গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের (গ্যাবো) বাবাকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি কোনো সময় উপন্যাস লিখতে চান নি? উনি নাকি একটি বিষয় নিয়ে যাও বা লিখতে চেয়েছিলেন, বেশ চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন, এক সন্ধ্যায় গ্যাবো ফোন করে একটা শব্দের ব্যাপারে জানতে চাইলেন তিনি বুঝে যান যে গ্যাবো নিজেই সেই ঘটনা নিয়ে লিখতে আরম্ভ করেছে, তাই আর উপন্যাস রচনায় মনোনিবেশ করেন নি।
গ্যাবো মূলত তার বাবা-মার প্রেমকাহিনী ও পরিণয় নিয়েই উপন্যাসটি লিখেছিলেন। এবং এই একটি বইই তার জীবিতাবস্থায় চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হয়েছিল, তা হচ্ছে Love in the Time of Cholera ।
মৃত্যু তার ডানা বিস্তার করে আসে কলেরার রূপ ধরে, মানুষ পালাতে দিশা পায় না ভিটে-মাটি ছেড়ে, সেই সময়ে প্রেম? হবে নাই বা কেন, প্রেমের গনগনে আবেগ কী যথেষ্ট নয় মৃত্যুভয়কে রুখে দিতে? মহাকালকে স্থবির করে কেবল নিজেদের সুবিধের মত পরিবর্তিত করতে? গ্যাবো যে নিজের জীবনের করাল অভিজ্ঞতা দিয়ে বলেছেন- প্রতিটি মারাত্নক অসুখের নিজস্ব গন্ধ আছে, কিন্তু কোনটিই বার্ধক্যের মত শক্তিশালী নয়। মানে কলেরাও হার মেনেছে সময় এবং ভালবাসার কাছে।
লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা আমার প্রিয় উপন্যাস নয়, গ্যাবোর একাধিক বই এর চেয়ে অধিকতর প্রিয়, কিন্তু লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরায় জীবনের নির্যাস মাখানো তীক্ষ সংলাপগুচ্ছ আছে, যারা মর্মে গিয়ে বেঁধে অব্যর্থভাবে। যারা চিন্তিত করে তোলে জীবনের অর্থ নিয়ে, একাকীত্বের তিক্ততা নিয়ে, অবশ্যম্ভাবী বার্ধক্য নিয়ে, ভালবাসার তুঙ্গস্পর্শী উথাল-পাথাল সুখবোধ নিয়ে। তাদের জন্যই এই লেখা-
গল্পের মহাপ্রেমিক ফ্লোরেন্তিনো অ্যারিজার জানালার দিকে তাকিয়ে রূপসীশ্রেষ্ঠা ফারমিনা দাজার চোখে চোখ রাখার মাধ্যমে যে প্রেম শুরু যা শিকড় গেড়ে ছিল অস্তিত্বের অতলান্তে ৫০ বছরেরও বেশী, যদিও দাদীমা বলেছিল, পুরুষের সত্যিকারের চরিত্র জানতে হলে তাকে অনেক্কক দিন বাঁচতে হবে। এত দিন বেঁচেও কী ফারমিনা বুঝেছিল ফ্লোরেন্তিনোর ভালবাসার ক্ষুধার স্বরূপ?
কৈশোর প্রেমের পিছনের ঘুরঘুর করতে যেয়ে স্পাই সন্দেহে দোষী শুনে হতভম্ব ফ্লোরেন্তিনো অনায়াসে সমস্ত গুজব এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়ে নিশ্চিত করে কিসের গুপ্তচর, কেবল এক দরিদ্র প্রেমিক আমি। তাঁকেই যখন নিশিকন্যাদের জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে সঙ্গমের পরামর্শ দেওয়া হয়, তখনও কুমার ছেলেটি সরাসরি বলেছিল কেবল ভালবাসার তাগিদের কৌমার্য বিলিয়ে দিতে পাড়ি আমি, এছাড়া নয়।
সেই পাগলপ্রেমিক বিবাহের প্রতিশ্রুতির ফ্রেমে আটকাতে চেয়েছিল ভালবাসাকে। ফারমিনা দাজা বিয়ের প্রস্তাব শুনে হতভম্ব হয়ে ভাবছিল কী বলা যায়, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আন্টি বলে দিল- হ্যাঁ বলো, যদিও তুমি ভয়ার্ত, যদি এটি ভবিষ্যতে দুঃখ বয়ে নিয়ে আসে তারপরও, কারণ তুমি যাইই কর, যদি এখন না বল, সারাজীবন তার জন্য পস্তাতে হবে। কী অসাধারণ উপলব্ধি জীবন, ভালবাসা ও দুঃখ নিয়ে! একটিবারের জন্য উচ্চারিত না শব্দটি তাড়িয়ে বেড়াতে পারে হতাশার শব্দহীন প্রান্তরের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত।
ফারমিনা দাজার বিখ্যাত উত্তর ছিল- আমি তোমাকে বিয়ে করব, যদি না তুমি আমাকে বেগুণ খেতে বাধ্য কর! বেগুণের সাথে ফারমিনার কী সম্পর্ক তারও উপর দিয়ে ঝলসে ওঠে ম্যাজিক রিয়ালিজমের অনন্য উদাহরণ, ফলে ফারমিনা অস্ফুট ওষ্ঠে মোটেও বেমানান শোনায় না বেগুণের স্বাদ না নেবার সেই আকুতি।
