মর্মর সাগর তীরের শহর বুরসা থেকে বাস ছেড়েছিল মাঝরাতে, এই তো সপ্তাহ তিনেক আগে। সেই বাসে ঘণ্টা ছয়ের ভ্রমণ শেষে বৃষ্টি ভেজা আঁধার ভোরে প্রিয় মহানগরী ইস্তাবুলের আতাখেন্ত এলাকায় প্রায় এতিম করে বাস নামিয়ে দিয়ে গেল! এত্ত বড় শহরে প্রায়ান্ধকার অবস্থায় আসলেই কিছুটা অসহায়বোধ ঘিরে ধরে, অতি ক্ষীণ হলেও শঙ্কা জাগে ঠিকানা খুঁজে পাবার, সময় নষ্ট করবার এবং ছিনতাইয়ের শিকার হবার। ফিনফিনে বৃষ্টিতে মিনিট দশেক ভিজে অবশেষে ট্যাক্সি মিলল, চললাম ঠিক ৫ বছর আগে যে বন্ধুরর ডেরাতে ছিলাম সেইখানেই, আনলির পরিবারের অ্যাপার্টমেন্টে।
সন্ধ্যায় বিমান ছাড়বে ঢাকার উদ্দেশ্য, এযাত্রা তুরস্কে অবস্থানের আজই শেষ দিন। ইস্তাম্বুলের বন্ধু, গাইড ফুলিয়া আনলিরকে এই জন্য পইপই করেই বলে রেখেছি বিমান যেহেতু কোনমতেই মিস করা যাবে না তাই ইস্তানবুলে এবার বেশি কিছু করা সম্ভব হবে না, শুধু ওরহান পামুকের সাথে দেখা করলেই হবে অল্প সময়ের জন্য, কিন্তু তাঁর জন্য আবার গ্যালাতাসার মহল্লায় যেতে হবে বিস্তর ট্রাফিক জ্যাম টপকে। কাজেই এত তাড়াহুড়োয় সেটা সম্ভব না হলেও অন্তত পামুকের উপন্যাস অবলম্বনে তারই তৈরি করা জাদুঘর মিউজিয়াম অফ ইনোসেন্স দেখে, বসফরাসের লোনা হাওয়ায় খানিকক্ষণ ঘুরলেই চলবে এযাত্রা। কারণ বিমানবন্দর যেতেও প্রায়ই দুই ঘণ্টা লেগে যায় জ্যামের কারণে।
আবার দেখা হয় সবার সাথে দীর্ঘ ৫ বছর পর, কিন্তু তাদের উষ্ণ আচরণে মনে হল যেন মাত্র কদিন বাহির কাটিয়েই ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছে। এন্তার খানাদানা এবং ধূমায়িত কফি ধ্বংস করে চাঙ্গা হয়ে বেরোবো শহর দর্শনে, ফুলিয়া জানালো তাঁর বন্ধু এজে আমাদের গাড়ী করে ঘুরাবে আজ সারাদিন, আর চমক হিসেবে আমরা যাব বিশেষ এক জায়গায়। কী সেই জায়গা? তা জানার আগেই এজে এসে হাজির যাকে দেখে গ্রীক পুরাণের কোন দেবী বলে ভ্রম হয়! মনে হয় এমন নিটোল মুখের সাথে ভাসা ভাসা আবেগময় চোখের কাউকে দেখেই তিন হাজার বছর আগে ভেনাসের মূর্তি গড়েছিল প্রেমপূজারী-কারিগর। এই দেবীই নাকি আজ আমাদের গাড়ীচালক?? গাড়ী না দিব্যরথ কে জানে!
দুই তুর্কি তরুণীর সাথে স্বেচ্ছায় সানন্দে পাকড়াও হয়ে হয়ে চললাম সেই চমকপ্রদ স্থানের উদ্দেশ্য, তখন রোদ চিকচিক করছে বসফরাসের জলে, চকিতের জন্য দেখা গেল গোল্ডেন হর্নও। এরপর অনেক গলি-উপগলিতে গোত্তা মেরে কেমন যেন বিবর্ণ এক রঙচটা দেয়াল আর ভবনের ভরা মহল্লায় প্রবেশ করলাম, সেখানের রাস্তায় আবার অনেক অনেক্কক কুকুর! সারমেয়কূলের অবস্থানের কারণেই হবে, সেখানে এক তীব্র গন্ধও বর্তমান! গাড়ী থেকে নামতেই আরও প্রকট হয়ে তাঁর অস্তিত্ব জানান দিল, আর ফুলিয়া এক কুকুরের মাথা আদর করে চাপড় দিতেই শুরু হয়ে গেল কুকুরদের কনসার্ট!
