এক সময়ের প্রেমিকা পোলিনকা খানতেভা ছিল রাশান স্তেপের মেয়ে, একেবারে দীঘল ঘাসের বনের ধারে রূপকথার শৈশব কাটানো মানুষ। স্তেপ বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে মাইলের পর মাইল দিগন্তের ওপার পর্যন্ত চলে যাওয়া তৃণভূমি, যার মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছে কিশোর ম্যাক্সিম গোর্কি। আবার অন্য মহাদেশের তৃণভূমি শুনলেই যেমন প্রেইরির ছোট্ট মেয়ে লরা ইঙ্গলসের কাঠের কুটির, পাম্পাসের ঘোড়সওয়ার গাউচো, সাভানার মাসাই এলমোরান, আর হাঙ্গেরির পুৎসতার অনিন্দ্য সাহসিকা ভেরোনিকার কথা মনে হয়। খুব জানতে ইচ্ছে করে সেখানের মানুষদের জীবনযাত্রা, যারা দড় প্রকৃতির মাঝে খাপ খাইয়ে নিতে। আর সেখানের পশু, পাখিদের জগত নিয়ে।
পোলিনকাকে এক আবেগ থরথর মুহূর্তে ঝোঁকের মাথায় বলে ফেললাম তাঁর ফেলে আসা ঘাসের রাজ্য আর পুষ্ট গমের আলোয় রাঙানো শৈশব নিয়ে একটা কবিতা লিখে দিব, রাজ্যের বইপত্র জোগাড় হল ঘাস ও তৃণভূমি নিয়ে, দেখি আমাদের ছোট গ্রহের মাত্র যে ৩০% ডাঙ্গা, তারই আবার ৩০% দখল করে রেখেছে ঘাস! যেখানে আর কিছুই হয়ত হবে না, সেখানেও নানা ধরনের ঘাস এসে হাজির! আবার যে কারণে মানুষের রাজত্বে তাঁর বিনাশ হয়ে যাচ্ছে, কারণ বন কাটার চেয়ে তৃণভূমি কেটে ফসলী ক্ষেত বানানো সহজতর। বুঝলাম এভাবে কবিতা হবে না, এই যে ঘাস নিয়ে বাংলার সেরা সব পংক্তি লিখে গেছেন জীবনানন্দ দাশ, কিন্তু শত ভাগ গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি উনি কোন দিনই বরিশালে উরি ঘাসে ছাওয়া চরে হাঁটেন নি ! উল্লেখ্য, নোনা পানির রাজত্বে নতুন চরে বিস্তার করতে পারা একমাত্র ঘাস উরির খোঁচা আলপিনের মত, সেই ঘাসে ১০ সেকেন্ড হাঁটলেই ”সবুজ ডাঙ্গা ভরে আছে ঘাসের মখমলে” টাইপ পদ্য লেখা শিকেই উঠত, বা পদ্মা চরের ছনের বনে হেঁটে হাত-পা রক্তাক্ত করলেও এত কাব্যিক ঘেসো কবিতা বেরুতো না কলম দিয়ে। যাই হোক, আবজাব কথা থাক, মোদ্দা কথা হচ্ছে ঘাসের রাজ্য আমাকে ভীষণ টানে, আর বিশেষ ভাল লাগে সেই অঞ্চলে পশু-পাখিরা। মনে আছে একজন আমার স্বপ্নের পাখি কোনটা জিজ্ঞাসা করাই বলেছিলাম ঘাস প্যাঁচা (Grass Owl)।
