গুরু সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন কাবুল শহর পরিভ্রমণে গেলে একখানা পুস্তক সাথে নিলেই চলে এবং তা নেওয়া অবশ্য কর্তব্য, সম্রাট বাবুরের আত্মজীবনী বাবুরনামা। সেই মোগল বাদশার আমল থেকে কাবুলের চেহারা বা রীতিনীতি নাকি এমন কোন পরিবর্তন হয় নি, কাজে কাজেই বাবুরনামা সাথে থাকছেই কাবুলের যাত্রাপথে সঙ্গী হয়ে যাযাবরদের কলিযুগেও ।
এই বিষয়ে কোনরূপ তুলনার ধৃষ্টতা নেই, কিন্তু বিশ্বের যে শহরটি সম্ভবত সবচেয়ে বেশী সময় জানা বিশ্বের রাজধানী বা কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল, যে একটি মাত্র শহর দুই দুইটি মহাদেশ জুড়ে অবস্থিত, সেই ইস্তাম্বুল ঘুরতে গেলে সাথে যে বইটি নিয়ে যাওয়া অবশ্য কর্তব্য সেটি ঐ মহানগরীরই বাসিন্দা ওরহান পামুকের আত্মজীবনী ইস্তাম্বুল। আমি অতি সৌভাগ্যবান যে ইস্তাম্বুলে যাবার আগে বইটি পড়া ছিল, ফলে সাথে ট্র্যাভেল গাইড লোনলি প্ল্যানেটের সাথে যেমন বিশাল কসমোপলিটানে অলিগলি ঘুরতে পারবেন, বিশাল সব প্রাসাদা আর ইতিহাসময় উপাসনালয় দেখতে পারবেন, তেমনি সুপ্রাচীন শহরটির কড়িকাঠ, পাথর, ধাতব পুরু আস্তরণ সরিয়ে যদি লাজুক আত্মার স্পর্শ পেতে চান তাহলে এর বিকল্প নেই, পড়তেই হবে পামুকের ইস্তাম্বুল।
বইয়ের প্রথম বাক্য থেকেই ছোট্ট ওরহানের জীবন কাহিনী, একেবারে শিশুকালে তার মানসিক জগত এবং তার উপরে মহল্লার বাড়ীগুলোর প্রভাব, বাবা, মা, পরিচিত ঘর, নিজের বিছানা সবই মূর্ত হয়ে উঠেছে পামুকের জাদুময় জীবন্ত লেখনীতে। আকাশ ছোঁয়া বিশাল ক্যানভাসে অবাক শিশুর মত মহাবিশ্বে নিয়ে খেলতে খেলতে নিজের অজান্তেই পামুক তার জীবনের সাথে আলতো জড়িয়ে ফেলেন পাঠককে, সম্মোহিত পাঠক দেখে সেই শিশুর শিশুতোষ চিন্তাগুলোর সাথে তার নিজের হারানো শৈশবের কতটা মিল! আধো আধো বোলে আমাদের নিয়ে ক্ষুদে ওরহান বাবা মার চৌহদ্দি পেরিয়ে নিয়ে যান পাশাদের প্রাসাদ আর মসজিদময় ইস্তানবুলের শহরতলীতে। সেখানে পুরনো পাথরের রাস্তায় চলছে নতুন বৈদ্যুতিক যান, ধ্বংসস্তুপের মাঝ থেকে চাড়া দিয়ে উঠছে নতুন প্রাণ। শীতের শহরে তুষারময় রাস্তার খণ্ডকালীন সৌন্দর্যে ঢেকে থাকে শীতের হিম, মনে পড়ে এক ডিসেম্বরে ইস্তাম্বুলের রাস্তায় পেঁজা তুলোর মত বরফ দেখে বিস্ময়ে স্রেফ হতবাক হয়ে ছিলাম, ভাবতেই পারিনি এত্ত এত্ত উষ্ণ জলের সাগর দিয়ে ঘেরা শহরেও শীত এমন জমাট বাঁধা আক্রমণ চালাতে পারে!
