ম্যারিস্যা ক্রাউসোভার সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের এক আড্ডায় অনেক অনেক বছর আগে, জাতিসংঘের স্বেচ্ছাসেবী ডাক্তার হিসেবে বাংলাদেশে কর্মরত ছিলেন দুই বছর, সেই অল্প সময়েই টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথারিয়া কিছু বাদ রাখেন নি ঘুরতে, ফাঁকে ফাঁকে ভারত, নেপালের হিমালয়ে। চেক দেশের মানুষ, নিজের নাম সহজ করে বলতেন মারিয়া, যাতে সহজেই লোকে উচ্চারণ করতে পারে, ভাঙ্গা বাংলায় নিজেকে বিদেশিনী বলে পরিচয় দিতেও শিখেছিলেন।
উনার সাথে মূলত বন্ধুত্ব হয়েছিল টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ শেষে, সেবার দলের অন্যরা ঢাকা চলে এলেও আমরা গিয়েছিলাম প্রথমে জাফলঙ্গে এবং পরে শ্রীমঙ্গলে। থাকা হয়েছিল মারিয়ার পূর্বপরিচয়ের সুত্র ধরে ফাদার জোসেফ লেহানের তত্ত্বাবধানে শ্রীমঙ্গলের মিশনে, যেখানে চেক দেশের মানুষ শুনেই তাকে ক্যাথলিক ভেবে নিয়েছিল সেখানের মানুষেরা, যদিও তিনি ছিলেন সকল ধরনের গোঁড়ামি মুক্ত একজন, আর ক্যাথলিক কি না সেই প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলাম- আমি মানুষ, শুনেই স্মিত হাস্যে ফাদার বলেছিলেন- মঙ্গল হোক।
সেইবারেই মারিয়া বলেছিলেন আমরা বন্ধু হলেও তুমি তো বয়সে আমরা মেয়ে পাভলিনারও অনেক ছোট, কাজেই আমাকে মামকা বলতে পার, চেক ভাষায় এর অর্থ মা।
এরপরে বহু আড্ডা হয়েছে মারিয়ার সাথে, অধিকাংশ সময়ই আমার বন্ধুদের নিয়ে তার গুলশানের বাসায় যাওয়া হত (দু,একজন বন্ধু অবশ্য যেত তার সংগ্রহের বিরল কনিয়্যাক, বেখোরাভকা বা রেডওয়াইনে চাখার আকর্ষণে, তবে ভবি ভোলবার নয়, ডাক্তার মানুষ, তাই দিতেন মেপে মেপে একটা ছোট গ্লাসে! ), উনিও রাজশাহীতে আমার বাসায় গিয়েছিলেন, পদ্মার চরের কাদায় নেমে আপন করে নিয়েছিলেন শহরটাকে। অবশ্য তখনকার বন্ধুরা দুর্বল ইংরেজিতে ঘুরে ফিরে ৩টা প্রশ্নই ছুড়েছিল মারিয়াকে-
1 ) What is Your Name?
2) Where are You From?
3) How Old are You?