তো এবার আমরা চলেছি এক বিশেষ ধরনের অতি বিরল ঘাস পাখির খোঁজে- যার নাম বাংলা ঘাসপাখি ( Roufous-rumped Grassbird, Graminicola bengalensis)। সেই বিশেষ পাখিকে নিয়ে আলোচনার মূল কারণ ২টি, প্রথমত তাঁর বৈজ্ঞানিক নাম রাখা হয়েছে বাংলার নামে, দ্বিতীয়ত এটি বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ঢাকাতেই আবিষ্কৃত হয়েছিল। যদিও RC Tytler পাখিটি উনি নাকি Dr Jerdon কে প্রথম আবিস্কার করেছেন সেই নিয়ে বিতর্ক শুরু করেছিলেন। এই ক্ষুদের পতঙ্গভুক পাখিটি চিহ্নিত করা খুবই দুরূহ কারণ এটি ঘাসের রাজ্যে ঝোপ থেকে ঝোপে উড়ে বেড়িয়ে খাদ্য সংগ্রহ করে, এবং ঘাসের আড়াল থেকে বেরোয় না বললেই চলে। বাংলা ঘাসপাখি নিয়ে RC Tytler লিখেছিলেন – ১৮৫২ সালে ঢাকাতে এই পাখি সংগ্রহ করার পরে বর্ণনা ও অংকনচিত্র Mr Blythএর কাছে পাঠিয়ে দিই। ঢাকার ঘাসের রাজ্য এদের দেখা প্রায়ই মেলে। মনে হয় Dr Jerdonএর Birds of Indiaতে Graminicola bengalensis নামের যে পাখিটি আছে এইটিই সেই বিশেষ পাখি। ঢাকার ঘাস এবং ঝোপঝাড়ের সাথে সাথে বাংলা ঘাসপাখিও সম্পূর্ণ নির্মূল হয়ে গেছে, যদিও কারও জানা নেই কেমন করে এমনটা হল, বা শেষ পাখিটি চাক্ষুষ কে করেছেন। সৌভাগ্যক্রমে পাখিটি এখনও বাংলাদেশে আছে, বিশেষ করে টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রান্তসীমার গাছপালায়। এবং আমরা আবার চলেছি টাঙ্গুয়ার হাওরে এবং মূলত বাংলা ঘাসপাখির খোঁজে যা গত কয়েক দশকে মাত্র কয়েকবার দেখা গেছে -
বর্ণনা- বাংলা ঘাসপাখি একটি ডোরাযুক্ত লালচে-বাদামি পোকা-শিকারি পাখি ( দৈর্ঘ্য ১৬ সেমি, ডানা ৬ সেমি, ঠোঁট ১.৪ সেমি, পা ২.৪ সেমি, লেজ ১৪.৭ সেমি)। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির লালচে-বাদামি পিঠে মোটা কালো লম্বা দাগ থাকে, তবে কোমর ও ডানায় রয়েছে লালচে রঙের দাগ। এর ঘাড়ের পিছনের লম্বা সাদা দাগ কিংবা পীত বর্ণের, ভ্রু-রেখা সাদা, দেহতলের অধিকাংশ সাদা কিন্তু বগল ও বুকের পাশ লালচে-পীত বর্ণের, ঘোর কালচে-বাদামি প্রশস্ত লেজের আগা সাদা, এর অনেকাংশ নিচে থেকে দেখা যায়, চোখ লালচে-বাদামি, পা ও পায়ের পাতা মেটে-বাদামি এবং ঠোঁট বাদামি। ৩ টি উপপ্রজাতির মধ্যে G.b.bengalensis বাংলাদেশে পাওয়া যায়।
স্বভাব- বাংলা ঘাসপাখি সাধারণত পানির ধারের নল ও উঁচু ঘাসে বিচরণ করে, খুব নিভৃতচারী ও দিবাচর পাখি। প্রজনন মৌসুম ছাড়া সচরাচর ঘন ঘাসে লুকিয়ে থাকে। ভুম, নলের ঝোপ ও ঘাসে খাবার খোঁজে।
খাদ্যতালিকায় রয়েছে পোকামাকড়। বিরক্ত হলে অনিচ্ছায় ঘাসের আড়াল ছেড়ে সামান্য উড়ে ঘাসে লুকিয়ে থাকে। প্রজনন মৌসুম ছাড়া ডাকে- এর- উয়িট-উয়িট-উয়িট। জুলাই-আগস্ট মাসে প্রজননকালে ছেলেপাখি নলের চূড়া থেকে শ্রুতিকটু গান গায় এবং নলের উপর দিয়ে ওড়ার সময় একটু করে গান ধরে।
