ভূমধ্যসাগরের যে দ্বীপে আমরা আছি তার অল্প নিচেই ইথাকি দ্বীপ, মহাকবি হোমারের ওডিসির নায়ক ওডিসিয়াস ছিলেন সেই দ্বীপের মানুষ। কেমন প্রাচীন পুরাণে জড়ানো এখানের প্রতিটি শব্দ- হোটলের নাম হয় পোসাইডন, জিউস, হারকিউলিস, হেলেনের নামে, মিথোস, মিনোটর, অ্যাটলাস নামের যানবাহন। দোলা দিয়ে যায় হৃদয়ে, মাথার অনেক উপরে কি চক্কর দিচ্ছে ইকারাস নামের দুঃসাহসী তরুণ? সূর্যদেবতা অ্যাপোলো কি আজ উপহার না পাওয়ার জন্য মুখ গোমড়া রাখলেন? কাছের সাগরে কি কান পাতলেই শোনা যাবে সাইরেনদের গান? সাইক্লপস নামের দানব কি মেষ চরাচ্ছে ঐ দূরের পাথুরে দ্বীপে? একা নির্জন রাস্তায় হেঁটে যেতে যেতে জলপাই বনের ফাঁক দিয়ে আসা রোদ মুখে আমার সক্রেটিসের কথা মনে হয় নাকি একিলিসের? জানি না, শুধু জানি গ্রীসকে অনেক অনেক ভালবাসি। এই পুরাণকথার আবেশে ডুবে থাকার জন্যই মাঝে মাঝে মনে হয় কেমন হয় কোন অজানা গ্রীক দ্বীপের জেলেপল্লীতে বাকী জীবন কাটিয়ে দিলে?
(করফুতে আমাদের ভিলা, দুই রাত কাটল এখানেই)
সকালে প্রথমেই যাওয়া হল জাহাজঘাটে, আলবেনিয়া যাবার ফেরীর টিকেট সংগ্রহের জন্য। সেখানের রোমান শহর সারান্দায় নামলে হাজার জানালার নগর বেরাতে বেশ জলদি পৌঁছে যাব আগামীকাল। কিন্তু বিধি বাম, জানা গেল গাড়ী নিয়ে আলবেনিয়া যাওয়া যাবে একমাত্র শনিবারেই! ফলে আবারও আমাদের গ্রীসের বন্দর হয়েই ল্যান্ডপথে প্রবেশ করতে হবে আলবেনিয়ায়, নষ্ট হবে বেশ কিছু সময়, ড্রাইভ করতে হবে একই রাস্তা ধরে। যা হোক, টিকেট কেটে করফুর প্রাচীন শহরকেন্দ্রে কিছুক্ষণ ঘুরপাক খেয়ে হাজার হাজার গাড়ী দেখে চললাম তীর্থযাত্রায়।
জেরাল্ড ডারেলের জন্য বেশ কিছু প্রাণী টিকে গেছে এই পৃথিবীতে, দেখতে হয়নি তাদের বিলুপ্তির করাল গ্রাস। সারা দুনিয়া চষে বেড়িয়েছেন অপরিসীম উৎসাহ এবং জন্তুদের প্রতি খাঁটি মমতা নিয়ে। আর এই সবকিছুরই বীজবপন হয়েছিল তাঁর এই করফু দ্বীপে। যেখানে পাঁশুটে বৃষ্টির লন্ডন থেকে আলো ঝলমলে গ্রীক দ্বীপে এসেছিলেন তারা পরিবার সমেত। যার সম্পর্ক জেরাল্ডে বড় ভাই বিশ্বখ্যাত লেখক লরেন্স ড্যারেল বলেছিলেন this brilliant little speck of an island in the Ionian," যার চমৎকার অধিবাসীদের নিয়ে মনে হয় লিখেছেন পরে আবার “A city becomes a world when one loves one of its inhabitants.” । এই দ্বীপের সেই উচ্ছল বছরগুলো নিয়েই জেরাল্ড ডারেল লিখেছিলেন তাঁর ক্লাসিক করফু ট্রিলজি- মাই ফ্যামিল এবং আদার অ্যানিমালস, বিস্টস বার্ডস রিলেটিভস, গার্ডেন অফ ইডেন।
