দেশের বাহির প্রথম এসে পড়েছিলাম বিশ হাজার লোকের এক অপূর্ব মায়াকাননে, মধ্য ফিনল্যান্ডের ভারকাউস নামের এক ছোট্ট শহরে ( এই লেখায় সামান্য বর্ণনা আছে), বইতে দেখেছিলাম সেখানে আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মেকানিক্যাল মিউজিক মিউজিয়াম! কী খটোমটো নাম রে বাবা! কিন্তু তাদের সংগ্রহে নাকি আছে সারা বিশ্ব থেকে সংগ্রহ করা অদ্ভুত সব সুরযন্ত্র যারা নাকি আপনা থেকেই বাজিয়ে যায় অপূর্ব সব সুরলহরী। নামের বিপরীতচিত্র পুরা! আর এমন জাদুঘর সারা গ্রহে আছে মাত্র ৪০টি।
আপনা থেকেই যন্ত্র বাজে নাকি? তাদের তো মানুষ দিয়ে বাজানো হয়, মানুষেরা গলা থাকে না, কেবল যন্ত্রের শব্দমালা খেলা করে( বিটিভিতে যন্ত্রসঙ্গীতের অনুষ্ঠান হচ্ছে শুনলেই ঘর থেকে পালিয়ে যেতাম, সেই আমিই আজ কী অমোঘ আকর্ষণে দিনভর শপ্যা, মোজার্ট, বিটোভেন, বাখ শুনি তা অবশ্য বলতে পারি না), কিন্তু এই বিশেষ জাদুঘরের যন্ত্রগুলো শুনলাম কোন মানুষ বাজায় না, কেবল বিশেষ জায়গায় চাপ দিয়ে চালু করে দিলেই হয়, তারা বেজে যায় আপন যন্ত্রে! সেই বিশেষ জাদুঘরটি পর্যটকদের জন্য ভারকাউস শহরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ, আবার মাঝে মাঝে সারা ফিনল্যান্ডের মাঝেও সবচেয়ে বেশী পর্যটক আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয় বলে বিশেষ পুরস্কারও পেয়ে থাকে।
জাদুঘরটি এক ইয়ুর্গেন কেইম্ফ নামের এক জার্মান ভদ্রলোকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ, উনার ফিনিশ স্ত্রী লিসা এবং ছেলে পাভেলকে নিয়েই মূলত এর দেখভাল করেন, পুরো শীতকাল জাদুঘর বন্ধ থাকে, উনারা তখন নানা যন্ত্রের পরিষ্কার এবং মেরামত সাধন করেন, অন্য দেশ থেকে দরে বনলে নতুন নতুন যন্ত্রও আনান, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিলামের ডাক থেকে অকেজো মাল কিনে নিজেরাই সারিয়ে তোলেন। বছরের বাকী সময়টুকু জাদুঘর দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। ফিনিশ, জার্মান, ইংরেজি ভাষায় গাইডেরা ধারাবর্ণনা দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখায় এত অনন্য সম্ভার। টিকেটের মূল্য ১৪ ইউরো। এই যে তাদেরওয়েবপেজ ।
বেশ কিছু বছর ভারকাউসে থাকার সুবাদে অনেক বার জাদুঘরটিতে যাওয়া হয়েছে, পকেটের টাকা দিয়ে কোন সময়ই টিকেট কাটতে হয় নি অবশ্য তার মূল কারণ ইয়ুর্গেন কেইম্ফ আমার খুব ঘনিষ্ঠ একজন বন্ধু হয়ে গেছিলেন প্রথম সাক্ষাতেই। এখন ৬৫ ছুঁই ছুঁই ভদ্রলোক, কর্মচাঞ্চল্যে ২০ বছরের তরুণকে হার মানাবেন, সারা দিন দৌড়ে বেড়াচ্ছেন কোন না কোন কাজে, সেই সাথে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করেন সবার আগে।
মনে পড়ে প্রথম পরিচয়েই হাত ঝাঁকুনি দিয়ে চোখ মটকে বলেছিলেন - I am officially an atheist, তার মানে অবশ্য ব্যাখ্যা করেন নি। সেই সাথে ব্যপক রাজনীতি সচেতন মানুষ, মারাত্নক অ্যান্টি-কম্যুনিস্ট, অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট। নানা দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা তাদের জাদুঘরে অতিথি হিসেবে দর্শন দিতে এলে উচিৎ দুকথা বলতে ছাড়েন না সেই দেশের চলমান রাজনীতি নিয়ে, শেষবার জাদুঘরটিতে যাওয়া হয়েছিল গেল শরতে, যখন আমার মা এখানে বেড়াতে এসেছিলেন। সেই সময়ের কিছু ছবি এবং আগের নানা বারের অভিজ্ঞতা শুনতে শুনতে চলুন ঘুরে আসি বিশ্বের সবচেয়ে বড় সুরযন্ত্র জাদুঘর (Mechanical Music এর বাংলা হিসেবে সুরযন্ত্র ব্যবহার করার ধারণা দিয়েছেন হিমু ভাই) থেকে।
