ইতালি তো একটি দেশ নয়, সে এক আলাদা গ্রহ। বিশাল ভূখণ্ডটির একেক প্রান্তে একে ধরনের মানুষ, সংস্কৃতি, খাবার, রঙ, জীবনধারা। ইতালি দেখে শেষ করা এক মানব জীবনে সম্ভব না, আর তার বিখ্যাত দ্বীপগুলোর কথা বাদই দিলাম! এত কিছুর মধ্যেও নেপলস ( যাকে ইতালীয়রা বলে ন্যাপোলি) আবার বিশেষ ভাবে আলাদা। সেখানের অধিবাসীরাই মজা করে বলে, তোমরা এখন ন্যাপোলিতে, আলাদা ধরনের জীবনে উপভোগ করে, আর সারা ইতালি ন্যাপোলিকে বিশৃঙ্খল, নোংরা, আড্ডাবাজ ইত্যাদি ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করে তাদের চেয়ে আলাদা করার চেষ্টা চালায় বটে, কিন্তু এখনও সারা ইতালির ভেনিস, রোম, ফ্লোরেন্স, পিসা, সিসিলি, তুরিন, মিলানের চেয়েও বেশি পর্যটক আকর্ষণ করে কিন্ত ভিসুভিয়াসের নাগালের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা ন্যাপোলি এবং অদূরের পম্পেই শহর। তিলোত্তমা নগরীটিকে টানা কবছর ইউরোপের আবর্জনার শহর বলে অভিহিত করা হলেও পর্যটকের ঢলের কমতি নেই তাতে।
নেপলস শহর কেন্দ্রে পা দেবার পরপরই সেখানের অধিবাসীরা রাস্তা পারাপারের বিশৃঙ্খলতা কয়েক মিনিটের জন্য হলেও পুরান ঢাকায় নিয়ে ফেলেছিল, সেই সাথে আছে সাইকেল আরোহিদের বেল না বাজিয়েই ঘাড়ের উপরে এসে পড়ার বেমাক্কা বাজে অভ্যাস। আর হ্যাঁ, দুটো গলিতে ঢুকতেই দেখা গেল আবর্জনার শহর নামটা এমনি এমনিই দেওয়া হয় নি, ডাস্টবিন উপচে রাস্তা ভরে আছে ময়লার ব্যাগে! সাত জলদি হোটেলে ব্যাগ করে সুহাসিনী রিসেপসনিস্ট ফ্রান্সেককার কাছ থেকে শহরের ম্যাপ বুঝে নিয়ে ভ্রমণসঙ্গিনীকে সাথে নিয়ে বৈকালিক নাস্তা আর সূর্য ডোবার আগ পর্যন্ত শহরটা ঘুরে দেখার মানসে রওনা দিলাম। উনি আবার আগের জনমে ইতালিয়ান ছিলেন, নানা ধরনের চীজ আর টম্যাটো সসের আস্ত বিশ্ব-কোষ। বেচারিরও খুব একটা দোষ নেই, শিশুকাল থেকে ইতালিতে যাওয়া-আসা থাকলে আমিও এমন উঁচু দরের চীজ ও ওয়াইন বিশেষজ্ঞ এবং ইতালি প্রেমিক হয়ে যেতেম নিঃসন্দেহে।
সে-ই জানালো ন্যাপোলিতে এক ক্ল্যাসিক পিজ্জারিয়া আছে যেখানে অনেক দশক ধরে একই রকম মজার পিজ্জা সার্ভ করা হয়, ঠিক ইতালিয়ান ঘরোয়া পরিবেশে, এমন চাইলে পিজ্জা বানানোর পুরো প্রক্রিয়া দেখা যায়! ম্যাপ দেখে সরু সরু গলি পেরিয়ে মূল রাস্তার এক কোণে পাওয়া গেল সেই পিজ্জা রেস্তোরাঁ, সামনে সাদা পোশাকে এক বাবুর্চি, মুখে অকৃত্রিম হাসির সাথে ইতালীয় ভাষায় তাদের পিজ্জার গুণগান। এমন কোন বড় রেস্তোরাঁ নয়, অল্প কটাই টেবিল- চেয়ার, পাশেই কিচেন এবং পিজ্জা বানাবার ওভেন, প্রায় সবই হচ্ছে চোখের সামনে। পিজ্জারিয়ার নাম Da Michele।
কিচেনের সামনে গ্লাসে দেখি এক অতি পরিচিত সোনালী-চুলো মহিলার ছবি, মজাসে পিজ্জা খাচ্ছে! মুহূর্ত পরেই মনে হল, আরেহ, ইনি তো প্রেটি ওম্যান জুলিয়া রবার্টস! উনিও নাকি ন্যাপোলিতে আসলেই এখানের পিজ্জা আস্বাদন করে যান!
