সতর্কীকরণ – নিরামিষভোজীদের জন্য অস্বস্তিকর হতে পারে।
রিও মহানগরীতে পা দেবার পরপরই ইসাইয়াস সেরণা বলল যেহেতু এটা আমাদের একসাথে ভ্রমণের শেষ গন্তব্য, আমাদের অবশ্যই উচিৎ হবে রিও সৈকতে আচ্ছাসে গড়াগড়ি করার পাশাপাশি একদিনের জন্য হলেও চুরাস্কোতে যাওয়া।
চুরাস্কো ? সে কী আচানক বস্তু? খায় না মাথায় দেয়?
পাড়ার দয়ালু মুরব্বী যেভাবে পরের গাছে ঢিল মেরে আম পাড়া বিচ্ছু ছোড়াকে হাসিমুখে উচিৎ-অনুচিত বোঝানোর চেষ্টা করেন, সেই সহৃদয় ভঙ্গীতেই ব্যাটা ঘাড় নেড়ে বলল- চুরাস্কো হচ্ছে ব্রাজিলিয়ান কাবাব খাবার জায়গা, যেখানে বারবিকিউ মেলে নানা ধাঁচে, এন্তার। কিন্তু দাম বেশ বেশী, তাই সে জমিয়ে রেখেছিল যাত্রাপথের শেষ গন্তব্যের জন্য, নগদ নারায়ণের কথা চিন্তা করে। এই সময়ের আমাদের লেমন গ্রাস হোস্টেলের কক্ষে আগমন ঘটল এক তাইওয়ানিজ জুজুৎসুবিদের, সে তার দেশের চ্যাম্পিয়ন। এসেছে ব্রাজিলের বিশ্ব সেরা জুজুৎসু স্কুলের তালিম নিতে। বেচারা নিজের দেশের সেরা অথচ ব্রাজিলে সারাদিন অন্যদের হাতে পিট্টি খাচ্ছে আর মাদুর পরিষ্কার করছে! যাই হোক, সে-ই বলল চমৎকার এক চুরাস্কোতে সে আমাদের নিয়ে যাবে, যেহেতু সে এখানে কয়েক মাস ধরে আছে, চিনে গেছে অনেক কিছুই। এবং এই কয়মাস থাকার পরেও সে হোস্টেলেই থাকে করান রিওর বাড়ী ভাড়া অনেক অনেক ব্যয়বহুল। ব্যাটা চোখে মটকে শুধু নিজের পেল্লাই বায়সেপ ফুলিয়ে বলল- আই অ্যাম এ মিট ইটার, ট্রাস্ট মি !
ব্যপক হুল্লোড় হল কয়দিন, সৈকত থেকে শুরু করে পাহাড়ে। পাথরের যীশু দেখলাম, দেখলাম ফ্যাভেলার মানব যীশুদের। লাপার নৈশ জীবন, ট্রান্সসেক্সুয়ালদের বিষাদে ঘেরা আঁধারে ঢাকা অধ্যায় । বিদায় নেবার সময় চলে আসছে ধীরে ধীরে, অবশেষে যেদিন সন্ধ্যায় বিমানরথে করে অতলান্তিক পাড়ি দেবার কথা সেদিন দুপুরে যাওয়া হল সদল বলে চুরাস্কো- অধম বঙ্গসন্তানের সাথে আছে দুই মেক্সিকান হুয়াদ ভিদাল ও ইসাইয়াস সেরণা, দলে নতুন মুখ জার্মান অস্ট্রেলিয়ান ফেলিক্স এবং সেই তাইওয়ানিজ বন্ধু, সে আবার অভিজ্ঞতার আলোকে জানাল চুরাস্কোতে মাংসের সাথে সাথে অনেক কিছুই মিলবে মুফতে, যেহেতু প্রথমেই বিল চুকিয়ে দিতে হবে, কিন্তু আমরা যেন অবশ্যই কোন কিছুই মুখে না দিই। বিশেষ করে সালাদ বা কোকাকোলা। কারণ, এগুলো পাকস্থলীতে গেলেই বুভুক্ষুর মতো খাওয়ার চাহিদাটা কমে যাবে, আর টানা যাবে না মাংসের পাহাড়! যে কারণে রেস্তরাঁগুলো ইচ্ছে করেই চোখে সামনের অন্যান্য খাবার সাজিয়ে রাখে এবং নিজে থেকেই কোমল পানীয় গছিয়ে দিতে চেষ্টা করে।
চুরাস্কো পৌঁছে টেবিল দখল করে বসা হল , ভেতরে মাংস আর চর্বির প্রাণ আইঢাই করা গন্ধ, পেটের ভেতরে মোচড় দেয়া আবহ, বাতাস যেন গরম হয়ে আছে ভাজা মাংসের স্পর্শে। মাংসখেকোদের জন্য স্বর্গরাজ্য। কেমন একটা আরামদায়ক উষ্ণতা ছড়িয়ে আছে কোণে কোণে, সেই সাথে আছে আমাদের নাস্তার পর কিছু না খাবার কারণে তৈরি হওয়া ক্ষুধাবর্ধক ক্ষুধা।
