চুপচুপে ঘর্মাক্ত অবস্থায় পাহাড়ি হ্রদের ঝিরঝিরে বাতাসে খোলা বারান্দার ছায়ায় বসে গাছপাকা পেঁপে খেতে কী দারুণই না লাগার কথা! তেমনই লাগছিল বটে। সারাটা দিন, সেই ভোর বেলা বান্দরবানে রুমা থানা থেকে ভারী ব্যাকপ্যাক কাঁধে রওনা হয়েছি, পথে চড়াই-উৎরাই, ঝিরি, খাদ, বন ইত্যাদি ইত্যাদি পায়ে দলে (কবিতার মত চলমান সে পথের কথা আরেকদিন হবে) যখন ঘামে ভিজে ছায়ায় জিরোচ্ছি, সাথে মিলেছে ঠাণ্ডা পাকা তুলতুলে পেঁপে,
আর গরম ভাত-ডাল-মুরগীর আশ্বাস, ভাবছি বাংলাদেশের উচ্চতম প্রাকৃতিক এই হ্রদ বগা লেকের সুশীতল জলের আহ্বানে সাড়া দিয়েই উদরপূর্তি করতে বসে যাবো, তখনই পর্বতারোহী এম এ মুহিত জানান দিল বাদুড় গুহা দেখতে হলে এখনই যেতে হবে! গুহা দেখে, ভালো মত ধুলো-ময়লা গায়ে মেখে তারপর হ্রদের জলে রগড়ে রগড়ে গোসল করে ধোঁয়া ওঠা ভাত খাওয়া যাবে !
যাত্রার শুরু থেকে শুনে আসছি এই গুহার কথা, সেটি নাকি এখনো সো কলড পর্যটকদের নাগালের বাহিরে আছে, যাদের কারণে টেলিভিশনে প্রচারিত একাধিক একদা গা ছমছমে বাদুড়ময় গুহাতে এখন বাদুড়ের বদলে মানুষের বিষ্ঠা মেলে, গুহার কোণে থাকে কোল্ড ড্রিংকসের বোতল, সিগারেটের মোথা। গুহাটাও নাকি আজব কিসিমের, পুরোপুরি পাথুরে নয়, বা পাহাড়ের অংশও নয়।
বরং এক ঢালে মাটির মাঝে বিশাল গর্ত দেখে অনেক বছর আগে আমাদের গাইড রুয়াত বম সেখানে ঢুকে এটি আবিষ্কার করেন, মুহিত ভাই এর আগে বার দুই গেছেন গুহার কন্দরে। তাঁর এক কথা, যেতেই হবে বাদুড়গুহাতে, কোনদিন সবাই এর খোঁজ পেয়ে যাবে, দিবে এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর নীরবতার বারোটা বাজিয়ে।
কী আর করা, যতই ক্লান্ত থাকি, অ্যাডভেঞ্চারের লোভ আছে ষোল আনা। আর উপর বাংলাদেশের গুহা বলে কথা! চললাম সদল বলে সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করতে। বেশী কিছুক্ষণ উপর দিকে ওঠার পর এক বনের মাঝে দেখি বড়সড় এক গর্ত, সেটিই নাকি গুহামুখ! উঁকি দিয়ে দেখি তা বেশ গভীর, লাফিয়ে নামার বা হাচরে পাঁচরে নামার উপায় নেই। মহা করিৎকর্মা রুয়েত চোখের নিমিষে পড়ে থাকা দুটো বাঁশ বিশেষ ভাবে কেটে এক প্রান্ত দড়ির মত করে বড় এক গাছের সাথে বেঁধে গর্তের কাছে ফেলে, আরও দুটো বাঁশ গুহামুখ থেকে মেঝে পর্যন্ত নামিয়ে বানরের মত তরতর করে নেমে গেল! তারপর পরই আসল আমাদের নামার আহ্বান! মুহিত ভাইও পর্বতের ফাটল দিয়ে নামার ভঙ্গীতে বেশ দ্রুতই নেমে গেলেন,
আমিই একটু ধীরে সুস্থে পৌঁছালাম সেই তলদেশে, এবং সাথে সাথে নাচ কুঁচকে ফেললাম অ্যামোনিয়ার বোটকা গন্ধে, যার উৎস বাদুড়ের বিষ্ঠা!
