সারায়েভো তখনও ঘুমে, আমরা চারজন হিম শীতল বাতাসের মাঝেই অটোম্যানদের তৈরি শতাব্দী প্রাচীন পাথর বিছানো রাস্তা মাড়াতে মাড়াতে দেখতে থাকলাম কয়েক বছর আগেই বোমায় প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া এক মহানগরীতে। কাঠের পাল্লা দেওয়া দোকানগুলো খুলতে শুরু করেছে একে একে। সবুজ কাঠের ব্যবহার বেশি, আর মসজিদের সাদা পাথরের। ধুমায়িত কফির গন্ধ ও বহুল কাম্য উষ্ণতার খোঁজে সেধিয়ে গেলাম প্রাচীন শহর কেন্দ্রের কাছের এক ক্যাফেতে।
দোকানী হেসে বলল- আমরা কেবল বসনিয়ান কফিই রাখি, অন্য জাতের কফি নয় ! চমৎকার লাগল সেই কফির পরিবেশন, কড়া ধাঁচের তরলে পরিমাণ মত চিনি মিশিয়ে নিলে চাঙ্গা হবার জন্য মন্দ নয় এমন হিম সকালে। বেশি ভাল লাগলো কফি ঢালার পাত্রটি, রূপোর তৈরি তৈজসের মত ঝকঝক করছে ।
সারায়েভো খানিকক্ষণ টইটই করে চেষ্টা করা হল সাবেক যুগোস্লাভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেড তথা বর্তমানে সার্বিয়ার রাজধানী শহরে পৌছবার রাস্তা খোঁজার। এবং মিনিট বিশেক পরেই নিজেদের আবিস্কার করলাম নুড়ি বিছানো এক সরু রাস্তায় যা বনের মাঝখান চিরে চলে গেছে অজানা গন্তব্য। একদিকে গগনচুম্বী পাহাড়, পাশেই সবুজ জলের নদী। এমনি চিকন রাস্তা যে দুইটি গাড়ী পাশাপাশি চলতে পারবে না, অন্যদিক থেকে কেউ আসলেই মহাবিপদ। এর মধ্যে আবার খানিক পরপরই দেখা দিতে লাগল পাহাড় কুদে তৈরি করা সুড়ঙ্গ, কোন কোনটা একাধিক কিলোমিটার লম্বা যার মাঝের অংশে পুরাই ঘুটঘুটে আঁধার। কেবল মনে হচ্ছে একটা সুড়ঙ্গের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকবে তলোয়ার হাতে ভীম দর্শন দুই জল্লাদ, না হলে বিশালাকার এক কুটিল ডাইনোসর।
এক সুড়ঙ্গ পেরিয়ে যাবার দেখি বাম পাশে লাল কালির সাইনবোর্ড, তাতে মাথার খুলি আঁকা আর লেখা MINE ! এমন আরও একবার নজরে আসল কাঠের বেড়ার পাশে একই রকম সাবধান চিহ্ন! দলের অন্যদের আর বললাম না এত চাপের মাঝে, সবাই ততক্ষণে বুঝে গেছে আমরা অতি পুরনো, যুদ্ধের সময় ব্যবহৃত কোন রাস্তায় ঢুঁকে পড়েছি, এরমাঝে মাইনের কথা বলে সবাইকে ভড়কানোর কোন মানে হয় না। নার্ভের অপর এমনিতেই অনেক প্রেশার পড়ছে। আর এঁকের পর এক লম্বা ঘুটঘুটে আঁধারে ডুবানো সুড়ঙ্গ মনে হচ্ছে শেষই হবে না । কোথাও আবার জল জমে আছে, তার গভীরতা বোঝা যাচ্ছে না, একবার গাড়ীর চাকা পাংচার হয়ে গেলে এই গহীন অজানা দেশে- খবর আছে !!!
