ইউরি গাগারিনের পৃথিবী দর্শন

তারেক অণু এর ছবি
লিখেছেন তারেক অণু (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৫/০৭/২০১৩ - ৭:২৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

7e5b4acdbb9f

পাইয়েখালি আমার জানা প্রথম রুশ শব্দ যার অর্থ চলো যাই! মহাশূন্যে প্রথম গমনকারী মানুষ রুশ দেশের মানুষ ইউরি গাগারিন রকেটে চেপে এই শব্দটি চিৎকার করে বলেছিলেন। ইউরি গাগারিন একজন মহানায়ক, ইতিহাসের এক অনন্য মুহূর্তের একমাত্র সাক্ষী। আজ পর্যন্ত পৃথিবী নামের নীল গ্রহে কয়েকশ কোটি মানুষ বাস করেছে, তাদের মধ্যে গাগারিনই প্রথম দেখেছিলেন শূন্য থেকে পৃথিবীকে দেখতে কেমন লাগে, কতটা ভয়াল সুন্দর শূন্যে ভাসমান আমাদের নীল বাড়ী। এই মানুষটিকে নিয়ে ব্যপক আগ্রহ সবার সারা বিশ্ব জুড়েই, নিঃসন্দেহে তার এই অর্জনের পিছনে হাজার মানুষের প্রত্যক্ষ এবং কোটি মানুষের পরোক্ষ অবদান ছিল তারপরও ইতিহাসের বিশেষ মুহূর্তে অবস্থানের কারণে গাগারিন হয়ে উঠেছেন অমর একজন মানুষ। তাকে নিয়ে তথ্যচিত্র পরিচালক Jamie Doran এবং লেখক Piers Bizonyর STARMAN, The Truth behind the Legend of Yuri Gagarin বইটা ব্যপক আগ্রহ নিয়ে পড়লাম গত ২ দিন ধরে, সেটারই একটা আলোচনা লিখেও ফেললাম ঝটপট।

yuri-gagarintimecover

১৯৩৪র ৯ মার্চ মস্কো থেকে ১৬০ কিলোমিটার পশ্চিমের এক ছোট গ্রাম ক্লুসিনো ( Klushino) ইউরির জন্ম, বাবা অ্যালেক্সি পেশাগত ভাবে ছিলেন যৌথখামারের একজন কাঠমিস্ত্রী এবং মা আন্না দুগ্ধখামারে কাজ করতেন। সাধারণ সেই কৃষক পরিবারের জীবন আরও কোটি কোটি রাশানের জীবনের মতই চিরতরে পরিবর্তিত হয়ে যায় ১৯৪১ সালে যখন ৩০০০ কিলোমিটার সীমান্ত জুড়ে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর কামানের গর্জনে। ছোট্ট ইউরি যুদ্ধের মাঝে বেড়ে উঠতে থাকেন উৎকণ্ঠা এবং জীবনের কালো দিককে সাথী করে। এর মাঝে রাস্তায় বোতল ভেঙ্গে কাঁচের টুকরো ফেলে জার্মান হানাদার বাহিনীর গাড়ীর চাকা ফুটো করার বানোয়াট অভিযোগে বিকৃতরুচির অধিকারী আলবার্ট নামের এক সৈন্য (যাকে গ্রামের বাচ্চার শয়তান বলে ডাকত) ইউরির পিঠাপিঠি ছোট ভাই বরিসকে চকলেট দেবার ছলে মাটিতে চকলেট ফেলে দেয়, বরিস চকলেট নেবার চেষ্টা করলে বুট দিয়ে তার নিস্পাপ ক্ষুদে আঙ্গুলগুলো থেঁতলে দিয়ে সেই শয়তান তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেয়ে এক আপেল গাছের ডালে নিজের স্কার্ফ দিয়ে ফাঁসি দেবার জন্য ঝুলিয়ে রেখে চলে যায় শিশুটিকে মৃত্যুর মুখে ফেলে। তার আগে সে ঝুলন্ত বরিসের কিছু ছবিও তোলে ক্যামেরা দিয়ে, এরপর গুলী করার জন্য পিস্তল হাতে নিলেও তার দলনেতার আদেশে ফিরে যায় গুলী না করেই। তৎক্ষণাৎ ইউরির বাবা-মা যেয়ে সেই ফাঁস থেকে বরিসকে উদ্ধার করেন। এই ঘটনা এক অমোচনীয় কালো দাগ ফেলে ইউরির মনে।

Yuri-Gagarin-as-a-schoolb-001

যুদ্ধের মাঝে গাগারিন পরিবার তাদের চার সন্তানের মাঝে ( ভ্যালেন্তিন, জয়া, ইউরি, বরিস ) বড় দুইজনকে চিরতরে হারিয়েই ছিলেন বলে ভেবেছিলেন শেষের একবছর, অবশেষে ১৯৪৫র শেষের দিকে ভ্যালেন্তিন এবং জয়া ফিরে আসে পরিবারের কাছে জীবন্ত অবস্থায়। জীবন এগিয়ে চলে আপান গতিতে, ইউরি এবং বরিস জীবনের প্রথম পড়া শুরু করে রাশান সৈন্যদের ফেলে যাওয়া সামরিক ম্যানুয়াল থেকে।

ইউরির স্কুলজীবন নিয়ে তার শিক্ষিকা ইয়েলেনা স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন ইউরি মাঝে সততা ছিল খুব বেশী পরিমাণে, যে কোন দুষ্টুমি করার পরে স্বীকার করে বলতেন- এটা আমি করেছি, আর করব না!

পরিবারের মত সন্তান ভ্যালেন্তিনের মনে পড়ে ৬ বছর বয়স্ক ইউরি যখন তাকে বা বাবাকে কাঠের ছোট মডেল বিমান বানিয়ে দিতে বলত, আর বলত- আমি বিমান চালক হব, দেশের একজন নায়কে পরিণত হব। সেই ক্ষুদে গ্রামের উপর দিয়ে বিমান উড়ত খুবই কম, হয়ত সেই বিরল ঘটনা থেকেই ইউরির মনে আকাশে ওড়ার বাসনা ঠাই নিয়েছিল প্রবল ভাবে।

১৬ বছর বয়সে ইউরি নিজের উপার্জন শুরু করার জন্য লেনিনগ্রাদে ( বর্তমানে সেইন্ট পিটার্সবার্গ ), সেখানের খুব সুবিধের করতে না পেরে ১৯৫০ সালে মস্কো চলে যান একটা মেটাল কোম্পানির চাকরি পেয়ে। সেখানেই জীবনের প্রথম ইউনিফর্মের গর্বিত মালিক হয়ে পকেটের শেষ রুবলগুলো খরচ করে ইউনিফর্ম সমেত একটি ছবি তুলে পাঠান বাড়ীতে।

তার ছাত্র জীবন পুনরায় শুরু হয় স্যারাটোভ টেকনিক্যাল স্কুলে, যেখান থেকে ১৯৫৫ সালে ২১ বছরের ইউরি গ্রাজুয়েশন পূর্ণ করেন। এর আগে ১৯৫১ বসন্তে স্থানীয় ফ্লাইং ক্লাবের দর্শন পেয়ে সেখান বিমান চালনা শেখা শুরু করেন, ট্রেনিং-এ ব্যবহার করা হয়েছিল YAK-18 ধরনের বিমান, প্রথমবারের সংক্ষিপ্ত উড্ডয়নে তারা ১৫০০ মিটার উচ্চতায় পৌঁছেছিল, ইউরির সহজাত দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে প্রশিক্ষক দিমিত্রি মার্টিনভ বলেছিলেন- চমৎকার চালাচ্ছ হে, এইবারই যে প্রথমবার বিমানে উড়ছ মনেই হচ্ছে না! উত্তরে সদা কৌতুকরত ইউরি বলেছিল- আহ, আমি সারাজীবনই বিমান চালাচ্ছি!