প্রথমেই টেবিলে দেখলাম একটা করে সবুজ চাকতি মত আছে, সেটা উল্টাতেই দেখি অপর পাশে লাল। শুনলাম চুরাস্কোতে খাবার সময় মানুষ এতই ব্যস্ত থাকে, বিশেষ করে তার মুখ যেহেতু সবসময়ই কিছু না কিছু চিবোতেই থাকে, তাই এই চাকতির ব্যবস্থা। সবুজ মানে মাংস দিতেই থাকে পাতে, দিতেই থাক, চলতেই থাকুক-
আর লাল মানে এখন বন্ধ, আপাতত কিছু দিও না, বা আমি আর পারব না।
অনেকেই এই কারণে বাজি ধরেও চুরাস্কোতে আসে যে দেখা যাক কে কতক্ষণ সবুজে টিকতে পারে। আর খাবার নিয়ে একের পর এক ওয়েটার আসতে থাকেন, দেখা গেল কেউ গরুর সিনার মাংস নিয়ে হাজির, এসে টেবিলে দাড়িয়ে এক ফালি করে কেটে দিল।
সে না যেতেই আরেকজন এসে হাজির কচি বাছুরের ভাজা মাংস নিয়ে।
তার পরপরই এসে গেলে চর্বিতে ভাজা কলজের টুকরো।
মানে আপনার মন, মুখ, হাত সবই ব্যস্ত। কেবল চোখ বাদে, কারণ খাওয়ার আনন্দে আপনি দুই চোখ বন্ধ করে মজাছে চিবিয়ে যাচ্ছেন, যেন জগতের সকল সুখ এরই মাঝে নিহিত।
আর সেই মাংসের স্বাদ? আহ, মরি মরি, কিছু অংশ ছিলে একেবারে মাখনের মত মোলায়েম, মুখে দেওয়ার পট জিহ্বার টাকরা পর্যন্ত গেল না গেল না, তার আগেই মুখগহ্বরে আরামদায়ক উষ্ণতা ছড়িয়ে মিলিয়ে গেল। ঘাড়ের মাংসের একটা ডিশের কথা খুব মনে আছে, চিবানোর সময় কেমন যেন কচকচ শব্দ হচ্ছিল, এমন সুস্বাদু মাংস জীবনে খুবই কম খেয়েছি। আমাদের মত মশলাদার খাবায় নয় কিন্তু, গ্রিলই মূলত করা হয়েছে লবণ, পিপার, মরিচের গুঁড়ো ছিটিয়ে।
আমাদের মাঝে সবার আগে পিঠ প্রদর্শন করে লাল চাকতি উপুর করল ইসাইয়াস, তাকে দুষ্টু মিষ্টি টক ঝাল কড়া মন্তব্য শুনিয়ে খাওয়া চালিয়ে গেলাম আমরা দুই হাতেই। সবই যে গোমাংস ছিল টা কিন্তু না,কিচেন থেকে বাহির হওয়া একজনের হাতে দেখি বিশাল শিকের মত, তাতে ক্ষুদে ক্ষুদের কি গাঁথা! কী সেগুলো? জানা গেল রসুনে ডুবিয়ে সেদ্ধ করা এবং ভাজা মুরগীর হৃৎপিণ্ড, মানে কিনা যাকে আমরা বলি জিউ। খেলাম গোটা কয়েক, কোনটাই বেশী করে খাওয়া হয় নি, কারণ মূল লক্ষ্য ছিল যতগুলো পারি আইটেম চেখে চেখে দেখব।
শুধু বেশী ভালো লাগায় ঘাড়ের মাংসের ডিশটা আরেকবার চাইতেই হল, আহা জগত অমৃতময়! আসল পিছনের পায়ের রগ জাতীয় অংশ, এমনকি গলার ঝুলকম্বল পর্যন্ত! মাংসের দোকান তো না, যেন উচ্চমার্গীয় রন্ধনশিল্পের প্রদর্শনী।
টানা খাবার চলল বেশ খানিকক্ষণ, তারপর হজমের জন্য একটু কোমল পানীয়, আবার খাওয়া। সবার শেষে বিল, জনপ্রতি মনে ৪০ ডলার করে ছিল, কিন্তু সুদেআসলে উঠিয়ে আনা গেছে সেটা। সেই তৃপ্তি নিয়েই সবাই বাহির হবার সময়ই সিদ্ধান্ত হল-- যে পরিমাণ খাওয়া হয়েছে, ট্যাক্সি না, হোস্টেলে ফিরব পদব্রজে!
