ল্য সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়া এবং অ্যান্তোনি গাউডির অন্যান্য সৃষ্টি

তারেক অণু এর ছবি
লিখেছেন তারেক অণু (তারিখ: শুক্র, ১৭/০১/২০১৪ - ৫:১৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

2645_155878720496_3888061_n

শুনতাম তাজমহল করতে ২২ হাজার শ্রমিকের ২০ বছর লেগেছিল, তাতেই মোঘল রাজকোষ আর জনগণের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা! আর সেইখানে যদি ২০০ বছর লাগে কোন স্থাপত্য গড়তে তাহলে কী অবস্থা হবে? চোখ কপালে তুলে নিশ্চয়ই ভাবছেন ২০০ বছরে রাজা তো রাজা, রাজত্ব পর্যন্ত বিলীন হয়ে যায় কালের গর্ভে, আর কোথাকার কোন স্থাপত্য! কিন্তু আসলেই এমন একাধিক অবিশ্বাস্য কীর্তি আছে মানুষের, যা গড়তে লেগেছে কয়েকশ বছর, প্রজন্মের পর প্রজন্ম! আর তাদের মধ্যে একটির নির্মাণ কাজ চলছে এখনো , যার শুরু হয়েছিল ১৮৮২ সালে, ধারণা করা হচ্ছে আধুনিক সমস্ত প্রযুক্তি নিয়েও শেষ করতে চলে যাবে আরও কয়েক দশক, এদিকে মূল স্থপতি অ্যান্তোনি গাউডি না ফেরার দেশে চলে গেছেন ১৯২৬ সালেই, কিন্তু বিপুল কর্মযজ্ঞ থেমে নেই, চলছে তার দিয়ে যাওয়া নকশা মোতাবেকই। চলুন ঘুরে সবাই সেই কালের সাক্ষী, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সন্ধিক্ষণ, অতুলনীয় ল্য সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়া উপাসনালয় থেকে।

2645_155878520496_3339154_n

কোথায় সেই ল্য সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়া?

বার্সেলোনা মহানগরীতে।

কিন্তু কোন দেশে? স্পেন?

ভুলেও এই ভুলটি করবেন না !

বার্সেলোনা মানে হচ্ছে ক্যাটালানিয়া, আপনি এসেছেন ক্যাটলান রাজ্যে, স্পেন নামের রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত তা ম্যাপে হলেও মানুষের মনে নয়। তাদের হিসাব খুব সহজ, আমরা হাজার বছরের বেশি সময় স্বাধীন ছিলাম, ঐ নচ্ছার স্প্যানিয়ার্ডগুলো আমাদের মেরে কেটে দখল করেছে মাত্র ৩০০ বছর আগে, কাজে কাজেই আমরা এখনো ক্যাটালান, এবং যে কোন যুগে নিজেদের রাষ্ট্র ফিরে পেতেও পারি। তাই আপনি এখন ক্যাটালানিয়ায়, এবং বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থপতি অ্যান্তোনি গাউডি একজন কাটালান।

2645_155878710496_4427778_n

খেলাপাগলদের বার্সেলোনার ন্যু ক্যাম্প আর অলিম্পিক ভিলেজ, রৌদ্র প্রত্যাশীদের জন্য উষ্ণ বেলাভূমি, ভোজনরসিকদের জন্য ফোর ক্যাটসসহ হাজার জাত-বেজাতের রেস্তোরাঁ, শিল্পবোদ্ধাদের জন্য পিকাসো জাদুঘরসহ নানা শিল্প সংগ্রহ থাকলেও বার্সেলোনায় প্রায় প্রতিদিনি সবচেয়ে বেশি মানুষের জমায়েত ঘটে ল্য সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়ার মূল ফটকে, যেখানে দাঁড়ালেই হয়ত সেই মূল্যবান দিনটির দুই-দুইটি ঘণ্টা টিকেটের অপেক্ষায় ব্যয় হবে অতি মন্থর ভাবে, আর যদি লিফট বেয়ে উপরের অংশে দাঁড়িয়ে গির্জা এবং তিলোত্তমা নগরীটির দিকে সপ্রশংস দৃষ্টি বোলাতে চান সেখানেও খরচ হবে বিস্তর সময় ও সামান্য অর্থ। তাই আমার ও ভ্রমণসঙ্গিনীর টিকেট ইন্টারনেটের মাধ্যমে আগেই কাটা ছিল, কমলালেবুর আভাময় এক ক্যাটালান সকালে হোটেল থেকে বেরিয়ে পদব্রজে সোজা সেঁধিয়ে গেলাম উপাসনালয়ের অভ্যন্তরে, অপেক্ষমাণ হাজার দর্শনার্থীর বক্রদৃষ্টির সামনে।