পরবর্তীতে উরাল নদীর তীরবর্তী ওরেনবুর্গ বিমান চালনা একাডেমীতে ভর্তি হন ইউরি , অন্য অনেক ব্যাপারে সাবলীলতা দেখালেও তার অবতরণ বা ল্যান্ডিং নিখুঁত হচ্ছিল না কখনোই। অবশেষে ইউরি নিজে নিজেই তার সমস্যা বাহির করে সেটার সমাধান করেন, আর কিছুই না, বিমানের সিটের উপরে একটা বালিশ দিয়ে তার উপরে বসতেন সবসময় যাতে দেখতে কোন সমস্যা না হয় ! তারপর থেকে পুচ্ছদেশের নিচে বালিস ছাড়া ইউরি কোন বিমান চালান নি! তার সম্পর্কে প্রশিক্ষকদের মন্তব্য ছিল- ইউরি হয়ত জিনিয়াস না কিন্তু জয়ী হবার মানসিক তাগিদ ছিল ভিতরে সবসময়ই, যুদ্ধবিমান চালানোর জন্য রোমাঞ্চপ্রিয় মন আর ঝুঁকি নেবার তাগিদ ছিল।

ওরেনবুর্গেই দেখা হয় তার ভ্যালেন্তিনা গরিয়াচেভার সাথে, পরবর্তীতে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তারা। ১৯৫৬ ফেব্রুয়ারিতে ইউরি সার্জেন্টের র্যামঙ্ক পান এবং ১৯৫৭র ২৬ মার্চ প্রথমবারের মত মিগ-১৫ বিমান একাকী চালান। সেই বছরের ৪ অক্টোবর ঘটে যায় ইতিহাস, মহাকাশে প্রবেশ করে প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক! ইউরি তখন ব্যস্ত তার পরীক্ষা নিয়ে, যার পরপরই চাকরির সুবাদে বদলি ঘটে সুমেরু বৃত্তের কাছে মারমানস্ক অঞ্চলে। এখানেই ১৯৫৯র ১০ এপ্রিল লেনা নামের এক ফুটফুটে কন্যা সন্তানের বাবা হন তিনি।

১৯৫৯র অক্টোবরের সারা সোভিয়েত ইউনিয়নের সমস্ত বিমান ঘাটি জুড়ে শুরু হয় এক রহস্যময় দলের আগমন। তারা বিশেষ অজানা কাজের জন্য কিছু পাইলটকে বাছাই করছিল। গাগারিন সেই সময়ের কিছু বাছাইকর্মের কথা বলেছিলেন পরে, শুধু চোখের জন্য সাত সাতটা পরীক্ষা পাশ করতে হয়েছিল তাকে, আর বিশেষ ধরনের মানসিক এবং অঙ্ক পরীক্ষায় সবসময় এক কণ্ঠ থাকে ভুল উত্তর দিয়ে যেত, যাকে উপেক্ষা করে মানসিক দৃঢ়তা ও একাগ্রতা দিয়ে তাকে পেতে হত সঠিক উত্তর। নানা প্রশিক্ষণে উৎরে গাগারিন পান নতুন চাকরি, তাকে শুধু বলা হয় অনেক উঁচুতে ওড়ার জন্য কিছু মানুষ বাছাই করা হচ্ছে। যতটা না নতুন চাকরির জন্য, তার চেয়েও বেশী সুমেরু বৃত্তর সেই বিমর্ষ পরিবেশ থেকে সপরিবারে রেহায় পাবার জন্য মহানন্দে গমন করেন নতুন গন্তব্যে।

সেখানে সারা সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্ভাব্য ২২০০ প্রার্থীর মধ্য থেকে তন্ন তন্ন করে বাছাই করে নেওয়া ২০ জন কসমোনাটের একজন হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করেন ২৬ বছর বয়স্ক ইউরি যেখানে তার সাথে পরিচয় হয় বাকীদের, যার মাঝে পরবর্তীতে মহাকাশযাত্রা করে বিশ্বখ্যাত জন গেরম্যান তিতভ এবং অ্যালেক্সেই লিওনভ।

ট্রেনিংএর অন্যতম কঠিন বিষয় ছিল আবদ্ধ কক্ষে একা থাকা, যাকে বলে আইসোলেসন ট্রেনিং, অনেক সময় দশ দিনের জন্যও। জানা যায় ইউরি তার চেম্বারের সবচেয়ে ক্ষুদে জিনিসটি নিয়েও গান গেতেন, পাওয়ার চেষ্টা করতেন নতুন নতুন অনুপ্রেরণা, অনেকটা মরুভূমির যাযাবরের মত, যে চারপাশে যা থাকে সেটা নিয়েই গান বানায়!

তিতভ ( পরবর্তীতে ইতিহাসের কনিষ্ঠতম নভোচারী, মাত্র ২৫ বছর বয়সে মহাশূন্যে গমন করা সোভিয়েত কসমোনাট Gherman Stepanovich Titov, যিনি কিনা প্রথম মানুষ হিসেবে মহাশূন্যে ২৪ ঘণ্টার বেশী থেকে ১৭ বার পৃথিবীকে প্রদিক্ষণ করেছিলেন, ঘুমিয়েছিলেন, স্পেস সিকনেসে আক্রান্তও হয়েছিলেন এবং প্রথমবারের মত মহাশূন্য থেকে পৃথিবীর ছবি তুলেছিলেন ) সম্পর্কে মজার তথ্য ছিল, তার শিক্ষক সাহিত্যপ্রেমী বাবা তিতভের ফার্স্ট নাম নিয়েছিলেন পুশকিনের বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম ইশকাপনের বিবি থেকে। আর তিতভকে তার ট্রেনিংমেটরা খুব অদ্ভুত মনে করত কারণ সুযোগ পেলেই উনি জোরে জোরে বা আনমনে নানা কবিতা বা সাহিত্যের উক্তি আওড়াতেন, শুধু সমসাময়িক সাহিত্য নয়, ক্ল্যাসিকাল বইগুলো থেকেও ! আবদ্ধ কক্ষের ট্রেনিঙে তিতভ শুধু পুশকিন আবৃত্তি করতেন। আর একবার সাথে মিথ্যা বলে একটা বই নিয়ে গিয়েছিলেন, যদিও নিয়মে আছে যে বই নেওয়া যাবে না, কিন্তু তিতভ বলেছিলেন এই বই আমার মুখস্থ, সাথে থাকুক বা না থাকুক, আমি কিন্তু বিড়বিড় করবই প্রতিটি লাইন, তার চেয়ে সাথেই থাক! কিন্তু ডাহা মিথ্যা কথা ছিল সেটি, ফাঁকে সেই সময়ে মজাসে একটি নতুন বই পড়া হয়ে গেছিল !

Гагарин_Титов

এরপরে কয়েক অধ্যায় জুড়ে সেই ট্রেনিংএর বর্ণনা এবং সোভিয়েত মহাকাশ অভিযানের পিছনের কিছু কালো অধ্যায় তুলে আনা হয়েছে, বিশেষ করে হিউম্যান গিনিপিগ হিসেবে ১২০০ স্বেচ্ছা সেবকের করুণ কাহিনী, যাদের উদ্দেশ্যমূলক ভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল নানা পরীক্ষায়, সবচেয়ে বেশী চাপে, তাপে, ঘূর্ণনে মানবদেহের উপরে কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে তবে একটা কথা পরিষ্কার থাকা দরকার এই বইটিতে রাশিয়ার সাথে পশ্চিমের দেশগুলোর যে রাজনৈতিক আদর্শগত দন্ধ ছিল তা সুযোগ পেলেই বরাবরের মত ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এবং লেখকদ্বয় সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকতে পারেন নি, বরং সুযোগ পেলেই সোভিয়েত অর্জনের চেয়ে সেই অর্জনের ফাঁকফোঁকর গুলো খুঁজে দেখাতে সচেষ্ট ছিলেন, বিশেষত বারবার বলার চেষ্টা করেছেন গ্যাগ্যারিনের উড্ডয়ন ছিল ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ, নিরাপত্তা ছিল না বললেই চলে। আবার বইটির বিস্তর পাতা গেছে ইউরি এবং তিতভের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে, সেটা নিয়ে একটা তথ্যচিত্রও বানানো হয়েছে, এই যে লিঙ্ক। এইটা বুঝতে হবে যে বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে মাত্র ২ জন সেরা পাইলট কে বেছে নেওয়া হয়েছিলে প্রথম মানুষ হিসেবে মহাশূন্যে যাবার জন্য, এবং সেই সুযোগ নিতে মুখিয়ে থাকবে সবাই-ই। যেমন এই লেখাতে বলেছিলাম চাঁদে প্রথম পা দেওয়া নিয়ে নিল এবং অলড্রিনের অল্প মনকষাকষির কথা। আর বইটির প্রথম সংস্করণে যা তথ্য ছিল তার প্রায় সবই গ্রহণযোগ্য বলে রায় দেয়া হলেও পরের সংখ্যার সবকিছুই প্রমাণিত সত্য নয়, বরং কিছুটা মনগড়া ঘটনারও মিশেল দেওয়া হয়েছে, সম্ভবত বইয়ের বিক্রি বাড়াতে, এবং সোভিয়েত আমলকে ব্যপক গালমন্দ করলে হয়ত তা বাজারজাতের জন্য বেশী ভাল এই দৃষ্টিকোণও কাজ করতে পারে।

স্পুটনিকের পর মহাকাশের প্রথম জীব হিসেবে লাইকা নামের কুকুরটা ইতিহাসের বিখ্যাততম সারমেয় হয়ে গেল। তার পরপরই ৩৫০০ চিঠি এসেছিল সোভিয়েত একাডেমী অফ সায়েন্সের কাছে স্বেচ্ছাসেবীদের কাছে থেকে, সবাইই মহাকাশে যেতে ইচ্ছুক, কেউই জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবিত ছিল না, সবাই চেয়েছিল নীল গ্রহটাকে আসল রূপে একপলক দেখতে, ইতিহাসে অমরত্ব নিশ্চিত করতে।

এরপরে আসে সেই অসাধারণ বিজ্ঞানীটির কথা, সোভিয়েত তথা মানুষের মহাকাশযুগের পুরোধা অথচ রহস্যে মোড়া ব্যক্তিত্বের কথা যার নাম জনসমক্ষে নেওয়া নিষিদ্ধই ছিল, কোন খবরে তার উপস্থিতি ছিল না, অথচ তিনিই ছিলেন এই বিশাল কর্মকাণ্ডের সর্বেসর্বা। তাকে আড়ালে বলা হত দ্য কিং, বস অফ দ্য বসেস, চীফ ডিজাইনার অথবা তার নামের আদ্যাক্ষর এস পি নামে। সের্গেই পাবলোভিচ করোলভ, দ্য ট্রু ম্যান বিহাইন্ড দ্য স্টোরি।

Yuri Gagarin

এরপর সংক্ষেপে বলা হয়েছে স্ট্যালিনের সময়ে কোন রকম প্রমাণ ছাড়া খামোখা অভিযোগে করোলভের ১০ বছরের নির্বাসন দেওয়া হয় ( স্ট্যালিন বুদ্ধিমান সৈন্যদের পছন্দ করতেন না বিদ্রোহের ভয় সহ নানা কারণে, করোলেভের উপরয়ালা মার্শাল Tukhachevskyকে এমন সন্দেহের বসে হত্যা করা হয় এবং তাদের অধীনে কর্মরত সবারই শাস্তি হয়) সাইবেরিয়াতে যার মানে নিশ্চিত মৃত্যু। কিন্তু নাৎসিদের আক্রমণের পরে কিছু লোকের কলকাঠি নাড়ার ফলে করোলভসহ অনেক নামী বিজ্ঞানী মুক্তি পান যুদ্ধে যোগদানের জন্য। যদিও মহাশক্তিধর ব্যক্তিটি কোনদিন জনসম্মুখে তার প্রতি রাষ্ট্রযন্ত্রের এই হঠকারী অন্যায় নিয়ে একটি কথাও বলেন নি।

নির্বাচিত কসমোনাটদের করোলভ আদর করে লিটল ঈগল বলে ডাকতেন, প্রথম থেকেই গাগারিন এবং লিওনেভকে তার বিশেষ পছন্দ হয়, তবে তিতভের সাথে সখ্যতা খুব একটা জমে উঠে নি কারণে হিসেবে বলা যেতে পারে এক বনে যেমন দুই বাঘ থাকে না তেমন দুই প্রবল ব্যক্তিত্বশালী পুরুষ একজন আরেকজনের অধীনে কাজ করতে পারে না ( বইয়ের দুই লেখক এই নিয়ে বেশ ত্যানা পেঁচিয়েছেন, তিতভ কিছুটা বুর্জোয়া পরিবারের ছেলে, তার বাবা ছিলেন শিক্ষক, তার নাক উঁচু, আত্মঅহংকারে ভুগতেন যে কারণে তাকে অনেক কিছু থেকেই দূরে রাখা হত। কিন্তু লেখকেরা ভুলে গেছে যে আমরা সহজেই বুঝে নিতে পারবে যেহেতু তিতভকে সোভিয়েত রাশিয়ার শ্রেষ্ঠ ২জন কসমোনাটদের একজন প্রথম থেকেই বলা হত সেটা তার যোগ্যতার কারণেই)। করোলভ তার লিটল ঈগলদের একদিন মহাকাশযানটিও দেখান, অবশ্য সেই কিম্ভূতকিমাকার যন্ত্র কী কাজে লাগবে তা বুঝতে কেউই সক্ষম হন নি।

এরপরে এসেছে করোলভের বাছাই প্রক্রিয়ার কিছু ঘটনা, তিনি যেমন যখন তখন সবার সামনে মিথ্যা অভিযোগ করতেন বজ্রকণ্ঠে, যেমন- ইউরি, তুমি কেন দাঁত বাহির করে হাসছ? অথচ আদপে ইউরি হাসছিলই না, এখন কিভাবে শান্ত ভঙ্গীতে সে বিগ বসের এই অভিযোগের জবাব দিবে এইটা যাচাই করাই ছিল করোলভের মূল উদ্দেশ্য। তিনি সবসময়ই স্বাধীনচেতা, নির্ভীক, বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ পছন্দ করতেন, বিশেষ করে যারা তার মুখোমুখি দাড়িয়ে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। অবশেষে সেই বিশেষ দিনটি আসে যা পরবর্তীতে প্রথম মহাশূন্যে হাঁটার রেকর্ডের অধিকারী অ্যালেক্সেই লিওনভের সাক্ষ্যে আমরা জানতে পারি যে নভোযান ভস্টকের সামনে যেয়ে তার ভিতরে প্রবেশ করার জন্য তিনি কসমোনাটদের জুতা খুলে ভিতরে যাবার আহ্বান জানান। সবার আগে ইউরি গাগারিন ইয়েস স্যার বলে জুতা খুলে ভিতরে ঢুকে পড়েন, অন্যরা খানিকটা হতচকিত অবস্থায় ছিল, যেখানে রকেটের মধ্যে জুতা পরেই ঢুকতে হবে সেখানে এখন জুতা খোলার দরকার কী এইটাই হয়ত তাদের মনে কাজ করছিল। কিন্তু ইউরির দেখাদেখি বাকী সবাইই জুতা খুলে তার অনুগামী হল। লিওনেভের মতে সেই মুহূর্ত থেকেই ইউরি গ্যাগারিন অলিখিত ভাবে প্রথম মানব হিসেবে মহাশূন্যে যাবার জন্য করোলভের গুড বুকে উঠে যান। সেই সাথে থাকে সাহায্য করেছিল হয়ত রাশান গ্রামাঞ্চলে বাড়ীর ভিতরে প্রবেশের আগে জুতা খোলার রীতি!

যাই হোক, জোর তালে প্রস্ততি চলতে থাকে। এর মাঝে ব্রিটিশ কম্যুনিস্ট বিরোধী খবরের কাগজে একাধিক খবর আসে যে সোভিয়েত মানুষ মহাশূন্যে গেছে কিন্তু অবতরণের সময় যান্ত্রিক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি ( আমার দেশ টাইপ আবর্জনা যুগে যুগেই ছিল দেখা যাচ্ছে)।

ভোস্টকের আটো সীটে আটার জন্য কিছুটা খর্বাকৃতির নভোচারী দরকার ছিল সেই হিসেবে লিওনেভ রেস থেকে ছিটকে পড়েন। উচ্চতায় ৫ ফিট দেড় ইঞ্চি ইউরি টিকে যান, এবং তিতভও। এই নিয়ে পরে সাক্ষাৎকারে তিতভ বলেছেন অবশ্যই আমিই নির্বাচিত হয়ে চেয়েছিলাম, কেবলমাত্র প্রথম মানুষ হবার লোভের নয়, সেই সাথে আমরা দেখতে চেয়েছিলেম কী আছে ঐ অসীমে। ১৯৬১র ৭মার্চ ইউরির ২য় কন্যা গালিয়ার জন্ম হয়, তার তিন সপ্তাহ পরেই ইউরি বিকানুর রওনা দেন জরুরী কাজে। সেখানে কসমনাটদের শেখানো হয় স্পেস স্যুট পরা এবং খোলা। বিশেষ ইন্টারভিউয়ের জন্য হাজির হন আরেক মহাপরাক্রমশালী ব্যক্তি, সোভিয়েত মহাকাশ যাত্রার কসমোনাট প্রসিক্ষণের প্রধান জেনারেল নিকোলাই পেত্রোভিচ কামানিন। তার একটা প্রশ্ন ছিল যদি সকল নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙ্গে যায় তখন একজন পাইলটের কি তার আসন শূন্যে উৎক্ষিপ্ত করা উচিৎ? এর উত্তরে তিতভ বলেছিলেন- খামোখা এই নিয়ে দুশ্চিন্তা করে সময় নষ্ট করার মানে হয় না, কন্ট্রোল রুম কোন না কোন ভাবে সব নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবে কয়েক মুহূর্তের মাঝে সে তো জানা কথা। আর ইউরি বলেছিলেন- যদি সকল ব্যবস্থা ভেঙ্গেই পড়ে তাহলে আসন ইঞ্জেক্ট আমাকে একটা বাড়তি সুযোগ দিবে।