গভীর জলে দণ্ডায়মান ঘন ঘাসে নলখাগড়া এবং উদ্ভিদের আঁশের উপর সূক্ষ ঘাসের শিকড় বিছিয়ে গভীর বাটির মত বাসা বানিয়ে এরা ডিম পাড়ে। ডিমগুলো সাদা, সংখ্যায় ৪টি, মাপ ১.৭ x ১.৪ সেমি।
বিস্তৃতি- বাংলা ঘাসপাখি বাংলাদেশের বিরল আবাসিক পাখি, প্রধানত সিলেট বিভাগের হাওরের চারপাশের নলে পাওয়া যায় এবং উনিশ শতকে ঢাকা বিভাগে ছিল এমন তথ্য আছে। ভারত, নেপাল, দক্ষিণ-পূর্ব চীন, মিয়ানমার ও ভিয়েতনামসহ দক্ষিণ, পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এর বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে।
অবস্থা- বাংলা ঘাসপাখি বিশ্বের প্রায় বিপদগ্রস্ত এবং বাংলাদেশে অপ্রতুল-তথ্য শ্রেণীতে রয়েছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতি সংরক্ষিত।
বিবিধ- বাংলা ঘাসপাখির বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ বাংলার ঘাসপাখি( ল্যাতিন graminis =ঘাস, bengalensis= বাংলার), সারা বিশ্বের প্রায় ৯০০০ প্রজাতির পাখির মধ্যে ১১টির বৈজ্ঞানিক নামের সাথে bengalensis বা বাংলার পাখি শব্দটি জড়িত আছে।
(তথ্যসূত্র- বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ, পাখি খণ্ড, এশিয়াটিক সোসাইটি)
আজকের যাত্রা- মধ্য রাতে বাস ছাড়ছে ফকিরারপুল থেকে, ভোরের সুনামগঞ্জে নেমেই হাসন রাজার মত দু চোখে নিশা লাগিয়ে রওনা দিচ্ছি হাওরের পথে। বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হকের সাথে বাংলা ঘাস পাখির সন্ধান ও ছবি তোলার এই অভিযানে যদি দিয়েছি আমিও। আসলে কদিন আগে কম্বোডিয়ায় সন্ধান পাওয়া বাংলা ঘাসপাখির বাসস্থানের বর্ণনা ও ছবি পেয়ে দেখা গেল আমাদের টাঙ্গুয়ার হাওরের শেষ ঘাস বনের অবস্থা যতই ছিটে ফোঁটা হোক না কেন তা কম্বোডিয়ার চেয়ে ভাল অবস্থানে আছে। কাজেই চেষ্টা করে দেখা যাক না কেন পাখিটির সন্ধান, বিশেষ করে যেখানে পাখিটি এই হাওরে একাধিক বার দেখা গেছে।
শুনেছি এবার যে নৌকা (বজরায়) থাকা হবে তাতে সৌর বিদ্যুৎ থাকবে , হয়ত নেটও থাকতে পারে, তাহলে প্রতিদিনই আপনাদের জানাব ঘাসের রাজ্যে ছোট্ট সেই প্রাণের খোঁজে আমাদের কৌতূহলী দৃষ্টির কথা। আপাতত ব্যাগ গোছানোর পালা, সবার উপরে রাখছি সদ্য গতকালই কেনা হুয়ান রুলফোর পেদ্রো পারামো। দেখি, অন্তত আজ রাত্রিকালীন যাত্রার সময় মেক্সিকোর কোমালার সেই মায়াবাস্তবতার জগত আমার বাস্তব ঘাসপৃথিবীর চেয়ে বেশি মায়াময় হয়ে ধরা দেয় কিনা-
মন্তব্য
তো শেষ পর্যন্ত কবিতাটা লেখা হলোনা?