গুহার এক দিকে কয়েক মিটার এগোতেই তা সরু হওয়া শুরু করল, সেই সাথে ইতস্তত বেরিয়ে আসা শুরু করল বিরক্ত হওয়া কিছু বাদুড়। খানিক পরেই হাঁটু ভাঁজ করে এগোলে থাকলাম তিন জনে, অবশ্য তার আগেই হেড ল্যাম্প জ্বালিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কয়েক মুহূর্ত পরেই সূর্যের ঝকঝকে রোদ আড়ালে চলে গেল, আর আমাদের গেরিলা ট্রেনিঙের মত হাতে –বুকে ভর দিয়ে এগোতে হল বেশ কিছুক্ষণ,
যখন মনে হল আর মা ধরিত্রী আরেকটু চেপে বসলেই তার ফাঁক দিয়ে গলতে পারব না, তখনই দুই পাথরের মাঝে ব্যবধান বাড়তে শুরু করল। অবিশ্বাস্য মনে হলেও দাঁড়ানো সম্ভব হল নিজের পায়ে, আসলে সরু পথে শেষে আমরা একটু বেশ বড়সড় চেম্বারে প্রবেশ করেছি। এর মধ্যেই ভ্যাঁপসা গরমে দরদর করে ঘেমে একাকার অবস্থা।
বাদুড়ের রাজ্যে তখন বিশাল তোলপাড়, যেদিকেই আলো ফেলা হয় সেদিকেই উড়ন্ত বাদুড়। সেই আলো-ছায়ায় False Vampire Bat ও আরেকটা অল্প বৃহদাকৃতির বাদুড়ই চোখে পড়ল। যদিও বাদুড় খেতে আসা সাপ চাক্ষুষ করেছেন মুহিত ভাই দুই বার। সেই সাথে বড়সড় শতপদী, নানা পোকামাকড়।
এই ভূগর্ভস্থ গুপ্ত স্থান কতটা আঁধারময়? সেটা জানার কৌতূহলে যেই না সকল টর্চ একসাথে বন্ধ করেছি, ব্যস- কালো রঙে ছেয়ে গেল আমাদের মহাবিশ্ব। চোখের সামনে আনলেও নিজের হাত দেখা যায় না সেই সূচীভেদ্য আঁধারের রাজ্যে। ফের সাতজলদি জীবনদায়িনী আলোক ফিরিয়ে আনা হল। এই বিশাল উঁচু প্রাকৃতিক প্রকোষ্ঠটি ঠিক পাথুরে নয়, বরং শিলীভূত মাটি নরম স্তরে স্তরে অবস্থান করে সৃষ্টি করেছে। তাই বেশী টানা হ্যাচড়া করলে মাটি ধ্বসে জীবন্ত সমাধি হবার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এর অন্য পাশে আরেকটি সরু পথ, যেখানে রুয়েত আগে প্রবেশ করে দেখেছে অন্য চেম্বার। কিন্তু আজ আমাদের ফেরার পালা, সেই একই পথ ধরে, বুকে ক্রল করে, সত্যিকার ভাবে ধুলিস্নান করে, ফের গুহামুখে। ইশ, সূর্যের পুড়িয়ে দেওয়া আলোকেও এখন কত আপন মনে হচ্ছে, ভালো লাগছে গাছের পাতা, পাখির কলতান- যা যা দেখা যায় এই গর্তের তলদেশ থেকে।
আবার একে একে উঠতে হল গুপ্ত গুহা থেকে, আমি জানি বেশী দিন এই সমস্ত স্থানগুলো লুকিয়ে থাকবে না বাংলার তরুণ-তরুণীদের থেকে, শুধু মনে রেখেন সেখানের প্রাকৃতিক পরিবেশের কোন ক্ষতি করবেন না দয়া করে, আর বাহিরের ময়লা নিয়ে এই জায়গাগুলোতে ফেলবেন না।
মন্তব্য
শেষরাতে আর্মেনিয়ান দুদুক শুনতে শুনতে আপনার পোস্টের ছবিগুলো দেখে অপার্থিব লাগলো। আমি খুবই ঘরকুণো মানুষ, আপনাকে দেখে সব সময় বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছা হয়।
- সুচিন্তিত ভুল
হয়ে পড়েন, সময় কিন্তু কম !
facebook
দারুণ! ইয়োরোপের দেশগুলোতে এরকম গুহা দেখিয়ে কত আয় হচ্ছে। আমাদের দেশেও দেখার আছে অনেক কিছু, একটু উদ্যোগ নিলেই হয়।
ফাহিমা দিলশাদ
গুহা নিয়ে আরও লিখতে হবে সময় করে, চেক দেশের এক গুহাতে গেছিলাম অনেক আগে, দারুণ
facebook
ভীষণ অরণ্য-তে এমন একটা গুহা ছিল না?
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
জাগুয়ার থাকত যেখানে?
facebook
না, বাদুড়ের গুহাই ছিল... তবে ওটার ভেতর নদী না খাল কি জানি ছিল...স্থানীয়দের তাড়া খেয়ে নৌকা সহ চলে গেছিল ওরা...
জাগুয়ারেরটা আলাদা, তয় ভালো জিনিস মনে করাইলেন... ভাবতেছি কিশোরের মত জাগুয়ারধরা ফান্দে আপনি আটকাইলে ভালই হত... বহুজনের জ্বালা মিটত
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
facebook
কিছুদিন আগে মাসুদ রানার একটা বইতে পড়েছিলাম খনির মধ্যে সরু সুরঙ্গের মধ্য দিয়ে বুকে ভর দিয়ে ঢুকে শত্রুর কাছ থেকে পালাচ্ছে, আপনাদের গুহায় ঢোকার ছবিগুলো সেই বর্ণনার সাথে মিলে যায়। সাহস আছে আপনাদের বলতেই হবে :-)।
কিছুটা
facebook
তারেক অণু , ভাইয়া এটা কী দেখাইলেন আপনি? আমিতো এই সাত সকালে পুরাই থ বনে গেলাম। রীতিমত গায়ের রোম দাঁড়ায় গেছে!!
