১০ জুলাই, ২০১৩, মধ্য দুপুরে সুড়কি বিছানো সবুজ চিরে গাড়ী ছুটে চলেছে রাশান সীমান্তের দিকে, অদূরেই বিশাল হ্রদ পেপসইয়ারভি, যার অন্যপাশে রাশিয়া এপাশে এস্তোনিয়া, সারা ইউরোপের ৫ম বৃহত্তম হ্রদ হলেও দুই দেশের সীমান্তে অবস্থিত সকল হ্রদের মাঝে এটি বৃহত্তম। দৃষ্টিনিবদ্ধ কোলে রাখা ম্যাপে, সামান্য ভুলচুক হলেই সরু কোন রাস্তায় ঢুকে কয়েকমাইল খামোখা নাকানিচুবানি খেতে হবে পথ হারিয়ে! অবশ্য পথ হারানোর জন্যই পথে নামা বলে খুব একটা খারাপ লাগে না অজানা জায়গায় এভাবে ঘুরপাক খেতে, বরং এভাবেই দেখা হয়ে যায় নাম না শোনা জনপদ, মিলে যায় নতুন বন্ধু, কিন্তু এই দেশে সেটা হলে বিপদ, সরু সরু রাস্তা চলে গেছে দূরের কোন ফার্ম হাউসে, বা দিগন্ত ছোঁয়া কোন জলাতে, তখন আবার কেঁচে গন্ডুষ! হাতে সময়েরও স্বল্পতা আছে, হ্রদ তীরের ভারনিয়া শহরে পৌঁছাতে হবে সময় মত। রাস্তা মসৃণ না হওয়ায় বেশ কেঁপে কেঁপে এগোচ্ছে চতুস্পদ, ম্যাপের ক্ষুদের অক্ষর দেখতে সমস্যা হওয়ায় আনমনেই সামনের দিকে তাকাতে কনিফারের বনের উপর দিয়ে আলোতে ভেসে চলা এক কালো বিন্দু নজরে আসল, তার ওড়ার ভঙ্গীতেই বোঝা গেল আকাশের রাজা ঈগল ছাড়া কোন আর পাখি এমন রাজসিক ভঙ্গীতে বাতাস চিরে এগোবে না। কিন্তু কোন প্রজাতির ঈগল এটি?
তার মুখে আবার কি যেন একটা ঝুলছে, হতভাগ্য কোন শিকার হবে, গাড়ী চালানোতে ব্যস্ত সহযাত্রী বন্ধু স্টেফানের উদ্দেশ্য যেই না বলেছি ঈগল, মুহূর্তের মাঝে সে রাস্তার একপাশে গাড়ী থামিয়ে চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল বিহঙ্গরাজকে সনাক্ত করার কাজে।
বিরল ছোট গুটিঈগল! দুই নজর দেখার পরেই সে উৎক্ষিপ্ত ক্ষেপণাস্ত্রের মতই সাঁ করে শুন্যে মিলিয়ে গেল, টেলিস্কোপ ফিট করে তার সাবলীল ভঙ্গিমা দেখার আর সময় দিল না! শুধু দূরবীনের মাধ্যমে বোঝা গেল মুখের খাবারটা ছিল কোন রসালো নাদুসনুদুস ব্যাঙ, যা এই ঈগলের প্রধানতম খাদ্য, অবশ্য বাগে পেলে সে কোন কিছুই ছাড়ে না, বছর দুই আগে তার গিরগিটি শিকার চাক্ষুষ করেছিলাম।