সত্যি বলতে, এবারের যাত্রাই এটিই ছিল সবচেয়ে বড় অ্যাডভেঞ্চার। অনেক ঘণ্টা ঢিমেতালে চালানোর পর অবশেষে সার্বিয়া যাবার রাস্তার খুঁজে পেলাম আমরা। বিদায় জানালাম বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর পাহাড়ি দেশগুলোর একটি- বসনিয়া হার্জেগোভিনাকে।
সার্বিয়া মানেই এককালে মনে হত যুদ্ধময়, যুদ্ধবাজ এক জাতি। দুনিয়া নামের কোঁকড়াচুলো এক মায়াময় তরুণী সেই ধারণা প্রথম ভাঙ্গিয়ে ছিল প্রায় এক দশক আগে। পরে আরও জেনেছি বা জানার চেষ্টা করেছি প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ থেকে শুরু করে, বসনিয়া, কসোভো সব জায়গাতে সার্বদের আসলে ভূমিকা নিয়ে। শিশুকালে যুগোস্লাভিয়া নামের এক দেশের কথা শুনতাম, পড়েছিলাম সেই দেশের রাষ্ট্রপতি মার্শাল তিতোর কথা, যে দেশের রাজধানীর নাম ছিল বেলগ্রেড। বিশাল এবং শক্তিশালী দেশটি আজ ৭টি আলাদা আলাদা দেশে বিভক্ত, তার মধ্যে সার্বিয়া সবচেয়ে বৃহৎ। সেই অনন্য নগরী বেলগ্রেড আজ সার্বিয়ার রাজধানী। বিশাল মহানগরীর হোস্টেলে ব্যাগ রেখে সেখানে গাড়ীর বনেটে বসে থাকা কিউট বিড়ালটিকে ম্যাও বলে
সোজা হোটেল মস্কোর সামনে, যেখানে অপেক্ষায় ছিল অনেক দিনের পুরাতন বন্ধু ইভানা মার্তিনভ এবং তাঁর বোন ইয়েলেনা। সোজা তারা টেনে নিয়ে গেলে দানিয়ুব আর সাভা নদীর মিলনস্থলে।
যেন আমাদের জন্যই অপূর্ব সাজে ছিল দিগন্ত, নদী, রঙ। এখানেরই বাসিন্দা ইয়েলেনা জানালো এমন অপূর্ব সূর্যাস্ত সে কখনও দেখেনি অনেক বছরেও! ২৩০০ বছরের পুরনো শহর বেলগ্রেড, এতদিনে কত জল বয়ে গেছে এই দুই নদী দিয়ে, কিন্তু টিকে গেছে শহর রক্ষা প্রাচীর, নির্মম দুর্গ। কাছেই মিলিটারি জাদুঘর, যেখানে ১৯৯৯ সালে সার্বদের ফেলে দেওয়া ন্যাটোর একমাত্র উড়োজাহাজটিও ছিল। কিন্তু এখন সেটি বন্ধ, তার বদলে আমরা চললাম ন্যাচারল হিস্ট্রি জাদুঘরে যেখান কয়েকটি ডাইনোসরের আসল নখ, দাঁত, মাথার ফসিলের সাথে সাথে ছিল ১২ কোটি বছর আগের বিবর্তনের পথ ধরে উদ্ভব হওয়া প্রথম ফুলের একটি মডেল।
নামার পথে দেখা হল সেই টেনিস কোর্টের সাথে যেখানে জীবনের প্রথম টেনিস খেলা শুরু করেছিলেন ওয়ার্ল্ড নাম্বার ওয়ান নোভাক জোকোভিচ।
আজব শহর বেলগ্রেড, সবসময়ই প্রাণোচ্ছল। এটি কি সোমবার না শনিবার বোঝা দায়, কারণ রাস্তায় ভিড় সবসময়ই ! ইভানার সাথে যাওয়া হল বেলগ্রেডের সবচেয়ে চমৎকার স্থানটিতে, যেখানে কেবল হেঁটে ঘোরারই অনুমতি আছে, গিজগিজ করছে পর্যটকে।
এর মাঝে সাহিত্যে নোবেল জয়ী একমাত্র যুগোস্লাভিয়ান ( জন্মগত ভাবে বসনিয়ান, তবে জীবন কাটিয়েছেন বেলগ্রেডে, এবং নোবেল পুরস্কারের সম্পূর্ণ থাকা দিয়ে বসনিয়ার যত বেশি সম্ভব লাইব্রেরী স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন) Ivo Andrić –এর কথা জিজ্ঞাসা করাতে তাঁর নোবেল জয়ী উপন্যাস The Bridge on the Drina কিনে এনে উপহার দিল ইভানা! অটোম্যান শাসনামলে বিশ্বের এই প্রান্তের দৈনন্দিন জীবনের ছবি লিখেই বিখ্যাত হয়েছিলেন ইভো, এখন পড়ার তালিকায় আরও একটি মাস্ট বই যুক্ত হল
জেলেনার ছেলে বন্ধু বেলেন আমাদের সাথে যুক্ত হয়ে নিয়ে গেল প্রথমে বেলগ্রেডের সবচেয়ে ক্ল্যাসিক ক্যাফেগুলোর একটিতে,
সেখানে জম্পেশ আড্ডার মাঝে সাবেক যুগোস্লাভিয়ার অনেক সুনাম করে, বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মুন্ডুপাত করে তাদের সাথেই চললাম নগরীর বোহেমিয়ান অঞ্চলে, যেখানে একসময় থাকত লেখক, চিত্রকর, কবিদের জমজমাট ভিড়।
সেই গল্প অন্যদিন হবে, কেবল ২লিটার সার্বিয়ান ইয়েলেন কেনা হয়েছে। চিয়ার্স---
মন্তব্য
এখন তো দেখি প্রায় প্রতিটা পোস্টের শেষেই একটা করে 'ফেনায়িত গেলাস' পাচ্ছি আমরা
নতুন মন্তব্য করুন