১ জানুয়ারি, ২০১৪। ল্যাটিচিউড ২১ ডিগ্রি ১৫মিনিট নর্থ, লংগিচিউড ৮৯ ডিগ্রী ৪৪ মিনিট ইস্ট এই অবস্থানে বঙ্গোপসাগরের মাঝে কূলকিনারা এমনকি তলদেশহীন এক জায়গায় ( যা সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড নামে সুপরিচিত) মাছ ধরার জাহাজ এফ ভি লাবিবায় ভাসছি আমরা কজন পাখিপ্রেমী (বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের পক্ষ থেকে ইনাম আল হক ও আমি যোগ দিয়েছি মূলত প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে, তাদের তিন জন সদস্যের সাথে) উদ্দেশ্য বঙ্গোপসাগরের পাখি, তিমি, ডলফিনসহ অন্যান্য জীববৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণ। বছরের প্রথম সূর্যোদয় দেখলাম সাগরের মাঝেই, ভোরের রূপোলী সাগর সূর্যকিরণের ছটায় সোনারঙা হয়ে গেল হয়ত আগত বছরে স্বর্ণালী সব সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েই।
দুপুরে বিশেষ আয়োজন ছিল ইলিশ খিচুড়ি সাথে টাইগার চিংড়ি। ক্যাপ্টেন হাসতে হাসতে বললেন- বাড়ীতে আসলে তো এই চিংড়ি খাওয়ানোর সামর্থ্য হবে না, এইখানেই খাওয়ায় আপনাদের। বেজায় খাওয়া-দাওয়া করে একা ডেকের উপরে বেরিয়ে আসছি একটু বাহিরে বসার জন্য, মনে হল আকাশ ফুঁড়ে বড় আকৃতির এক জোড়া পানচিল মাস্তলের উপর দিয়ে একটা আরেকটাকে তাড়া করতে করতে উড়ে গেল, ( আমাদের পইপই করে বলে দেওয়া হয়েছিল সামুদ্রিক পাখি দেখা মাত্রই যেন আগে ছবি তুলে রাখি, দূরবীনে পর্যবেক্ষণ যেন পরে করি, কারণে পাখিটি মুহূর্তের মাঝেই উধাও হয়ে যেতে পারে, তখন আর সেটির কোন গ্রহণযোগ্য সাক্ষ্য থাকবে না।)। তাই ক্যামেরার লেন্স দিয়েই মুহূর্তের মাঝে ফোকাস করে একটানা ক্লিক করে যে কয়টা ছবি সম্ভব তুলতে তুলতেই মনে পাখি দুটো কেমন জানি অন্য ধরনের, ঠোঁট বেশ মোটা আবার লেজ সরু লম্বা, মনে হচ্ছে পাখির পিছনে তীর লেগে আছে! তখন সূর্য প্রায় মাথার উপরে, পাখিদুটো যে একই প্রজাতির এইটুকুই কেবল বোঝা গেল, মাস্তলের উপরে যেয়েই অজ্ঞাত কারণে গোত্তা খেয়ে আবার একটি আরেকটিকে তাড়া করতে করতে মিলিয়ে গেল যে পথে দিয়ে এসেছিল সেই পথেই। সাথে সাথে ডাইনিংরুমের দরজায় যেয়ে চরম উত্তেজনায় একটা হাক দিলাম- ইনাম ভাই, ইমারজেন্সি !