শেষোক্ত প্রশ্নটি শুনেই মারিয়া গম্ভীর হয়ে বলতেন- হুম, এমন প্রশ্ন একজন লেডিকে কেউ করে না! যদিও ঘুরে ফিরে ৩ প্রশ্নই আসত বারবার।
সেইবার বিখ্যাত বরেন্দ্র জাদুঘর ঘুরতে যেয়ে মারিয়ার কাছের এক অসাধারণ জিনিস শিখলাম ভ্রমণ নিয়ে, খুব তাড়া দিচ্ছি স্বল্প সময়ের মাঝে জাদুঘরের সমস্ত জিনিস এক পলক দেখার জন্য, এই সময় মুখে অভিজ্ঞতাপূর্ণ হাসি নিয়ে মামকা বললেন- My Boy, পৃথিবীটা অনেক অনেক বড়, তোমার কল্পনার চেয়েও অনেকগুণে বড়, তুমি যতই চেষ্টা কর, তাড়াহুড়ো কর- এই বিপুল বিশ্ব তুমি কখনোই এক জীবনে দেখে শেষ করতে পারবে না, বরং যতটুকুই দেখ- মনোযোগ দিয়ে দেখ, উপভোগ কর, তাতেই আসল সন্তুষ্টি।
ভ্রমণের নেশা ছিল তার প্রবল, বেড়ে উঠেছিলেন সোভিয়েত সমাজব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণে তৎকালীন চেকোশ্লাভাকিয়ায় যেখানে যথেচ্ছ ভ্রমণের কিছু সুযোগ ছিল না, বিশেষ করে প্রতিবেশী দুয়েকটি দেশ বাদে বিদেশ ভ্রমণ ছিল অসম্ভব ব্যাপার। তারপরও সেই লৌহ নিগড় গলে একটা ইউথ ক্যাম্পের ব্যবস্থায় গিয়েছিলেন মেক্সিকোতে। পরবর্তীতে শিশুকন্যাকে নিয়ে আফ্রিকাতে বেশ কবছরের জন্য, তাঞ্জানিয়ায়। মূলত আফ্রিকার সেই অবস্থানই তার জীবনে মাইলফলক হয়ে দাড়ায়, উপলব্ধি করেন জীবনে একা হলেও এগিয়ে যেতে পারবেন তিনি সমস্ত বাঁধা পায়ে দলে। বেশ ক,দশক আগে ব্যাপারটি মোটেও সহজ ছিল না একজন পশ্চিমা নারীর জন্য এক অজানা ভূখণ্ডে, এখনো না।
কিন্তু মারিয়া নতুনের আবাহনে ভয় পান নি কখনোই, বাংলাদেশেও এই ভাবেই এসেছিলেন একবছরের জন্য স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে, যৎসামান্য বেতনে, যদিও পরে সেই চুক্তি বাড়িয়ে অবস্থান করেছিলেন দুই বছর। একাধিক বার রাস্তায় গাড়ী থামিয়ে ভিক্ষুকদের ঔষধ দিতে দেখেছি তাকে, কিন্তু ভিক্ষা হিসেবে টাকা দিতেন না কখনোই। অবশ্য বাংলাদেশ নিয়ে তার অভিযোগের অন্ত ছিল না, প্রায়ই বলতেন- ঢাকার মত রাজধানী শহরেও সন্ধ্যা ৬টার পরে সমস্ত মেয়েরাই, সে হোক দেশী বা বিদেশী, এক অর্থে বন্ধী। সময় কাটাবার তেমন ব্যবস্থা নেই বাহিরে, বিনোদনের বড়ই অভাব, এমনকি কেউ শরীরচর্চার জন্য বাহিরে যাবে তাও পুরোপুরি নিরাপদ না। সেটা অবশ্য ২০০১ সালের কথা, এখনো কি ঢাকার অবস্থা একই আছে? পাঠিকারাই ভাল জানেন।
বাহিরে যাবার পরও মামকার সাথে যোগাযোগ নিরবিচ্ছিন্ন ছিল, নানা দেশ থেকে টার ইমেইল পেতাম, কখনও ফিলিপাইন, কখনও ইসরায়েল, কখনও ঘানা থেকে। অবশেষে তিনি চেক প্রজাতন্ত্রে ফিরে এলে তার প্রাগ শহরের বাড়ীতে বেড়াতে গিয়েছি একাধিকবার। প্রাগ-১ এর কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত প্রায় ৫০০ বছরের প্রাচীন বাসগৃহ, প্রতিটি ঘরে থরেথরে সাজানো বই, যেখান থেকে প্রতিবারই উপহার দিতেন অসাধারণ কিছু একটা। সাবেক একাধিক প্রেমিকাও আমার সাথে তার আতিথ্যগ্রহণ করেছে নানাসময়ে, হাসিমুখে ঘুরে দেখিয়েছেন সমস্ত প্রাগ শহর, দূরের গুহা, দারুণ সব দুর্গ, স্বচ্ছ নদী, এবং সেই সাথে আওড়ে গেছেন তার দেশের ও জাতির ইতিহাস। কখনও নিয়ে গেছেন ফ্রাঞ্জ কাফকার বাসগৃহে,
কখনও চমৎকার স্বাদের স্প্যাগেটি রান্না করে খাইয়েছেন, সাথে যোগ দিয়েছে তার মেয়ে পাভলাসহ যমজ নাতনীরাও!