ঝকঝকে অট্টালিকার ভিড়ে আবছা আঁধারের ২৪ ঘণ্টার রাজত্ব যেখানে তেমন এক এঁদো গলিতে যখন নির্জনতা ভেঙ্গে অনুপ্রবেশ করলাম শতাব্দীপ্রাচীন রুস্তম পাশা উপাসনালয়ের খোঁজে, পামুক আমার সাথে থাকেন। মুগ্ধ শ্রোতার মত শুনতে থাকি তার নির্লিপ্ত নিখুঁত বিবরণ, মোড়ে দাড়িয়ে ধূসরবর্ণা শতচ্ছিন্ন কোট পরে থাকা কলা বিক্রেতা যে এত রহস্যের আঁকর তা আর কেউই জানে না, মুখ দিয়ে ভকভক ধেনো মদের গন্ধ উদগিরণ করা মলিন লম্বাটে মুখের ভাগ্যবলিয়ে, যার চেয়ে ঢের চকচকে ভাগ্যগণনার কাছে সাহায্যকারী খরগোশদুটো, নিঃস্পৃহ ভাবে কেবল তাকিয়ে থাকেন আমাদের গমন পথের দিকে, জীবনের সকল কৌতূহল বিকিয়ে দিয়েছে সে তরল গরলের কাছে, প্রাচীন অনেক সম্রাটের মতই।
শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া বসফরাসের তীরে যায় আমরা বুনো লোনা বাতাসে স্নানের জন্য, একদিকে ইউরোপ, অপরদিকে এশিয়াকে রেখে হাজার সৌখীন মাছশিকারি বড়শি ফেলেছে সেতুর উপর থেকেই, নিচেই রেস্তোরাঁ, সেতুর সাথে সংযুক্ত এবং বসফরাসে ভাসমান, মাছ ভাজার গন্ধে ত্রিভুবন পরাস্ত হবার আগেই একটা পাবলিক বাসে চেপে তাকসিম স্কয়ারের দিকে যাত্রা শুরু হয়। পামুক বলে যান বসফরাস ঘিরে তার জ্বলজ্বলে স্মৃতিগুলো, দস্তয়েভস্কির চরিত্রের মত কেমন ঘোর লাগা গলায় মূর্ত হয়ে ওঠে ভেনিসে নগরীর মতই ইস্তাম্বুলের জলরাস্তাগুলো, অতীত-বর্তমান এক হয়ে সেথা ঘুরপাক খেতে থাকে এক অদ্বিতীয় বন্ধনে। সুলতানদের কথা আসে মেঘের ভেলায় শব্দে, হারেমের রূপসী বন্দিনীর কান্না চাপা থাকে গরাদের আড়ালে, মর্মর সাগর থেকে কৃষ্ণ সাগরের দিকে ধেয়ে যাওয়া বাতাস আর গাঙচিলেরা ছাড়া তাদের কোন শ্রোতা নেই, ছিলও না আবহমান কাল ধরে।
পামুক তার বাবার কথা বলেন, যে বাবা আজীবনের স্বপ্ন ছিল লেখক হবার, সেই মায়াহরিণের পিছে ছুটে পরিবার ফেলে তিনি আত্মগোপন করেছিলেন প্যারিসের অখ্যাত হোটেলে, ভেবেছিলেন লেখকদের স্বর্গভূমির আলোবাতাসে কিছুদিন অতিবাহিত করলে হয়ত সাহিত্যদেবী তার কলমে ধরা দেবেন। তা আর হয় নি, বাবা ফিরে আসেন। পামুক তার মায়ের কথা বলেন, সেই অপরূপার একাকীত্ব, বেদনা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আনন্দ, সব কিছুরই ছবি আঁকেন শব্দতুলি দিয়ে আলগোছে। দাদীর আদরের কথা তার মনে আসে, ফিরে আসে টুল বেঞ্চির নানা রঙের দিনগুলির কথা, এবং আঁকা শুরু করার কথা, শত হলেও যৌবনদীপ্ত দিনগুলোতে চিত্রকরই হয়ে চেয়েছিলেন তিনি।
