আমার সবচেয়ে প্রিয় বাংলা গান আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, বাচ্চাবেলা থেকেই যখন খালি পায়ে প্রভাত ফেরীতে যেতাম কোন এক অজানা আবেগে আ-আআ-আ এই সুরটাতে টান দেবার সময় শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠত, চোখের কোণ ভিজে উঠত, কিন্তু ঠিক কোন কারণে তা বলতে পারি না। আর টেলিভিশনে যখনই জহির রায়হানের অমর সৃষ্টি জীবন থেকে নেয়া দেখানো হত, সেখানে প্রভাতফেরীর দৃশ্যে অন্যলোকের সুরমূর্ছনা নিয়ে বেজে উঠত জগত উতালপাথাল করা গানটি। ৫২-এর ভাষা আন্দোলনে নিজের ভাষার জন্য দখলদারদের বুলেটের মুখে বুক চিতিয়ে লড়াই করে যাওয়া নির্ভীক মানুষগুলোর কথা মনে করে বুক ফুলিয়ে বাংলায় একটা চিৎকার দিতাম মাঝেই মাঝেই, এখনো দিই, মনের মাঝে সুর বেজে ওঠে- ও আমার বাংলা মাগো, চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণের বাজায় বাঁশী।
আর একটা স্বপ্ন ছিল- ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে একটা প্রভাতফেরীতে অংশ নেওয়ার, সবার সাথে প্রাণ মিলিয়ে প্রিয় গানটি সবাইকে ছুঁয়ে গাওয়ার। কোন ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় যাওয়া হয় না, নিজের শহর রাজশাহীর একাধিক শহীদ মিনারে যাওয়া হত বাবার হাত ধরে, বন্ধুদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, কিন্তু ঢাকার প্রভাতফেরী, শহীদ মিনারের উদীয়মান লাল টকটকে সূর্যটা ছোঁয়া হয়নি কখনোই।
এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে অবস্থানের সুবাদে প্রথম থেকেই তিরতির আবেগে কাঁপছিলাম ঢাকায় প্রভাতফেরীর অংশগ্রহণের সম্ভাবনার আনন্দে, সেইসাথে ছিল বইমেলার লোভ আর শুরু হয়ে গেল ইতিহাস- শাহবাগ! ইতিহাসের সাক্ষী হবার সৌভাগ্য কতজনের হয়ে থাকে? আমাদের হয়েছিল, ঝাঁঝালো শ্লোগানে মুখরিত প্রজন্ম চত্বরে, লাল-সবুজ একখণ্ড মানবিক বস্ত্র আড়াল করে দিয়েছিল বাকী বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, আর অদূরেই আম্মার বিশাল প্রতিকৃতি, যেন মনে করিয়ে দিচ্ছিল প্রতি মুহূর্তে- জয় আমাদের হবেই।
২১ ফেব্রুয়ারির সারা রাত শাহবাগে উদযাপনের জন্য অন্যান্য সচলদের সাথে যোগাযোগ শুরু হয়েছিল কয়েকদিন ধরেই, অনেকেই বললেন তারা সন্ধ্যার পরে এসে বেশ কয়েক ঘণ্টা থাকবেন, কেউবা সারা রাত, একেবারে সূর্য উঠিয়ে ফিরবেন বাড়ীতে। শাহবাগে সেদিন জনতার ভিড়ে তিল ঠাই নেই, থাকবার কথাও নয়, একুশের চেতনা দোলা দিয়েছে সকলকে, সেই সাথে আকাশ কেঁপে উঠছে রাজাকারের ফাঁসি চাই, কাদের মোল্লার ফাঁস চাই শ্লোগানে। ঢাকায় নতুন বিধায় প্রায় এসকর্ট করে নিয়ে গেলেন তপতী এবং অন্দ্রিলা, তাদের সাথে কথা বলতে বলতেই খুঁজে পাওয়া গেলে একে একে অনেককেই। সাথে ছিলেন জুন ভাই, তানিম এহসান, প্রিয়ম মজুমদার অভি, সাঁঝের আঁধারের সাথে সাথে আসল খেকশিয়াল, ভাস্কর দা, শাহেনশাহ্ সিমন, সাইফ, অকুতোভয় বিপ্লবী সহ অন্যরা। আরও পরে যোগ দিলেন অরফিয়াস, তারেক রহিম, মণিকা রশিদ, রাতঃস্মরণীয়, দুষ্টু বালিকা, বুনোহাঁস। এরমাঝে ধুমকেতুর মত উদয় হয়ে সবাইকে আনন্দে ভাসিয়ে আবার সৌরজগতের অন্য প্রান্তে চলে গেলেন সবার