Shah Waez (শাহ্ ওয়ায়েজ।)
Facebook
..............................................................................................
ভাবনা আমার শিমুল ডালে লালচে আগুন জ্বালে, মহুয়ার বনে মাতাল হাওয়া খেলে।
এক মুঠো রোদ আকাশ ভরা তারা, ভিজে মাটিতে জলের নকশা করা,
মনকে শুধু পাগল করে ফেলে।
ক্যান ?
facebook
তারেক অণু, খুবই এক্সাইটিং লেখা দাদা।
Shah Waez (শাহ্ ওয়ায়েজ।)
Facebook
..............................................................................................
ভাবনা আমার শিমুল ডালে লালচে আগুন জ্বালে, মহুয়ার বনে মাতাল হাওয়া খেলে।
এক মুঠো রোদ আকাশ ভরা তারা, ভিজে মাটিতে জলের নকশা করা,
মনকে শুধু পাগল করে ফেলে।
ধন্যবাদ
facebook
অনুদা, আপনার লেখা পড়লেই খালি তিন গোয়েন্দার কথা মনে পড়ে।
শৈশবের তিন গোয়েন্দার মিশেল যে বড় হয়ে দেখতে পাব কখনো ভাবিনি।
আপনার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইল। জারি থাকুক ঘুরাঘুরি, লেখালেখি।
ভালো থাকবেন।
বাদুড় গুহা জটিল লাগছে।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
খুব বেশী ঘুটঘুটে ছিল আসলেই
facebook
সেই জুর্ল ভার্নের পাতাল অভিযানের মতো রোমাঞ্চকর!
যদিও পড়তে পড়তেই ঘুহার চিপায় ভ্যাপসা গরমে হাঁসফাঁস করছিলাম। গেলে নির্ঘাত দম আটকে মারা যেতাম!
নাহ, ঠিকই টিকে থাকতে!
facebook
রুদ্ধশ্বাসে লেখাটা পড়ে শেষ করলাম! পাথরের শক্তপোক্ত গুহা হলেও নাহয় একটা কথা ছিল! এভাবে দু-তিনজনে মিলে হুরমুর করে একদম অপরিচিত এরকম একটি গুহায় ঢুকার সাহস পান কই!? যে কোন মূহুর্তে মাটি ধসে চাপা পড়তে পারতেন! যাই হোক, ঘুরাঘুরি সাবধানে কইরেন।
লেখার কথা আর কী বলবো! এক পোস্টেই সম্পূর্ণ একটা রোমাঞ্চ উপন্যাস পড়ার স্বাদ পেয়েছি। ঘুরাঘুরি আর লেখালেখি আরো চলুক। বেস্ট অফ লাক ম্যান।
নাহ, মুহিত ভাই তো কয়েকবার গেছেন, তবে সাবধানের মার নেই
facebook
ধরুন, ভেতরে নামলেন এরপর কেউ ঐ বেয়ে ওঠার বাঁশটা সরিয়ে ফেলল! কিভেবে বের হতেন? এজন্যেই আমি গুহা ভয় পাই।
কিছুকাল আগে Cave Enthusiast এর বাংলা বানিয়েছিলাম 'গুহোৎসাহী'
শব্দটা আপনার বেলায় খুব চমৎকার মানিয়ে যায়।
উপায় বাহির হয়ে যেতো, না হয় নতুন সুড়ঙ্গ খুড়ে ফেলতাম
facebook
ভুলে, একটা য-ফলা পড়ে গেলেই কামসারা...
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
দাও ফিরিয়ে অরণ্য, লও এ নগর।
-দেব প্রসাদ দেবু
হ
facebook
জটিল ব্যাপারস্যাপার ভাই। খুবই ভালো লাগলো দেখে। ঘুরতে ইচ্ছা করে ষোল আনা কিন্তু আলসেমীর কাছে পরাজিত। আমাদের বাসার কাছেই একটা পাহাড় আছে, সেখানে একদিন ঘুরতে গিয়েছিলাম, ওখানেও একটা গুহা আছে। সাথে টর্চ ছিলো না বলে ঢুকিনি, কিন্তু একদিন হুট করে ঘুরে আসবো ইনশা আল্লাহ।
আপনার ঘুরাঘুরি দেখতেও অনেক ভালো লাগে।
-- কালোদিঘী
কি সব সাংঘাতিক বিপজ্জনক কান্ড যে করো তোমরা!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
অন্ধকারে দম বন্ধ হয়ে আসে..দারুণ লেখা
গুহাতো সত্যি ভয়ংকর ছিলো। আপনার মত বড় হলে একদিন আমিও যাবো নিশ্চয় ।
মাসুদ সজীব
নতুন মন্তব্য করুন