করোলভ এবং কামানিন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছিলেন এই দুইজনের উপরে, এবং কামানিনের মতে তিতভ ছিলেন অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী চরিত্রের, ফলে তাকে রাখা হয় ২য় মহাকাশ অভিযানের জন্য যা কিনা ২৪ ঘণ্টার বেশী সময় পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে থাকবে আর ইউরিকে নির্বাচিত করা হয় প্রথম মানুষ হিসেবে দুই ঘণ্টারও কম সময়ের প্রথম যাত্রার জন্য। অবশেষে বিশেষ মিটিং ডেকে জানানো হয় ইউরি গাগারিন হতে যাচ্ছেন প্রথম অভিযানের কমান্ডার এবং তিতভ তার ব্যাকআপ। এই ঘটনায় তিতভের হতাশা পরিষ্কার প্রকাশ পায়, তিনি অকপটে বলেওছেন যে তাকে নির্বাচন করা হবেই এমনটাই ভেবে নিয়েছিলেন সবসময়ই।

gagarin-titov

অবশ্য নির্বাচনের শেষ চাবিকাঠি নাড়া হয়েছিল আরও অনেক উপর থেকে, সোভিয়েত রাষ্ট্রের কর্ণধার নিকিতা ক্রুশ্চেভ আর ইউরি গাগারিনের মিল ছিল অনেক দিক থেকেই, দুইজনই এসেছেন কৃষক পরিবার থেকে। দুইজনই সদাহাস্যমুখি, কোলাহলমুখর। বিশেষ করে যে সাম্যবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ার কথা ছিল সোভিয়েতদের তাদের একজন কৃষকের ছেলে যে কিনা নিজেও বাবার সাথে কাজ করেছে, তরুণ কালে ফেরীতে মজুর হিসেবে শ্রম দিয়েছেন, সেই লোকই যদি মহাকাশে যায় তাহলে রাষ্ট্রযন্ত্রের আমরা সবাই-ই সমান এই প্রোপাগান্ডার জন্য তার চেয়ে বেশী শক্তিশালী প্রমাণ আর কী হতে পারে?

gagarin_yuri

চূড়ান্ত যাত্রা আগের বর্ণনা আছে পুরো এক অধ্যায় জুড়ে, সেখানে স্বয়ং গাগারিনের লেখা পাতলা বই The Road to The Stars ( বাংলা হয়েছিলে সম্ভবত পৃথিবী পেরিয়ে নামে) এর রেফারেন্স দিয়ে বলা হয়েছে সেইবারই প্রথম ইউরি তার চিফ ডিজাইনার করোলভকে কিছুটা ক্লান্ত দেখেন। ঐতিহাসিক যাত্রা শুরু আগের টানটান উত্তেজনার আবেগময় মুহূর্তগুলোর কথা উঠে এসেছে কয়েকজনের রোজনামচায়।

41QHWNFFD9L._SY300_

শুরু হল ১০৮ মিনিটের সেই অবিস্মরণীয় মহাযাত্রার শুরু, তার আগে অবশ্য নাসার মত ৪-৩-২-১-০ স্টাইলে কাউন্টডাউন করা হত না রাশিয়ায়, বরং পূর্ব নির্ধারিত সময়ে ১২ এপ্রিল, ১৯৬১, মস্কো সময় সকালে ৯ টা ৬-এ রকেটের উড্ডয়ন শুরু। এরপরে স্বয়ং ইউরির কথাতেই বলা হয়েছে ঘণ্টায় ২৮,০০০ কিলোমিটার বেগে ছুটে চলা মহাকাশযান থেকে রিপোর্টে তিনি জানান সব ঠিক আছে, জানালা দিয়ে মেঘ দেখা যাচ্ছে, সব কিছুই দেখা যাচ্ছে এবং সবকিছুই খুবই মনোমুগ্ধকর। ইউরি ভাবছিলেন পৃথিবীর মানুষ এই যাত্রার কথা জানতে পারলে কিরকম প্রতিক্রিয়া দেখাবে। শিশুকালে যে মা তাকে ঘাড়ে চুমু খেয়ে প্রতিদিন ঘুম পাড়াতেন, মা কি জানেন তিনি মহাকাশে? কারণ মাকে যাত্রার আগে কেবল বলে এসেছিলেন ব্যবসাজনিত কাজে দূরে যেতে হবে। উৎকণ্ঠিত মা প্রশ্ন করেছিলেন, কতদূরে ইউরা? অনেকদূরে মা !

Gagarin3

সেইদিনই পরে রেডিওতে তার নাম এবং যাত্রার কাহিনী শুনে সারা পরিবার উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছিল, এবং দুই শিশুকন্যা রেখে এমন অর্বাচীন যাত্রায় যাবার জন্য কিছুটা ভৎসনাও করা হল। কিন্তু গ্রামের বাড়ীতে কেউ কিছু জানত না। তার বাবা অ্যালেক্সেই গাগারিন নিজের কাজে বেশ ভোরে বাড়ী থেকে বাহির হয়েছিলেন পথে একজন তার ছেলে ইউরি সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন করাই তিনি কারণ জানতে চাইলে সেই লোক বলল- তুমি জান না ! রেডিওতে বলল মেজর গাগারিন নামে একজন মহাশূন্যে গেছে!

সাধাসিধে বাবা বললেন- আপনার ভুল হচ্ছে, আমার ছেলে স্রেফ একজন সিনিয়র লেফটেন্যান্ট। তবে সাধুবাদ দিই তাকে যে মহাশূন্যে গেছে। তারপরও নিছক কৌতূহল বশে স্থানীয় পার্টি অফিসে যেয়ে দেখেন সেখানের কর্মকর্তাকে ফোন করে বলা হচ্ছে গ্রামের নথি দেখে নিশ্চিত হবার জন্য যে ইউরি গাগারিনের জন্ম এই গ্রামেই। সেই কর্মকর্তা আবার উল্লসিত কণ্ঠে বলছিল- নথি দেখার কোন দরকার নেই, সেই ছেলের বাবা স্বয়ং আমার সামনে! বলেই বাবা গাগারিনের হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়েছিল ঊর্ধ্বতন কারো সাথে কথা বলার জন্য।

মহাশূন্য থেকে ১০৮ মিনিট পরে অবতরণ করলেন প্রথম নভোচারী ইউরি, ছোট গ্রাম Smelkovkaতে, ট্রাক ড্রাইভার ইয়াকভ লুসেঙ্কো তাকে দেখলেন প্যারাস্যুটে করে ঝাপিয়ে পরতে, সেদিকে তিনি এগোলেন গ্রামবাসীদের সাথে নিয়ে, এবং গাগারিন হাসিমুখে তাদের বললেন- আমি ইউরি অ্যালিক্সিয়েভিচ গাগারিন, মহাকাশের প্রথম মানুষ। এখনই অনেক মানুষ, গাড়ী, ক্যামেরা আসবে এইখানে, তোমার কোথাও যেও না, এই স্মৃতি আমরা বাঁধিয়ে রাখব।

এছাড়াও সেই গ্রামের এক মহিলা এবং তার শিশুকন্যা ইউরিকে আকাশ থেকে নেমে আসতে দেখে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল। ইউরি চিৎকার করে বলেছিল, আমি তোমাদের বন্ধু কমরেড, একজন বন্ধু! মহিলা কোনমতে জিজ্ঞাসা করেছিলেন তুমি কী পৃথিবীর বাহিরে থেকে আসছ? এক গাল হেসে ইউরি বলেছিল- ঠিক তাই!

তার আগের বছর গ্যারি পাওয়ার্স নামের এক মার্কিন গুপ্তচরকে রাশিয়ান বাহিনী গুলী করেছিল যার ঘটনা সারা সোভিয়েত ইউনিয়ন জানত, কাজেই সেই গ্রামের অনেকেই প্রথমে ভেবে নিয়েছিল ইউরি আরেক মার্কিন গুপ্তচর। যদিও তার হেলমেটে লেখা CCCP তাদের সন্দেহ দূর করেছিল। অল্পক্ষণের মধ্যেই সারা গ্রাম সামরিক বাহিনীর লোকে লোকারণ্য হয়ে গেলে, আগত মেজর গাসিয়েভকে স্যালুট করে ইউরি বলল- কমরেড মেজর, সোভিয়েত কসমোন্যান্ট সিনিয়র লেফটেন্যান্ট গাগারিন রিপোর্টিং। গাসিয়েভ হেসে বলেছিল- আপনিও এখন মেজর! উড়ন্ত অবস্থাতেই প্রোমোশন দেওয়া হয়েছে আপনাকে!