সেই সাথে অব্যাহত আছে তার ভ্রমণ স্পৃহা, সত্তরের ওপর বয়স , হিপ জয়েন্টে ধাতব দণ্ড বসানো হয়ে, পায়েও আছে কিছু সমস্যা, লাঠি ছাড়া হাঁটতে পারেন না, কিন্তু ঠিকই লোকাল ট্রেনে চেপে চলে যান রাশিয়ার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে, টানা এক সপ্তাহ ট্রান্স-সাইবেরিয়ান ট্রেনে চেপে! কখনও আবার মেক্সিকোতে যেয়ে বিশেষ বাসে চাপেন যা গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস পেরিয়ে চলে যায় পানামা পর্যন্ত!
আবার অবসর জীবনেও প্রবেশ করছেন না একবারে, বলেন- ডাক্তারিতে যদি প্র্যাকটিস না থাকে তাহলে সব ভুলে যাব ! তাই সপ্তাহে কয়েকদিন হাসপাতালে ঠিকই যান ৫ দশকের পেশা আরও বেশী করে ঝালিয়ে নিতে।
অবশ্য ইদানীং বলছেন বছরে বড় ভ্রমণ মাত্র একটা করে করবেন, বলেই চলে গেলেন বলিভিয়া, পেরু, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা! সেই সাথে ছোটখাট বেড়ানো তো আছেই। তবে অর্থের প্রচলিত হিসাবে ধনী নন তিনি, বরং কষ্টার্জিত অর্থের কিয়দংশ সবসময়ই টিপে টিপে সংগ্রহ করে তাই দিয়েই ভ্রমণের খরচ মিটিয়েছেন সারাজীবন। এই ব্যাপার কৌতুক করলেই বলেন – অভিজ্ঞতা , জ্ঞান, ভ্রমণ, শখ, আনন্দ সবদিক দিকেই আমি একজন কোটিপতি, শুধু অর্থের দিক দিয়েই কোটিপতি আর হওয়া হল না জীবনে! অবশ্য তাতে কোন আফসোসও নেই!
একবার এক্স-গার্লফ্রেন্ডসহ মামকার বাড়ীতে বেড়ানোর সময় তার আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে আমরা HOTEL MAMA লেখা একটা পাত লাগিয়ে এসেছিলাম তার দরজায়, তখন কেবল এক বাসায় বসবাসের চিন্তা ভাবনা চলছিল, তার বছর তিনেক পরে বান্ধবীতে জানিয়েছিল, মামকা আমাদের পরিকল্পনা শুনেই তাকে বলেছিল- ছোকরার কাছে এখন মনে হয় দুনিয়া দেখাটাই মুখ্য, ওর টানে জড়াও কিন্তু বেশী ভেসে যেও না !
আমি আজও জানিনা মামকা কী করে সেই অব্যর্থ ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন। যোগাযোগ আজও অব্যাহত আছে আমাদের, আর অব্যাহত আছে শতাধিক দেশ ভ্রমণকারী মামকার ভ্রমণ, বাংলাদেশের বন্ধুদের কথা জিজ্ঞাসা করেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবসময়ই, আর গলাই জড়িয়ে রাখেন তার প্রিয় বস্তু- বাংলাদেশের গামছা!
(কদিন আগে একজন জানতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশে মেয়েরা কেন স্বাধীন ভাবে ঘুরতে পারে না।
পারে না তা ঠিক না, তবে বাঁধা আছে কোটি কোটি, তারপরও অনেকেই ঘোরেন সাধ্যমত, হাচল নীলম তো তার ৮ বান্ধবীকে নিয়ে সুযোগ পেলেই ঘুরে বেড়ান দেশের মাঝেই।
তাইই ভাবলাম মামকার ভ্রমণ নিয়ে দুর্বল ভাষায় কিছু লিখি, হয়ত তার ঘোরার নেশা এবং চেতনা আকৃষ্ট করবে বাংলাদেশের কোন কোন তরুণীকেও। )
মন্তব্য
মামকা কে স্যালুট
মামকা বেঁচে থাকুক আরো শতবর্ষ, ঘুরে বেড়াক এই পৃথিবীর প্রতিটি কোণা।
-----------------------------------------------------------
আঁখি মেলে তোমার আলো, প্রথম আমার চোখ জুড়ালো
ঐ আলোতে নয়ন রেখে মুদবো নয়ন শেষে
-----------------------------------------------------------
স্যালুট
facebook
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
facebook
"ওর টানে জড়াও কিন্ত বেশী ভেসে যেও না!"