পাশের দেয়াল জুড়ে এই পিজ্জারিয়ার সাথে সংযুক্ত আদি মালিকদের ছবি, কিছু লেখা, সেই সময়কে ধরে রাখার চেষ্টা ধূসর ফ্রেমে। এই সময় আবারও ভূমধ্যসাগরীয় ভুবন ভুলানো ঝলমলে হাসি দিয়ে ভ্রমণসঙ্গিনী জানাল, তুমি এখনও বোঝো নাই, এই রেস্তোরাঁ হচ্ছে দিয়েগো ম্যারাডোনার প্রিয় পিজ্জারিয়া! ঐ দেখ ছবি, এটার জন্যই নিয়ে এসেছি এইখানে।
আসলেই তো ! বাংলাদেশে ন্যাপোলি নামটা এককালে মনে হয় পরিচিত হয়েই ছিল এই কিংবদন্তীর ফুটবলারের জন্য, যিনি মামুলি এক ক্লাবকে প্রায় একক প্রচেষ্টায় করেছিলেন চ্যাম্পিয়ন। এই শহরে আরও তার কথা স্মরণ করে মানুষ, ঈশ্বরের আসনে বসানো আছে তার ছবি একাধিক জায়গায়-
সেই দিয়েগো প্রায়ই রাতে আসতেন এখানে, আমাদের মতই পিজ্জা খেতে ! আর কী লাগে! চট করে দুটি পিজ্জার অর্ডার দেওয়া হল, সাথে লাল পানীয়। এত যে বিখ্যাত রেস্তরাঁ, রথী-মহারথীরা যাতায়াত করে নিয়মিত, তারপরও এরা তাদের ঐতিহ্য ছাড়ে নি, মাত্র দুই ধরনের পিজ্জা পাওয়া যায়, একটাতে ওভেন থেকে বাহির করা ময়দার রুটির উপরে পাতলা টম্যাটো সস, অন্যটিতে এর উপরেই সামান্য চীজ! ব্যাস! দাম বাংলাদেশী টাকায় একটার ৩০০ অন্যটার ৪০০!
তবে খুব বেশি ভালো লাগল এই ভেবে যে এত চাহিদা থাকা সত্ত্বেও তারা পিজ্জার দাম বাড়ায় নি ( ঢাকায় ৪০০ টাকায় কোন পিজ্জা পাওয়া যাবে , জানতে ইচ্ছা করে), আর নানা ধরনের খাবার দিয়ে দোকান ভর্তি করে নি, বরং খাবারের মান ও গ্রাহক সেবা এক রেখে অক্ষুণ্ণ রেখেছে নিজেদের সুনাম। আর নানা দেশের বিখ্যাতরা এসে স্বাদ নেয় এইখানেই ইতালীয় পিজ্জার, তাও ব্যবসার সাইনবোর্ড হিসেবেই কাজ করে। সেই সাথে কোন সিট আগাম রিজার্ভ দেবার ব্যবস্থা নেই, দুপুরে আসলে হয়ত ৫০ জনের পিছনের আপনাকে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হবে, আপনি যেই হন না কেন!