খুব উৎসাহ নিয়ে বাহির করলাম কালামি এলাকার হোয়াইট হাউস নামের বিখ্যাত বাড়িটি। জেরাল্ড ডারেলরা অবশ্য করফুর একাধিক ভিলাতে ছিলেন কয়েক বছর ধরে। কিন্তু আঁতিপাঁতি করে খুঁজে সন্ধান পাওয়া গেল এই একটিরই। সেই সময়ে অবশ্য এই দ্বীপে ছিলেন হয়ত ১০টি বিদেশী পরিবার, অথচ এখন প্রতি দুইটি বাড়ীর একটি হয় পানশালা না হয় হোটেল। ভিড়ে গিজগিজ করে মৌসুমে। চমৎকার ভিলাটির নিচের অংশ রেস্তোরাঁ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, একেবারে সাগরের উপরের কাঠের জেটির সাথে তার সম্পর্ক, আর দুইতলায় আছে একটি হোটেল মত, যেখানে থাকতে হলে বেশ আগে থেকে বুক করতে হয়। তবে ঠিক অন্য হোটেলের মত নয়, বলা যায় ডারেল ভক্তরাই আসেন এখানে, অনেকটা নিজের বাড়ি মনে করেই থাকেন তারা ড্যারেল পরিবারকতৃক ব্যবহৃত আসবাবপত্র সঙ্গী করে।
দ্বীপের এই শ্যুটিং হয়েছিল জেমস বন্ডের ফর ইউর আইজ অনলি সিনেমার আর গ্রীক ধনকুবের ওনাসিসের জীবনে নিয়ে নির্মিত গ্রীক টাইকুন সিনেমার)
নানা কোণে বিভিন্ন প্রাণীর চমৎকার সব ভাস্কর্য। একটা কাঠের তাকে দুই লেখক ভাইয়ের বেশ কিছু বই রাখা হয়েছে বিক্রির জন্য। ছবি তুলে, ভিডিও করে, মেঘলা সাগর কড়া গ্রীক কফির সাথে উপভোগ করে সত্যিকারের তীর্থছোঁয়ার অনুভূতি নিয়ে চললাম সরু পাহাড়ি পথে ক্যাসিওপি নামের জনপদের দিকে। অসাধারণ একটা দ্বীপ পাহাড়, সাগর, বনের সমন্বয়ে। অধিকাংশ জায়গা একেবারে ভিউ কার্ডের মত। কেবল অ্যাপোলো মুখ দেখালো না বটে কিছুটা উপভোগ ব্যহত হল বটে, কিন্তু তাতে কীই বা আর এসে গেল!
দ্বীপের অন্য মাথায় যেয়ে স্পেশাল অ্যাকোরিয়াম দর্শনে যাওয়া হল ভূমধ্যসাগরের নানা মাছ দর্শনে, এখানের সবচেয়ে ছোট মাছ, সবচেয়ে বড় লবস্টার, সী আরচিন, সী কিউকামবার, তারা মাছ, সবচেয়ে বর্ণীল মাছ, আর ভয়ানক হিংস্র মোরে ইল বা সাগরের বাইন মাছ দেখা গেল।
সেই সাথে আন্তর্জাতিক সরীসৃপ বিভাগে যেয়ে দেখা মিলল নানা ধরনের কচ্ছপ, গিরগিটি, ক্যামেলিয়ন, সাপ ইত্যাদির। বিবিশ নামের আমাদের দেশি অজগরটি অ্যাকোয়ারিয়ামের গাইড তুলে দিলেন আমাদের হাতে, গলায়, কাধে! বর্ণমালার প্রথম শব্দ অ বলেই বলা হয়- অজগর আসছে তেড়ে! এমন ভয়াবহ বাজে, অদ্ভুত, ভুল ও ক্ষতিকর তথ্য দিয়েই শুরু হয় আমাদের শিক্ষা। কী দারুণ প্রাণীটি, সাবলীল ভাবে হিলহিল করে বুলিয়ে গেল তাঁর স্পর্শ সবার দেহেই।
আজ সাগর উত্তাল বলে কাচ ঘেরা বিশেষ জাহাজে করে ডুব দিয়ে সাগরের মাছ দর্শন আর হলো না। চললাম করফুর ৩০০ সৈকতের কয়েকটি দর্শনে—
কাল আবার দেখা হবে, আলবেনিয়ায়! ততক্ষণ পর্যন্ত সাথেই থাকুন , নাকি?
মন্তব্য
সাপের সাথে ছবিটা সেরকম হয়েছে। অজগর সাপের নাকি অনেক ওজন হয়ে থাকে, এটা কি সত্য?
পানপাত্র
আমিও যেন ঘুরে এলাম। অনেক ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন