘুরে দাঁড়িয়েছেন বারংবার, বাবার মৃত্যু, দুই স্ত্রীর বিয়োগব্যাথা এবং একমাত্র সন্তান হ্যারির অকালমৃত্যু ভিতরে ভিতরে হয়ত দুর্বল করে ফেলেছিল তাকে, কিন্তু বরাবরের মতই পথ এবং বন্ধুত্বের টানকে উপেক্ষা করেন নি।
তবে সবচেয়ে বেশী উপভোগ করেছি সবসময়ই তার স্বনামে প্রকাশিত জীবনের শেষ অভিযানটা, যার অসংখ্য সংলাপে মনে হয়েছে অ্যালান একজন সত্যিকারের দার্শনিক, জীবনের নানা গূঢ় রহস্য তিনি ব্যাখ্যা করেছেন অতি সরলভাবে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে, বলেছেন জীবনে সুখী হবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায়টি- যে যাই বলুক, জীবনে ভাল জিনিসটাই সবসময় সুখের।
সেই সাথে গাছ নিয়ে লিপিবদ্ধ করা তার মনোভাব মনে হয় জগতের সমস্ত গাছের সামনে লিখে রাখি যাতে মানুষ দুইবার চিন্তা করে তাদের কাটার আগে- বড় একটা গাছ কাটার আগে সবার একবার ভেবে দেখা দরকার। সুন্দর বড় গাছ দেখতে চিরদিনই আমার ভাল লাগে। শৈত্যপ্রবাহের সময় কি গর্বভরে মাঠ উঁচু করে থাকে ওরা, প্রাণ ভরে অনুভব করে বসন্তের পদধ্বনি! কি অসাধারণ শোনায় তাদের কণ্ঠ, যখন তারা কথা বলে বাতাসের সাথে। পাতার ফিসফিসানির কাছে হার মানে বায়ূ দেবতা ঈওল্যাসের হাজারটা বীণা। সারাদিন পাতাগুলো চেয়ে চেয়ে দেখে সূর্যালোক, সারারাত ধরে দেখে তারা। শতাব্দীর পর শতাব্দী তাদের খাবার জোগায় মা ধরিত্রী। অনেক দালান-কোঠা-বংশের উত্থান পতন দেখার পর অবশেষে ঘনিয়ে আসে চূড়ান্ত দিন। হয় লড়াইয়ে সেদিন জিতে যায় বাতাস, নয়তো নেমে আসে অস্বাভাবিক মৃত্যু।
জীবনের কষ্টিপাথরে যাচাই করা অভিজ্ঞতা দিয়ে দ্ব্যর্থহীন ভাবে বলেছেন সভ্যতা তো রূপার গিলটি করা বর্বরতা মাত্র। মানুষকে কতটা উন্নত করেছে এত সভ্যতা? চল্লিশ বছর কি তারও কিছু বেশি সময় আদিবাসীদের মাঝে কাটিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে লক্ষ করেছি তাদের আচারআচরণ। এখন বেশ কয়েক বছর ইংল্যান্ডে থেকে যথাসাধ্য বোঝার চেষ্টা করেছি আলোর সন্তানদের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি দেখলাম? বিরাট কোন অগ্রগতি? না, মোটেই নয়। আদিবাসীদের তুলনায় খুব সামান্যি এগিয়ে আছে শ্বেতাঙ্গ মানুষেরা। এদের যা বেশি আছে তা হলো- উদ্ভাবনী আর সাংগঠনিক ক্ষমতা। কিন্তু যে অর্থলোভ শ্বেতাঙ্গদের কুরে কুরে খায় দুরারোগ্য ব্যাধির মত, তা আদিবাসীদের নেই বললেই চলে। আমার সিদ্ধান্ত হয়তো হতাশাব্যঞ্জক, কিন্তু সব দিক থেকে বিচার করলে দেখা যাবে, সভ্য আর বর্বর মানুষের মধ্যে সত্যিই বিশেষ কোন পার্থক্য নেই।
অতি সভ্য যে মহিলা তার পুঁতির মালা পড়া কালো বোনটির কথা ভেবে বুড়ো এক বোকা শিকারির সরলতায় হাসছেন, তাঁকে বলব, আপনার গলায় যে মালাটি শোভা পাচ্ছে তার সাথে ওই মালার যে বড় বেশী মিল। বিশেষ করে, আপনার লো-কাট পোশাক যে বর্বরদের কথায় মনে করিয়ে দেয়। আপনি যেভাবে শিঙ্গা আর ঢোলের শব্দে ফিরে তাকান, বিবাহ-যুদ্ধে জয়ী ধনী যোদ্ধাটির হাতে নিজেকে সপে দেন, রঞ্জক পদার্থ আর পাউডারের প্রতি আপনার টান, ঘন ঘন পালকওয়ালা ক্যাপের ধরন পরিবর্তন- এই সবই একটা আত্মীয়তার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। তাছাড়া, সুশিক্ষিত যে অলস ভদ্রলোকটি ক্লাবে বসে বিজ্ঞানসম্মত ডিনার খাচ্ছেন, যে ডিনারের খরচ অনাহারী কোন পরিবারের সাতদিনের আহার জোটাতে পারে- তাকে বলব, স্যার, আমার লেখা পড়ে বর্বরের কথা ভেবে তো মিটিমিটি হাসছেন, কিন্তু এখনই যদি কিছু লোক এসে আপনার মুখে মুষ্ট্যাঘাত করে, তাহলেই দেখা যাবে, কতটুকু বর্বরতা আপনার মধ্যে লুকোনো আছে।
বর্বরতার মাটিতে মহীরুহের মত ডালপালা মেলেছে এই সভ্যতা- যেটা একদিন মিশরীয়, গ্রীক, রোমান বা ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যাওয়া অন্য সভ্যতার মতই পতিত হবে। মানুষের উন্নতিকল্পে গঠিত আধুনিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা আমাকে বলে কোন লাভ নেই। স্বীকার করি, কোন কোন প্রতিষ্ঠানের অনেক সুযোগ সুবিধে আছে, যেমন- হাসপাতাল। কিন্তু মনে রাখতে হবে, হাসপাতাল ভরানোর জন্য আমরাই জন্ম দিই রোগাটে মানুষের।
মানুষের দক্ষতা অসীম, কিন্তু স্বভাব সোনার বালার মত। এটাকে চারপাশে ঘোরা যাবে, ঘষে মেজে চকচকে করা যাবে, এমনকি ফোলানোও যাবে একটা পাশ চ্যাপ্টা করে- কিন্তু কখনোই এর পরিধি বাড়ানো যাবে না। তারা, পাহাড় বা মহাকালের মতই এটা অপরিবর্তনীয়।
১৮৮৭ সালে, আজ থেকে ১২৫ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল বইটি, অবাক হয়ে দেখেছি অ্যালান কতখানি নির্ভুল, যে যুদ্ধকে তিনি ঘৃণা করে গেছেন আজীবন, সেই যুদ্ধই মানুষ লড়ে যাচ্ছে আজীবন ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন রূপে। মানব চরিত্রের বহুমাত্রিকতাকে সবসময় বর্ণনা করেছেন একজন দর্শকের ভঙ্গীতে একই সাথে বুড়ো জুলু আমস্লোপোগাসের লড়াইয়ের প্রতি পিপাসা এবং দরদী মনের কথা বলে তার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবার ভার ছেয়ে দিয়েছেন পাঠকদের উপরে, নিজের সিদ্ধান্ত আমাদের উপর জোর করে চাপিয়ে দেন নি। হেনরি কার্টিসের মত অ্যালান কোয়াটারমেইন সম্পর্কে আমরাও বলতে পারি- জাঁকজমকের ওপর ছিল তাঁর চিরকালীন ঘৃণা। ওরকম একজন মানুষ আর কোনদিনই পাব না। তিনি ছিলেন নিখুঁত ভদ্রলোক, অতুলনীয় বন্ধু, অসাধারণ স্পোর্টসম্যান এবং সম্ভবত আফ্রিকার শ্রেষ্ঠ শিকারি।
প্রায়ই স্বপ্ন দেখি আফ্রিকার অবারিত বুনো প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছি আমি ও অ্যালান, ফিসফিস করে অভয় দিয়ে প্রিয় বন্ধু বলে যাচ্ছে- প্রকৃতির বুকে কান পেতে তার অনন্ত স্পন্দন শুনে মানুষ ভোলে তার দুর্দশা। প্রকৃতির অদৃশ্য, চলমান মহাশক্তির মাঝে নিজেকে বিলীন করে দেয় সে। কারণ, এই মাঝেই তার পরিচিতি, এখান থেকেই সে এসেছে, আবার মিশে যাবে এর সাথেই। এই প্রকৃতিই আমাদের জন্ম দিয়েছে, সমাধিও একদিন সে-ই দেবে।
( এই পোস্টটি প্রিয় অনুবাদক খসরু চৌধুরীর জন্য, ভাষার উপরে তার অসাধারণ দখল আর বর্ণনার স্বচ্ছতা যে আমাদের অনেকের আটপৌরে জীবনে কতখানি রোমাঞ্চ এনে দিয়েছে তা হয়ত তিনি কোনদিনই জানলেন না!
কদিন আগে খবর পেলাম আমার দাদার বাড়ীর পাশের গ্রামেই বর্তমানে তিনি আছেন, অবাক হবার সাথে সাথে খুবই ভাল লাগল। আশা করছি উনার সাথে এবার দেখা হবে)
মন্তব্য
অনবদ্য স্মৃতিচারণ।
"নেশা" বইটাই আমার সবচেয়ে প্রিয় অ্যালান কোয়াটারমেইন এর সবগুলোর মধ্যে।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
আহা, শুনে বড় ভাল লাগল! শুধু নেশা নিয়েই একটা পোস্ট দিতে হবে। বিশেষ কিছু জায়গা বিশেষ করে ষাঁড়ের লড়াই, বাঘ মারা, হেঙ্গা বধ, প্যাগের কথা বেঁছে বেঁছে পড়ি প্রায়ই।
facebook
আপনার এই সুন্দর লেখাটা পড়ে আবার কিং সলোমন’স মাইন পড়লাম।
It is far. But there is no journey upon this earth that a man may not make if he sets his heart to it. There is nothing, Umbopa, that he cannot do, there are no mountains he may not climb, there are no deserts he cannot cross; save a mountain and a a desert of which you are spared the knowledge, if love leads him and he holds his life in his hand counting it as nothing, ready to keep it or to lose it as Providence may order............... এই লাইন গুলো আমার খুব প্রিয়।
facebook
সলোমনের গুপ্তধন থেকে শুরু করেছিলাম, কোন অ্যালান কোয়াটারমেইন ই মনে হয় বাদ দেই নি। দেশে যদ্দিন ছিলাম হেনরী রাইডার হ্যাগার্ডের যত বই বের হয়েছিল সেবা থেকে সব খেয়ে শেষ করে আসছি। আহা, কিসব দিন ছিল!!!
আহা, কিসব দিন ছিল!!!
facebook
চমত্কার একটা লেখা। কোয়াটারমেইন কে নিয়ে এত কথা হল, শী কে নিয়ে কিছুই না দেখে একটু অবাক হলাম!
নেশার মত নেশা খুব কম বইতেই পেয়েছি। বাকি পুরিয়াগুলোর কি হল তা এখনও জানতে ইচ্ছে করে খুব!
হোয়াইট হার্ট ব্ল্যাক হার্ট কি মিস করেছেন?
হ্যাগার্ডের সব লেখা নিয়ে সিরিজ টাইপ একটা কিছুর আবদার রইল আপনার কাছে। ভাল থাকুন।
শী অ্যান্ড অ্যালান এখনো পড়া হয় নি, আর এখানে লিখতে চেয়েছিলাম শুধু অ্যালানের বইগুলো নিয়ে, কাজেই শী, আর রিটার্ন অফ শী বাদ পড়েছে।
হোয়াইট হার্ট ব্ল্যাক হার্ট বেশ আগে পড়েছিলাম, খুব একটা ভাল লাগে নি।
তাদুকির পুরিয়া! আশা করেছিলাম হ্যাগার্ড আরও কিছু কাহিনী জানাবেন, কিন্তু ক্যামনে কী!
facebook
হ্যাগার্ডের এই কালজয়ী চরিত্রের উপর চমৎকার স্মৃতিলেখ্য। অনেক সুখস্মৃতি জমে আছে এই লেখকের সৃষ্টিগুলোর সাথে, সলোমনের গুপ্তধন, দ্য গোরিলা হান্টারস, শী, রিটার্ণ অফ শী, নেশা অনবদ্য একেকটা সৃষ্টি একটানে নিয়ে যায় আফ্রিকার গহীনে, রোমাঞ্চের নেশা ধরিয়ে দেয় মনের ভিতরে। দারুন লাগলো অণু।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
দ্য গোরিলা হান্টারস অন্য লেখকের লেখা রে বুটা, ব্যালান্টাইনের।
হ্যাগার্ড একটা অমানুষ।
facebook
সরি। ভুলে গিয়েছিলাম। থ্যাঙ্কস দোস্ত!
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
তবে খুব বেশি অবাক হয়েছি হ্যাগার্ডের ল্যাতিন আমেরিকা নিয়ে লেখা একাধিক উপন্যাস পড়ে, ব্যাটা এত জানত কী করে!
facebook
আসলেই তো! কি করে জানত?
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
প্রচুর পড়ত নিশ্চয়ই।
facebook
কি দারুন পড়তে, জানতে - আবার ও
facebook
দারুণ লাগলো লেখাটা।
মাকুমাজান এলান, বুগুয়ান হেনরি, সেই আমস্লোপোগাস কুঠার- আহ কী সব দিন ছিলো
আহ ইনকোসি কাস! আমস্লোপোগাস একটা চরিত্র বটে।
facebook
"দ্য লিগ অফ এক্সট্রা অর্ডিনারি জেন্টলমেন" চলচ্চিত্রে অ্যালান কোয়াটারমেইনের ভূমিকায় শন কনারিকে আসলেই দারুন মানিয়েছিল। তবে কাহিনি অদ্ভুতুড়ে হলেও এই ছবিটাও কিন্তু আমার মজাই লেগেছে
****************************************
চরিত্র বেশী হওয়াতে অধিক সন্ন্যাসীতে গাঁজন নষ্ট হয়ে গেছিল!
