সত্তর বছর বয়সে কি আমি নিজেকে হিমালয়ের কোন দুর্গম গুম্ফায় আবিস্কার করব? নাকি আদিপুরুষের ভিটে আফ্রিকার সাভানার কোন লালমাটির গোলাঘরে? নাকি ফিনল্যান্ডের বরফাচ্ছন্ন লাল কাঠের উষ্ণ কুড়েতে? পলিনেশিয়ার প্রবাল দ্বীপে? নাকি প্রিয় ভুখন্ড পেরুর কোন নাম না জানা গ্রামে? পদ্মাপারের রাজশাহীতে? জানি না। তাতে আদৌ কিছু যায় আসেও না হয়ত।
আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।
জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক; আমি প্রয়োজন বোধ করি না
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
জীবনানান্দ দাশ কি এই নীলাভ নক্ষত্রের আভায় জ্বলজ্বলে শব্দগুলো নিজের জন্যই কেবল লিখেছেন, নাকি আমার মত অচলদের জন্যও, যাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য HYOHAKUSHA হওয়া?
HYOHAKUSHA একটি জাপানিজ শব্দ, এর মানে যারা সুনির্দিষ্ট গন্তব্য ছাড়াই ঘুরে বেড়ায় বা ভ্রমণ করে, মূল উদ্দেশ্য থাকে পথে থেকে মুগ্ধ হওয়া।
জানি ভাগ্য বলে কিছু নেই, থাকতে পারে না, তারপরও নিজেকে যথেষ্ট সৌভাগ্যবান বলে মনে হয় যে আমার এক হাতের ক্যালসিয়াম, আয়রন ফসফরাস এসেছে কোন প্রাচীন নক্ষত্রের কেন্দ্রে সৃষ্টি হয়ে পরবর্তীতে নাক্ষত্রিক বিস্ফোরণে ব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে পড়ে, অথচ আরেক হাতের বা পায়ের কণিকাগুলো হয়ত এসেছে যোজন আলোকবর্ষ দূরের নক্ষত্রের মৃত্যুতে। তাদের এক হবার কোন সুযোগ নেই আপাত দৃষ্টিতে, কিন্তু লক্ষ কোটি অণু-পরমাণু মিলে আমি তৈরি হয়েছি, জীবনচেতনা প্রাপ্ত হয়ে বহমান জীবনের অপূর্ব জাদুতে আশীর্বাদ প্রাপ্ত হয়েছি, দৃষ্টি মেলে দেখেছি ঝিলমিল রংধনু, শুনেছি বুনো হাঁসের ডানার শব্দ, গন্ধ পেয়েছি বৃষ্টির পর সোঁদা মাটির, স্পর্শ করেছি রমণী অধর, আবৃত্তি করেছি জীবনানন্দ- এক অতি ক্ষুদ্র কিন্তু না চাইতেই না বুঝে পাওয়া অসম্ভব মূল্যবান জীবনে অতৃপ্তি থাকবার নয় কোন! তাইই আলাদা ভাবে জীবনে লক্ষ্য ঠিক করা হয়ে উঠে নি জীবনের প্রতি প্রগাঢ় মুগ্ধতায়।
জাপানি কবি বাশোর মত হাতে লাঠি, পিঠে মাদুর আর মাথায় কবিতা নিয়ে বেরোলে কেমন হয় প্রাচীন পথ বেয়ে বিশ্বের আরেক মাথা দেখার নিমিত্তে? কিন্তু একজন HYOHAKUSHA র যে কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য থাকতে নেই! আমারও নেই! সেই পথের শেষ পর্যন্ত দেখতেই হবে এমন দিব্যি তো কেউ দেয় নি! কেমন হবে যদি কোন দুর্ঘটনায় চলৎশক্তি হারিয়ে চিরদিনের মত রাজশাহীর পৈতৃক বাড়ীতে নিজের গড়ে তোলা বইয়ের রাজ্য আটকা পড়ি ? সেইটাও তো একটা পথ, তাই না? অন্তবিহীন পথ চলারই আরেক নাম জীবন, তেমন তাঁরও থাকতে পারে নানা শাখা-প্রশাখা, সবগুলোই হয়ত সমান গুরুত্বপূর্ণ বা গুরুত্বহীন।