মেয়ের এমন খবরে বিচলিত বাবা লরেঞ্জো ডাজা সবাইকে নিয়ে যান দূর গ্রামে, খারাপ স্বাস্থ্যের চেয়েও খারাপ যে দুর্নাম, তাকে এড়ানোর জন্য। উদ্যত বুলেটের মুখে ফ্লোরেন্তিনো সেই কঠোর বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, আমাকে গুলি কর, প্রেমের জন্য মৃত্যুর চেয়ে গৌরবের আর কিছুই নেই। প্রেমের কারণেই খুন হয়ে কি ইতিহাসে অমর হতে চেয়েছিল সে? লেখক আমার উত্তর দেন না, ঘটনা এগিয়ে চলে অমোঘ ঘড়ির সাথে।
বিয়ে হয় শহরের বিত্তশালী ডাক্তারের সাথে ফারমিনার, অনেক অনেক দশক পর এক আশ্চর্য পোষা তোতা পাখি আমগাছ থেকে ফিরিয়ে আনতে যেয়ে পড়ে যেয়ে মারা যাবার আগে শেষ নিঃশ্বাসটুকু খরচ করে যে বলতে পেরেছিল ঈশ্বর জানেন আমি তোমাকে কতটা ভালবাসি। যদিও সুদীর্ঘ বৈবাহিক জীবনে তিনি জড়িয়েছিলেন অনৈতিক সম্পর্কে। এখানেই গ্যাবোর মুন্সিয়ানা, খুব সংবেদনশীল স্বচ্ছ ভাষায় তিনি দেখালেন স্বামী পরকীয়া করছে তাঁর চেয়ে ফারমিনার কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়াল স্বামীর সেই গোপন প্রেমিকা কেন একজন কৃষ্ণাঙ্গ ছিল সেটি। ব্যবচ্ছেদ করে দেখালেন উপনিবেশিক মানসিকতার বহমান বাস্তবতা। আর বিয়ের সারবত্তা ছিল “Always remember that the most important thing in a good marriage is not happiness, but stability.”
সময় ও ঘটনা থেমে থাকে নি প্রেমিক ফ্লোরেন্তিনোর জীবনেও, এক চাচা যিনি বলতেন আমি মোটেও ধনী নই, আমি অর্থবান একজন গরীব মানুষ, যা মোটেও এক জিনিস নয়, তাঁর সুবাদে জাহাজ কোম্পানির বিশাল পদে অধিষ্ঠিত হন ধাপে ধাপে। এবং খুবই হতাশাজনক ভাবে আবিস্কার করেন তিনি যে একই মানুষ একসাথে একাধিকজনকে ভালবাসতে সক্ষম। জনারণ্যে চিৎকার করে সেই স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য হন ফ্লোরেন্তিনো, বলেন- আমার হৃদয়ে একটি বেশ্যাখানার চেয়েও বেশী প্রকোষ্ঠ আছে।
ফ্লোরেন্তিনো অনেক বছর পর বুঝতে পেরেছিল একজন মানুষের চেহারা যখন তার বাবার মতো দেখাতে শুরু করে তখন থেকেই তার বুড়ো হওয়া শুরু হয়। কিন্তু উদ্দাম ভালবাসা চলতে থাকে সমান তালে , শত শত প্রেমিকার সান্নিধ্য লাভের পরও ৭৩ বছর বয়স্ক ফ্লোরেন্তিনো যেই মুহূর্তে সংবাদ পান যে ফারমিনার স্বামী মারা গেছে, সেই মুহূর্তেই তাঁর ১৪ বছর বয়স্ক প্রেমিকা আমেরিকা ভ্যিকুনাকে চিরবিদায় দিয়ে বিয়ে করার মানস ব্যক্ত করেন খাঁটি ভালবাসার কাছে, যাকে অনেক অনেক বছর আগে আবেগ নিয়ে প্রুতিশ্রুতি দিয়েছিলেন We,ll grow old waiting।
ফারমিনা তাকিয়ে দেখল কুৎসিত এবং বিমর্ষ কিন্তু মূর্তিমান ভালবাসাকে। হয়ত বুঝল প্রেম যত্রতত্র ঘটলেও মৃত্যু নিকটতর হলে তা আরও দৃঢ় হয়ে ওঠে। তখন থেকেই তারা পরস্পরের সঙ্গ পেয়েই সুখী ছিল হয়ত এই কারণেই যে Old people, with other old people, are not so old।
অবশেষে যখন আমাদের প্রেমিক-প্রেমিকা এক ভাসমান জলযানে কলেরার হলুদ পতাকা উড়িয়ে জানা মহাবিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভাসতে ভাসতে পরস্পরকে আশরীর ভালবাসল, তাঁর আগমুহূর্তেই ফারমিনার বলা I smell like an old woman যেন চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলে সমস্ত অনুভূতিকে, ফিরিয়ে নিয়ে আসে মানবমনের শাশ্বত বৈশিষ্ট্য। “and the two of them loved each other for a long time in silence without making love again.” আবার যখন ফারমিনা জিজ্ঞাসা করল কতক্ষণ এইভাবে থাকা যাবে, ৫৩ বছর ৭ মাস ১১ দিন ও রাত্রি ধরে অপেক্ষামান উত্তর দিয়েছিল ফ্লোরেন্তিনো – চিরকাল!