facebook
অনুবাদে খসরু চৌধুরী অসামান্য; তাঁর প্রায় প্রতিটি লেখা আমার পড়া।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির স্নাতক, নওগার (??) কাছে গয়েশপুর গ্রামে নিবাস।
উনার ভৌতিক অভিজ্ঞতার একটি সিরিজ রহস্য পত্রিকাতে চলতো, এক কথায় অপূর্ব। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতের কথা শুনেছিলাম, খসরু চৌধুরীর লেখাতে সেই ভূত আমার চোখের সামনে চলে এসেছিল।
উনার সাথে দেখা হলে অভিজ্ঞতার কথা লিখে জানাতে ভুলবেননা।
গয়েশপুর আমার দাদা বাড়ী পাশের গ্রাম, আসলে আমাদের এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় সেখানে থাকেন, কতবার যে গেছি সেখানে, কিন্তু কোনদিন জানতাম না যে খসরু চৌধুরী সেখানে থাকেন!
চেষ্টা করব-
facebook
এলান এন্ড দ্যা হলি ফ্লায়ার আর সলোমনের গুপ্তধন পড়ছি।সেবার বই কিনতে সূদুর সিলেট যেতে হত।বছরে যে দু'তিনবার যাওয়া হত লুকিয়ে
তিন গোয়েন্দা আর মাসুদ রানা কিনা হত।
পড়ে ফেলব,পড়ে ফেলব আমার আর সহ্য হচ্ছেনা…
আর আপনাতো লেখা ভাই কী বলব। কিছুই বলার নেই শুধু পড়া ছাড়া…
ধন্যি আপনার অধ্যবসায়
facebook
অনেকদিন পর আজকে সকালেই (আসলে গতকাল হবে) দেখা হলো খসরু ভাইয়ের সাথে। সেবায়। উনি নওগাতেই থাকেন। আগে আপনার লেখাটা চোখে পড়লে উনাকে দেখাতে পারতাম। দেখি আগামীকাল ফোনে পাইনাকি।
যদি ভাব কিনছ আমায় ভুল ভেবেছ...
এসে যোগাযোগ করব।
facebook
লেখাটা পড়ে খুব বেশি ভালো লাগলো অণুদা। আপনার সব লেখাই নিয়মিত পড়া হলেও এটা ক্যাম্নে মিস গেলো বুঝতে পারছিনা।
যাই হোক, শৈশব-কৈশোর এর স্মৃতিগুলো এক পলকে ফিরিয়ে আনার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আসলে শৈশব-কৈশোরের কথাই বা বলছি ক্যানো, হ্যাগার্ডের যে কোন বই-ই তো বারবার পড়ার মতো। আর তার উপর যদি হয় অ্যালান কোয়াটারমেইন এর বই, তাহলে তো কথাই নেই। সেই ক্লাস এইটে থাকতে পড়েছিলাম "অ্যালান কোয়াটারমেইন"; অ্যালানের জীবনের শেষ অ্যাডভেঞ্চার, কোন সন্দেহই নেই সবচাইতে রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারও বটে! সেই জু-ভেনডি! দেশটাকে ভালোই বেসে ফেলেছিলাম। কি চমৎকার বর্ণনা ছিলো! আজো চোখ বন্ধ করলেই মনে করতে পারি নিজের মতো করে সাজানো সেই জু ভেনডি দেশ আর দেশের মানুষগুলোর কথা, সেই যুদ্ধের কথা, সেই দুই রাণী নাইলেপথা-সোরাইসের কথা আর সেই আমস্লোপোগাসের কথা!! আর সেই ভালোলাগার পেছনে সবটুকু কৃ্তিত্বই দিতে চাই খসরু চৌধুরীকে। অনবদ্য অনুবাদের জন্য সব পাঠকরাই তার কাছে কৃতজ্ঞ বোধ করি।
দেখা কি হয়েছিলো এবার তার সাথে? দেশে যখন এসেছিলেন? তার শুভাকান্ক্ষীদের শুভেচ্ছা তার কাছে পৌঁছে দিয়েছেন আশা করি।
হ্যাগার্ডের অন্য বইগুলো নিয়েও লিখবেন এই আবদার রইলো।
ধন্যবাদ,
জু ভেনডির দিকে নিজেই যাত্রা শুরু করব শীঘ্রই, জানাব
facebook
বরাবরই আপনার লিখা পড়ে মুগ্ধ হই, এবারো এর ব্যতিক্রম হলো না ...
(উম্মাদ)
নতুন মন্তব্য করুন