মিশন নাগাল্যান্ড, মিশন কামাখ্যা-৫, কাজিরাঙ্গা

তারেক অণু এর ছবি
লিখেছেন তারেক অণু (তারিখ: সোম, ০৮/১২/২০১৪ - ১১:৪১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

10847946_10154883557745497_3075590853319786183_n

পূর্ণিমার মায়া ভরা পূর্ণ চাঁদ অস্তাচলে গেলেও ভোরের আকাশে তার অদ্ভুত আভা থেকে গেছে। সূর্যোদয় হতে ঢের দেরী, যদিও সেই আভার কারণে পথ চলতে খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না কারোরই, আর সেই সাথে আছে রোমাঞ্চ! হাতির পিঠে চেপে বিশ্বখ্যাত কাজিরাঙ্গা ন্যাশনাল পার্ক দেখার আনন্দে ভোর ৪টায় উঠেছি সব্বাই, তারপর শীত ঠেকানোর সমস্ত প্রস্তুতি নিয়ে এখন বনের প্রবেশদ্বারে। এই অসময়েও পর্যটকদের ঢল, সবাই সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাতির পিঠে ওঠার স্তম্ভে।

আমাদের হাতির নাম কাঞ্চন, শান্ত স্বভাবের এক মেয়ে হাতি। আমি, মুহিত ভাই, তন্ময় ও তুহিন চেপে বসলাম লোহার রড দিয়ে তৈরি অদ্ভুতুড়ে হাওদায়! অন্যরাও চেপে বসল অন্য হাতিতে, যেহেতু একটিতে মাহুতসহ ৫জনের বেশি স্থান সংকুলান হচ্ছে না, বরং ছোটখাট হাতিতে দেখলাম ২জন বসতে পারে। ব্রহ্মপুত্র পারে অবস্থিত কাজিরাঙ্গা সারা বিশ্বে বিখ্যাত মূলত এশিয়ান এক শৃঙ্গ গণ্ডারের জন্য, এই সংরক্ষিত অঞ্চলে আছে প্রায় আড়াই হাজার এক শৃঙ্গ গণ্ডার। লোভী, মূর্খ মানুষদের হাত থেকে তাদের রক্ষায় নেয়া হচ্ছে একের পর এক পদক্ষেপ, কিন্তু সব ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চোরাশিকারিরা ঠিকই শিকার করে নিয়ে যাচ্ছে অসাধারণ বিশালদেহী প্রাণীটি, তাদের অদ্বিতীয় শিং-এর জন্য।

10670284_10154883041705497_4987078507714856307_n

এছাড়াও এই পার্কে আছে ১০৬টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার, কয়েক হাজার বুনো মহিয, সোয়াম্প ডিয়ারের সবচেয়ে বড় পাল এবং প্রায় ৫০০ প্রজাতির পাখি। প্রথম প্রবেশ ঘটল হেলেদুলে হাতিঘাসের বনে, বিশাল ঘাসগুলোর আড়ালে গণ্ডার, বাঘ, বুনো মহিষ তো বটেই বুনোহাতিও লুকাতে পারে অনায়াসে! তাই হাতির হাওদা থেকে খুঁজে নিতে হবে কী কী প্রাণী আছে এই ঘাসরাজ্যে। মিনিট দশেকের মাঝেই দেখা মিলল মা গণ্ডার আর তার ছানার!

10858479_10154882986180497_5406157625970303938_n

কুয়াশাময় সকালে শিশির ভেজা ঘাস মনের সুখে ছিড়ে খাচ্ছে মা ও ছানা, দেখতে তা যতই সুখকর হোক, এই সময়ে মা কিন্তু থাকে খুব বেশি অ্যাটাকিং মুডে! ছানাকে রক্ষার জন্য মা যে কোন নড়াচড়ার দিকে আসতে পারে তেড়েফুঁড়ে।

গন্ডারের ছানা দেখেই তন্ময় দা বললেন তার আজীবনের স্বপ্ন গণ্ডারের একটি বাচ্চা পালা, সেটা ঢাকার ফ্ল্যাটে ঘোরাঘুরি করবে শিং উচিয়ে, আর কারেন্ট চলে গেলে পিঠে না শিং-এ মোমবাতি নিয়ে চলাচল করবে, আর তন্ময় দা গুণগুণ করে গাইবেন , আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী!! আমি হৈ হৈ করে বললাম, খবরদার, গণ্ডার পালার জিনিস না ! সেটি স্বাধীন থাকবে, ইচ্ছামত গুঁতোবে! নাহলে কিসের গণ্ডার!