----ইমরান ওয়াহিদ
ছবি থাকলে ভালো হত।
আমি পাখি নিয়ে লেখা শুরু করছি, দাড়ান। তবে আপনাদের মত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব দিতে পারব না, তবে গাছপালার মতে অভিজ্ঞতালব্ধ লেখা লিখতে পারব নিশ্চয়!
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
"অপেক্ষায়, নাজির"
হ
facebook
শুরু করে দেন-
facebook
হ, করুম, কাক না, কাঠ ঠোকরা কোনটা দিয়ে শুরু করি সেটা নিয়েই ভাবছি।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
facebook
এখন পর্যন্ত না , আগে স্তেপে বা পাম্পাসে থাকি কদিন, তাপ্পর দেখা যাবে-
facebook
প্রত্যাশা রাখছি দেখা পেয়ে যাবেন, আমরাও পাখির ছবি দেখব একসময়।
সৌরবিদ্যুত ওয়ালা বজরার কথা শুনে চমৎকৃত হলাম।
শুভেচ্ছা
আশা করছি, পরশু হতেও পারে!
facebook
শুভকামনা।
facebook
অণু ভাই,
ছবি ছাড়া আপনার লেখা কেমন যেন পানসে পানসে লাগে। ছবি আসুক তাড়াতাড়ি।
অঃ টঃ একটা টাইপো চোখে পড়ল। শেষ থেকে দ্বিতীয় প্যারায় ঘা
facebook
ঘাসপাখির ছবি কই, অণু ভাই?
জীবনানন্দ চোখ ছিল সুদূর বিস্তৃত, এজন্যই জীবননান্দের কাব্যজগত কেমন ঘাসময়! আহা কি বিজন ঘাস!
পোলিনকা-প্রেয়সিকে নিয়ে একটা লেখা নামান না, অণু ভাই, প্লিজ! গদ্য বা পদ্য, যাই হোক! প্রেয়সীকে ঠকাতে নেই!!
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
facebook
লিখে ফেলুন কবিতা। কথা দিয়ে কথা রাখতে হয়
উরির ঘাসের খোঁচায় আমি জেরবার
কবিতা লিখতে বলে 'কে আবার!
বললে আম্রা শুনছি না হে
উরি ঘাস একটা অভিশাপ
facebook
তারেক অণু'ও একটা অভিশাপ।
মাইন্যাশে মাইন্যাশে= পিল্যাশ
.......
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
কেবল পৌছালাম
facebook
উরি ঘাস!! উরি বাবা!!
____________________________
ঘাসপাখির ছবিসহ আপনার পরবর্তী পোস্টের অপেক্ষায় থাকলাম।
গোঁসাইবাবু
আপনি দেশে ফিরত গেছেন দেখে একটা শয়তানী তৃপ্তির হাসি দিয়ে ভেবেছিলাম ১ লাখ ৪৭ হাজার বর্গ কিমি আর কতই ঘুরাঘুরি করে তামাতামা করবেন। আপনার ঘুরাঘুরি তো আরো বেড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। হিংসার জ্বালায় যে আপনার ফেইসবুকের ছবি দেখবো না বা লেখা পড়বো না তাও সম্ভব হচ্ছে না। এই ছবি না দেখলে লেখা না পড়লেই নিজেরই ক্ষতি। আপনি ঘুরাঘুরির মধ্যে লেখার সময় পান কই? আমি ৯৯% নিশ্চিত আপনি চরম উদাসের ম্যাটল্যব প্রোগ্রাম দিয়ে লেখেন।
--------------------------------
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হব – বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনোজলে পার
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।
facebook
নতুন মন্তব্য করুন