১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয় এই মহাযজ্ঞ জোসেফ মারিয়া বোকাবেইয়া নামে এক পুস্তক ব্যবসায়ীর হাত ধরে, ভ্যাটিকান সিটি ভ্রমণের পর যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন ক্যাটালানিয়ায় এক দারুণ গথিক স্থাপত্য গড়ে উঠবে, যা আকর্ষণ করবে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি। প্রারম্ভে মূল স্থপতি অন্যজন থাকলেও পরের বছরই তাতে যোগ দেন ঈশ্বরের স্থপতি খ্যাত আন্তনি গাউডি এবং ১৮৮৪ সালে তিনি নিয়োগ প্রাপ্ত হন মূল স্থপতি হিসেবে। দীর্ঘ চার দশক কাজের পরে ১৯২৬ সালের গাউডির মৃত্যুর সময়ে স্থাপত্যটির এক-চতুর্থাংশও নির্মাণ করা সম্ভব হয় নি, এবং সেই নির্মাণ কাজ চলছে এখনো, যেখানে মিলেছে ক্যাটালান, গথিক এবং আর্ট নুয়েভোর স্থাপত্যধারা।

2645_155878550496_7774738_n

দেখলাম আধুনিক প্রযুক্তির দান আকাশ ছোঁয়া বেশ কটি ক্রেন এবং অন্যান্য নানা সরঞ্জাম, এদের সাহায্য নিয়েও নির্মাণযজ্ঞ চলছেই দশকের পর দশক, মাঝে বলা হচ্ছিল গাউডির মৃত্যু শতবার্ষিকীতে ২০২৬ সালে শেষ করা হবে নির্মাণ কাজ, এবং তাতে প্রতিফলিত হবে গাউডির স্বপ্ন। কিন্তু ইতিমধ্যেই বলা হয়েছে অন্তত আরও ২ বছর লাগবে সম্পূর্ণ কাজ শেষ হতে, এবং তারপরেও বলা সম্ভব হচ্ছে না গাউডির আদি নকশা অনুযায়ী, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়েও ২০০ বছরে কাজটি শেষ হবে তো! যে কারণে স্থানীয় অনেক মানুষই এই মন্দার বাজারে এমন ব্যয়বহুল নির্মাণ কাজের হাতি পোষার বিরুদ্ধে, যদিও সেই কারণেই ফি বছর আসছে মিলিয়ন পর্যটক। আবার নির্মাণ শেষ হলে এটি বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু চার্চ।

2645_155878555496_6087647_n

এক নজরে গির্জাটি বুঝে ওঠা বেশ কঠিন, মনে হয় বড়সড় একটা জিগস পাজল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, একদিকে ভাঙ্গাচোরা, তো অন্যদিকে বেশ সাজানো গোছানো। একই দেয়ালের দুটি পাশাপাশি অংশ হয়ত কয়েক যুগ আগে পরে নির্মিত, ফলে একদিক রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতে হয়ে গেছে কালের সাক্ষী জমকালো কৃষ্ণ বর্ণের, আবার অন্যদিক সদ্য মোড়ক খোলা আনকোরা বইয়ের মত, অনাগত ক্লেদ ও গর্বময় ভবিষ্যতের অপেক্ষায়। তবে হ্যাঁ, সকল দর্শনার্থীকে দুইটি একইসাথে করতে সক্ষম ভুবন নন্দিত এই কলাগৃহ, যা হচ্ছে কিংকর্তব্যবিমূঢ় এবং চক্ষুচড়কগাছ!