সোভিয়েত ইউনিয়নের কর্ণধার নিকিতা ক্রুশ্চেভের সাথে তার ফোনালাপ ছিল নিম্নরূপ-

WEB11866-2011_640

ক্রুশ্চেভ : তোমার কণ্ঠ শুনতে পারে খুবই ভাল লাগছে গাগারিন অ্যালেক্সিয়েভিচ।
গ্যাগ্যারিন : নিকিতা সের্গেইভিচ, আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে মহাকাশে প্রথম মানব মিশন সফল হয়েছে।

ক্রুশ্চেভ : বল দেখি ফ্লাইটের সময় কেমন লাগল? মহাশূন্য কেমন? কী কী দেখলে?
গ্যাগ্যারিন : এমনিতে ভালই ছিলাম। অনেক বেশী উঁচু থেকে বিশ্ব দেখলাম। সাগর, পর্বত, বড় শহর, নদী, বন সব দেখা যাচ্ছিল।

নানা রাষ্ট্রীয় কথার মাঝে ক্রুশ্চেভ বারবার তার কৌতূহল প্রকাশ করছিলেন, এবং আনন্দে আতিশয্যে পুঁজিবাদী দেশগুলোর প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বললেন ওরা পারলে আমাদের টপকে দেখাক। গাগারিন তাকে এমন সুযোগ দেবার জন্য অসংখ্যা ধন্যবাদ দিয়ে জানালেন যে ভবিষ্যতে দেশের জন্য এমন আরও মিশনে তিনি প্রস্তত।

কী সেই মিশন? সম্ভবত চাঁদ। উড্ডয়নের আগে দ্য বস করোলভ চন্দ্রযানের একটি ক্ষুদে মডেল তার হাতে দিয়ে বলেছিল ভবিষ্যতে আসল মডেলই ব্যবহার করতে হতে পারে! ইউরি যে চাঁদ নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন সেটা জানা যায় একাধিক সূত্রে। তিতভ এত মানুষের ভিড় ঠেলে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাওয়া ইউরির কাছে কোনমতে ঘেয়ে কেবল প্রশ্ন করেছিলেন ভরশূন্য অবস্থায় কেমন লাগে? উত্তর ছিল স্বাভাবিক, বিশেষ কিছু নয়!

Titov,_Khruschev,_Gagarin_1961

পরবর্তীতে ডাক্তারি পরীক্ষার পরে ইউরিকে মস্কোর জাঁকালো রাষ্ট্রীয় সভায় হাজির করা হয় , ধোপদুরস্ত নতুন পোশাকে লাল গালিচা সম্বর্ধনা দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয় তাকে, এবং চরম অস্বস্তির সাথে ইউরি পরে খেয়াল করেন তার জুতোর ফিতা খোলা! যে কোন মুহূর্তে ফিতায় চাপ লেগে উল্টে কেলেঙ্কারি ঘটে পারে সারা জাতির কর্ণধারদের সামনে! পরে ইউরি তার ভাইয়ের কাছে বলেছিলেন স্পেস ফ্লাইটের চেয়েও সেই খোলা জুতোর ফিতে তাকে অনেক বেশী নার্ভাস করে রেখেছিল!

The-one-from-a-U.S.-newspaper-on-12-April-1961-Yuri-Gagarin-pioneered-manned-spaceflight

মায়ের সাথে দেখা করে ক্রন্দনরত মাকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে ইউরি বলেছিল, আমি আর এমন কাজ করব না মা, প্লিজ কান্না থামাও।

তবে এই জাঁকালো অনুষ্ঠানের মাঝে গুরু করোলভের জন্য অন্য অনুভূতি কাজ শুরু করে ইউরির মনে, করোলভ ছিলেন রাষ্ট্রীয় সিক্রেট, তার কোন মেডাল পরার অনুমতি ছিল না, প্যারেডে থাকার অনুমতি ছিল না, মিডিয়াতে কথা বলা দূরে থাক। নোবেল প্রাইজ কমিটি পৃথিবীর প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ এবং প্রথম মানবকে মহাশূন্যে পাঠানোর পিছনের মূল মানুষটিকে পুরস্কার দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করে সোভিয়েত কতৃপক্ষকে চিঠি দিলেও তারা সেটার কোন উত্তর দেবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে নি।

এক অনুষ্ঠানে কয়েকজন ফাদার তাকে জিজ্ঞাসা করেন , Yuri Alexeyevich, did you see Jesus Christ far up above the Earth?

He replied, Holy Father, you,d know better than me whether I,d have seen him up there.

04a-Life-titelblatt-m-Gagarin-und-Chruschtschow-1961-04-21

এরপর শুরু হয়ে যায় ইউরির এক অন্যধরনের জীবনে, যেখানে সে একজন সুপার হিরো, বিশ্বের নানা প্রান্তে যেতে হয়, মিশতে হয় হাজারো লোকের সাথে, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোতেও লাখো লাখো মানুষ তার জন্য দাড়িয়ে থাকে। কিন্তু নিজের এই সুপার হিরো ইমেজ অসহ্য বোধ হচ্ছিল ইউরির কাছে, তার মতে সে খুব সাধারণ একজন মানুষ, ভুলচুক সবসময়ই হয়, দুর্বলতা আছে তারও, কিন্তু সবাই তার কাছে সবকিছুই খুব নিখুঁত দাবী করে। তাই মস্কোতে যখন এক মহিলা তার কেটে ফেলা গাল দেখে বলে উঠেছিল- দেখ দেখ, শেভ করতে যেয়ে সেও গাল কেটে ফেলে, হেসে ফেলেছিল ইউরি। কানাডায় দার্শনিক বাট্রান্ড রাসেলের সাথে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে একটা সেমিনারে মূল আকর্ষণ হিসেবে অংশ নেন তিনি। এর মাঝে ৮ আগস্ট তিতভ মহাকাশে গমন করে, সেই অবস্থাতেই টেলিগ্রাম পাঠান ইউরি। এর পরপর জান কিউবাতে, বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সাথে দেখা করে বলেন – যে জাতি নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন তাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না।

yuri-gagarin-meets-fidel-castro-1965

24163

বইটিতে এর পরে আসে সোভিয়েত স্পেস মিশনের বাকী অভিযানগুলোর কথা, বিশেষ করে মহাকাশে প্রেরণের জন্য প্রথম নারী বাছাইয়ের কথা। ক্রুশ্চেভের ব্যক্তিগত নির্দেশে কেবল শ্রমিক এবং কৃষক পরিবার থেকে আসা মহিলাদের বাছাই করা হয়েছিল, কারণ সোভিয়েতরা বহির্বিশ্বকে দেখাতে চাচ্ছিল যে তাদের দেশের সাধারণ একজন খেঁটে খাওয়া নারীও মহাশূন্যে যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত একজন যুদ্ধে নিহত ট্রাক্টর চালক বাবা এবং সেলাই মিলে কর্মরত মায়ের কন্যা ২৫ বছর বয়স্ক ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা ১৯৬৩র ১৬ জুন মহাকাশে যান আরেক নতুন ইতিহাস রচনা করেন।

images

এর মাঝেই ইউরি কর্নেল পদে প্রোমোশন পান। এবং ব্যস্ত ছিলেন লাখো ধরনের কাজের বিশেষ করে মানুষ উপকারে, হাজার হাজার চিঠি আসত তার কাছে প্রতিদিন সারা বিশ্ব থেকে, থেকে সাধারণ রাশান জনগণের কাছে থেকে, সেখানে লেখা থাকত কারো ছেলেকে পুলিশের কাছ থেকে ছাড়ানোর আবেদন, কারো মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য সুপারিশ, তার নামে ভদকা চালু করার অনুরোধ এমনতর সব বিষয়। সবাইকেই সাধ্যমত সাহায্য করতেন ইউরি, তার অনুরোধ ফেলার সাধ্য কারো ছিল না সেই দেশে, তাইই হয়ত মানুষ তার কাহেই উপকার চাইত। শুধু একবার চুরি করে গাছ কাঁটার জন্য এক লোকের মুক্তির জন্য চিঠি উপেক্ষা করে উল্টো তার শাস্তির জন্য সুপারিশ করেছিলেন, কারণ তদন্তে দেখা গেছিল সে লোক আসলে কাঠের চোরাকারবারি, আর ইউরির কথা ছিল সবাই যদি গাছ এইভাবে কেটে শেষ করে ফেলে তাহলে বন টিকবে কিভাবে!