দুইটি জীবন সমান্তরাল ভাবে চলে, রেল লাইনের মত নয়, ডাবল হেলিক্স ডি এন এ-র মত, পরস্পরকে ভেদ করে, পরস্পরকে ছুয়ে , পামুক এবং ইস্তাম্বুল। শুরু নেই, শেষ নেই। আদি নেই, অন্ত নেই। আছে শুধু বিরামহীন পথ চলা। মাঝে অল্প কিছু বিরল মুহূর্তে আমি তাদের সঙ্গী।
গোল্ডেন হর্নে পামুক আমার সঙ্গী হন, জাহাজের ভেঁপুর শব্দে গোধূলি আকাশ যখন চিমনীর ধোঁয়া আর তোপকাপি প্রাসাদের আড়ালে হারিয়ে যায়, পামুক আমাকে দেখিয়েছিলেন সেই বাড়ীটা যেখানে প্রথম প্রেমিকার ছবি অমর করেছিলেন তিনি ক্যানভাসে। বিত্তশালী পরিবারের বালিকাটি সুইজারল্যান্ডে চলে যেতে বাধ্য হয় পরিবারের ইচ্ছায়, দিবস-রজনী জেগে তাকে লেখা সুদীর্ঘ ৯টা পত্রের ৭টা খামের ভরা হয়েছিল, যার মধ্যে ৫খানা ডাক মারফত পাঠানোও হয়েছিল।
উত্তর আসেনি একটিরও।
বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প-বলিয়ে বলে যান তার লেখক হয়ে ওঠার পিছনের কাহিনীগুলো, সাহিত্যের ট্রেন ধরার পিছনে ইস্তাম্বুলের অবদান, এই শহরের জল কাদা ঘাস গম্বুজের ভূমিকা।
আধো আধো বাক্য, অগোচরে ফেলা দীর্ঘশ্বাস, সৃষ্টি সুখের উল্লাস- সব চলে লাইন ধরে।
জীবন কাহিনী শেষ অধ্যায়ে জীবনের পরিকল্পনা নিয়ে জীবনদাত্রী মায়ের সাথে সেই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা মনে করেন পামুক, যার শেষ বাক্য ছিল- আমি চিত্রকর হতে চাচ্ছি না, আমি হতে যাচ্ছি একজন লেখক।
( ওরহান পামুকের ইস্তাম্বুল প্রথমবার পড়ার সময় ভালো লাগার শিহরনে আমার জ্বর চলে এসেছিল, অসাধারণ এই জীবনালেখ্যর অন্যতম আকর্ষণ লেখার ফাঁকে ফাঁকে অসংখ্য আলোকচিত্র- পামুকের এবং ইস্তাম্বুলের।
ফুলিয়া, জুলাল, ফাতিহ, এমেল, ব্যাতিকান, ফিলিয, রিযা, হিলাল, খুরতুলুস -আমার ইস্তাম্বুলের বন্ধুরা গত কদিন ধরে অবস্থান করছে তাকসিম স্কয়ারে, তাদের সাথে সংহতি প্রকাশ করেছেন বন্ধু পামুকও। আমারও যেতে ইচ্ছে করছে বসফরাসের তীরে। )
মন্তব্য
বরাবর এর মত অসাধারণ লেখনী
নাহ, কাজের ফাঁকে লিখে ফেললাম সংক্ষেপে, পড়ার জন্য ধন্যবাদ
facebook
বইটা পড়ার ইচ্ছে ছিল। হয়ে উঠেনি। এবারে আর না পড়লেই নয় দেখছি:-)
অবশ্যই অবশ্যই পড়তেই হবে!
facebook
প্রাচীন শহরটি বিপ্লবীদের শ্লোগানে মুখর হোক । যা কিছু অন্যায়, যা কিছু অসুন্দর তা যেন গেঁড়ে না বসে পামুকের ইস্তাম্বুলে । বিশুদ্ধ পরিবর্তন আসুক প্রথাবিরোধীদের আত্মত্যাগে । কেননা "পৃথিবীতে যতোদিন অন্তত একজনও প্রথাবিরোধী মানুষ থাকবে, ততদিন পৃথিবী মানুষের ।"
facebook
বাংলাদেশের সন্দেশ থেকে প্রকাশিত বইটির অনুবাদ কপির কিছু অংশ পড়েছি,বইটি আমারও খুব প্রিয়!