2645_155878530496_865569_n

বিশেষ করে তার মূল ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে, অবশ্য বিশালাকার বিস্ময়টির মূল ফটক বা সামনের façade আসলে তিনটি, যার প্রতিটিতে খোদাই করা আছে বাইবেলের নানা বিষয়ভিত্তিক কাহিনী, এবং অবশ্যম্ভাবী ভাবেই গাউডির অন্যতম বৈশিষ্ট্য প্রকৃতি, যেমন একটি ফটকের দুই মূল স্তম্ভের নিচেই আছে দুটি কাছিম, যা কিনা জল ও ডাঙ্গার প্রতীক, প্রস্তরীভূত কাল ও অপরিবর্তনীয় বস্তুর প্রতীক আবার, অন্য দুটি স্তম্ভের সাথে আছে পরিবর্তনের প্রতীক ক্যামেলিয়ন গিরগিটি!

2645_155878735496_38959_n

তবে প্রকৃতির আসল ছোঁয়া পেতে আপনাকে প্রবেশ করতে হবে মূল প্রার্থনাঘরে যেখানের বিশালাকার স্তম্ভগুলোর গা বেয়ে শীর্ষে নজর ঠেকলে অভিভূত হয়ে নিজেকে আবিষ্কার করবেন কংক্রিটের মোহময় বৃক্ষে নিচে, সোনালি ডালপালা ছড়িয়ে দিব্যি এক কুঞ্জবনের আবহ গড়ে তুলেছে সে ছাদের আশ্রয়ে, কারণ সে একা নয়, বরং এখানের প্রতিটি স্তম্ভই একটি বনস্পতির প্রতীক।

2645_155878650496_3786669_n

তার মধ্যে আবার কিছু নির্মাণাধীনগুলোর শেষ প্রান্ত স্বর্ণালী হবার কারণ হিসেবে জানা গেল সেখানে নিখাঁদ সোনা ব্যবহার করা হয়েছে জৌলুস, স্থায়িত্ব, আবেদন ও বিস্ময় বাড়াতে এবং জাগাতে।

2645_155878630496_1951147_n

দৃষ্টিনন্দন সব শিল্প কর্ম তৈরি করা হয়েছে জানালার বর্ণীল কাঁচ দিয়ে, তার গ্রহণযোগ্যতা আবার শত গুণে বাড়িয়ে দেয় সগৌরবে প্রবেশ করা অবারিত সূর্যকিরণ, ভিতরে গড়ে উঠে একের পর এক জাদুমুহূর্ত, সাররিয়েল সঙ্গীতের মত। মানুষের সৃষ্টির প্রতি মুগ্ধতায়, মানুষের কল্পনাশক্তির অপরিমেয় ক্ষমতায় শ্রদ্ধা ফিরিয়ে নিয়ে আসে এমন অমর কীর্তি, হোক না তা নির্মাণাধীন, হোক না তা কোন কল্পিত দেবতার উদ্দেশ্যে নির্মিত।

2645_155878605496_2973496_n

বেজায় মানুষের ভিড়, সকলেই কৌতূহলের আবীর মেখে ভুরু কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করছে কী ছিল গাউডির মনের গহনে, কিন্তু থিতু হয়ে উপভোগের সময় কম, বরং গুটি গুটি এগোতেই হচ্ছে সবসময়। এরই ফাঁকে লিফট বেয়ে উঠে গেলাম অন্য ধরনের স্তম্ভশীর্ষগুলোর খুব কাছে, সেখানে যেমন আমাদের স্বাগতম জানালো প্রস্তরপায়রা, তেমনি নয়নাভিরাম বার্সেলোনা।

2645_155878670496_1903902_n

সেখানেও নজরে আসল গাউডির অনন্য সৃষ্টির দিকে, ঝুড়ি ভর্তি ফলের আদলে গড়া দুর্দান্ত সব স্থাপত্যের। যাদের বর্ণচ্ছটা মুগ্ধ করে আমাদের, সেই সাথে জানালা এবং বারান্দাগুলোর অসাধারণ সহাবস্থান করে চমকিত।