ঠিকানা - Da Michele on Via Sersale, 13
বেশ ফুর্তিতে নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে পিজ্জা খেয়ে সন্ধ্যার নেপলসে ঘুরতে বেরিয়ে একাধিক জায়গায় দিয়েগো ম্যারাডোনার স্মৃতি বিজড়িত কিছু জায়গা বিশেষ করে যীশুর জায়গার তার ছবি বসিয়ে তৈরি স্থাপনা দেখে
তখন আমাদের গন্তব্য ভূমধ্যসাগর—
( ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা দুই দেশেই অনেক স্থানীয় বন্ধুর আমার, দেশ দুটোতে যাবার সৌভাগ্যও হয়েছে, অবাক হয়ে আনন্দ নিয়ে খেয়াল করেছি তাদের মাঝে মোটামুটি গলায় গলায় ভাব, একসাথে ফুটবল দেখে নিয়মিত, নিজের দলের পক্ষে চিল্লিয়ে গলা ফাটায় কিন্তু অন্য দলকে গালাগালি করে না। বরং তারা চায় যেন ইউরোপ হারে, ল্যাতিন আমেরিকা জিতে।
অথচ বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে এই দুই দেশ একটি সমর্থন করলে সাথে সাথে যেন অন্যটিকে গালি দিতেই হবে ! সামনের মাসে বিশ্বকাপ, ইতিমধ্যেই ফেসবুক ভর্তি হয়ে গেছে I support Brazil, fuck Argentina বা Cheers Argentina, Go to hell Brazil ধরনের কথায়।
এর কী কোন দরকার আছে? আপনি যাকে ইচ্ছা সমর্থন করুন, কিন্তু অন্যকে তার সমর্থনের জন্য কেন কটু কথা বলবেন?
ফুটবল দেখার সময় আমি ব্রাজিলের পাগলা ভক্ত, তাদের তাড়া করে ফিরেছি গত দুই বিশ্বকাপ, কিন্তু তাই বলে কেন আমাকে আর্জেন্টিনার বিদ্বেষী হতে হবে, কেন আমি মেসির অসাধারণ ফুটবলের প্রশংসা করব না। দিনের শেষে ফুটবল তো একটা খেলা-ই , নাকি?
আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিল সমর্থক ফুটবল পাগল বন্ধুদের কাছে আমার এটাই বার্তা, যেখানে খোদ সেই দেশের মানুষগুলোও এমন নোংরা আক্রমণ করে না, আমরা কেন একটা খেলার অন্য দুই দেশ নিয়ে ব্যক্তিগত লড়াই করছি? তারচেয়ে আসুন খেলা উপভোগ করি, প্রিয় দলকে সমর্থন করি গলা ফাটিয়ে, এবং শেষ পর্যন্ত জয় যেন ফুটবলেরই হয়।)
মন্তব্য
পিতজা খাবো পিতজার মতই সুস্বাদু লেখা
ইসরাত
গ্রাচ্চি গ্রাচ্চি !
facebook
একদম ঠিক বলেছেন। খেলা খেলাই। খেলা দেখে গালি গালাজ করারও কিছু নাই আবার উত্তেজনায় হার্ট এটাক হওয়ারও কিছু নাই।
ফাহিমা দিলশাদ
সহমত।
facebook
নেপলস বেড়িয়ে আনার জন্য ধন্যবাদ।
তবে শেষে একটা থাপ্পড় খেলাম। নিজের কাছে নিজে।
P.S.: ছবিগুলো ছোট লাগছে কেন?
- দীপালোক
আপনিও দাঙ্গাবাজ সমর্থক নাকি?
ছবির ব্যাপারটা ঠিক বুঝছি না ! আগের মতই দিচ্ছি, কিন্তু পিচ্চি আসছে !
facebook
খেলা দেখার সময় একটু আধটু চিল্লাহল্লা করে ফেলি আরকি, মনে মনে।
বেচারি কিন্তু চিজ ও টম্যাটোতে বিশেষজ্ঞ ছিল, ওয়াইনে ছিল না।
শুধু দামটুকু বাদ দিলে বাকী সব লক্ষ্ণন মিলে যায় ঢাকার হাজি বিরিয়ানির ঐতিহ্যের সাথে!
এমনকি খেলা না হয়ে জীবনও হয়, তাতেই বি কি? ঝগড়া-ফ্যাসাদ বা কটু কথা জীবনের জন্যও ইনজুরিয়াস!
তবে বন্ধু মহলে একটু কটুবর্ষন না হলে মনে হয় জমে না!
আচ্ছা, অণু ভাই তাহলে ব্রাজিল? শিল্পভারে দমবন্ধ অবস্থা হয় না কখনো? তুলনায় দেখুন, আর্জেন্টিনা কেমন নির্ভার, অবাধ!