এই জাতের পাখিরা শিকারের সন্ধানে সাধারণত চক্রাকারে বাতাসে ভেসে ভেসে ঘুরে বেড়ায়, তাই সিদ্ধান্ত হল কিছুক্ষণ এই জায়গাতে থেকে সুযোগ দেওয়া যাক ব্যাটাকে ফটোশেসনের, আমাদের অপার আনন্দের সাগরে ভাসিয়ে বাতাসে ভেসে ভেসে অল্পক্ষণের মাঝেই হাজির হল, এবং এক জোড়া! বাংলাদেশে বড় গুটিঈগলের দেখা মিললেও সামান্য ছোট আকৃতির এই জাত ভাইয়ের দেখা মিলেনি এখন পর্যন্ত। সাবলীল ভাবে আমাদের দৃষ্টিসীমার মাঝে চক্কর দিল দুইজনই বেশ কয়েকবার, শিকারের হদিশ করতে পারল না তাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, আস্তে আস্তে আবার আবছা হতে হতে মিলিয়ে গেল বিশালদেহী পাখিগুলো আকাশের নীলে।
মহাখুশী হয়ে ফেরার এন্তেজাম করছি এই সময় পাশের দিঘল ঘাসের বিস্তীর্ণ রাজ্য থেকে গুরুগম্ভীর শব্দ ভেসে আসল- কর্ন ক্রেক ( ক্রেক জাতীয় পাখির বাংলা নাম রাখা হয়েছে গুরগুরি, সেই হিসেবে কর্ন ক্রেকের নাম ভুট্টা গুরগুরি দেওয়া যেতে পারে, ইতিমধ্যেই এই নাম পাঠিয়ে দিয়েছি) ! অতি লাজুক এই পাখির ডাক মাঝে মাঝেই শোনা যায় কিন্তু তার দর্শন মেলা অতি দুরূহ। মাঝে মাঝে হঠাৎ মনে হয় ঘাস বুঝি একটু নড়ে উঠল, মুরগীর মত কিছু একটা সরসর করে চলে গেল, একটু ঠোঁটের আদল, মেটে রঙের পালক, এর বাহিরে কিছু দেখার আশা করাই বৃথা! বছর খানেক আগে এক গ্রীষ্মে টানা কয়েক ঘণ্টা তার গান শুনেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল, তার টিকির পালকের দেখাও মিলে ছিল না!
যেহেতু সে খুব কাছে থেকে ডাকাডাকি করছিল, স্টেফান মুচকি হেসে বলল- দাড়াও, ব্যাটাকে রাস্তায় বের করে আনার চেষ্টা করি।
কীভাবে?
আর কেমন করে, তার ডাক দিয়েই! সাথে হাজার পাখির গান রেকর্ড করা আছে, সেখান থেকে ভুট্টা গুরগুরির ডাক এক বিশেষ মাইক্রোফোনে বাজিয়ে সেটাকে প্রলুব্ধ বা ক্ষুব্ধ করার চেষ্টা করে দেখা যাক!
রেকর্ড ছাড়ার প্রায় সাথে সাথেই ভুট্টা গুরগুরি পাল্টা জবাব দিল মহারোষের সাথে, যেমন বলছে- কার এত্ত সাহস আমার হারেমের রমণীদের সাথে ফস্টিনস্টি করতে আসে ! এমন বেশ কবার পাল্টাপাল্টি হবার পর ঘাসের দঙ্গল থেকে তার আবছা অবয়ব দেখা গেল, প্রথমেই খানিকক্ষণ আন্দজা করার চেষ্টা করল ব্যাপারখানা কী! আরেকটা পুরুষ গুরগুরির বদলে দুইখানা মানুষ আর একটা গাড়ী মেঠোপথে কেন সেটা তার বোধগম্য হল না! তারপর আমাদের অবাক করে ভীম গতিতে দৌড়ে অন্য পাশের ঝোপে ঢুকে পড়ল!
এক্কেবারে টি-রেক্সের মত সেই দৌড়! পাখিরা যে বর্তমান পৃথিবীতে ডাইনোসরদের সবচেয়ে কাছের টিকে থাকা বংশধর এই নিয়ে কারো সন্দেহ থাকলে তাদের পা জোড়া এবং দৌড়ানো খেয়াল করার চেষ্টা করেন , ডাইনোসরের মতই সামনের দিকে ঝুকে বিশাল লম্বা লম্বা পা ফেলে মুহূর্তের মাঝে পগার পার!