2645_155878580496_632222_n

2645_155878675496_3210764_n

এত জটিল অথচ মনোমুগ্ধকর সরল স্থাপত্যগুলো অবলোকন করে প্রথমে কিছুতেই বুঝতে পারি না কেন এগুলো নির্মাণের জন্য শত বছরও যথেষ্ট নয়, আবার অল্পক্ষণ চিন্তা করলে মনে হয় কালজয়ী হতে হলে হয়ত এই পরিমাণ সময়, শ্রম, মেধা দিতেই হয়, তাইই যদি না হবে তাহলে আপাতজটিল এই স্থাপত্যকলা কেন আমাদের মত কোটি জ্ঞানহীন মানুষের মনে মুগ্ধতার আবেশ আনতে পারে। সবচেয়ে বেশি ভাল লাগল নিচে নামার সময় প্যাঁচানো সিঁড়ি দেখে, বিশেষ ধরনের শামুকের (মোলাস্ক) খোলসের আদলে গড়া সিঁড়ি দেখে কেমন যেন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে, ব্ল্যাকহোলের কথা মনে হয়! পাক খেয়ে খেয়ে যেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড চলে যাচ্ছে সেই অতল কৃষ্ণকেন্দ্রে, যার থেকে মুক্তি নেই কোনকিছুর, এমনকি আলোরও!

2645_155878705496_4965819_n

আবার বাহিরে এসে কয়েক দিক ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে , বোঝার ব্যর্থ চেষ্টা করে সিনর গাউডিকে বিশাল এক স্যালুট দিয়ে রওনা দিলাম তার আরেক অমর কীর্তির উদ্দেশ্যে, যার নাম কাসা মিইয়া বা ল্য পেদ্রেরা।

2645_155878840496_430569_n

আন্তনি গাউডির সাতটি সৃষ্টি ইউনেস্কো কতৃক ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট বা বিশ্ব সম্পদ ঘোষিত হয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম ১৯০৬ থেকে ১৯১২ সালের মাঝে নির্মিত এই নন্দিত ভবনটি। ভার্জিন মেরির ভক্ত গাউডি চেয়েছিলেন এই কাজটি যেন বিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে গড়ে ওঠে, সেই সাথে ভবনের ভিতর এবং বাহির থেকে যত বেশি সম্ভব বাঁক (Curve) নির্মাণের কাজ সফল হয়েছিল তার, ফলে ভবনের অনেক কক্ষেই মাপমত আসবাবপত্র স্থাপন করা সম্ভব হয় নি!

2645_155878745496_16374_n

মূল ফ্লোরের প্রয়োজনীয় সমস্ত আসবাবপত্রের নকশা অবশ্য গাউডি নিজেই করেছিলেন, তা নিয়ে ভবন নির্মাণের জন্য অর্থের যোগানদাতা মিসেস মিইয়া একটি পিয়ানো বসাবার জায়গার অভাবের কথা উল্লেখ করলে স্পষ্টভাষী গাউডি বলেছিলেন – বেহালা বাজালেই হয়!

2645_155878820496_12035_n

সেই সাথে গাউডির একান্ত ইচ্ছা ছিল কাসা মিইয়ার বাসিন্দারা যেন একের অপরের পরিচিত হয়, বন্ধু হয়, তাই এখানে লিফট আছে প্রতি একতলা অন্তর অন্তর, যাতে এক তলার লোক অন্য তলায় যেয়ে লিফটের জন্য অপেক্ষা করতে করতে অন্য তলার বাসিন্দাদের সাথে মোলাকাতের সুযোগ পায়। এমন বাঁকময় ভবন সম্ভবত আর একটিও নেই পৃথিবীতে, আর তার অভ্যন্তরে প্রবেশের সাথে সাথেই বাঁকের সাথে সাথে নজর কাড়ল ঝলমলে সব রঙের ব্যবহার! যত্রতত্র, সবখানে! সেই সাথে একটুকরো বাঙময়, বাঁকময় নীলাকাশ।

2645_155878835496_3598409_n

কোন এক তলাতে অমর স্থপতির প্রতিকৃতি, তার নানা কাজের নমুনা,

2645_155878755496_8115360_n

2645_155878815496_2328395_n

যদিও সে দিয়ে আমরা ঘিরে রয়েছি বার্সেলোনায় সারাক্ষণই! কাসা মিইয়ার আকৃতি যেমন মুগ্ধ করল আমাদের, তেমনি বিস্মিত করল তার ছাদ! একেবারেই অন্যধরনের ডিজাইনে তৈরি করা এক গাদা চিমনি আর স্কাইলাইটের সমন্বয়ে গঠিত এক অন্যভুবন।