ইয়ুর্গেনের বিশাল বাড়িটাই আসলে জাদুঘর, বা বলা চলে জাদুঘরের এক অংশে উনি থাকেন। আর সেই সাথে দুটো রঙ ঝলমলে ম্যাকাও পাখি এবং একটি পাহাড়ি ময়না ( পাহাড়ি ময়না খাঁচার পাখি না, এটাকে বন্দী রাখা বেআইনি, কিন্তু নিতান্ত মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছিল বলে এখানেই তার যত্ন চলছে) ।
এর পরের বিশাল সংগ্রহশালা, তা দুই তলায় নানা কক্ষে বিভক্ত। একের পর এক উল্লেখযোগ্য যন্ত্রের ইতিহাস ও কাজ টকঝালমিষ্টি ভাষায় বর্ণনা করে যান ইয়ুর্গেন, তারপর সেটাকে বাজিয়ে শোনান, মানে বিশেষ কোথায় চাপ দেন, ব্যস দেখি সেটা আপনা থেকেই বাজতে শুরু করে। বিশেষ করে পিয়ানোগুলোতে যখন সাদা-কালো চাবিগুলো ছন্দের তালে তালে উঠানামা করতে থাকে, তখন কেমন যেন অপ্রস্তত করা গা ছমছমে অনুভূতি হয় বৈকি! সেই সাথে একটা বেহালা দেখলাম যা সুইচ টেপার পর আপনা থেকেই ছড় দুলিয়ে দুলিয়ে সূরমূর্ছনা তৈরি করে যায় বিমূঢ় দর্শকের সামনে।
আছে কিছু অদ্ভুত রেকর্ড প্লেয়ার, সেখানে বুলেটের অসংখ্য ছিদ্রের মত ধাতব প্লেট গুলো ঢুকিয়ে দিলেই মোলায়েম স্বর্গীয় বাতাসের মত সঙ্গীত শোনা যায়, সেই সাথে আছে আধুনিক যুগের রেকর্ড আর মান্ধাতার আমলের রেকর্ড প্লেয়ার।
এই জাদুঘরের সবচেয়ে বিখ্যাত সংগ্রহ একটি বিশাল পিয়ানো যার নাম গোলায়েথ পিয়ানো, এটিও নিলামে কিনে কর্মক্ষম করে তোলা হয়েছে, দাম এখনকার বাজারে ১ মিলিয়ন ইউরোর বেশী।
যা বলেছিলাম ইয়ুর্গেনের রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে, জার্মান এক প্রাচীন পত্রিকার উপর সে পা রেখে লাফাল খানিকক্ষণ তাতে লেখা দুইভাই- ছবি আছে হিটলার এবং স্ত্যালিনের! এরপরে শুভ্রদাড়িওয়ালা, কালো হ্যাট পড়া এক বৃদ্ধের ছবি দেখিয়ে প্রশ্ন করল- বলো দেখি ইনি কে? কেউ উত্তর দেবার আগেই হৈ হৈ করে বলবেন – না না কার্ল মার্ক্স নয়, মার্ক্স আমার বন্ধু না। এই লোক আমার সত্যিকারের বন্ধু, নাম চার্লস ডারউইন ! আর তার কড়া হিসেব, জাদুঘরে থাকার সময় মোবাইল ব্যবহার করা যাবে না, সে যেই-ই হোক, একবার লিথুয়ানিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে বেশ ঝাড়ি দিয়েছিল ট্যুরের সময় মোবাইলে কথা বলার জন্য।
কিছু কিছু যন্ত্রে ভাজ করা কার্ড ঢুকিয়ে হাতল ঘোরাতে থাকা অবস্থার সুরলহরীর সৃষ্টি হল, প্রতিটি মিউজিকের জন্য আলাদা আলাদা কার্ড। তাতে সুর অনুযায়ী নানা ছিদ্র, হঠাৎ দেখে মনে হতে পারে যে ফাজিল উইপোকার দল এই যথেচ্ছ কাজ করে গেছে, কিন্তু আসলে এই সৃষ্টিশীলতার পেছনে আছে কিছু মানুষের অসাধারণ উদ্ভাবনী শক্তি আর সঙ্গীতের প্রতি পরম মমতা।
কয়েকটা ঘরে আছে বিচিত্র সব ভাস্কর্য, মজা হচ্ছে সবগুলোই কোন না কোন সুরযন্ত্রের অংশ, নিচের ছবিতে যে দাঁড়কাক কাঁধে ফন দেখছেন সেও বাঁশী বাজানো শুরু করে লাল চোখ মেলে সুইচে চাপ পড়লে,
আবার এই ভদ্রলোকরা রীতিমত বাজনা বাজায় আমাদের মজা দেবার জন্য, তাই মায়ের সাথে ইয়ুর্গেনের ছবি তোলা হল তাদের সাথে।
আর এই দড়াবাজিকর সুরের তালে তালে চেয়ারের উপরে ভর দিয়ে নানা কসরত দেখান, ( আসলে পরের বার গেলে ভিডিও করে আনতে হবে)।
একটা সবুজ রঙে পিয়ানো দেখিয়ে ইয়ুর্গেন বললেন, বিশ্বে এমন পাগল দেশ একটাই আছে যারা সবুজ রঙের পিয়ানো বানায়, সুইডেন অবশ্যই! এমন আরও নানা মজার মজার কথাতে মাতিয়ে প্রায় ঘণ্টাখানেকে আমাদের ঘুরিয়ে দেখাল তার অপূর্ব সংগ্রহশালা। জানালেন ইদানীং তারা পুরনো সুরযন্ত্র মেরামত করে বিক্রিও করছেন, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেকেই এগিয়ে আসছেন ক্রেতা হিসেবে।
