দেখো, আমরা ভাষাসৈনিক নই, সৈনিক বলতে যা বোঝায় আমরা তো তা ছিলাম না, বরং বলতে পার আমরা সকলেই ছিলাম ভাষা আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত। যার সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল যে সাংগঠনিক ভাবে সাহায্য করেছে, যে নকশা করতে পারে সে নকশার ধারণা দিয়ে সাহায্য করেছে, যার পেশী সবলতর সে বেশী ইট পরিবহন করে সাহায্য করেছে। সকলের ভূমিকায় অনস্বীকার্য।
- দৃঢ় কণ্ঠে এই কথাগুলো বলছিলেন সাঈদ হায়দার দাদু। স্থান- তার উত্তরার বাসভবন, সময়- ২২ ফেব্রুয়ারির রোদেলা সকাল ২০১৪।
৮৯ বছরের জীবন্ত ইতিহাসের সাথে আমাদের পরিচয় সেইদিনই। ১৯৫২র ২৩ ফেব্রুয়ারী রাতে ঢাকায় প্রথম যে শহীদ মিনার গড়া হয়েছিল উনি তার মূল দুইজন নকশাকারের একজন। মুখে আবেগ নিয়ে বলে চলেছিলেন সেই উম্মাতাল সময়ের কথা, ভাষার জন্য প্রাণদানের প্রতিজ্ঞার কথা, কিভাবে একটি সাদামাটা স্থাপত্য বাঙ্গালীর আদর্শের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হল সেই অলৌকিক কাহিনী।
আমরা বলতে আমার সাথে ছিলেন রাব্বি খান ভাই, বন্ধু ফোকলোরবিদ উদয় শঙ্কর বিশ্বাস এবং মাঝে মাঝে হায়দার দাদুর গত ৫৩ বছরের সহকর্মী। আগের দিন ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪তে তার নাতির কন্যা সন্তানের জন্ম হয়েছে, চার পুরুষ দেখে যাবার আনন্দে তার মুখ ঝলমল, তার চেয়েও বেশী তৃপ্তিদায়ক ছিল সেই শহীদ মিনার গড়ার স্মৃতি রোমন্থন। বললেন, কিই আর এমন হয়েছিল, একটা চৌকোণা কাঠামোর উপরে একটু উঁচু করে কিউব, আটপৌরে, দেখতেও খুব আকর্ষণীয় কিছু একটা না। কিন্তু সেটিই হয়ে গিয়েছিল আমাদের নয়নের মণি, বাঙ্গালীত্বের প্রতীক। সেটিকে বারবার ধ্বংস করেও তো আমাদের দমানো যায় নি, ফুঁসে উঠেছে ছাত্র –জনতা বারংবার, ঠিকই আদায় করে নিয়েছে নিজেদের অধিকার।
তবে বর্তমান শহীদ মিনারের নকশা নিয়ে হায়দার দাদু খুব একটা সন্তুষ্ট নন, কারণ মূল নকশার অনেক কিছুই এখনো অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। ডাক্তারি ডিগ্রী পাবার পরপরই বিশেষ নিয়মের আওতায় ৫ বছরের জন্য তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে তার বদলী হয়ে যায়, সেখানের বাংলা ভাষাভাষীদের সাথে অবশ্য তিনি মাতৃভাষার চর্চা ঠিক অব্যাহত রাখেন। সবসময় রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন তিনি। জিয়াউর রহমানের সময় তার তৈরি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে ভাষাসৈনিকদের তালিকা খবরের কাগজে ছাপিয়ে সোনার মেডেল ও সম্মাননা দেবার কথা চলছিল কিন্তু তার অনেকেই এটি প্রত্যাখ্যান করেন, কারণ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নয়, সেগুলো দেয়ার পায়তারা করা হচ্ছিল রাজনৈতিক দল থেকে।
উদ্দীপ্ত কণ্ঠে যেন আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি সেই ঝাঁঝালো মুহূর্তগুলোতে, খুব আফসোস হচ্ছিল সাথে ভিডিও ক্যামেরা না নেওয়ায়। তবে দাদু কথা দিয়েছেন সামনের মাসে একদিন সময় দেবেন আড্ডার জন্য, আমাদের জানাবেন কী ঘটেছিল সেই সময়ের ঢাকায়। উনার লেখা দুটি বই ( একটি বাংলায় লেখা জীবনস্মৃতি , অন্যটি ইংরেজিতে লেখা) উপহার দিলেন সবাইকে। আশ্বাস দিলেন বইগুলো পড়ে মাথায় যে প্রশ্নগুলো আসবে সেগুলোর উত্তর দিবেন তিনি।
ফেরার আগে একটি বিশেষ আলোকচিত্র দেখাবার জন্য শোবার ঘরে নিয়ে গেলে সেখানে দেখি একটি আধখোলা খাতা, তাতে লেখা কয়েকটি লাইন। হায়দার দাদু হেসে বললেন- জীবন এত্ত ছোট, তাই চেষ্টা করি সময়ের সদ্ব্যবহার করার। তোমরা আসার আগে আমি লিখছিলাম। বিস্ময়ে, মুগ্ধতায় বিমূঢ় হয়ে এই কর্মযোগী জীবন্ত ইতিহাসের কাছ থেকে আমরা বিদায় নিই আবার দেখা হবার প্রতিশ্রুতি নিয়ে।
( ইচ্ছা ছিল ডা. সাঈদ হায়দারের আত্মজীবনী পড়ার পরে এবং উনার সাক্ষাৎকারের ভিডিও নিয়ে বৃহৎ আকারের পোস্ট দেবার, কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাস চলে যাচ্ছে! এমন অসাধারণ স্মৃতি যদি সচলায়তনে এই মাসে ভাগাভাগি না করি তাহলে কেমন করে হয়! হোক না ছোট পোস্ট, তার গুরুত্ব তো অসীম, তাই না?
পরবর্তীতে বইয়ের আলোচনা, ভিডিও ইত্যাদি আসিতেছে। )
মন্তব্য
"এমন অসাধারণ স্মৃতি যদি সচলায়তনে এই মাসে ভাগাভাগি না করি তাহলে কেমন করে হয়! হোক না ছোট পোস্ট, তার গুরুত্ব তো অসীম, তাই না?"
-অবশ্যই!
"পরবর্তীতে বইয়ের আলোচনা, ভিডিও ইত্যাদি আসিতেছে।"
অপেক্ষায় থাকলাম।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
দেখি, পারলে সামনের মাসেই
facebook
হুম
facebook
মর্মস্পর্শী এই আখ্যানটির জন্য কোন ধন্যবাদই যথেষ্ট নয়!
৮৯ বছর পেরিয়ে গেছে, তবু কি প্রত্যয়ী! উদ্যমী! বিশেষত চোখ দুটো থেকে এখনো ঝিলিক মারছে সেই সাহস, মাথা নত না করার দীপ্ত প্রত্যয়!
আমার মত অনেকেই হয়ত প্রথম পরিচিত হয়েছে একুশের প্রথম শহীদ মিনারের রূপকারের সাথে।
কৃতজ্ঞতা বাড়ছেই কেবল, অণুদা, শুধু বিদেশ না, দেশ দেখতেও আপনার ব্লগগুলি অপরিহার্য হয়ে পড়ছে এখন।
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
ধন্যবাদ, চেষ্টা করব আরও তথ্যবহুল পোস্ট দিতে, শুভেচ্ছা
facebook
ভ্যাঁক করে বোকার মত কেন কেঁদে দিলাম বুঝলাম না রে!
অণুরে ধন্যবাদ দিবো না বরং আর্শিবাদ করি তাঁর পথ চলা চলতেই থাকুক এমন সব অসাধারণ ইতিহাসের হাতধরে।
সাঈদ দাদুর জন্য অনেক শ্রদ্ধা ভালোবাসা। অনুরোধ থাকলো আবার সাঈদ দাদুর কাছে যাবার ব্যাপারে বেশি দেরি করবেন না প্লিজ!
অবশ্যই
facebook
বরাবরের মতই ভালো লাগলো।
---ভাবুক পাঠক
শুভেচ্ছা
facebook
কী বিনয়ি এই মানুষগুলো। অথচ শুয়োরের বাচ্চারা 'ভাষাসৈনিক' উপাধি নেয়ার জন্য কীই না করে বেড়ায়।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
কার সঙ্গে কিসের তুলনা !
facebook
শুভেচ্ছা
facebook
এই বিষয়ক পরবর্তী পোস্টের অপেক্ষায় রইলাম ...
সুবোধ অবোধ
আমিও
facebook
অবশ্যই।
অনুদা উনার সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানার অপেক্ষায় রইলাম।
উনার জন্য শ্রদ্ধা, ভালবাসা রইল।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
ধন্যবাদ
facebook
চমৎকার !
অপেক্ষায় রইলাম।
প্রশ্নঃ ইংরেজি বইটার নাম কী?
রাসিক রেজা নাহিয়েন
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
পরবর্তী পোস্টের অপেক্ষায় রইলাম
তাহসিন রেজা
নতুন মন্তব্য করুন