সেখানে ব্যবহার করা হয়েছে কোথাও ভাঙ্গা বোতল, কোথাও মার্বেল, কোথাও চুনাপাথর।

2645_155878775496_2107581_n

2645_155878785496_11829_n

2645_155878780496_7452247_n

নানা চিমনী, স্তম্ভের সাথে স্থান পেয়েছে সুদৃশ্য সব আর্চ, যার ভিতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে গাউডির ম্যাগনাম ওপাস- ল্য সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়া!

2645_155878800496_690958_n

এমন অদ্ভুতুড়ে ছাদে কাটিয়ে দেয়া যায় অনেক অব্যক্ত সন্ধ্যা-দিবস-রজনী, কিন্তু বরাবরের মতই হাতে সবই আছে, অফুরন্ত না হলেও পর্যাপ্ত, কিন্তু নেই সময়! তাই সময়ের সদ্ব্যবহারের জন্য জোরসে কদম চালিয়ে শহরের আরেকদিকে গাউডির আরেক অনন্য সৃষ্টি পার্ক গুয়েল।

2645_155878860496_2258426_n

১৯০০ সালে যাত্রা শুরু হওয়া নয়নাভিরাম স্থাপত্যময় উদ্যানটির নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯১৪ সালে, এবং এইখানেরই এক বাড়ি কিনে তাতে বসবাস শুরু করেন স্বয়ং গাউডি, যেখানে তিনি কাটিয়েছেন জীবনে শেষ বিশটি বছর, যে বাড়ি আজ পরিণত গাউডি জাদুঘরে। পার্ক গুয়েল এক রূপকথার রাজ্য, স্থাপত্যকলার জটিল হিসেব আর কৌশলের চেয়ে সেখানে জীবনের রংঝলমলে দিকই বেশি নজরে আসে। গাছের আদলে নির্মিত দেয়ালে পাখির কৃত্রিম বাসা তৈরি করে দিয়েছিলেন গাউডি স্বয়ং, আজও এই পার্ক ভর্তি থাকে কয়েক ধরনের টিয়াসহ নানা জাতের পাখিতে।

2645_155895560496_7856813_n

বসার মূল বেঞ্চ গাউডি বানিয়েছিলেন অজানা কোন সমুদ্র দানবের দীর্ঘ দেহের আদলে, স্থানে স্থানে ব্যবহার করেছেন দুর্লভ টাইলস, মোজাইক।

2645_155878855496_6296245_n

আপন মনের সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে প্রাণ নিয়ে এসেছেন ইট-কাঠ-পাথরের ভাস্কর্যেও।

2645_155878870496_7565884_n

2645_155878875496_6362675_n

বেশি দৃষ্টি কেড়েছে বহুবর্ণ সরীসৃপ স্যালাম্যান্ডার, এমন বিখ্যাত স্যালাম্যান্ডার মনে হয় না ভূভারতে আর আছে। শহরের উদ্যানের মাঝে গাউডির সৃষ্টিশীল মনের বাস্তব রূপ জল সরবরাহের পথে মুগ্ধতা কুড়াচ্ছে সকলের, কখনো সরীসৃপ রূপে, কখনো বিহঙ্গরূপে।

2645_155878925496_6569338_n

2645_155878890496_6671882_n

2645_155878885496_2103887_n

2645_155878935496_7905685_n

2645_155878940496_1066151_n

দূরে ভূমধ্যসাগরের সুনীল আমাদের হাতছানি দেয়, সারাদিন বিস্ময়ের ভারে এবং সৌন্দর্য শোষণে অক্লান্ত মনের কাছে তার আবেদনও নিছক ফেলনা নয়। হোটেলে ফেরার আগে লোনা জলে একটু সাঁতার হয়ত নতুন উৎসাহ যোগাবে রাতের ক্যাটালানিয়াকে বুঝতে, সেই মোতাবেকই সাত তাড়াতাড়ি করে বাসে চেপে যাওয়া হল সমুদ্রের পাড়ে, পথে বাস থেকেই নজরে আসল আন্তনি গাউডির আরেক মাস্টারপিস কাসা বাতিও ( Casa Batlló),

