নকশাদার এক টিনের থালা, ঝকঝকে পাত্রটি ঝুলছে রান্নাঘরের দেয়ালে, বিচিত্র আঁকিবুঁকি আর রঙের প্রলেপ দেখে মনে পড়ে যাচ্ছে নানীর বাড়ীতে বাচ্চাবেলার সেই থালাটির কথা যেখানে নিয়মিত আম-দুধ খেতাম আমরা! মায়াময় স্মৃতির ধূসর পর্দা ছিড়ে মূর্ত হল কিছু সুপরিচিত তৈজসপত্র, সবই সাজানো-গোছানো রান্নাঘরে! কাঠের বারকোশে আলগোছে রাখা চামচের সারি, পিছনে থরে থরে সাজানো প্লেট, পেল্লাই গামলা, কী নেই সেই জাদুঘরে?
এখন বলুন রান্নাঘর আবার জাদুঘর হয় কী করে? আসলে কেবল রান্নাঘর, বা সেই বাড়ীটি নয়, বিশাল গ্রামটিই একটি জাদুঘর ! মধ্য ইউরোপের দেশ হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট থেকে ঘণ্টা খানেকের ট্রেন ভ্রমণে দূরত্বে অবস্থিত এই স্ক্যাঞ্জেন গ্রামের সীমানার মাঝে দেখা মিলবে প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় হাঙ্গেরির জীবনযাত্রা, নানা ধরনের বাড়িঘর, গির্জা, খামার ব্যবস্থা, শহররক্ষা প্রাচীর, এমনকিও কবরস্থান, তবে এর আকর্ষণের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে আছে মাতিও জাতির মহিলাদের সেলাই করা অপূর্ব সব পোশাক, যার সূক্ষ, রঙ ঝলমলে সৌন্দর্য আজও বিস্ময়ের উদ্রেক করে শিল্পরসিকদের মনে।
আজকের ভ্রমণসঙ্গী হাঙ্গেরির তরুণী কবি সুজানা চোব্যাঙ্কো যে পইপই করে বলে অবশেষে প্রায় টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এসেছে তাঁর পূর্ব-পুরুষের জীবনযাত্রা দেখাতে। মূলফটকের সাথেই অবস্থিত এক রেলস্টেশন, প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াবার খানিক পরেই কু ঝিক ঝিক করে ছোট ট্রেন এসে হাজির, সাথে লাল ইউনিফর্ম পরা গার্ড, টিকেট চেক করে দর্শনার্থী বোঝাই করে ট্রেন রওনা দিল সেই জাদুঘর গ্রাম চিরে, যেন শুরু হল আমাদের টাইম মেশিনে চেপে অতীত অবলোকন।
হাঙ্গেরিতে এই ধরনের জাদুঘরগুলোর মাঝে এটিই বৃহত্তম। সেই গার্ড সাহেবই আবার আমাদের গাইড, হাঙ্গেরিয়ান এবং ইংরেজিতে সে ব্যাখ্যা করতে থাকল , বিশাল হাঙ্গেরির আটটি ঐতিহাসিক অঞ্চলের বাড়িঘরের প্রমাণ আকারের রেপ্লিকা বানিয়ে রাখা হয়েছে , সেই সাথে রাস্তা, দোকান, আস্তাবল, এমনকি গির্জাও। যাতে মানুষে সহজেই বুঝতে পারে অতীতের সংগ্রামময় জীবন নিয়ে, যা তাদের নিয়ে এসেছে বর্তমানে। সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করল চমৎকার গড়নের ছাদগুলি, নানা স্তরে খড় বিছিয়ে একেকভাবে তৈরি করা হয়েছে একেক অঞ্চলের বাসগৃহের ছাদ।
এর মাঝে রেল লাইনের এক পাশে নজরে আসল বেশ কয়েকটা খাড়া খাড়া নৌকা যার অর্ধেক মাটিতে পোঁতা!