কামানিন ১৯৬১র ডিসেম্বরের গাগারিনের ভারত ভ্রমণ নিয়ে বলেছিলেন যীশু শত লোককে মাছ-রুটি খাইয়ে হয়ত মুগ্ধ করে ছিলেন কিন্তু ইউরি লাখো মানুষকে কেবল হাসি দিয়ে সন্তুষ্ট করতে সক্ষম এই প্রমাণ আমরা পেয়েই যাচ্ছি! ইউরির উষ্ণ হাসি এবং স্বভাবের প্রশংসা করে স্বয়ং করোলভ বলেছিলেন যুদ্ধ উত্তেজনা থামিয়ে দিতে পারে প্রাণখোলা ইউরি। কিন্তু এত কিছুর মাঝে ছোট্ট একটা ভুলের ফলে ইউরির ক্যারিয়ার অন্য দিকে মোড় নেয়, বন্ধুদের সাথে ক্রমিয়ার এক বন্দরের পারিবারিক ছুটি কাটাবার সময় বেশ মাতাল অবস্থায় সেখানে পরিচিত হওয়া এক তরুণী নার্সের ঘরে ঢুকে ছিল ইউরি, তার কয়েক মিনিটের মাঝেই সন্দেহবশত তার স্ত্রী একই ঘরে প্রবেশ করে, তার রোষ থেকে রক্ষা পেতে জানাল দিয়ে লাফ দিয়ে নিজেকের মারাত্নক আহত করে মহাকাশ ফেরত বীর! হাসপাতালে এক মাসের বেশী থাকতে হয়েছিল সেই চোট সারাতে এবং বেশ কিছু মিথ্যা কাহিনী রটানো হয়েছিল তার সেই ব্যর্থ অভিযানকে সামাল দেবার জন্য।

লেখকেরা অবশ্য নানা রেফারেন্স দিয়ে বলেছেন সেই সময়ে রমণীদের কাছে জনপ্রিয়তায় ইউরির সাথে পাল্লা দিতে কেবল মাত্র বিটলসএর চার ছোকরাই হয়ত পারত, সব দেশের নারীরাই তার সঙ্গের জন্য পাগল ছিল, লাখো রমণী শুধু চোখের ইশারায় বিছানায় যেয়ে প্রস্তত ছিল, সেই হিসেবে এত জনপ্রিয়তার মাঝে একজন স্টার যা করেন, ইউরির মাঝে আত্র থেকে বেশী স্থলন দেখা যায় নি। কিন্তু সেই আহত হবার ঘটনা অনেকের গুড বুক থেকে তার নাম মুছে দেয়।

RIA-gaagrin-top

এর মাঝে সোভিয়েত মহাকাশ অভিযানের উপরে আসে সবচেয়ে বড় আঘাত, ক্যান্সারে ভুগে করোলভ মাত্র ৫৯ বছর বয়সে মারা যান ১৯৬৬র প্রথম দিকে, এত বড় আঘাত সামাল দেওয়া আর সম্ভব হয় নি অত বড় রাষ্ট্রের পক্ষেও। জীবনের শেষ অপারেশনের মাত্র দুই দিনে আগে ইউরি এবং লিওনভ দেখা করতে গিয়েছিলেন গুরুর সাথে, তাদের কাছে জীবনে প্রথমবারের মত তার উপরে চলা নির্মম অত্যাচারের কথা বলেন করোলভ, বলেন পুলিশের পীড়নের কথা, সাইবেরিয়ার নির্বাসনের কথা, সেখান থেকে ফেরার পথে মুচিগিরি এবং মজুরি করে ট্রেন ভাড়া জোগাড়ের কথা। গুলাগের দিনগুলোর কথা আর কোথাও বলেননি সর্বকালের অন্যতম সেরা এই বিজ্ঞানী।

প্রথমবারের মত নাড়া খায় ইউরির মন, বুঝতে পারেন তিনি দেশের চলন ব্যবস্থার কোথাও বড় ধরনের গলদ আছে, তাছাড়া করোলভের মত একজন স্বীকৃত জাতীয় সম্পদকে কেন এতটা হেনস্থা স্বীকার করতে হল বিনা বিচারে। গুরুর মৃত্যুর পরে ইউরি বলেছিলেন করোলভের দেহভস্ম চাঁদে না নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত আমার শান্তি নেই। কসমোনাটরা যোগসাজশ করে উনার দেহভস্মের কয়েক মুঠো পরের মহাকাশযাত্রা অভিযানের সময় শূন্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলে বলে শোনা যায়।

ku-xlarge

এত জনপ্রিয়তার মাঝেও নিজের অজান্তেই পরম শক্তিশালী শত্রু তৈরি করে ফেলেছিলন সদাহাস্যরত ইউরি। নিকিতা ক্রুশ্চেভ তাকে যেমন তার আমলের সাফল্যের প্রতীক হিসেবে সারা বিশ্বের কাছে তুলে ধরত, ততই পরবর্তী সোভিয়েত প্রধান ব্রেজনেভের কাছে চক্ষুশুল হয়ে গেলেন তিনি। অথচ তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত কোন সমস্যা ছিল না। ব্রেজনেভ ক্ষমতায় আসার পরে ইউরির প্রভাব, সুযোগ সুবিধা প্রায় রাতারাতি উধাও হয়ে গেল। এই নিয়ে তিনি শুধু বলেছিলেন ব্রেজনেভকে আমি পছন্দই করতাম কিন্তু কোনদিন তার কাছে যেয়ে মনের কথা বলতে পারলাম না। অন্যদিকে প্রতিপক্ষ ক্রুশ্চেভের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত হওয়ায় গ্যাগ্যারিনকে যতদূর সম্ভব দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ব্রেজনেভ।

এর মধ্যে সয়ূজ দুর্ঘটনায় ভ্লাদিমির কোমারভ মারা যান, যেই মিশনে ব্যাকআপ হিসেবে ছিলেন ইউরি। এই ভয়াবহ ঘটনার পর সয়ূজের পরবর্তী যান ঠিক করতে ২ বছরের সময়সীমা নির্ধারণ করে ইউরির আকাশে ওড়ার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। যদিও যুদ্ধ বিমান চালানোর অনুমতি আদায় করে ফেলেন তিনি পরবর্তীতে।

corpse_custom-1a2c8e99bc85469ad8a5a976f4bfbc91d056a09a-s6-c30

তার পরের ঘটনা যথেষ্ট রহস্যজনক, ১৯৬৮র ২৭ মার্চ মিগ বিমানের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় তার বিমানটি বিধ্বস্ত হয়, ইউরি সহ অপর বৈমানিকের দেহ খণ্ড খণ্ড হয়ে পুরো এলাকার উপরে ঝরে পরে। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে ইউরি আমাদের ছেড়ে চলে যান চিরতরে, অথচ উনার স্বপ্ন ছিল চাঁদে যাবার। এখন পর্যন্ত তার মৃত্যুর কারণ চুলচেরা করে জানা সম্ভব হয় নি, তবে তার পরিবারের অনেকেই মনে করত স্বয়ং ব্রেজনেভের আদেশে তাকে হত্যা করা হয়েছে,যদিও এই ধারণার পক্ষে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি। হতে পারে কোন পাখির সাথে লেগে প্লেনটি দুর্ঘটনায় পড়েছিল, অথবা পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া কোন দ্রুত গতির বিমানে সুপার সনিক বীমের ফলে সৃষ্ট অয়েভে স্পিন করে এই দুর্ঘটনা ঘতেছিলে। কেজিবি এই ঘটনার তদন্ত করেছিল একাধিকবার, এমনকি বছর কয়েক আগেও নতুন করে খতিয়ে দেখা হয়েছিলে একমাত্র সোভিয়েত সুপারহিরো যিনি কিনা আদতে মানবজাতির সুপারহিরো, তার মৃত্যুর কারণ।

162873094

ইউরির অকাল মৃত্যুর পরে তার সহকর্মী কসমোনাটরা গিয়েছিল গাগারিন পরিবারের সাথে দেখা করতে, সেখানে যেয়েই তিতভ ইউরি সম্পর্কে সবচেয়ে হৃদয়গ্রাহী সত্যটা অনুধাবন করতে পারেন- ইউরি গাগারিন ছিলেন এমন একজন , যাকে মানুষ ভালবেসেছিল।

starman-truth-behind-the-legend-of-yuri-gagarin-20299883

( ব্যবহৃত ছবিগুলো গাগারিন বিষয়ক ওয়েবপেজ থেকে নেওয়া,

এই পোস্টটি প্রিয় পড়ুয়া রেজাউল করিম সুমন ভাইয়ের জন্য)


মন্তব্য

মধুপায়ী এর ছবি

মারাত্মক! এক টানে পড়ে শেষ করলাম।

কিন্তু, ভাই, 'কসমোন্যান্ট' বলে কোনো শব্দ আছে কি? শব্দটা কি cosmonaut নয়?
আমার জানায় ভুল থাকলে দুঃখিত।

তারেক অণু এর ছবি

বিশাল ভুল করে ফেলেছিলাম খাইছে , শুধরে দেবার জন্য ধন্যবাদ

wishu এর ছবি

বছরের এই সময়টা মহাকাশ নিয়া ব্যাপক লেখালেখি হয়

তারেক অণু এর ছবি

তাই নাকি !

