আমাদের পাশের পাড়ার নাম সাগরপাড়া, সেই পাড়ার নামে রাজশাহীর মানুষ যত না চিনত, তার চেয়ে ঢের বেশি চিনত সাগরপাড়ার বটতলার কথা বললে। বিশাল ঝাঁকড়া এক বটগাছ ছিল রাস্তার মোড়ে, ছোট থেকেই দেখেছি তাঁর নিচে চায়ের স্টল, রিকশার স্ট্যান্ড, মানুষের ভিড়। সরু সরু রাস্তা তখন জালের মত বিছিয়ে ছিলে শহরময়, সাথে খোলা কুৎসিত ড্রেন। রিকশার টুংটাং-এ মুখরিত থাকত রাজশাহী, অটো রিকশার গো গো হর্ন তখনো আসে নি। একদিন সেইসব অলিগলির নকশা বদলে বড় পিচ ঢালা রাস্তা গড়া হল, তবে বটগাছটিকে বাঁচিয়েই। বদলে গেল আমার চেনা শহরের ছবি, তবে মানুষের সুবিধাও হল চলাচলে, আর বটগাছটি তো রয়েছেই আমাদের সেই সময়ের কথা মনে করিয়ে দিতে, যার নিচে যেয়ে কোন স্মৃতিমেদুর সন্ধ্যায় বলা যায়-
নিশিদিন দাঁড়িয়ে আছ মাথায় লয়ে জট,
ছোটো ছেলেটি মনে কি পড়ে, ওগো প্রাচীন বট?
কদিন আগে প্রবল টর্নেডো বয়ে গেছে প্রিয় শহরের উপর দিয়ে, লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেছে চেনা রূপ, উপড়ে নিয়ে গেছে আমাদের শৈশবের সাথী সেই বটগাছ।
কেবল সাগরপাড়ার বটগাছই নয়, বাংলাদেশের অন্যতম নয়নাভিরাম রাস্তা রাজশাহী বিশ্ব-বিদ্যালয়ের প্যারিস রোডের অনেকগুলো গাছই ভূলুণ্ঠিত, মেডিক্যাল কলেজের দানবীয় গাছও শিকড় সহ পড়ে আছে চত্বরে। কেমন হু হু করে ওঠে বুকের মাঝে, জন্মের পর থেকেই মাথার উপরে আশ্রয় দিত যে গাছগুলো সেগুলো আর নেই, অনেক নিকটাত্মীয়ের মতই চলে গেছে না ফেরার দেশে। স্কুলে যাওয়া-আসার পথে প্রতিদিন মাথার উপরে চন্দ্রাতপের মত যে অসাধারণ ঘন ক্যানোপির ছায়া দিত প্যারিস রোডের গাছগুলো, সেখানে আজ জায়গায় জায়গায় রোদেলা আকাশ দেখা যায়, মনে হয় কামানের গোলা ছিন্নভিন্ন করে গেছে আমাদের সবুজ পৃথিবীকে।
এমন আরও মহীরুহ যার কোটরে খুড়ুলে প্যাঁচার পরিবার দেখে বিমলানন্দ পেয়েছিলাম, ডালে ডালে নানা ধরনের অর্কিড দেখে ভালবাসা জন্মেছিল পরগাছার উপরে, কোনটার ডালে বিশ্রাম নিতে আসত মেটে-মাথা কুরাঈগল, গোঁড়ায় খুনসুটি করতো কাঠবেরালির দল, সেগুলোও আর নেই !