জানা গেল, সেগুলো আসলে কবরের স্মৃতিচিহ্ন বা এপিটাফ্ এবং প্রতিটি নৌকার গায়েই ছুরির আঁচড় চালিয়ে চেষ্টা করা হয়েছে মানুষের মুখের আদল দেবার।
এমন মধ্যযুগীয় গোরস্থান দর্শনের রোমাঞ্চ মন ঘিরে থাকতেই ট্রেন থেমে গেল, এখন আমাদের হাতে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় আছে গ্রামের বেশ কিছু বাড়িঘর ঘুরে দেখার।
কী চমৎকার সাজানো গুছানো বাড়ীগুলি কিন্তু জনমানবহীন! অনেক গৃহেই ঢুঁকে মনে হল বাড়ীর সদস্যরা কেবল বাহিরে গেছেন, যে কোন সময় ফিরে আসবেন। মনোলোভা চিত্রকর্ম আঁকা কাঠের চেয়ার, বড় বড় সিন্দুক, লেপ-তোশকে মোড়া ছোট বিছানা, এক কোণে সেলাইয়ের যন্ত্রপাতি, ঝুলানো আছে অর্ধ-সমাপ্ত কাজ, এই নিয়েই সমস্ত বাড়ী। কোন কোনটার চত্বরে পানীয়জলের কুয়ো, ঘোড়ার আস্তাবল, বেড়া দিয়ে ঘেরা শস্যক্ষেত্র। অল্প কিছু বাড়ীতে আগের যুগের পোশাক পরা আধুনিক হাঙ্গেরিয়ানদের দেখাও মিলে গেল, তাঁরা সবাই-ই এই গ্রামের বেতনভুক্ত কর্মচারী।
সবচেয়ে বড় গৃহে ছিল একটি গ্যালারী, যেখানে প্রদর্শন করা হচ্ছে হাঙ্গেরির উত্তরাঞ্চলের বিখ্যাত মাতিও জাতির নকশা করা নানা পোশাক। অতি সুক্ষ সুচিকর্ম এবং রঙদার সেলাইয়ের জন্য বিশেষ সুনাম ছিল একসময় মাতিওদের।
বিশেষ করে তাদের বিয়ের পোশাক (নারী পুরুষ উভয়েরই) এক দেখার মত কলা, ঠাসবুনটের নানা রঙের সুতোতে বুনানো নানা রঙের নকশা, বিশেষ করে মহিলাদের স্কার্ট, আর শার্টের উপরের অংশের সৃষ্টিতে বিমোহিত হয়ে থাকতে হয় অনেকক্ষণ।
জাদুঘরের একাংশ জুড়ে সেইসব ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিহিত অবস্থায় পুতুলের বিশাল সংগ্রহ, এছাড়াও আছে পোশাকের সাথে সংযুক্ত করা যায় এমন সব হাতে বুনানো জিনিস।
সংগ্রহের প্রায় সবই অষ্টাদশ বা উনবিংশ শতকের স্থাপত্য ও জীবনধারাকে নির্দেশ করে, কয়েকটি বাড়ীর দেয়াল ও প্রাচীর পাথরের তৈরি, কোন কোনটি আবার সরু সরু গাছের। আছে কামারের দোকান, রুটি বানাবার বেকারির অসাধারণ মডেল, কৃষকের নানা যন্ত্রপাতি, পানীয় সংরক্ষণের ব্যবস্থা ইত্যাদি ইত্যাদি। স্ক্যাঞ্জেন গ্রাম ঘুরে আসলে মধ্যযুগীয় হাঙ্গেরির পূর্ণাঙ্গ জীবনযাত্রা সম্পর্কে যেমন সম্যক ধারণা পাওয়া যায়, তেমনি মুগ্ধ হতে হয় মাতিও জাতির বুননশৈলীতে। সেই ইতিহাস কাছ থেকে দেখের উপলব্ধি করার আনন্দ নিয়েই আমাদের যাত্রা ফের শুরু দানিয়ুব তীরের উদ্দেশ্যে।
মন্তব্য
অপূর্ব, অণু ভাই! অনেক দিন ধরেই ঘুরছি আপনার সাথে! তবু ক্লান্ত হচ্ছি না একটুও, সীমাহীন বৈচিত্র্যের জন্যই হয়তো বা!