মালাকাইটের ঝাপি এর ছবি

সহজিয়া লেখা , একটানে পড়ে ফেললাম ।
ধন্যবাদ লেখক কে ,গুরুতর বিষয় আমার মত নাদান পাঠকের বোধগম্য করিয়া উপস্থাপন করিবার জন্য । দেঁতো হাসি
চলুক

তারেক অণু এর ছবি
সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আপনার নিকটা অতীব সুন্দর। আমার খুব প্রিয় একটা বইয়ের নামে নাম। কিন্তু প্লিজ চন্দ্রবিন্দু ছাড়া ঝাঁপিয়ে পড়তে নেই, ওটা যোগ করে নিন হাসি

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

তারেক অণু এর ছবি
তাহসিন রেজা এর ছবি

দারুণ লেখা। পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে।

তারেক অণু এর ছবি

পড়ে ফেলেন

স্পর্শ এর ছবি

ঘুম থেকে উঠেই অনবদ্য একটা লেখা পড়লাম। শেয়ার করার জন্য অনেক ধন্যবাদ। সের্গেই পাবলোভিচ করোলভ এর কথা শুনেছিলাম কিছুদিন আগে। কী দুর্ভাগ্যময় জীবন কাটিয়েছেন! জনস্বীকৃতি, বা শান্তিময় জীবন হয়তো পান নি। কিন্তু রহস্যভেদ করেছেন মহাকাশ যাত্রার। সেই হিসাবে তার অর্জনও অতুলনীয়।

সোভিয়েত রাশিয়া, নিয়ে অনেক স্বপ্নময় কথা শুনি। কিন্তু ওদের কারো সাথে কথা বললে বোঝা যায় কী অভাবনীয় দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে গেছে ওরা। আমার এখানে একজন পোস্টডক ছিলো, স্টিভ, রাশিয়ান। তার বাবা ছিলো রকেট সাইন্টিস্ট। পাবলোভিচের মতই পরিণতি হয়েছে তারও। পাবলোভিচের কথা তাও তো জানতে পারলাম আমরা। এমন হাজারো বিজ্ঞানী, লেখক, চিন্তককে স্বীকৃতিহীন নরকবাস পোহাতে হয়েছে। স্টিভ বলে, সেসব দিনের কথা ভাবলে এখনো শিরদাড়া দিয়ে শীতল স্রোত বেয়ে যায়।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

তারেক অণু এর ছবি

আসলেই, কত জন যে হারিয়ে গেল আমরা জানব না কোনদিনই

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

একজন সাধারণ মানুষের অসাধারণ হয়ে ওঠার গল্প পড়তে সবসময় ভালো লাগে। ধন্যবাদ অণু, চমৎকার লেখাটির জন্য

তারেক অণু এর ছবি

একজন সাধারণ মানুষের অসাধারণ হয়ে ওঠার গল্প পড়তে সবসময় ভালো লাগে। চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

একটানা পড়ে ফেললাম। দারুন লাগল। গুরু গুরু
[সম্ভবত: অল্প সময়ের মধ্যে এত বড় লেখা লিখতে গিয়ে কিছু বানান ও লেখার গঠনসংক্রান্ত সমস্যা রয়ে গিয়েছে। তাতে রসগ্রহণে কোন বাধা পড়ে নি। তবে লেখা যেহেতু তারেক অণুর অতএব সময় করে সেগুলো ঠিক করে দিতে পারলে খুব ভাল লাগবে এইটা মৃদু করে জানিয়ে রাখলাম। হাসি ]
- একলহমা

তারেক অণু এর ছবি

সত্য, ভোর হয়ে গেছিল শেষ করতে করতে মন খারাপ

অতিথি লেখক এর ছবি

খুব ঝরঝরে করে লেখা ছিল। একটানে পড়ে ফেললাম। ধন্যবাদ, সুন্দর এই লেখাটার জন্য ।
- মুকুল

তারেক অণু এর ছবি
মাহবুব লীলেন এর ছবি

কী খাইলে মানুষ এত কিছু করতে পারে?
[প্রশ্নটা গাগারিন সম্পর্কে নয়; তারেক অণু সম্পর্কে। কেমনে সম্ভব ডেলি ডেলি এমন লেখা তৈরি?]

তারেক অণু এর ছবি

ভাত আর ( খাইছে ), আজকে কথা হবে দাদা

সুমিমা ইয়াসমিন এর ছবি

পাইয়েখালি

হাসি

তারেক অণু এর ছবি

দাভাই দাভাই

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

চমৎকার লেখা - অনেক কিছু জানা গেলো। তবে একটা জিনিস বুঝলাম না - জুতা খুলে উঠতে হবে কেন? (কে জানে, বুঝলে হয়তো আমিও নভোচারী হতাম।

যাকগে - লীলেন ভাইয়ের প্রশ্নের সাথে সহমত ঘোষনা করছি - সচলায়তনের পাতা তো বটেই- মুখমলাটে (ফেবু) কিছুক্ষন পরপর এমন সব স্ট‌্যাটাস দেয় যে --- থাক আর বল্লাম না।

তারেক অণু এর ছবি

সেইটাই ব্যাপার চোখ টিপি , দেখানো হয়েছিল রকেটকে পবিত্র হিসেবে দেখাতে সম্ভবত

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগল, স্তালিন ছিল বদ্ধ পাগল, সে নাকি বেছে বেছে বিজ্ঞানী আর প্রকৌশলীদেরকে গণহারে গুলাগে পাঠাতো। তার পরও মহাকাশ অভিযানে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবদান এমন যে আজো সেসব শুনলে মের্কিনীদের গাত্রদাহ হয়। নাসাতো এখন পুরাই দেউলিয়া প্রতিষ্ঠান, সবকিছুর পেছনে ব্যবসা খুঁজলে যা হয় আরকি, এইটাতো এখন একদম স্পষ্ট যে শুধুমাত্র সোভিয়েতের সাথে পাল্লা দেওয়ার জন্যই মের্কিন মুল্লুক নাসার পিছে লক্ষকোটি টাকা ঢালতো, না হলে নাসার অবস্থা আজ এরকম হতো না।

তবে ভাই ইয়ে, আপনার লেখায় একটা ভাইটাল তথ্য বাদ পড়ে গেছে, ইউরি গ্যগারিন মহাকাশে গিয়ে "বুরাকের চিঁহি ডাকের সাথে আযানের ধ্বনি" শোনেন, আর পৃথিবীতে অবতরণকালে ল্যান্ড করেন কাজাখস্তানের বৈকনূর কসমোড্রোমের কাছের একটি গ্রামের মসজিদের গম্বুজের উপর, সেই সময় মসজিদে জোহরের আযান হচ্ছিল, আযানের সুমধুর ধ্বনি শোনার পর উনি তৎক্ষণাত কালেমা তৈয়বা পড়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, আর নিজের নাম রাখেন আল্লামা মোহাম্মদ ইউরি স্যাকারিন, কারণ আযানের ধ্বনি উনার কাছে স্যাকারিনের মতই সুমিষ্ট লেগেছিল।

-- রামগরুড়

তারেক অণু এর ছবি
প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

আজানের সাথে সাথে কি কালেমা তৈয়বাও শুনেছিলেন তিনি? নাহলে সারা জীবনে যে কোনদিন কালেমা তৈয়বা শোনেনি, "আযানের সুমধুর ধ্বনি শোনার পর উনি তৎক্ষণাত কালেমা তৈয়বা পড়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন" কীভাবে?