কিন্তু জানি আমি চলতে চাই, দেখতে চাই, জানতে চাই, উপভোগ করতে চাই বিশ্বের আদিগন্ত রূপ- মরুভূমি থেকে মেরু, পর্বত থেকে তৃণভূমি আর সেখানের মানুষসমাজকে। নির্দিষ্ট গণ্ডি বা পরিকল্পনায় আটকে না থেকে হতে চাই HYOHAKUSHA , তাতে কারো কোন লাভ হচ্ছে না বটে, কিন্তু ক্ষতিও হবার সম্ভাবনা নেই। মানব সম্প্রদায়ের একজন হয়েও তাদের প্রতি যথেষ্ট দায়িত্ব পালন করা হচ্ছে না মানি, আবার ৫০০ কোটি বছর পর সমস্ত জ্বালানী শেষ করে সূর্যটা এক বিশাল লাল দানব নক্ষত্রে পরিণত হয়ে যখন ধূসর হয়ে যাওয়া নীল গ্রহটাকে গিলে ফেলবে তখন তো আমাদের অস্তিত্বই নেই( অবশ্য তার অনেক অনেক আগেই মানুষ বলে কোন প্রাণী থাকবে না, এমন হতেই পারে মাত্র কয়েকশ বছরের মাঝেই।) , কাজেই মনগড়া দায়িত্ব পালনও যে মহাকালের ক্যানভাসে খুব কাজের তা মনে হয় না।
জীবনের সবচেয়ে সুখের মুহূর্ত ছিল ঠিক যখন আবিস্কার করলাম প্রমত্ত আনন্দে যে I do Exist, জীবনটা যেন লাখো গুণ রঙিন হয়ে গেল। সবুজ ঘাসের চকচকে শিশির দেখলে ভাল লাগার আবেশে গড়াগড়ি দিতে ইচ্ছে করে, বালতি বালিত জোছনা ফেলা নদী দেখলে ঝাপ দিতে ইচ্ছে করে, মগডাল থেকে শীতে পাতার পাক খেয়ে আলতো পড়া দেখলে আবেগ উথলে ওঠে হৃদয়ের গহীনে, প্রতি পলে কত সহস্র জীবন লুকিয়ে আছে তা আবিস্কার করে কেবলই তীব্র সুখে কাতর হয়ে ওঠে দেহের প্রতিটি অণু-পরমাণু, বলে- বেঁচে আছি, বেঁচে আছি। আর তখনই মনে হল একবারই মাত্র পাওয়া এই সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটা নিয়ে কী করা যায় উদ্দেশ্যহীনতার মোড়কে পৃথিবী দেখার উদ্দেশ্য ছাড়া!
মাঝে মাঝে জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে ভেবে অদ্ভুত এক ধূসর বিষণ্ণতা ঘিরে ধরার চেষ্টা করে দৈনন্দিন জীবনকে। আমি চলে যাবার পরও ভিজতে থাকা চালতা ফুলের স্নিগ্ধতা আর লক্ষীপ্যাঁচার গানের সুখময় বহমান ভবিষ্যৎ খুব একটা শান্তি দেয় না বটে, কিন্তু জগতব্যপী বিস্তৃত নেই নেই হাহাকারও তৈরি করে না। বরং মনে হয় শুধু, এখনই সময়- জিপসি সময়ের ঘোড়ায় চেপে যে দিকে ইচ্ছে সেদিকে ধাওয়া করবার, HYOHAKUSHA হবার। পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তর, পথ, নদী, জনপদ, গিরি পাড়ি দিতে দিতে মনে করবার যে--আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ।।
মন্তব্য
লেখাটা খুব ভালো লাগলো।
বাংলায়ও একটা শব্দ আছে 'ভবঘুরে'।
নচিকেতার গানটা মনে পড়লো।
"আমি ভবঘুরেই হবো এটাই আমার অ্যাম্বিশন
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
গানটা খুব প্রিয়।
তবে হুওহাঁকুসা আর ভবঘুরে মনে হল একটু আলাদা, হুওহাকুসার পথচলা আরেকটু গভীর। তাদের জীবনবোধ আরেকটু জীবনের নেশা জড়ানো।
facebook
আমার খুব পছন্দের একটা গান
facebook
লেখাটা খুব বেশি ভাল লাগলো
শুভেচ্ছা। নতুন জীবন কেমন কাটছে?
facebook
হুওহাঁকুসা হওয়া এই জীবনে সম্ভব না। চারদিকে শেকল। তবু পড়ে শান্তি শান্তি লাগছে।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
হয়ত নিজের অজান্তে আমরা সবাইই তাই !