ডাক শুনেই ইনাম ভাইয়ের আগে ক্যাপ্টেন দৌড়ে আসলেন কোন দুর্ঘটনা হয়েছে ভেবে! হয়ত দড়িদড়া খুলে কিছু পড়ে গেছে, বা আগুন লেগেছে। কিন্তু পাখি বিষয়ক ইমারজেন্সি শুনেই তার মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। ততক্ষণে পাখিযুগল লাপাত্তা। ক্যামেরায় ছবি দেখেই ইনাম ভাই বেশ আনন্দ নিয়ে বললেন, ”ঘটনা মনে হয় ঘটেই গেল- বাংলাদেশের জন্য নতুন পাখি আবিস্কার করেছেন, নতুন বছরের জন্য এর চেয়ে ভাল উপহার হতেই পারে না! ”
পরে ফিল্ড গাইড দেখে করে জানালেন, এটি ছিল Red-billed Tropic Bird/ Phaethon aethereus, যে পাখিটি বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় দেখা যায় তা কেউ জানত না! সারা বিশ্বের ক্রান্তীয় সাগরেই তার যাতায়াত, সুদূরের গ্যালোপাগোস দ্বীপপুঞ্জ থেকে ক্যারিবিয়ান সাগর, আরব সাগর, লোহিত সাগর, প্রশান্ত, অ্যাটলান্টিক ও ভারত মহাসাগরে এর দর্শন মেলে। সাঁতারে দুর্বল কিন্তু উড়তে ওস্তাদ এই সামুদ্রিক পাখিটি জীবনের অধিকাংশ সময়ই সমুদ্রের উপর উড়ে অতিবাহিত করে, কেবল মাত্র ডিম ফোটানোর সময় তারা ডাঙ্গায় ফিরে আসে।
বাংলাদেশে যেহেতু Tropic Bird এই প্রথম দেখা গেল, তাই বেশ চিন্তা ভাবনা করে তাদের নাম দেওয়া হল বিষুবীয়া। সেই হিসেবে Red-billed Tropic Birdএর বাংলা নাম লাল ঠোঁট বিষুবীয়া। উল্লেখ্য যে বিশ্বে মাত্র তিন ধরনের বিষুবীয়া দেখা যায়- ধলা লেজ বিষুবীয়া, লাল লেজ বিষুবীয়া এবং লাল ঠোঁট বিষুবীয়া। সবারই এমন অপূর্ব লম্বা লেজ আছে। বাকী দিনটা কেটে গেল বিষুবীয়াগুলোর খোঁজেই।
উল্লেখ্য যে আমাদের সমুদ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১৩র ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে। তখন পায়ের নিচে পৃথিবী দুলছে, কাঁপছে আপন উল্লাসে নীল দরিয়া, আমাদের হাতের মুঠোয় নিয়ে। বঙ্গোপসাগরের কোন এক কোণে আমাদের জাহাজ, গন্তব্য নেই। আসলেই গন্তব্য নেই, বিরামহীন ভাবে লাবিবা নামের জাহাজখানা চলছে লোনা দরিয়া দিয়ে আগামী ৩০ দিন, রূপোলী ফসল হচ্ছে তার একমাত্র লক্ষ্য, ২০০ টন মাছ আহরণ করে তারপর সে তীরে ফিরবে। বেশ বড় ধরনের মাছ ধরার ট্রলার লাবিবা, প্রায় ৪০ জন্য কর্মী এখানে কাজ করবে দিবা-রাত্র। প্রতি চার ঘণ্টা পর পর বিশাল জাল খানা তোলা হবে সমুদ্র থেকে, তাতে অবস্থা ভেদে থাকে এক থেকে ৮ টন মাছ থাকে, যখন জাহাজটির হিমাগারের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ২০০ টান মাছ ধরা হয়ে যাবে তখন তারা তীরের দিকে ফেরা শুরু করবে। সাধারণত এই কাজে ৩০ দিন সময় লাগে, এবং এই সময়ে ইঞ্জিন সচল থাকবে সর্বদাই।
দীর্ঘ যাত্রায় কিন্তু আমরা পাখি দেখেছি মাত্র পাঁচ ধরনের তার মধ্যে অতিপরিচিত খয়রামাথা গাঙচিল ও পালাসি গাঙচিলই দখল করেছিল ছিল মত দেখা পাখির ৯৯ শতাংশেরও বেশী। দিঘ প্রতীক্ষার পর ৩১ ডিসেম্বর দুপুর ৩টায় যাত্রাপথে যুক্ত হল স্মরণীয় মুহূর্ত, জাহাজের পাশ দিয়েই তীর বেগে উড়ে গেল এক কালো পাখি, তার পিছু পিছু ধাওয়া করল আমাদের দৃষ্টি, অবশ্যই দূরবীনের মাধ্যমে। অন্য অনেক মহাসামুদ্রিক পাখির মতই সেও জাহাজের পিছনে জলের ঘূর্ণনের পথটা মাছের সন্ধানে একবার দেখে আবার ফিরে আসল পূর্বনির্ধারিত যাত্রাপথে, পাশের ডেক থেকেই শুনি ইনাম ভাইয়ের উল্লাস ভরা কণ্ঠ Thats the Bird, Thats the Bird !