( এই লেখাটি ভোজনরসিক, সত্যিকারের খাইয়ে শাহেনশাহ্ সিমনের জন্য।
মাংস খাওয়া নিষেধ হবার কারনেও চুরি করে মাংস খেয়ে সিমন এক ভোজনরসিক গ্রুপের ওয়ালে লিখেছিল এই সেদিন- সবরকমের শঙ্কাকে মায়রেবাপ বইলা আপিস শেষে গ্যালাম বনানীর "চাপ সামলাও" এ। ছোটখাটো সাইজের দোকান, দেয়ালে যাবতীয় "চাপ" এর ছবি। ওয়েটারদের টিশার্টে লেখা কোপা সামসু। আর কিচেনকুক দের টিশার্টে লেখা জুম্মন কসাই। আর খাওয়া হলো চিকেন আর বীফ। চাপ এবং বটি কাবাব। নিলাম এক প্লেট চিকেন বটি (ডাক্তারের কথা কিছু হলেও মানতে হয়)। ২টা লুচি, বেশ কিছু সালাদ আর অনেকগুলা বটি কাবাব নিয়ে আসলো। স্বাদ ফাটাফাটি। মূল্য ২১০ টাকা মাত্র! খেয়ে আর এনভায়রনমেন্টে বেশ মজা পাইছি।
হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা লড়াকু সিমন জলদি জলদি সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরবে, আমরা সুখাদ্যের সন্ধানে স্বর্গ মর্ত্য পাতাল খুঁজে ফিরব এই আশায় বুক বাঁধি।
দেখতে পাচ্ছি, এই লেখা পড়ে সিমন বলছে – তারেক অণু একটা বদলুক, এখান চুরাস্কো পামু কুতায়?
কোন সমস্যা সিমন, ভাই আমার, ভাল হয়ে ওঠ, তো পাকস্থলীটা যেন আবার গরুর মাংস হজম করে জলদি, তারপর দেখব কত খাইতে পারিস। )
মন্তব্য
দিলেন তো এইই সন্ধায় খিদাটা লাগাইয়া >:(
facebook
তারেক ভাই, দুপুরে কিছু খাইনাই, আর এই ভোর সন্ধ্যায় আপনার এই জাতীয় পোস্ট আমাকে পৈশাচিক কষ্ট দিচ্ছে।
আসলে, আমারই লেখা উচিত ছিল যে - ভরপেটে পড়বেন!
facebook
সাগর সৈকতের বাতাসটাই এমন ক্ষিদে-জাগানিয়া ! কেমন চনমনে অনুভূতি হয় । আহা ! হলুদ চাকতির ব্যবস্থা থাকা উচিত, মানে হল 'রোসো, একটু জিরিয়ে নিই' ।
রোসো, একটু জিরিয়ে নিই' ।
facebook
আহারে, ছেলেটা খেতে খুব ভালোবাসে...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আবার খাবে, অবশ্যই - আশায় বুক বেঁধে আছি-
সিমন এখন কেমন আছেন? প্রার্থনা করছি, সেরে উঠবেন শিগগীর।
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
ঠেসে ঠেসে খাওয়াব, ভাল হয়ে উঠুক একবার
facebook
লেখাটা পড়া শুরু করতেই আমারো সিমন এর কথা মনে হয়েছিল - শেষে এসে দেখলাম ওর কথাই লিখেছেন।
facebook
শুধু গোমাংস খাবার জন্য হলেও চুরোস্ক যাওয়ার বাসনা রইল
facebook
facebook
শেষ কথাগুলোই কেমন যেন করে দিল।
facebook
আমি যে কি বলবো বুঝে পাচ্ছি না! শুধু মনে হলো নিজে না খাই অন্তত আমার বরকে খাওয়ানোর জন্য হলেও একবার যাওয়া লাগবে।
সিমন ভাইয়া আবার সব কিছু নিয়েই প্রতিযোগীতা করবে দেখো! আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।
--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি
এহ, আগে নিজে খা, তারপর বর টানিস !