ইস্তাম্বুলের অন্যতম কুকুরাশ্রম ইয়েদেকুলেতে আপনাকে স্বাগতম! এখানে আহত বেওয়ারিশ সমস্ত কুকুরেরা ঠাই পাই, তাদের সেবা করে সারিয়ে তোলা হয় পরম মমতায়, অনেকের জন্য খুঁজে বাহির করা মানুষ মালিক, তাদের পৌঁছে দেওয়া হয় নতুন ঠিকানায়। কয়েকজন জন্তুপ্রেমী মানুষ মিলে নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন এই মহাযজ্ঞ, সাধারণত এমন অনেক মানুষের ডোনেশন নিয়েই চলছে এই গৃহমৃগাশ্রম।
আবার এমন জায়গা বেশ কটি আছেও ইস্তাম্বুলে। প্রাণী অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট কর্মী ফুলিয়ার সাথে সবারই বেশ সখ্য, এমন বেড়াল আশ্রমও আছে বেশ কটি! যেখান থেকে ফুলিয়া তিন তিন খানা বেড়াল নিয়ে গেছে আপন আলয়ে আশ্রয় দেবার জন্য, যাদের সাথে খেলা করলাম আজ সকালেই।
তিন হাজার কুকুর আছে এই ইয়েদেকুলে আশ্রমে! অধিকাংশই এসেছে গাড়ীর সাথে দুর্ঘটনার ফলে! চিচো (Çiço ) নামের এক কুকুরের কোমর ভেঙ্গেই গেছে বলা চলে দুর্ঘটনায়, সে বেচারা সামনের দুই পা দিয়ে কোনমতে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে চলছে। তার জন্য আমাদের সামনেই আনা হল বিশেষ ধরনের হুইল চেয়ার জাতীয় যন্ত্র, সবাই মিলে সেখানে চেপেচুপে আতঙ্কিত কুকুরটাকে বসানোর পর দেখা গেল সে ভালই খাপ খাইয়ে নিয়েছে দুই পা আর দুই চাকার সাথে! এমনকি মহা উৎসাহে অন্য কুকুরের সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে দাঁত খিচিয়েও আসলো!
অনেক কুকুরের জন্য আলাদা আলাদা ঘর, সেখানে খাবার, পানীয় ও ঔষধ দেওয়া হয় নিয়মিত। কেজবান নামের এক কেয়ার-টেকার বললেন এখন তোমার হাউকাউতে হয়ত মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু যখন একটা আহত কুকুরকে সারাতে পারি, দেখি যে নিজে নিজে দৌড়ে বেড়াতে পারছে , মনে হয় এখানেই নিহিত আমার জীবনের সার্থকতা, এই অবলা প্রাণীগুলোর সেবা করার মাঝে।
(শিশুকাল থেকে দেখা আসা সরকারি বেতনভুক কর্মচারীর লাঠি দিয়ে কুকুর পিটিয়ে মারা এবং গ্রামের সাধারণ জনগণের খামোখায় কুকুরের গায়ে গরম জল বা ভাতের মাড় ঢেলে দেওয়া ও সঙ্গমরত কুকুর-কুকুরীর লিঙ্গ পৈশাচিক আনন্দ নিয়ে কেটে ফেলার দৃশ্য ভিড় করে আসে স্মৃতি দুয়ারে। আচ্ছা, আমরা এমন কেন? নিরীহ কুকুরকে কেন এই হেনস্থার শিকার হতে হয় বাংলাদেশে?)
আশ্রমের কর্মচারীরা একটা চমৎকার ক্যাফেও করেছে, সেখানে মেলে কুকুর সম্পর্কিত নানা খেলনা, পুস্তিকা, তাদের খাবার ইত্যাদি! আমাদের সাথে সাথে একখানা ঢুঁকে বেশ ইতিউতি চাইতে লাগল, ভাবখানা এমন যেন তারও কফির তেষ্টা পেয়ে গেছে! এছার আছে কুকুর বিষয়ক বইয়ের একটা বড় সংগ্রহ।
পাশের ঘরে নেট দিয়ে ঘেরা এক ছোট বিছানায় দেখা মিলল কদিন আগেই জন্ম নেওয়া তিনটে কুকুরছানার! জগতকে দেখার কী অপলক আকুতি তাদের চোখের তারায়। জানা গেল এখনো মানুষ মালিক পাওয়া যায় নি তাদের।
ছানাগুলোর জন্য অনেক আদর দিয়ে, ধেড়েগুলোর জনা ফুলিয়ার বয়ে আনা খাবার রেখে এজে দেবীর চারচাকার আধুনিক রথে চেপে আমাদের যাত্রা আবার শুরু আধা দিনের ইস্তাম্বুলে-
মন্তব্য
ফুলিয়ার জন্য ফুলেল শুভেচ্ছা, আপনার জন্যও!
আপনাকেও।
এজা কে শুভেচ্ছা না দেবার জন্যও ধন্যবাদ
facebook
অনেকের কুকুর অপছন্দ হতেই পারে, কুকুরকে হুশ-হাস বলে তাড়িয়েও দেয়া সম্ভব, খালি খালি লঠি সোটা দিয়ে পেটানোর কোন প্রয়োজন নেই -আসলেই। আমরা মনে জাতিগতভাবেই একটু স্যাডিস্ট
জানি না, কিন্তু পেটানো চোখে পড়ে খূব বেশী
facebook
হুইলচেয়ারওয়ালা কুকুরটা ঘুমায় কিভাবে?
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ঘুমাবার সময় খুলে রাখা হয় চাকা
facebook
খুব ভাল লাগল।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
facebook
________________________
সেই চক্রবুহ্যে আজও বন্দী হয়ে আছি
নতুন মন্তব্য করুন