অতিথি লেখক এর ছবি

এই একই প্রশ্ন আমারও, শৈশব থেকে বিখ্যাত মানুষের যত "তৎক্ষণাত" ধর্ম পরিবর্তনের করার কাহিনী শুনেছি, তাতে মনে হয় এঁরা সবাই একটি করে কালেমা লেখা কাগজ পকেটে নিয়ে ঘুরতেন, কারণ কখন কার হেদায়েত হবে তা কেঊ জানে না, হেদায়েত আসা মাত্রই যেন বিন্দু মাত্র কালক্ষেপন না করে "তৎক্ষণাত" ইসলাম কবুল করা যায়।

আবার এমনও হতে পারে, এই সব মহাশুন্য মিশনে নভোচারীদের কালেমা/নামাজ শিক্ষা বই পকেটে নিয়ে যাওয়া বাধ্যতামূলক, কারণ অনেকের ক্ষেত্রে এও শুনেছি যে ধর্ম পরিবর্তনের পর "তৎক্ষণাত" দুই রাকাত শোকরানা নফল নামাজ পড়েছেন।

-- রামগরুড়

তারেক অণু এর ছবি
সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

গড়াগড়ি দিয়া হাসি
রামগরুড় ভাই কি রেজিস্টার্ড মতিবেদক? চিন্তিত

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

প্যান্টের উপ্রে লাল আন্ডি না পিন্ধেও যে সুপারম্যান হওয়া যায়, তার এক নাম্বার উদাহরণ গ্যাগারিন
বসকে গুরু গুরু লেখককে আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

দারুন লেখা আর ছবি, কেম্নে পারেন ভাই? চিন্তিত
ইসরাত

তারেক অণু এর ছবি

এমনেই

বেচারাথেরিয়াম এর ছবি

সুন্দর লেখা হইছে। গ্যাগারিন সম্পর্কে এত কিছু জানা ছিল না আগে। বইটার সফট কপি খুজে পাইছি।আজকেই পড়া শুরু করব/

তারেক অণু এর ছবি

কস্কি মমিন! কই পাইলেন!

বেচারাথেরিয়াম এর ছবি

নেট ঘাটতে হইছে ম্যালা, কোন চিপা দিয়া জানি বাইর হইয়া পড়ল। লাগ্লে কইয়েন, পাডাই দিমুনি।

অতিথি লেখক এর ছবি

আমারে সন্ধান দেন। পড়তে চাই।

স্বয়ম

তারেক অণু এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

যথারীতি একটানে পড়ার মতো লেখা। খুব ভালো লাগলো। অনেক কিছু জানলাম। করোলভ সম্পর্কে আরো কিছু জানতে মন চায়। কবে যে লিখবেন।

স্বয়ম

রাত-প্রহরী এর ছবি

হাততালি

----------------------------------
Kamruzzaman Palash

তারেক অণু এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

এই গুরুত্বপূর্ণ কঠিন বিষয়টাকে এত সুন্দর, সহজ, এবং সাবলীল ভাবে উপস্থাপনের জন্য সাধুবাদ ।

শাকিল অরিত

তারেক অণু এর ছবি

ধন্যবাদ শাকিল ভাই, রাত জেগে লেখার জন্য কিছু বানান ভুল থেকে গেছে, পরে ঠিক করে নিব।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

আমাদের কিশোর বয়সে শোনা আশ্চর্য এক নাম, 'ইউরি গ্যাগারিন।'

তারেক অণু এর ছবি

আসলেই আশ্চর্য

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়তে পড়তে চোখে পানি চলে আসলো। ইউরি, তোমার জন্য মানবসমাজ গর্বিত।

আব্দুল্লাহ এ এম

তারেক অণু এর ছবি

লেখা -গুড়- হয়েছে ইউরি আমাদের গর্ব

স্যাম এর ছবি

আরো একটা মনে রাখার মত লেখা ! কোট করার জন্য হাত নিশপিশ করছিল - বিরাট মন্তব্য হয়ে যাবে বলে ক্ষ্যামা দিলাম হাসি

তারেক অণু এর ছবি

কোট করেন মিয়াভাই পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

নিরীহ মানুষ  এর ছবি

অণু আমাদের গর্ব

তারেক অণু এর ছবি

আই কিচ্চি

নিরীহ মানুষ  এর ছবি

কত অজানারে জানাইলা এবং দেখাইলা বন্ধু

তারেক অণু এর ছবি
সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

মূলবই না পড়ে পপি গাইড পড়ে কতো পোলাপানে সার্টিফিকেট পেয়ে শিক্ষিত হয়ে গেলো।
আপনার এই লেখাটা পপি গাইডের মতো হইছে, মূল বই আর পড়তে হবে না। হাসি

তবে তাড়াহুড়ার ছাপ স্পষ্ট। নাহয় একটু দেরিতেই দিন, তাড়াহুড়োটা কইরেন না। পড়তে কষ্ট হয়। যাহোক, করেই যখন ফেলেছেন, একসময় অবসর পেলে বানানগুলো মুদ্রণপ্রমাদগুলো শুধরে দিয়েন। আর ছবিগুলোতে ক্যাপসন যোগ করে দিয়েন। তাহলে ভালো হবে বলে মনে হয়।

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

তারেক অণু এর ছবি

জে না, মূল বই পড়তেই হপে চোখ টিপি

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

সকালে অর্ধেক পড়ছিলাম, একটু আগে বাকীটুক পড়ে শেষ করলাম।
যতটুকু জ্ঞান হয়েছে, এরচেয়ে বেশি এই বিষয়ে জানার আগ্রহ নাই... অতএব আমার পপিই পছন্দ চোখ টিপি

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

তারেক অণু এর ছবি

আপ্নি লুক খ্রাপ রেগে টং

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

এতদিনে জানলেন?

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

তারেক অণু এর ছবি

আগেই জানতাম এখন প্রমাণ পেলাম

তারেক অণু এর ছবি

কেবল দেখলাম আপনার পপির ফডু! ফডুশপ ১০০% !

ওডিন এর ছবি
তারেক অণু এর ছবি

কী দিলেন! কিচ্ছু দেহি না অ্যাঁ

ওডিন এর ছবি

দিলাম, নট বেড। দেঁতো হাসি আমি দেখতেছি অবশ্য

(ফেসবুকের নয়া ফিচারের মত সচলেও ছবি দিয়ে কমেন্ট করার ধান্ধা করতেছি আরকি)

তারেক অণু এর ছবি

চালায়ে যান!

তুলিরেখা এর ছবি

খুব ভালো, খুব ভালো, খুব ভালো।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তারেক অণু এর ছবি
দিগন্ত এর ছবি

কোমারভ কিভাবে মারা গিয়েছিলেন তা নিয়ে বিরাট গল্প-কথা আছে। এন-পি-আরে পড়েছিলাম। এর পর থেকেই গ্যাগারিনের সাথে কর্মকর্তাদের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে বলে শোনা যায়।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

তারেক অণু এর ছবি

সেটাই হবার কথা, অনেকেই এটাও বলে যে কোমারভ নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও গাগারিনকে বাঁচানোর জন্য নিজে থেকেই মিশনে গেছিলেন, সেটা অবশ্য বেশী গাজাখুরি মনে হয় আমার কাছে

এপোলোনিয়া এর ছবি

অজানা অনেক কিছু জানা হইল। ধন্যবাদ হাততালি

তারেক অণু এর ছবি

জানার কোন শেষ নাই

কড়িকাঠুরে  এর ছবি

সুপারহিরো... গুরু গুরু

তারেক অণু এর ছবি
খায়রুল মাসুদ  এর ছবি

কোমারভের জন্য দু:খ হয় , অদ্ভুদ দুনিয়া

তারেক অণু এর ছবি

হুম, আসলেই

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখাটা পড়তে পড়তে শেষে এসে কেমন যেন আবেগে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিলো----

-এস এম নিয়াজ মাওলা

তারেক অণু এর ছবি

আসলেই, কী সব অসামান্য অর্জন মানুষের

তানভীর এর ছবি

ঝরঝরে লেখা। তবে মজা পেলাম বেশি এই প্রশ্নটাতে- ম্যাঁও

"Yuri Alexeyevich, did you see Jesus Christ far up above the Earth?"

তারেক অণু এর ছবি
ছায়াপথের পথচারী এর ছবি

দুর্দান্ত লেখা, অণু ভাই। দারুণ লাগলো পড়ে। মহাকাশ ফেরত সুপার হিরোদের খ্যাতির বিড়ম্বনা আর সরকার থেকে অভিযান পরবর্তী উপেক্ষা দেখছি কমন কাহিনী! পড়ছি বায অলড্রিনের "Magnificent Desolation" - ভদ্রলোক অনেক মানসিক অশান্তির মধ্য দিয়ে গেছেন এই দুই কারণে। তবে অন্তত মাথা উঁচু করে লিখেছেন সব কথা। মহাকাশ নিয়ে আরো লেখার অপেক্ষায় হাততালি

তারেক অণু এর ছবি

আজ তো ব্ল্যাকহোলের ছবিই পাওয়া গেল প্রথমবারের মতো

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।