2645_155878945496_2671034_n

আরেক রূপকথার সোনার দেয়াল, রূপার ছাদের চেয়েও বর্ণময় বহুরঙা ভবনটি আগামীতে যাবার তালিকায় রেখে অতিমানব সেই স্থপতির উদ্দেশ্যে শুধু শত সহস্র কুর্নিশ করে চলি মনে মনে।

( গাউডির কাজ নিয়ে উৎসাহীরা এই অ্যালবামে উকি দিয়ে কিছু ডিটেইলস ছবি দেখতে পারবেন। আমি মুগ্ধ দর্শক, স্থাপত্য আর শিল্পকলার চিরনবীন ছাত্র, তাই গাউডি নির্মিত বিশ্বের বিস্ময়গুলোর ভিতরের রহস্য, কার্য, কারণ, নির্মাণ প্রক্রিয়া অভিজ্ঞ স্থপতিদের হাতেই ছেড়ে দিলাম। কেবল রেখে গেলাম ভবঘুরের মুগ্ধতার বয়ান।

আমার বন্ধু, ভবিষ্যতের স্থপতি তানজিলা আহমেদের ( যে কিনা সচলায়তনে মাঝে মাঝে উঁকি দেয় 'দ্বিতীয় সুবর্ণরেখা' নামে) জন্মদিন আজ, এই পোস্টটি তার জন্য।

শুভ জন্মদিন তানজিলা। )


মন্তব্য

মুস্তাফিজ এর ছবি

ল্য সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়া নিয়ে তথ্যে কিছুটা বিভ্রান্তি আছে। গাউড়ি মারা যাবার পর ১৯৩৬ সালে স্পেনের সিভিল ওয়ারের সময় এর নকশা পুড়ে গেলে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে গাউড়ির সাথে কাজ করা কারিগরদের স্মৃতি আর গাউড়ির অন্য কাজ গুলো থেকে ধারনা নিয়ে আরেকটি নকশা করা হয়, বর্তমান সেই নকশানুযায়ীই কাজ চলছে। দেরী হবার আরেকটি অন্যতম কারণ অর্থনৈতিক। এই কাজে আলাদা কোন ফান্ড না থাকাতে শুধু দানের উপর ভিত্তি করেই এর কাজের অর্থায়ন চলছে।

...........................
Every Picture Tells a Story

তারেক অণু এর ছবি

চলুক

স্পেনের সিভিল ওয়ারের সময়ই না কাজ থেমে ছিল কিছুদিন?

বর্তমান প্রধান স্থপতির সাক্ষাৎকারে পড়েছিলাম তার মতে বর্তমানে গির্জার যে চেহারা দাঁড়াচ্ছে তা গাউডির নকশার প্রায় ৯০ ভাগ, কাজেই আমরা সেতাকে স্বাগতম জানাতেও পারি। হয়ত বোঝাতে চাচ্ছিলেন- আর কত? চোখ টিপি

শাব্দিক এর ছবি

চলুক আমার লেখাটা পড়েই প্রশ্ন জেগেছিল যে মুল নকশা কি শতভাগ অপরিবর্তিত আছে নাকি। ধন্যবাদ মুস্তাফিজ ভাই প্রথম মন্তব্যেই উত্তরটা পেয়ে গেলাম।

---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।

তারেক অণু এর ছবি

হাসি

শাব্দিক এর ছবি

অসাধারন ব্যাপার। ধারনাই ছিল না এমন স্থাপত্যের সম্পর্কে চলুক

---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।

তারেক অণু এর ছবি

জটিল জায়গা্‌, চলতেই আছে, তো চলতেই আছে !

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগল।

বিবর্তনবাদী

তারেক অণু এর ছবি

ধন্যবাদ

নির্ঝর অলয় এর ছবি

চলুক

তারেক অণু এর ছবি
এক লহমা এর ছবি

চলুক

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

তারেক অণু এর ছবি

গ্লেসিয়ারের আর গল্প কবে আসবে?