-তূর্য রায়
কার অনুবাদ?
facebook
সৌরিন নাগ
ধন্যবাদ
facebook
খুব প্রিয় একটা বই।
খুব ভালো লাগলো রিভিউ। ধন্যবাদ অণু।
জীবনের তাগিদে ষাট বছর পর্যন্ত কাজ করব - মানে আরও ১৭ বছর।
আর যদি ষাট বছরের বেশি বাঁচি - তবে কাজ থেকে অবসর নিয়ে ঢাকা শহরকে নিয়ে বিরাট ক্যানভাসে একটা গল্প লিখবো। সেই গল্পের নায়ক হবে আমার প্রিয় শহরটা।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
ধন্যবাদ গল্প-বলিয়ে। আপনার লেখা আছে নাকি কোন বই নিয়ে তাসনীম ভাই?
facebook
জানি আমি কিছু বলার আগে দুইন্নার মানুষ পড়ে কমেন্ট করে ফেলবে তাই আস্তে আস্তে পড়ছি আর কমেন্ট করলাম না হুহ্!
--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি
আরে, আগে পরে কী যায় আসে !!!
সেদিন আরেকজন বলেছে সে মেঘার আগের আমার সমস্ত লেখা পড়ে , কিন্তু কমেন্ট করে না
facebook
তিনটা বই কিনেছি পামুকের। একটাও পড়া হয়নি।
আমারও কয়েকটা জমে গেছে। এইটা সংগ্রহে থাকলে, এইটা দিয়েই শুরু করেন।
facebook
এটা নেই। দ্যা ব্ল্যাক বুক, স্নো আর সিলেক্টেড স্টোরিজ আছে।
হুমম... আমরাও বিশ্ব ভ্রমনে বেরুবার আগে তারেকাণু'দার সমগ্র (ততদিনে কয়েক খণ্ড বেরিয়ে যাবে নিশ্চয়) বগলে চেপে যাত্রা শুরু করব
নাহ
facebook
বিশ্বভ্রমণ আর হইল না
ক্যান ক্যান
facebook
দুষ তো আপ্নারি... গাইডবুক ছাড়া এই অকূল পাথারে থুক্কু বিশ্বে আমরা কি করিব?
লাইনে আসুন
facebook
বইটা থেকে সরাসরি আরো কিছু কিছু বিশেষ লাইন হুবহু তুলে দিতে পারতেন। তাহলে লেখার প্যাটার্নটা বুঝতে পারা যেত।
ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .
হয়ত
facebook
লেখাটা দারুণ হইসে।
পামুকের বইটা পড়ার ইচ্ছা হইতেসে।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
পড়ে ফেলেন, জোস !
facebook
অসাধারণ।
--------------------------------------------------------------------------------
ধন্যবাদ ভাবী
facebook
please translate this book in bangla then it will be easy for us to read this book.
পড়তে চান বাংলায় অথচ লিখতে চান ইংরেজীতে!?
facebook
------------------
সুবোধ অবোধ
------------------
শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি কেন এত বোকা হয়?!!
আপনি একেকটা বই এর রিভিউ দেন,'অবশ্য পাঠ্য' তালিকার লিস্ট বড় হয়!!! কিন্তু আপাতত এমন মাইনকা চিপায় আছি যে শুরু করতে পারছি না!!
লেখাতে
------------------
সুবোধ অবোধ
------------------
শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি কেন এত বোকা হয়?!!
কইরা দেন ! জীবন ছুটূ!
facebook
বইটা অর্ধেকের মত পড়ে আর পড়া হয়নি। পড়ে শেষ করতে হবে দেখি। অবশ্য পড়তে ভাল লাগছিল বেশ।
রিভিউ ভাল লাগল।
শেষ করেই ফেলেন, কয়েকটা দারুণ টুইস্ট আছে
facebook
বরাবরের মতই অসাধারন
facebook
বই আর আপনার ঘুরে বেড়ানো দুটো মিলে জম্পেশ হয়েছে।
অনেক অনেক ধন্যবাদ
facebook
নতুন মন্তব্য করুন