ব্যাটা কী আর আসবে! নাকি বুঝে গেছে আমাদের ফন্দী? খানিক পরেই আশ্বস্ত হয়ে তার আগমন লক্ষ্য করলাম, একেবারে সেই ইলেকট্রনিক যন্ত্রের কাছে যেয়ে দাঁড়িয়েছে যেখান থেকে শব্দ বাহির হচ্ছে ! শুধু তাই না, সেটার সাথে পাল্লা দিয়ে ডাকাডাকিও করল বেশ!
কী অপূর্ব একটা পাখি! দেখা মেলে না বলে তার পালকের চোখ ধাঁধানো সন্নিবেশন নজরে আসে না কখনো, আপন পরিবেশে একেবারে মাতিয়ে রাখল নানা অঙ্গিভঙ্গি করে! তবে খুবই লাজুক, ফাঁকা পথটাতে কোনবারই বেশিক্ষণ থাকল না, খানিকটা পরখ করে, ইতিউতি চেয়েই আবার দৌড় দেয় অন্যপাশে!
রাস্তার একদিকে ঘাসের মাঝে উবু হয়ে বসে স্টেফান তার বুনো সৌন্দর্য ফ্রেমবন্দী করার চেষ্টারত, অন্যপাশে আমি। কখনো তার দেখা মেলে, কখনো কেবল দৌড় বোঝা যায়!
এর মাঝেও সফল হল তাকে ফাঁকায় ডেকে এনে দেখার এবং দেখাবার চেষ্টা, হয়ত তাতে অল্প চাতুরি ছিল কিন্তু তারচেয়েও কোটি গুণ মিশে ছিলে ভালবাসা।
( সন্ধ্যেয় জাহাজে করে ফেরার পথে লেখাটি শুরু করেছিলাম, হঠাৎ মনে হল সচলায়তনের নানা লেখা চিত্র-বিচিত্র ধরনের যানবাহনে থাকা অবস্থায় লেখা এবং পোস্ট করা হলেও জাহাজে অবস্থানরত অবস্থায় কোন সময়ই লেখা হয় নি! যাক, সেইটিও হল!
এই পোস্টটি আমাদের সহসচল প্রকৃতিপ্রেমিকের (পিপি দা) জন্য। )
মন্তব্য
facebook
খুব ভাল লাগল লেখাটা। চমৎকার একটা পাখি
জাদুর পাখি !
facebook
অপূর্ব লাগলো ভুট্টা গুরগুরিকে। বিশেষ করে যেখানে সে এসে যন্ত্রের থেকে বেরোনো ডাক শুনে অবাক হয়ে নিজেও ডাকছে। মনে মনে নির্ঘাত ভাবছিল, এই দু'পেয়ে পালকহীন ব্যাটারা করেছে কী! বাক্সে পাখি ভরেছে নাকি?
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ওর ডাক শুনে পারেন নেটে, উইকিতেই আছে, পুরাই জলদগম্ভীর!
facebook
কত অজানারে জানালে যে তুমি,
'অবাক' বললে হল না কিছুই!
তোমার ব্লগের জাদু-কাঠি দিয়ে,
তারেক অণু রে, আমরা দুনিয়া ছুঁই।
- একলহমা
facebook
facebook
এরম খামোকা পাখিটারে উত্যক্ত করার তীব্র নিন্দা জানাইলাম.
..................................................................
#Banshibir.
হ
facebook
উত্যক্ত বলে উত্যক্ত!! এত বড় বড় পুলাপান সব কামানের মত ক্যাম্রা বাগায়া দিনে দুপুরে ইভ টিজিং করতেছে বেচারা পাখিটারে। তবে পাখিটারো দোষ আছে, পর্দা ছাড়া মাঠে ঘাটে ঘুরঘুর করতেছে।
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
পাখিটা পুলা!
facebook
ক্যামনে চিন??