আগামী বইমেলায় 'বাংলার পথে পথে - ১' এবং 'পৃথিবীর পথে পথে-২' হাতে পেতে চাই।
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
ধন্যবাদ। তবে খালি মেলা উপলক্ষে বই লিখতে চাই না কিন্তু !
facebook
আপনার পুষ্ট বয়কট করবো ভাবছি কিন্তু মানব মনতো ঘুরে ফিরে লোভ সামলানো যায় না তাই পাঁচতারা দিয়ে গেলাম।
নানান স্তরে সাজানো গড়নের ছাদের ঘর প্রথম দেখলাম
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
ঢাকায় আসলে এসেন আমাদের প্রদর্শনীতে। আরও ২ দিন আছে
facebook
অসাধারণ একি ছবি ব্লগ! এমন করে যে, কোন জাতি তাদের বিশেষ একটি সময়ের সমাজব্যবস্থা/জীবনযাত্রাকে ধরে রাখার কথা চিন্তা করেছে, সেটা ভাবতেও অবাক হচ্ছি। জাতি হিসাবে আমরা যা করছি যা দেখছি, আর আপনি কি দেখালেন!
facebook
---------------------
আশফাক(অধম)
facebook
স্যুভেনির বিক্রির ব্যবস্হা আছে নাকি ওখানে? কিরাম সুন্দর্য রে!
তা তো একটু থাকবেই ---
facebook
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
।
কী ব্যাপার, দেখা হল না যে বড় !
facebook
সুমায় নাইক্যা পরেরবার
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
অ !!
সময় নাই এই কথাটা শুনলেই আমার ভয়াবহ বিরক্তি লাগে, যেন দুনিয়ায় একলা আমারই সময় আছে।
facebook
অসাধারণ। নিজেদের হাজার বছরের পুরানো ঐতিহ্য কে কিভাবে আধুনিক মানুষের কাছে নিয়ে আসা যায় তার জ্বলন্ত উদাহরণ এই গ্রাম। আপনাকে ধইন্যা আবারো আমাদের দেখার সুযোগ করে দেয়ার জন্য।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
জাপানেও এমন গ্রাম আছে, তাতে কিছুটা প্রাচীন জাপানের ছোঁয়া মেলে।
facebook
আপনি ভাই একজন বস্ পাব্লিক। আপনার কল্যাণে অনেক অজানা বিষয় এবং জায়গা সম্পর্কে জানতে পেরেছি। আপনার ভ্রমণ চলুক অবিরাম।
গোঁসাইবাবু
ধন্যবাদ
facebook
এরকম কিছু গ্রাম আমাদেরও তৈরি করা দরকার, যেমন প্রাচীন বাংলার গ্রাম, পাল/সেন আমলের গ্রাম, সুলতানি আমলের, মোগল আমলের, ব্রিটিশ আমলের, পাকিস্তান আমলের, ইত্যাদি। মাত্র পঞ্চাশ বছর আগে আমাদের গ্রামগুলো যেমন ছিল, এখন তার রুপ বেমালুম বদলে গেছে, বলতে গেলে হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে।
আসলেই
facebook
১৫, ১৭, ২৪, ৩১, ৩২-এর ছবিগুলি খুব পরিচিত লাগল যেন।
****************************************
মানুষে, মানুষে আর কতই বা পার্থক্য, বা গ্রামে গ্রামে !
facebook
বহুবার ঠিক করেছিলাম আপনার পোষ্ট পড়ব না (হিংসায়) পরে আবার ভাবি যেতেতো পারবোনা তাই না পড়ে ঠকে লাভ নেই তাই পড়ি।
ছোটবেলায় আমার ও ছোটবোনের দুটি বাসন ছিল যথাক্রমে ‘ফুলবা’ (ফুলের ছবি আঁকা) ও ‘আমবা’ (আমের ছবি আঁকা) ।
অভিমন্যু .
________________________
সেই চক্রবুহ্যে আজও বন্দী হয়ে আছি
সামনে আরও আসিতেছে-
facebook
আমাদের দেশের সোনারগাঁয়ে এমন কিছু হাতের কারুকাজ দেখা যায়। আছে সেই আমলের পালকি, নানা রকম পোশাক, কিছু গয়না ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেকটা সোনারগাঁয়ের মতই মনে হল তবে কিছু কিছু জিনিষ যেমন কবরের স্মৃতিচিহ্ন এগুলো নতুন দেখা হল।
ফাহিমা দিলশাদ
খুব সুন্দর।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ইশ! এরকম করে যদি আমাদের দেশের নিদর্শনগুলোকে গুছিয়ে রাখা যেতো!
**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।
মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।
নতুন মন্তব্য করুন