মানুষের মৃত্যুতে মানুষ কাঁদে, কিন্তু গাছের মৃত্যুতে? মানুষ যে না তার প্রমাণ পেয়েছি দেশে হেফাজতের ঢাকায় সমাবেশের সময় অগণিত গাছ কাটা হলেও কোন বিজ্ঞ পরিবেশবিদ বা সংস্থার কাছে এর প্রতিবাদ না শোনায়। তবে কি গাছেরাই গাছদের সাথী? তারাই মর্মর ধ্বনি তুলে সান্ত্বনা দেয় জীবিত অন্য সদস্যদের, শোনায় অ্যালান কোয়ার্টারমেইনের বার্তা- - বড় একটা গাছ কাটার আগে সবার একবার ভেবে দেখা দরকার। সুন্দর বড় গাছ দেখতে চিরদিনই আমার ভাল লাগে। শৈত্যপ্রবাহের সময় কি গর্বভরে মাঠ উঁচু করে থাকে ওরা, প্রাণ ভরে অনুভব করে বসন্তের পদধ্বনি! কি অসাধারণ শোনায় তাদের কণ্ঠ, যখন তারা কথা বলে বাতাসের সাথে। পাতার ফিসফিসানির কাছে হার মানে বায়ূ দেবতা ঈওল্যাসের হাজারটা বীণা। সারাদিন পাতাগুলো চেয়ে চেয়ে দেখে সূর্যালোক, সারারাত ধরে দেখে তারা। শতাব্দীর পর শতাব্দী তাদের খাবার জোগায় মা ধরিত্রী। অনেক দালান-কোঠা-বংশের উত্থান পতন দেখার পর অবশেষে ঘনিয়ে আসে চূড়ান্ত দিন। হয় লড়াইয়ে সেদিন জিতে যায় বাতাস, নয়তো নেমে আসে অস্বাভাবিক মৃত্যু।
কিন্তু এবার দেখেছি রাজশাহীর আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেরই মত খারাপ এই গাছগুলোর জন্য, সবাইই একবার হলেও বলছে- ইশ, এইভাবেই ভেঙ্গে গেল এত বড় বড় গাছগুলো! চেনা শহরে ফেরা আর কোন সময়ই আগের মত আনন্দময় হবে না পরিচিত গাছবন্ধুরা না থাকায়। বিশাল একটা শূন্যতা তাড়া করবেই আমাদের- স্মৃতি ও বর্তমানের মাঝের পার্থক্য, যা গড়ে দিয়ে গাছগুলো উপড়ে নিয়ে গেছে এক ভয়াল টর্নেডো, অচেনা করে দিয়ে গেছে চিরচেনা জীবনকে।
মন্তব্য
পথের পাশে যে কোন গাছে দেখতে দেখতে আসলেই একরকম অভ্যাস দাঁড়িয়ে যায়। কোন একদিন ঐ গাছটাই না থাকলে মনে হয়, "ইস, ওখানেই তো ছিল একটা গাছ"
অণুদা দুফোঁটা অশ্রু এসে গেল চোখে। নস্টালজিয়ার গাছ হারানোর বেদনা আপনজন হারাবার চেয়ে কোনও অংশে কম নয়, এ ভালো করেই জানি। লেখাটার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমি নিজেও নস্টালজিয়ার বৃক্ষদের নিয়ে ‘সেইসব মহীরুহ’ নামে একটা সিরিজ আরম্ভ করতে যাচ্ছিলাম, সেই সময় আপনার এ লেখাটি বাড়তি প্রেরণা হয়ে আবির্ভূত হল।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
সত্যি বড় মন খারাপ করা ব্যাপার।
একবার আমাদের বাড়ির একটা কদম গাছ উপড়ে গিয়েছিল ঝড়ে। খুব কষ্ট হয়েছিল সেদিন।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
অণু, আপনার লেখা পড়েই জানলাম ভয়াবহ খবরটা।
আর বেশী কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে না। ইস্!
------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ
অণুদা মায়ের কাছে শুনেছি এই ঝড়ে আমাদের অনেক গাছ ভেঙ্গে পড়েছে আর গোরস্থানের অনেক পুরানো বড় বড় গাছ ভেঙ্গে গেছে। এত খারাপ লেগেছে শুনে, একটা গাছ মানে তার সাথে অনেক অনেক ভালবাসা আর স্মৃতি।
শুনলাম গোরস্থানের অনেক গাছ যার কিনা একটা ডাল ভেঙ্গেছে ঝড়ে তেমন গাছগুলো পুরা কেটে ফেলেছে মানুষে অল্প কিছু টাকার জন্য।
কোন মানে হয়!!!
মানুষের চেয়ে বর্বর আর লোভী প্রানি আসলে আর একটাও নেই।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
"বিশাল একটা শূন্যতা তাড়া করবেই আমাদের- স্মৃতি ও বর্তমানের মাঝের পার্থক্য, যা গড়ে দিয়ে গাছগুলো উপড়ে নিয়ে গেছে এক ভয়াল টর্নেডো, অচেনা করে দিয়ে গেছে চিরচেনা জীবনকে।"
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
আহা, গাছ নেই তো ছায়াও নেই।
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
-আনন্দময়ী মজুমদার
যদি আমাদের একজন বৃক্ষমন্ত্রী থাকতেন, তিনি তাহলে বলতেন- এ ব্যাপারে বটগাছটিরই দোষ। কথায় আছে না, অতি বড় হয়ো না, ঝড়ে ভাংবে মাথা। বটগাছটি কেন অত বড় হতে গেল, ঝড়ে তো ভাংবেই ।
লেখাটা পড়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। সত্যিই গাছ নিয়ে ভাবার সময় বোধয় আমাদের নেই…
-আরাফ করিম
কিছু ছবি তুলে রেখেছিলেন, অনু ভাই?
ভাবলাম রাজশাহী বেড়াতে যাব, অথচ কি দুর্ভাগ্য!
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
OMG (ও মা গো)
____________________________
নতুন মন্তব্য করুন