facebook
আমাদের মত যাদের নুন আনতে পান্তা ফুড়ায়- এ লিখা পড়ে তাদের বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাসই বেরিয়ে আসবে শুধু।
মনে হয় না। বেঁচে আছি তো আমরা সবাইই
facebook
আপনার বুড়ো বয়েসে একটা 'হুওহাকুসা শাস্ত্র' নামুক আঙুল বেয়ে। শুভকামনা অণু ভাই।
_____________________________________________________________________
বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।
facebook
লেখাটা খুব ভালো লাগল।
HYOHAKUSHA হয়ে পৃথিবীর পথে প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে আমরা যারা ঘরকুণো মানুষ তাদের শোনাতে থাকুন আপনার অসাধারণ সব অভিজ্ঞতা।
শুভকামনা অণু দা।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
ঘরকুনো হলে কোন সমস্যা নেই তো !
সেটাও তো বললাম পরিষ্কার করে।
facebook
চলাই জীবন, ভেতরে বা বাইরে, নিরন্তর ছুটে চলা, দুপাশে ছড়ানও আশ্চর্য ঘাসফুল ছুঁয়ে বিহ্বল নৈশব্দের ঘ্রান চিনে নেয়ার নাম জীবন বা বেঁচে থাকা।
অনেক ভাল লাগলো লেখাটি। আজ মন্তব্য করতে মন চাইলো। ভালো থাকবেন।
স্বয়ম
বাহ, প্রথম লাইনটা চমৎকার লিখেছেন তো
facebook
ঠিকই, পথ চলাতেই আনন্দ। চলতে থাকুন আর লিখতে থাকুন। আপনার জন্য শুভকামনা।
গোঁসাইবাবু
আপনার জন্যও
facebook
আমার তো আর HYOHAKUSHA হওয়া হল না, আপনি হয়েছেন এতেই খুশি!
কে জানে !
facebook
ভ্রমণের টেণ্ডার সব দখলে নিয়া বইসা আবার উস্কানিমূলক পোস্ট দ্যান মিয়া
মানী লোক হিসেবে আমার ভ্রমণানুভূতি নিদারুণ ভাবে আহত
ভাগ্যিস এইসব অনুভূতি নিয়া ব্লাস্ফেমী ভাইয়া মাথা ঘামায় না
ভাবতেছি, দুই-চাইরশ বচ্ছর পরে ভ্রমণধর্ম নামে নয়া কোন ধর্ম বানান গেলে আপনার নাম নিশ্চয় ধর্মগুরুদের কাতারে থাকবে, আর আপনার পোস্টগুলা ধর্মগ্রন্থের... তদ্দিন কুনোমতে বাইচ্চা থাকলেই হইছে...
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
facebook
চরৈবেতি - চরৈবেতি, চল, অগ্রসর হও। তীব্রতা ও ক্রমাগতিতেই জীবনের সৌন্দর্য ও সার্থকতা। জীবনের মূলমন্ত্রওতো তাই।
নদী যেমন উৎস হতে মোহনা পর্যন্ত নিজস্ব গতিতে বয়ে চলে, এই বয়ে চলার নামইতো জীবন।
facebook
ধুর, সব কিছু ফেলে রেখে হাঁটা দিতে মনে চায় মাঝে মাঝে।
কি আছে দুনিয়ায়!
হ
facebook
পরবর্তী জীবনে আমি HYOHAKUSHA হইতে চাই। লেখা ভালো লেগেছে।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
facebook
HYOHAKUSHA হবার বাকি রেখেছেন কিছু?
এইসব পোস্ট দিয়ে পাঠককে চ্রমুদাস বানানোর নিন্দা জানাই
facebook
ভাল লাগলো
শুভেচ্ছা, অনেক দিন আফ্রিকার কোন পোষ্ট নাই, কী ব্যাপার?
facebook
বেঁচে থাকার চেয়ে বিস্ময়কর আনন্দদায়ক অনুভূতি আর কিছু নেই। বয়ে চলা নদীর দুপাশে খোপার মতো গুচ্ছ গুচ্ছ গ্রাম, উত্থাল পাতাল জোনাকি, বর্ষার চারিদিকে থৈ থৈ জলরাশি, দিগন্তজোড়া সবুজ ধানক্ষেত, কুয়াশার চাদরে জড়িয়ে থাকা মেঠো পথ, দূর পাহাড়ের চূড়ায় প্রভাতে প্রথম সূর্যালোক আর চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা জীবনের কোলাহল, বেঁচে থাকার অনন্য উপহার। আপনার লেখা গদ্যময় জীবনান্দ হয়ে উঠছেন দিন দিন
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
facebook
নতুন মন্তব্য করুন