প্রিয় ব্যানার্জী স্যাম এবং রসের হাড়ি চরম উদাস, রাস্তার পাশের এক মঞ্চে বসে সবাই গলা মিলাল স্লোগানে, মাঝে মাঝেই কিন্নরকণ্ঠের রেশ ছড়িয়ে গেল মণিকাদির কল্যাণে, চলতে লাগল আড্ডাবাজি। হঠাৎ এসে হাজির হলে আরিফ জেবতিক, পূর্বপরিচয় না থাকায় কেবল আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাঁক দিলেন- আরে ভূ-পর্যটক, আমিও উত্তর দিলাম- গানম্যান কোথায়? ( তখন কয়েকজনে ব্লগারের নিরাপত্তার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে গানম্যান দেবার কথা উঠেছিল)। সচলের অনেকের সাথেই প্রথম দেখা হল, অনেক পাঠকও এসে কুশলাদী জিজ্ঞাসা করে গেলেন, দেখা হয়ে গেল দেশের প্রথম মহিলা এভারেস্টজয়ী নিশাত মজুমদারের সাথে, ভিড় বাড়তেই থাকল মধ্য রাতের দিকে, সেই সময়ে রাষ্ট্রের নানা মান্যগণ্যদের শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাবার কথা, তাই আড্ডায় সিদ্ধান্ত হল আরও কয়েক ঘণ্টা পরে সবাই মিলে যাওয়া হবে শহীদ মিনারের দিকে। যদিও রাত সাড়ে বারোটার পরে ভিড় কিছুটা কমে গেল। ঝিম তাড়ানোর জন্য সুযোগ পেলেই চা, সেই সঙ্গে টা খাওয়া চলছিল সমান তালে।
রাত দেড়টার দিকে দেখি তিনজন শাড়ি পরা তরুণী হেঁটে হেঁটে শহীদ মিনারের দিকে যাচ্ছে, তিন জন শাড়ি পরা তরুণী, সাথে কোন বাবা নেই, ভাই নেই, মামা নেই, প্রেমিক নেই, বন্ধু নেই! কি যে ভাল লাগল দেখে। তারা সন্মান করেছিল শাহবাগের তরুণ প্রজন্মকে, তারা জানত কোন শালীনতার হানি হবে না প্রজন্ম চত্বরের বন্ধুদের দ্বারা। কি যে অপূর্ব ভালোলাগায় ভরে গেলে আমাদের পৃথিবী, আমি মুগ্ধতার আবেশে অনেকক্ষণ কথা বলতে পারি নি।
কায়রোর তাহরির স্কয়ারে শত শত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল, কিন্তু শাহবাগে ০, যদিও ছাগু গ্রুপ, ছাপোষা সাংবাদিক, জামাত শিবির কত কলঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা করেছে শাহবাগের তরুণপ্রজন্মের নামে। সাইফ ভাই খানিকক্ষণ পরপরই হুংকার দিয়ে উঠছেন- শুনলাম শাহবাগে গাঁজা আর মেয়ে পাওয়া যায়, কুতায়? তাতে মজা পেয়ে আমাদের সাথে সাথে পথ চলা তরুণ-তরুণীরাও হেসেই যাচ্ছে।
অবশেষে রাত সাড়ে তিনটার দিকে, ধলপহরের আলো ঢাকার বুকে চুমু এঁকে দেবার আগে আগেই পৌঁছালাম সবাই শহীদ মিনারে, নিরাপত্তার কারণে মূল বেদীতে ওঠা নিষেধ ছিল, কিন্তু খাঁটি ভালোবাসা জানানোর জন্য দূরত্ব কোন ব্যপার নয় কোনসময়ই, বিশেষ করে সারা জীবনের অন্যতম একটি স্বপ্নপূর্ণ হবার আবেগে আমি আত্মহারা, অন্য সবার সাথে গলা মেলালাম প্রিয়তম গানটিতে-
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি,
আমি কি ভুলিতে পারি
মন্তব্য
যে হারে "ড়" দিয়ে "র" কে প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে, বাংলা একাডেমি না সেটাকেই আবার নিয়ম করে দেয়। অন্য অনেকের লেখায় দেখেছি, আপনার লেখায়ও চোখে পড়লো (পরা/পড়া)।
এতজন মিলে আড্ডা দেবার যে আনন্দ, বিশেষ করে ক্যাম্পাসগুলোতে, সেটা আর কোথাও পাওয়া যায় কিনা জানি না। আপনার লেখা পড়ে আবারো ক্যাম্পাসের সময়গুলোর কথা মনে পড়ে গেলো।
ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .
এতজন মিলে আড্ডা দেবার যে আনন্দ, বিশেষ করে ক্যাম্পাসগুলোতে, সেটা আর কোথাও পাওয়া যায় কিনা জানি না।
facebook
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
facebook
রাত দেড়টার দিকে দেখি তিনজন শাড়ি পড়া তরুণী হেঁটে হেঁটে শহীদ মিনারের দিকে যাচ্ছে, তিন জন শাড়ি পড়া তরুণী, সাথে কোন বাবা নেই, ভাই নেই, মামা নেই, প্রেমিক নেই, বন্ধু নেই! কি যে ভাল লাগল দেখে। তারা সন্মান করেছিল শাহবাগের তরুণ প্রজন্মকে, তারা জানত কোন শালীনতার হানি হবে না প্রজন্ম চত্বরের বন্ধুদের দ্বারা।
কোথায় যাচ্ছেন এইবার?
জানাব--
facebook
আমার নাম কোই অণু?
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
আর কেউ বাদ পড়ল নাকি !
facebook
ফেব্রুয়ারী তে তুমি বাংলাদেশ এ আছো জানতাম। ২০'র সন্ধ্যারাত থেকে ২১'র মধ্যরাত অবধি আমিও শাহবাগ এ ছিলাম। কিন্তু তুমি যে সেসময় ঢাকায় থাকবে তাতো টের পাইনি। দেখা হয়ে গেলে ভালো লাগতো।
রাত-প্রহরী
পরের বার!
facebook
লেখাটা পোড়ে অনেক ভালো লাগলো
facebook
গানটা আমারও অনেক প্রিয়। যখনই শুনি গায়ে কাটা দিয়ে উঠে।
facebook
আব্দুল্লাহ এ।এম।
facebook
নতুন বিবাহ হবার কারণে রাতে যেতে পেরেছিলাম না এবার। পরের বার যাবো সারা রাত থাকবো আম্রা দুজন।
--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি
কোন দুজন ?
facebook
কেন আমি আর আমার বর!!!
--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি
বোরিং!
facebook
অনেক ধন্যবাদ লেখাটির জন্য, কিছুদিন পর যখন অনেক কিছু মনে থাকবেনা - অণুদার এই লেখা পড়ে ঠিক আবার সব কিছু চোখের সামনে সব ভেসে উঠবে ।
facebook
লেখকের উচিত ছিল পরা/পড় ‘র মধ্যে সংশোধন টানা, একুশের চেতনা শুধু বুকে ধারণ করলে চলবেনা। কথায়, কাজে ,লেখায় তা প্রকাশ করতে হবে।
পোস্টের জন্যধন্যবাদ, শুভকামনা রইল।
তুহিন সরকার।
ধন্যবাদ
facebook
আমার যখন সাত-আট বছর বয়স তখন আমরা থাকতাম নাটোরের সিংড়া উপজেলায়। গান শিখতাম ওখানকারই একটা গানের স্কুলে। প্রত্যেক একুশে ফেব্রুয়ারীতে গানের স্কুল থেকে অনুষ্ঠান। করা হত আর ফেব্রুয়ারীর শুরু থেকেই শুরু হত তার জন্য রিহার্সেল। মাসজুড়ে প্রতিদিন বিকালবেলা এই গানটা গাইতাম। সেই থেকে এই গানের প্রতিটা শব্দ আর সুর খুব আপন মনে হয়।
এখনো ফেব্রুয়ারী মাসে যেকোন দিক থেকে 'আ-আআআআ' ভেসে এলেই ভেতর থেকে একটা অদ্ভূত শিহরণ টের পাই!
এখনো ফেব্রুয়ারী মাসে যেকোন দিক থেকে 'আ-আআআআ' ভেসে এলেই ভেতর থেকে একটা অদ্ভূত শিহরণ টের পাই!
facebook
একুশের ওই রাত আমার জন্যও খুব স্মরণীয় রাত ছিল।
facebook
ঈর্ষা!
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
নতুন মন্তব্য করুন