মামকা কি মাসুদ রানা-র পাঠিকা ছিলেন?
কে জানে
facebook
হুম, বহুদিন পর মনে পরে গেলো। একবার তুমি, আমি আর লুছেন্ট মিলে গেলাম মারিয়া'র বাসায়। আথিথেয়তার মুল আকর্ষন ছিল রেড ওয়াইন। সেই প্রথম আমার রেড ওয়াইন খাওয়া। ঠিক আমার লন্ডন চলে যাবার আগের কথা। সেই দিনটার কথা আজ ও ভুলিনি। মারিয়া এক বিশ্বয় আজ ও আমার কাছে। কেমন আছে সে, কোথায় আছে এখন?
আছে বেশ ভালই, প্রাগে থাকে, ঘুরে বেড়ায় বিশ্ব
facebook
মামকা আপনাকে কি বলে ডাকত?
রাসিক রেজা নাহিয়েন
অণু
facebook
এমন মানুষের সঙ্গ পাওয়া দুর্লভ সৌভাগ্য। তুমি যথার্থই ভাগ্যবান।
আশা করি বাংলাদেশের পড়ুয়ারা এই লেখা থেকে অনেক প্রেরণা পাবেন।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
বাহ , ছবিটি তো বেশ !
facebook
অণু-দাদা, তোমার খোমাখাতায় একটা বার্তা দিসিলাম, নজরে পড়ে নাই, মনে লয়।
এই পাতাটা দেখ। পাতাটা তোমার-ও।
আবার ঐ পাতাতেই হাচল-ও হইসি
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/50144
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
facebook
অনেকদিন পর দেখলাম, শরীরডা ভালা? মনডা ভালা? অবশ্য আমাদের মনটা ভাল হয়ে গেল মামা ম্যারিস্যার গল্প শুনে।
অল ভালা ! প্রাণডা পুড়ে অবশ্য
facebook
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
facebook
এই কথাটাই আমি মনেপ্রাণে মানি।
তারপরেও, ক্ষতিত কী !
facebook
মামকা---
টাইপো - বাঁধা->বাধা
____________________________
চন্দ্রবিন্দু আমাকে পছন্দ করে না, আমিও তারে পাত্তা দিই না
facebook
মামকার বয়েসে আমাদের মায়েরা বাড়ির উঠোনেও ঠিকমতো যেতে পারেন না।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
হুম, অভ্যাস একটা বিশাল ব্যাপার, বাংলাদেশের পাহাড়ের মহিলারাই আবার এই বয়সেও প্রবল পরিশ্রমের কাজগুলো করে
facebook
অণু ভাইয়া, আপনার কয়টা গার্ল ফ্রেন্ড এক্স হইছে? এটা কিন্তু নির্দোষ কৌতুহল।
মামকাকে স্যালুট।
-নিয়াজ
গুপন
facebook
মামকাকে খুব ভালো পাইছি, অনুপ্রাণিত ও হইছি, দেখি সাম্নের বছর কই ঘুরতে যাওয়া যায়
facebook
ফটুব্লগ দেন মামকাকে নিয়ে। শিরোনাম "হোটেল মামায় আমি, মামকা এবং নানাবিধ গার্লফ্রেন্ড"। জুম করা ফটু দিয়েন।
..................................................................
#Banshibir.
facebook
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
facebook
৫ তাঁরা
facebook
"অভিজ্ঞতা , জ্ঞান, ভ্রমণ, শখ, আনন্দ সবদিক দিকেই আমি একজন
কোটিপতি, শুধু অর্থের দিক দিয়েই কোটিপতি আর হওয়া হল না জীবনে! "
কি অসাধারণ জীবন বোধ! স্যালুট মামকা।
আসলেই
facebook
নতুন মন্তব্য করুন