সুরযন্ত্রের প্রতি তার নিষ্ঠা এবং ভালবাসা অবাক করে আমাকে সবসময়ই, মনে হয় সেই সৃষ্টিশীল মানুষগুলোর কথা যাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতার কাঁধে ভর দিয়ে মানবসভ্যতা এগিয়ে যায়। গত ক্রিসমাসেও ইয়ুর্গেন এসএমএস করলেন There is no god but only musik ( জার্মান তো Musicকে Musik লেখেন মনের ভুলে !) আর মা বলেছিলেন এই অসাধারণ জাদুঘরটিতে না আসলে তার ইউরোপ ভ্রমণ সম্পূর্ণ হত না কখনোই।
মন্তব্য
দারুন বরাবরের মতই।।।।।আপনি মোট কতগুলা দেশ ঘুরেছেন বলেন ত!!!!!!!!!!
একটাই ঘোরার চেষ্টা করে যাচ্ছি , বুড়ো পৃথিবী তার নাম
facebook
বড়ই উচ্চমার্গীয় জবাব।
নাহ, সরল কথা
facebook
কবে যাবো বিদেশে আহারে...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
দেশই বিদেশ, বিদেশই দেশ
facebook
আমার মত আলসেদের বিদেশে থেকেই বা কি হল? এসব ঘুরে ঘুরে দেখবার জন্যে একটা অদম্য স্পৃহা থাকা চাই। এই যে অণু আর আমি একই শহরে থাকি, এই মিউজিয়াম আমার থেকে ততটাই দূরে, যতটা অণুর থেকে; তবু আমার যাওয়া হয়নি। অণুর মাঝে দেখবার, ঘুরবার, জানবার এক অদম্য স্পৃহা আছে।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
হয়ে যাবে, কুন ব্যাপার না!
facebook
পোস্টটা যেন সুদূর ফিনল্যান্ড থেকে ভেসে আসা সুর। শুনতে ইচ্ছা করছে সুরগুলো।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
আসলেই ভিডিও করা দরকার
facebook
দারুন!
****************************************
facebook
বিশ্বজনে যোগে যেথায় বিহারো, সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও।
বাহ
facebook
আহা! চোখের সামনে দেখতে দেখতে হারিয়ে গেল কলের গান।
অডিও ক্যাসেট এখন জাদুঘরে, আর আপনে আসছেন কলের গান নিয়ে
facebook
আমি যেইসব হাউমাউখাউমানুষেরগন্ধপাউ মার্কা গান শুনি তাদের বেশিরভাগই উত্তরদেশীয়। নো ওয়ান্ডার তারা এতো ভালো গায়/বাজায় কারণ এদের এইরাম মিউজিয়াম আছে।
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
হাউমাউখাউমানুষেরগন্ধপাউ মার্কা
facebook
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
facebook
এসপোতে আমার দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু থাকে। ওখানে বেড়াতে গেলে এই মিউজিয়াম দেখতে ভুলব না। আপনি না থাকলে হয়তো এই অদ্ভুত সংগ্রহশালার কথা জানাই হত না।
এসপো থেকে ৩৫০ কিলো দূরে, ভারকাউস শহরে, অবশ্যই যাবেন। মালিক ব্যাটাকে আমার শুভেচ্ছা দিবেন সে যখনই যান
facebook
facebook
এই সুরযন্ত্র টা আমার খুব পছন্দ। সম্ভবত এটারই একটা ছোট সংস্করণ গত বছর ছোট ভাইএর থেকে উপহার পেয়েছি। ড্রামের গায়ে খাজ কাটা। বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের ধাতব পাত সেই খাজে বাড়ি খেয়ে খেয়ে বিভিন্ন মাত্রার কম্পন তুলছে। আমারটাতে হাতল দিয়ে ড্রামটা ঘুরাতে হয়। হ্যাপি বার্থডে গান বাজে। মন খারাপ হলেই এইটা বাজাই।
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
facebook
সুরের ভিডিও দেখার ইচ্ছা জাগল। আশাকরি অনতিদূরে তা পূরণ হবে। লেখা বরাবরের মতই । ভালো থাকবেন অনু দা।
চেষ্টা করব
facebook
মনপ্রাণ ভরে গেল!
চলতেই থাকুক...
facebook
নতুন মন্তব্য করুন