সকালে রিমঝিম বৃষ্টিতে ঘুম ভাঙল, ম্যাকেডেনিয়ার বৃষ্টি। হোস্টেলের বারান্দায় চোখে পড়ে ২০০০ মিটারের উঁচু পর্বত, সিক্ত আপেল গাছ। হয়ত এইভাবেই বৃষ্টি দেখেছিলেন অ্যালেক্সান্ডার দ্য গ্রেট, হয়ত গুরু অ্যারিস্টটলের কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন এইভাবেই আনমনে মাঝে মাঝে প্রকৃতির মাঝে হারাবার। । শৈশবে দুইজনেই ম্যাকেডেনিয়ার বুকে ভোরের বৃষ্টি দেখতেন হয়ত। আর দেখতেন Anjezë Gonxhe Bojaxhiu নামের এক শিশু যিনি বিশ্বে পরিচিত হয়েছিলেন মাদার তেরেসা নামে।
হোস্টেলের নাস্তার টেবিলে মিলল কেবল এক পিস কেক টাইপ বস্তু আর কফি। বস্তুখানা বেশ সুস্বাদু, মনের আনন্দে আড়াই খানা খেয়ে ফেললাম, এই সময় চোয়াড়মুখো এক ব্যাটা এসে বলল- নাস্তার টেবিলে দেখি কিছুই নেই! ব্যাটা অবশ্যই ইংরেজ। ইংরেজ ছাড়া এমন বৈষয়িক জ্ঞানসম্পন্ন ইতর খুঁজে পাওয়া খুবই দুর্লভ। এত সস্তা দেশে নাস্তার জন্য কান্নাকাটি করে ছোটলোকের মত। যাই হোক, রাস্তায় নেমেই প্রথমে চললাম গতরাতে না দেখা ম্যাকেডনিয়ান সংসদ ভবন আর মাদার তেরেসার জন্মবাড়ি দেখার জন্য। তখন প্রচন্ত কনকনে পাহাড়ি বাতাস ইচ্ছে মতো হুল ফুটাচ্ছে যত্রতত্র, তার মাঝে সংসদ ভবন ও প্রাঙ্গণ দর্শন সেরে সোজা মাদার তেরেসার জন্মবাড়ী। সেখান থেকে আবার আলেক্সান্ডারের বিখ্যাত ঝর্ণাটি দেখা যাচ্ছে।
এরপর মাদার তেরেসা মেমোরিয়াল হাউস, সেখানে তার জীবনের নানা উল্লেখযোগ্য নিদর্শন রাখা আছে, নোবেল কমিটির চিঠি, তাঁর হাতে লেখা নানা পত্র ইত্যাদি। ভাল লাগলো বাড়ীর সামনে তাঁর প্রমাণ আকারের ভাস্কর্য এবং সমগ্র ভবন জুড়ে সাদা পায়রা দেখে।
যাত্রা আবার শুরু, এবারে গন্তব্য ম্যাকেডোনিয়া আর আলবেনিয়ার সীমান্তে অবস্থিত হ্রদ ওহরিদ। পথে কয়েক উপত্যকায় কেবল মসজিদ দেখলাম, আর উড়তে দেখলাম আলবেনিয়ান পতাকা। সেই রহস্য এখনো ভেদ করার সময় পাই নি, মানে এক স্বাধীন দেশের ভিতরে কেন আরেক দেশের পতাকা উড়ছে, তখন আবার গাড়ীতে গান বাজছিল কুমার বিশ্বজিতের ক্ল্যাসিক সৃষ্টি- তুমি রোজ বিকেলে আমারে বাগানে ফুল তুলিতে আসতে !
পথে বেশ ক জায়গায় হাইওয়ের ব্যবহারের জন্য ট্যাক্স দিতে হল , যদিও খুব সামান্য পরিমাণে। ওহ, বলা হয় নি ম্যাকেডোনিয়ায় ট্যাক্সি ভাড়া খুবই কম, এসি ট্যাক্সি মেলে ১০০-২০০ টাকায় শহরের মধ্যে। ঢাকার চেয়ে অনেক সস্তা এবং সুলভ।
দুপুরের মাঝেই পৌঁছালাম ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষিত ওহরিদ শহরে, শহরে গড়ে উঠেছে ওহরিদ হ্রদের কোল ঘেঁষে। 501 must visit natural wonders বইটা পড়ে জেনেছিলাম ইউরোপের প্রাচীনতম হ্রদ ওহরিদের কথা, ৩০ লক্ষ বছর পুরনো এই হ্রদটি ইউরোপের সবচেয়ে গভীরতম একটিরও। এখানে অন্তত ২০০ ধরনের প্রাণ আছে যা বিশ্বের আর কোথাও মেলে না। যার মাঝে আছে ৮ ধরনের মাছে, বিশেষ করে কোরান নামের মাছটি যার মাংস গ্রীষ্ম-শীতে সাদা থেকে লালে রূপান্তরিত হয়। আসলে শেষ হিমযুগের সময় ইউরোপের প্রায় সব হ্রদেই নতুন জল এসেছিল কিন্তু ওহরিদে নানা কারণে সেই প্রাচীনতা রক্ষা পেয়েছে। এর ৬৫% মেকাডোনিয়ায়, বাকী ৩৫% আলবেনিয়ায়। অনেক দিনের স্বপ্নে ছিল হ্রদটিকে ছোঁয়ার, অবশেষে আজ সেই কাঙ্খিত দিন।