পাঁচ শতাধিক রমণীর সাথে সঙ্গমের অভিজ্ঞতা নিয়ে ফ্লোরেন্তিনো তাঁর প্রেমিকাকে জানান দেয়, i remained vrigin for you। কিসের দাবী তাঁর? কী এই কৌমার্য? সে তো দেহের নয়, মনের! তাঁর মনে ফারমিনার জন্য যে স্থান তাতো আর কারো সাথে ভাগাভাগি করে নি প্রেমিকপ্রবর, অতি সন্তর্পণে পাহাড় দিয়েছে সে ভালবাসার নিভু নিভু প্রদীপ। এইখানেই তাঁর সার্থকতা, তাঁর পরিণয়।
জীবনের জয়গান দীপ্তস্বরে গেয়েই বইটির সমাপ্তি টেনেছিলেন গ্যাবো- “ He [The captain] looked at Florentino Ariza, his invincible power, his intrepid love and was overwhelmed by the belated suspicion that it is life, more than death, that has no limits.”
এইভাবেই সকল কিছু এমনকি হন্তারক মহাকালকেও অগ্রাহ্য করে চলে কলেরার মাঝেও ভালবাসা, চলে জীবন। জীবনই যে ভালবাসা।
মন্তব্য
চমৎকার রিভিউ। কাব্যিক!
মার্কেসের নায়কদের অবধারিতভাবেই প্রচুর শয্যাসঙ্গীনী থাকে। এই ব্যাপারটা বুঝি না…
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
বাস্তব জীবনের গল্প যখন, বাস্তবেও তাই ঘটে হয়ত-
facebook
নতুন করে পড়ছি আবার বিভিন্ন লেখা। আবার হয়ত কয়েকবছর পর পড়ব। তারপর আবার।
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
আসলেই, পড়া হবে বার বার
facebook
কোট করা লাইঙ্গুলা অসাধারণ।
হবেই তো , সেগুলো তো গ্যাবোর লেখা
facebook
চমৎকার রিভিউ।
"লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা" আমারও গ্যাবোর লেখা সবচে প্রিয় উপন্যাস নয়, তবু বারবার পড়তে ভালো লাগে।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
আসলেই
facebook
বইটি পড়া শুরু করতে হবে। বইটি এখনো পড়িনি ভাবলেই নিজেরে কেমন বলদ বলদ লাগে। গ্রন্থালোচনা যথারীতি অসাধারণ।
গোঁসাইবাবু
পড়ে ফেলেন
facebook
'সতী' এবং 'সতীত্ব' শব্দ দুটি নিয়ে কদিন ধরে গবেষণা করতে গিয়ে এই প্রশ্ন আমার মনেও জেগেছে, সতীত্ব কি শারীরিক না মানসিক?
facebook
ভালো লাগলো আপনার বই রিভিউ। আগ্রহ পেলাম বইটা পড়ার ও মুভিটা দেখে ফেলার। জেভিয়ের বার্ডেম ( স্কাইফল, নো কান্ট্রি ফর ওল্ড ম্যান) করেছেন, ফ্লেরোন্তিনোর চরিত্রটা। আইএমডিবিতে অবশ্য কিছু লোকের আলোচনাও পড়ে আসলাম, তাদের ভাষায়, "নামটা ভালো লাগে নাই, নাইলে মনে হয় দেখতাম" -মানুষ বড়ই বিচিত্র!
কিছু টাইপো ছিল, "তীক্ষ " , "We,ll grow", "প্রুতিশ্রুতি ", "অনেক্কক "
শুভেচ্ছা
সিনেমাটা বইয়ের তুলনায় বেশ জলো হয়ে গেছে
facebook
খুব ভালো লেখা।
এই লাইনটা আবার একটু দেখেনতো!
শুভেচ্ছা।
facebook
রিভিউ ভালো লাগলো। মার্কেসের লেখায় ঘটনার একেবারে ঘনঘটা সবসময়। এটাকে একটা লেখায় তুলে আনাটা সহজ কাজ না। ভাল লিখেছেন আপনি।
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
ধন্যবাদ
facebook
____________________________
facebook
যেই বইগুলা বারবার পড়ি তার মধ্যে একটা , রিভিউ ভাল লাগলো
ইসরাত
বারবার পড়া হলে আপনিও লিখুন না একটা-
facebook
নতুন মন্তব্য করুন