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
পাখি আপনি আমাত্তে বেশী বোজেন?
facebook
না রে ভাই, একটা পাখি পর্যন্তই আমার দৌড়। তোমার মত এত পাখি-পুখি আর দেখলাম কো
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
লাইনে আসুন! বৌ এর সামনে খুব ভালু লোক !
facebook
"কেঁচে গন্ডুষ" হবার কথা।
কোথায় পাঠাতে হয় নাম?
ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .
পাখিদের বাংলা নাম দেবার দীর্ঘ প্রক্রিয়া নিয়ে একটা বিশদ লেখা দিব শীঘ্রই, সেখানে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া থাকবে। সেই সাথে তালিকা দেবার চেষ্টা করছি যে পাখিগুলোর ইতিমধ্যেই নাম দেওয়া আছে সেগুলোর।
facebook
ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
facebook
খুব ভাল্লাগছে অণু।
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
facebook
অপূর্ব ! আমারো মজা লেগেছে যন্ত্রের কাছে এসে ডাকাডাকির ছবি আর লেখা।
facebook
ওরে আমি তো ভুট্টা গুরগুরির ফ্যান হইয়া গেলাম। হাহা কী সুন্দর যন্ত্রের সাথে পাল্লা মিলায়া ডাকে
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
facebook
ঈগলটার হাবভাবে রাজকীয় একটা ভাব আছে।ভুট্টা গুরগুরিটা কিউট।আর ব্লগ লেখক একটা বস।তাঁর ক্যামেরাটা-ও বস।
ধন্যবাদ,অণুদা।
কে বস্লুক !
facebook
বরাবরের মতই
আব্দুল্লাহ এ এম
ধন্যবাদ
facebook
ভুট্টা গুরগুরিকে ইভটিজিং করার জন্য ইউনুস বাবুনগরীর পক্ষ থেকে চরম নিন্দা জানাই
এইটা ছেলে, মানে পুলা, মানে আগুনের গুলা !
মেয়ে পাখি গান গায় না
facebook
facebook
চরম লেখা হইছে। তবে একটা কথা --
খামাকা অবলা পাখিরে বেপর্দা কইর্যা আবার তার ইমান-আকিদা নিয়া ছিনিমিনি খেল্লেন, তাও আবার রোজা-রমজানের দিনে। শয়তানের ওয়াসওয়াসা একেই বলে। ভাল হইয়া যান ভাই, ভাল হইয়া যান।
গরুড় হচ্ছে কিনা পাখিদের রাজা, আর তার উপরে রাম গরুড়! আপনে তো ক্ষেপবেনই
facebook
পড়া শেষ করে মন্তব্য করতে গিয়ে দেখি আমি সাইনাউট! সচলে আগে দিনের পর দিন লগইন
থাকা যেত ,এখন একটু এদিক ওদিক গেলেই হাওয়া হয়ে যেতে হয় কেন! ভারী বিরক্তিকর ব্যাপারটা
যাই হোক, এত সুন্দর একটা পাখির ব্যাপারে জেনে মেজাজ খ্রাপ করা ঠিক না যদিও। আসল কথাটা হলু রোজায়
ধরেছে। ক্ষিদা পেয়ে গেছে কী সুন্দর নামটা পাখির! গুরগুরি! আস্তে আস্তে হাঁটে বলে এই নাম নাকি?
আঞ্চলিক নাম থেকে নেয়া, কারণ না জানা দরকার, হয়ত গুড়ি মেরে আগায় বলে!
facebook
খুবই সৌন্দর্য।
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
facebook
পাখিটা অনেক সুন্দর।।।
facebook
প্রতি বার এর মতোই অসাধারণ। ..... কিন্তু পাখি টার মনে এই ভাবে কষ্ট দেয়া উচিত হয় নি.
facebook
মাসুদ সজীব
অশেষ ধন্যবাদ তারেক। পোস্টটা কোনভাবে নজর এড়িয়ে গিয়েছিল। সুন্দর পাখিটা।
নতুন মন্তব্য করুন