অবশেষে সাগরের ভাসার এতগুলো দিন পরে দর্শন পেলাম পোমারাইন জেগারের ( Pomorine Skua ), ভীম দর্শন পাখিটি আমাদের প্রাপ্তির আনন্দে মুড়ে আবার উড়াল দিল দূর গন্তব্যে। জীবনে প্রথম দেখা মিলল এই বিরল পাখির, যদিও পরের দিন মানে ঐতিহাসিক ১ জানুয়ারিতে একসাথে আমরা চারটে পোমারাইন জেগারের দেখাও পেয়েছি, তাদের অপূর্ব দক্ষতায় মাছ ধরা, উথাল-পাথাল ঢেউয়ের মাঝে চুপটি করে অবতরণ করা, তীরবেগে ধাওয়া- পালটাধাওয়া, দ্রুতগতির উড়াল আমাদের করেছে আনন্দিত।
এক সপ্তাহের সাগরযাত্রায় দেখেছি স্পিনার ডলফিনের ঝাঁক, উড়ুক্কু মাছের জল ফুঁড়ে ছুটে চলা, টুনা মাছের লাফ, জাল থেকে উদ্ধার করা অলিভ রিডলে কাছিম, অক্টোপাস, স্কুইড, বর্ণীল কাঁকড়া, দুঃখজনক ভাবে জাল আটকে মৃত অজস্র হাঙ্গর, নানা প্রজাতির টন টন মাছ, সাগরের নানা অজান জীব। কিন্তু মনের মুকুরে সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা হিসেবে গেঁথে গেছে এক জোড়া লাল ঠোঁট বিষুবীয়ার সেই উড়াল, নতুন বছরের প্রথম দিনে দেশের জন্য সম্পূর্ণ নতুন জাতের এক পাখি আবিস্কারের চেয়ে সুখকর আর কীই বা হতে পারে একদল পাখিপ্রেমীর কাছে !
( এই বছরে আরও দুই প্রজাতির পাখি বাংলাদেশে প্রথমবারের মত আবিস্কার করেছেন তরুণ গবেষক সায়েম ইউ চৌধুরী, ( সরু ঠুটি গাঙচিল/ Slender-billed Gull এবং কালা ঈগল/ Black Eagle), আশা করছি সায়েম শীঘ্রই আমাদের শোনাবেন সেই আবিস্কারের কাহিনী। )
মন্তব্য
সানগ্লাসপক্ষীও নাম দিতে পারবেন। অথবা বাংলায় রোদচশমা পাখি।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
হা হা, কিন্তু অন্য বিষুবীয়াগুলোর এমন রোদ চশমা ধরনের দাগ নেই যে !
facebook
আমাদের তারেক অণুর আবিস্কার, 'লাল ঠোঁট বিষষুবীয়া'।
গর্বিত বোধ করছি।
বিশ্বের প্রথম হলে কী দারুণই না হতে পারত !
facebook
নতুন পাখিকে স্বাগতম আমাদের সবুজ বাংলায়।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
facebook
____________________________
facebook
অভিনন্দন অণু ভাই!
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
facebook
বিষুবীয়া! বাহ্ পছন্দ হইছে নামটা
নতুন পাখি তোমায় দিলাম নীল সাগরের সুনীল আকাশ
কড়িকাঠুরে
বাহ
facebook
বেশ ভাল লাগল। হয়ত প্রকৃতির খেয়াল বা থেলা যা প্রকৃতিকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করবে পরোক্ষভাবে। হয়ত দুই পাঁচ দশ বিশ বছর হোক সচলায়তনে সেটা জানতে পারব। ধন্যবাদ। মুসাব
মন্তব্যটা ঠিক পরিষ্কার হল না
facebook
অভিনন্দন, অণুদাদা!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
শুভেচ্ছা
facebook
পাখিটা কি সুন্দর!!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
facebook
বিষুবীয়া -নামটাই কেমন ছন্দময়!
শুভেচ্ছা
ট্রপিক শব্দটাই তো আনন্দ নিয়ে আসে মনে -
facebook
বাতাসের কাছে খবর আগেই কিছুটা শুনেছিলাম। বিস্তারিত জেনে অনেক ভালো লাগলো।
facebook
নতুন মন্তব্য করুন