এক লহমা এর ছবি

৩ পর্বে সমাপ্ত হই গিচে ত! হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

তারেক অণু এর ছবি

তাহলে নতুন কিছু কর -

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

১।
বাহ দারুণ! হাততালি

২।
বার্সেলোনা মানে স্পেনই জানতাম। ক্যাটালান নামটা কেবল খেলার পাতাতেই পড়েছি এতদিন, এটা যে রীতিমত একটা অনুভূতি তা জানতামই না।

৩।
গির্জা হিসেবেও কি এটি চালু আছে? না হয়ে থাকলে সম্পুরক প্রশ্ন- চালু হবার পরে কি এতে পর্যটকদের প্রবেশাধিকার থাকবে?

৪।
তানজিলা আপুকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

তারেক অণু এর ছবি

আরেব্বাস- বলে কী!! তাঁদের আলাদা ফুটবল দল পর্যন্ত গঠনের পায়তারা চলছে।

পর্যটকদের প্রবেশাধিকার সবসময়ই থাকবে।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

তাইলে ঠিকাছে, এই রীতি আমাদের দেশেও আসুক, এই কামনা করি হাসি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

তারেক অণু এর ছবি

আমেন

অতিথি লেখক এর ছবি

হেহে থেঙ্কু

আমিই তানজিলা খাইছে

তারেক অণু এর ছবি

আইডি ? অ্যাঁ

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ অণুদা! পড়ে ফেলসি পুরাটা! অনেক ভালো হইসে! আপনি অন্য কিছুর চেয়ে আর্কিটেকচার নিয়ে ভালো লিখতে পারেন কিন্তু! সত্যি!
অনেক কিছু জানলাম... এবং আসলেই অনেক ভালো লাগসে।
আরো ঘুরেন আর আরো লিখেন! চলুক

দ্বিতীয় সুবর্ণরেখা হাসি

তারেক অণু এর ছবি

আপনিও ডিজাইন করেন, দারুণ সব নকশা নিয়ে ! আর ঘুরতে থাকেন, গোল পৃথিবীর এই মাথা থেকে ঐ মাথা-

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

সিনর ত্বরিতাক্য অস্থানুকাল গুরু গুরু

জবরদস্ত ঘুরন দিয়েছেন আরও একবার

তারেক অণু এর ছবি

আবারও আস্পনে!

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

ওয়াও! উত্তম জাঝা!

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

তারেক অণু এর ছবি

কী মিয়া, নতুন কোন গাছের কাহিনী বললেন আমাদের?

সুজন চৌধুরী এর ছবি

বাহ! দারুণ! অনেক কিছু জানা গেলো!! ধন্যবাদ তারেকাণু!

তারেক অণু এর ছবি

যান যান, সবই আপনার জানা ছিল দেঁতো হাসি

সুজন চৌধুরী এর ছবি

ভাগ‌্যিস! এই পোস্টটা দিছিলেন! এখন রেফারেন্স দেয়া যাবে!

তারেক অণু এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

মাসুদ সজীব

তারেক অণু এর ছবি
সাফিনাজ আরজু এর ছবি

চলুক চলুক
অনুদা আপ্নে বস লোক।
কি একখান পোস্ট দিলেন, এখন যাইতে মন চায় ল্য সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়া।
তানজিলা আপু কে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। হাসি

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

তারেক অণু এর ছবি

এখনই যান, শীতের সময় বাহির হন আপন ডেরা ছেড়ে!

আয়নামতি এর ছবি

বাহ! দারুণ! অনেক কিছু জানা গেলো!! ধন্যবাদ তারেকাণু!

হাসি

তানজিলার জন্য অনেক শুভকামনা।

তারেক অণু এর ছবি
রোমেল চৌধুরী এর ছবি

বাহ, ভালোই তো! দাঁড়াও লহমা, আমিও ইতিহাস তুলে আনছি। বিদিশি নয় একেবারেই দিশি।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

তারেক অণু এর ছবি
ফারিহা এর ছবি

অসাধারণ স্থাপত্য শিল্পকর্ম ছিল তাঁর, আন্টনির প্রতিটি শিল্পকর্ম আমাকে মুগ্ধ করেছে।

তারেক অণু এর ছবি

আসলেই

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।