কিন্তু তার আগে বেশ বেগ পেতে হল পাহাড়ি অচেনা শহরে বড় গাড়ী নিয়ে হোস্টেল খুঁজে বাহির করতে, একবারে গোলকধাঁধার মাঝে আটকে গেছিলাম থেকে থেকেই। সেই ঝামেলা শেষ করে, ব্যপক মধ্যাহ্নভোজন সেরে অবশেষে হ্রদের পাড়ে। দূর দিগন্তে আলবেনিয়ার পর্বত, একসময় নিষিদ্ধ ছিল তাদের এলাকায় প্রবেশ, এখন অবশ্য শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বিরাজমান। এক তরুণ মাঝির সাথে পরিচয় হল,
সে খুবই সামান্য পয়সায় ঘুরিয়ে দেখাল হ্রদের কিছু অংশ, জানালে তাদের জীবনের কথা, এরপর নামিয়ে দিল সেইন্ট জোভান গির্জার সামনে। অতি বিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক সেটি এই অঞ্চলের।
ঘন্টাখানেক হ্রদের সৌন্দর্য ও বিশালতা উপভোগের পর শহর কেন্দ্রে ফেরার সময় দাদুকে অচেনা ফল পাড়তে দেখে তাঁর নাম জিজ্ঞাসা করাই উনি ফোকলা হাসি দিয়ে আমাদের প্রত্যেককে উপহার দিলেন একটি করে ফল, যেটাতে কামড় দিতেই মনে হল হোমারের অসাধারণ পংক্তিমালা- ফিগস আফটার ফিগস
আসলেই এটি এক ধরনের ফিগ বা ডুমুর। এমন সুস্বাদু ফল জীবনে খুব কম খেয়েছি।
এক জায়গায় দেখি ন্যুড বিচ লেখা সাইনবোর্ড, খামোখা চিত্ত চঞ্চল করার দরকার নেই ভাবার পরও যেই না তাকিয়েছি সেটা কতদূরে জানা জন্য দেখি লেখা দূরত্ব ??? মাইল ! ভাবলাম- চরম উদাসের মত প্রাক্টিকাল বজ্জাতেরা আছে দেশে দেশে!
শহর কেন্দ্রে সূর্যাস্ত উপভোগ করে মার্শাল তিতো রাস্তায় পায়চারি শেষে চকচকে টাইলস বসানো রাস্তা বেয়ে
এগোতেই নজরে আসল এক অসাধারণ বিস্ময়ে। ১১০০ বছরের পুরনো এক গাছ ! একই দিনে আবেগ ভরে স্পর্শ করলাম তিরিশ লক্ষ বছরের পুরনো হ্রদ আর ১১ হাজার বছরের পুরাতন গাছকে।
এবার হোস্টেলের ফেরা, বারান্দা থেকে দেখা যাচ্ছে রাতের ওহরিদ শহর। এর মাঝেই চলছে আগামীকালের পরিকল্পনা, কালকের গন্তব্য এইখানে (ছবিটা নেট থেকে নেওয়া)
জানেন নাকি কোথায় এটা?
মন্তব্য
তিরিশ লক্ষ বছরের পুরনো হ্রদ আর ১১ হাজার বছরের পুরাতন গাছ -এসবের তুলনায় আমরা অনেক বেশি ক্ষণস্থায়ী।
হ্রদের ছবিটা ভালো লেগেছে (ফ্লিকারে গিয়েও দেখে আসলাম)
প্রতিদিনই ঘুরছি, আপনার সাথে সাথে, পেছনে পেছনে।
শুভেচ্ছা
পানি কি প্রাচীণ থাকতে পারে আদৌ?
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
এমন টেকনিক্যাল কুশ্চেন কি না করলেই নয় ট্রিপের মাঝখানে? হিক হিক
facebook
প্রাচীণ জল তো শুধু বোতলেই থাকে, শুধু শুধু হ্রদের ঘাড়ে চাপান কেন?
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
এই হ্রদ কত প্রমান? একটা অন্তত ৮০ প্রমান হ্রদের খোঁজ পাইলে আমারে খবর দিয়েন। মনের সুখে সাঁতার কাটুম!
গ্রিসে যাবেন? কোন সময় গেলে এইখানে গিয়া একটা পোস্ট দিয়েন পারলে -- http://www.bbc.com/news/world-europe-29239529 । আলেক্সান্ডারের কবর / সৌধ মনে হয় পাওয়া গেসে। অন্তত সমতুল্য কারও!
****************************************
আসলেই কি কোশ্চেন মার্ক দেয়া ছিল? সে ক্ষেত্রে আপনার উচিত ছিল সরেজমিন তদন্ত করে দূরত্বটা নির্ণয় করে জনস্বার্থে সবাইকে জানানোর ব্যবস্থা করা।
গাছের বয়স ১১০০ বছর নাকি ১১ হাজার বছর? দুই রকম তথ্য এসেছে, ঠিক করে দিন।
একটা জিনিস জানতে চাইছি। উচ্চারণটি কি ম্যাকেডোনিয়া নাকি ম্যাসেডোনিয়া??
মনের সুখে আপনার সাথে ঘুরছি ...
ভাল থাকবেন
সাইদ
হ, বুঝছি! দাঁড়ান, সেনজেন ভিসার আবেদন করছি শীঘ্রই। বাকিটা আপনার কাছ থেকে বুঝে নিবোনে!
নতুন মন্তব্য করুন