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
কটু কথাও হয়ত চলে কিন্তু হাতাহাতি, খুনোখুনি হয় যে?
facebook
ঠিকানা টুকে রাখলাম, সামনে দিয়ে যাবার সময় একদিন ঢুঁ মেরে আসব
(আমি ইউরোপের ধারে কাছেও থাকি না )
পৃথিবীর পথে পথে এর পর এখন নতুন বই বরে করে ফেলুন,
নাম হবে পৃথিবীর খাবার দোকানে দোকানে
শুভেচ্ছা
আমি তো এমনি এমনিই খাই !
facebook
প্রথম কথা আপনি এতলেখা কি করে লেখেন ? আপনার কি ৪৮ ঘন্টায় একদিন
ফেবুর সেরা সময় আসছে সমনে, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে জল ঘোলা হবে বিস্তর। তারপর দু-দল গত দুই বিশ্বকাপের মত সমপরিমান ব্যর্থ হলে শান্তির সু-বাতাস বইবে আর না হলে আমরাই শ্রেষ্ঠ বলে একদলের বুক ফুলে আকাশ কে ছুঁয়ে ফেলবে। আবার কেউ কেউ আত্নহত্যা খেয়ে বসে থাকে রাগে অভিমানে আর দু:খে।
ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে তর্ক-বিতর্কের চেয়েও আমার মনে হয় গুরুত্বপূর্ণ হলো নির্লজ্জের মতো নিজ ঘরের ছাদে কিংবা বারান্দায় ভিন দেশের পতাকা উড়ানো। দয়া করে এই কাজটি থেকে বিরত থাকুন সবাই।
মাসুদ সজীব
সময় নাই, পাখির একটা বই দিনের ১০ ঘণ্টা করে নিয়ে যাচ্ছে, শেষ হলে ঘুরতে যামু
facebook
ছবিগুলো এরম টুনিট্যাক সাইজের ক্যানো গো!
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
ফ্লিকার কী জানি করছে! দেখেন তো মুরব্বী-
facebook
আপনাকে করা অতি পুরাতন প্রশ্ন আবার নতুন করে করি--
ভাইরে, আপনি পা রাখেন নাই এমন জায়গা এই ধরাধামে আর আছে নাকি?
গোঁসাইবাবু
কম্পুচিয়া, সেখানে কম্পমান হতে যাইতেছি
facebook
ভ্রমণসঙ্গিনীর কোন ছবি তো দেখলাম না?
ময়না পরে সালোয়ার কামিজ
বিউটি পরে শাড়ি
ব্রাজিল ব্যাটা ভিক্ষা করে
আর্জেন্টিনার বাড়ী
গুপন থাক- আমারও তো ছবি নাই, বুদ্ধমূর্তিরও নাই !
facebook
"দিনের শেষে ফুটবল তো একটা খেলা-ই , নাকি?"
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
আমরা খেলা দেখে গলা ফাটাবো চিল্লাফাল্লা করবো। কিন্তু তা যেন ৯০ মিনিটই হয়। কারণ চিল্লাফাল্লা ছাড়া খেলা দেখতেও মজা লাগে না। একটা অনুরোধও করব-
আমাদের বাসার ছাদে কিংবা বাসার ফ্লাটে ভিনদেশী পতাকা না উড়ালেই কি নয়। আমাদের দেশের গ্রামে-গঞ্জে, শহরে কিংবা বাড়ির ছাদে বা ফ্লাটের জানালায় ভিন দেশী পতাকা দেখতে চাই না। শুধু চাই লাল সবুজের পতাকা। যদিও আমার চাওয়া বা না চাওয়ায় কারো কিছু আসে যায় না।
-এ এস এম আশিকুর রহমান অমিত
চার বছর ফুটবল বিশ্বকাপ হবে আর হুড়োহুড়ি-মারামারি-গালিগালাজ হবে না, এটা কিভাবে সম্ভব?
বাংলাদেশী বা ভারতীয় বাঙ্গালীদের এসব ছাড়া বুঝি খেলা রোচে?
নাহ্! এতো এতো নামি দামি খাবার (তাও আবার বেশীরভাগ বাইরের বিশ্বের) খেয়েও আপনি নিরামিষ রয়ে গেলেন অণু।
ভালো থাকবেন।
এরপর মেক্সিকো গেলে আমার জন্য ঝাল মরিচ আনবেন।
শুভকামনা নিরন্তর।
---------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ
ভালো লিখা, অনেক কিচু জানা গেল
বড় হলে আমিও একদিন নেপলসে পিৎসা খেতে যাবো!
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
নতুন মন্তব্য করুন