facebook
আমি তো বিফ খাই না
--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি
তাহলে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকেন, এখানে কী?
facebook
সকাল সকাল লেখাটা পড়েই ক্ষিধেটা বেড়ে গেলো ।
আরাফ করিম
facebook
মনোমুগ্ধকর পোস্ট।
ব্রাজিলিয়ান খাবার এবং ভ্রমন নিয়ে সচলায়তনে একটা পোস্ট দেয়ার ইচ্ছা ছিল কিন্ত সাহস যোগাড় হয়নি। এই লাইনের ত্রাসের নাম তারেক অণু। বসে ছিলাম কবে আপনি একটা পোস্ট দিবেন। আশাকরি আসাই (Açaí), meat sandwich (ব্রাজিলিয়ান নামটা ভুলে গেছি) সহ ব্রাজিলিয়ান অন্যান্য খাবারের উপর আর একটা লেখা দিবেন।
আহসান
পিলিজ লেখা দেন
facebook
সকাল বেলা খালি পেটে অফিস এ এসে এই লেখা অভিশাপ পরবে আপনার উপর। আমার একখান প্রশ্ন ছিল, আপনি যে হারে খাওয়াদাওয়া করেন আপনার ত এতদিনে হাতি হয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু আপনার ত দেখি রাম্প মডেলদের মত ফিগার কেম্নে?
হা হা, সিকিরেট!
ওস্তাদ জ্যাকি চান যেদিন আইসক্রিম খান সেদিন ১৫ মিনিট বেশি দৌড়ান!
facebook
কথাটির অন্য অর্থ বুঝেছিলাম।
আব্দুল্লাহ এ.এম.
facebook
ধুরো!!!
ক্ষুধা লাগায় দিলেন!
এমনিতেই গরুর মাংসের নাম শুনলে ক্ষুধা বাইড়া যায়,তার মধ্যে যে বর্ণনা দিছেন...
সুবোধ অবোধ
facebook
জিব্বা দেইখা কি করুম ভাই???
লাগছে ক্ষুধা!!!
**********************
সুবোধ অবোধ
*************************
শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি কেন এত বোকা হয়?!!!
আমারও!
facebook
যতই চুরাস্কো-মুরাস্কো বলেন আমার কাছে খাবারের স্বর্গ হইলো চাংখারপুল,পুরান ঢাকা, এইখানের বিরানী-খিচুড়ি-তেহারি-চাপ না খাইলে জীবন রাখার মানে হয়না!!
আহ হাঁ! কি দরকার ছিল এসব বলার
facebook
যাক উল্টা তারেক অণুর ক্ষুদা লাগায় দিতে পারসি তাহলে, এখন বোঝেন ঠ্যালা!!
আইতেছি
facebook
যদ্দুর মনে পড়ে আমারে কইছিল চুরাস্কো মানে হাড্ডিছাড়া গরুর মাংস। আহা কি মজার জিনিস এই চুরাস্কো, এক্কেবারে বেহেস্তি আইটেম! ১৫ দিনে চাইর কিলো ওজন বাড়াইয়া তারপর প্লেনে কইরা বাড়িত আইছি!
টাইম পাইলে উরুগুয়ের বিফ স্টেক নিয়া একখান পোস্ট দিমু, জটিল জিনিষ!
...… জিপসি
উরুগুয়ের বিফ স্টেক
facebook
চুরাস্কো ভোজন বেশ হলো! লেখায়-দেখায় পৌনে পূর্ণভোজন।
facebook
এই হা করা ইমো দিয়ে খাবার গুলো ভেতরে পাঠান ।
facebook
আমার কাছে কিন্তু শুকর বেশি ভাল লাগে। গরুটা কেমন পানসে টাইপের।
জানিনা , এই বারে গরুই ভাল লেগেছিল
facebook
নতুন মন্তব্য করুন