যদিও হাতির পিঠে থাকায় এই যাত্রা আমরা নিরাপদ, অল্পক্ষণ তাদের ছবি তুলে শান্তিমত চরতে দিয়ে তৃণভূমির অন্য প্রান্তরে নিয়ে চলল আমাদের মাহুত। সেখানে থৈ থৈ সবুজের মাঝে মাথা দুলাতে থাকা বেগুনি রঙা ফুলে দেখিয়ে মাহুত বলল, দেখুন গন্ডার খুবই ভদ্র প্রাণী, তারা হাতি, মোষের মত যত্রতত্র পায়খানা করে না, ঘুরে ঘুরে একই জায়গায় এসে গোবরত্যাগ করে যায়, এবং সেখানে জন্ম নেয় এই ফুলের গাছ! অবশ্য এর সাথে গণ্ডারের খাদ্যাভাসের কোন যোগসূত্র আছে কিনা সেটা জানা যাচ্ছে না !

আরও একাধিক বিশালদেহী পুরুষ গণ্ডারের সাথে মোলাকাত হয়ে গেল, বর্ম পরা এক একটা ট্যাঙ্ক যেন! নিরীহ ভঙ্গীতে সবুজ রসালো নাস্তা সারতে সারতে ইতিউতি তাকাচ্ছে কুতকুত চোখে, যে বেচাল দেখলেই দেবে জগত সংসার ভুলিয়ে, তারই ফাঁকে ফাঁকে দেখা দিল অন্তত গোটা চল্লিশেক সোয়াম্প ডিয়ার (এই হরিণের বাংলা নামটা সম্ভবত বারশিঙা), হাতির পিঠে থাকায় তাদের কিছুটা কাছে যাওয়া গেল বটে, কিন্তু চঞ্চলা হরিণীরা বিশাল হাতির অস্তিত্বের সাথে সাথে অন্য কোন কিছু টের পেলেই ভো দৌড় দিয়ে মিশে গেলে দূরের প্রান্তরে।

10433937_10154883606555497_8556396218511605960_n

জলাভুমির প্রান্তে একাকী চরে বেড়াচ্ছিল আরেক বিশাল দানব, বুনো মোষ! কিন্তু আমাদের চোখ মূলত খুঁজে ফিরছিল হলুদ-কালো ডোরাকাটা বেড়াল, অত্যন্ত আমাদের ম্যানগ্রোভ শেকড়ময় কাদা প্যাচপ্যাচে সুন্দরবনে চেয়ে এই ঘাসের প্রান্তরময় বনও অনেক ভাল পরিবেশ বাঘের বসবাসের জন্য, এবং শীতকালে বাঘ দেখার জন্যও। যদিও আপন পরিবেশে লুকিয়ে থাকার ওস্তাদ প্রাণীটিকে খুঁজে বাহির করা মোটেও সহজ কিছু নয়, এবং তার দেখা আমাদের মিললও না!

তবে ঘণ্টা খানেকের হাতি সাফারি থেকে ফেরার আগে চোখে পড়ল বুনো হাতি! জীবনে এই প্রথম বুনো হাতি দেখলাম, তাও তিন তিন খানা! মিয়া, বিবি, বাচ্চা! তার মধ্যে মদ্দাটা আমাদের পোষা হাতিকে হাতীয় বাসায় বকাঝকা করায় তাদের বিরক্ত না করে ফিরলাম আপন ডেরায়, ততক্ষণে ঘন কুয়াশা চিরে দেখা দিচ্ছে সূর্য কিরণ, শোনা যাচ্ছে পাখ-পাখালির আওয়াজ।

14412_10154883677715497_86752286234265863_n

চা-নাস্তার পরপরই আমাদের আবার যাত্রা কাজিরাঙ্গার বনে, তবে এবার চার পেয়ে হাতিতে চেপে নয়, বরং চার চাকার জিপ গাড়ীতে! সাথে সঙ্গী হিসেবে বনরক্ষী মনোজ।

10805679_10154883536095497_1303969886555597401_n

এবার অন্য রাস্তায়, প্রথমেই জলার ধারে দেখা দিল লম্বা পাখি মদনটাক, কয়েক ধরনের হাঁস, বিশেষ করে চখা-চখি, মেটে হাঁস, নীলশির, সেই সাথে জলার অপর পাশে চরে বেড়ানো গণ্ডার আর মোষ! আছে কয়েক ধরনের বক ও বগা, আকাশে উড়তে থাকা মেটে মাথা কুরা ঈগল, মাটিতে চরে বেড়ানো সকল গৃহপালিত মুরগীর পূর্ব-পুরুষ লাল বনমুরগি!

10858374_10154883181705497_3875847560885291966_n

এবার মন প্রাণ চোখ দিয়ে আমরা খুঁজতে থাকলাম বাঘের ডোরা, যদিও এই দুর্ভেদ্য ঘাস বন ছেড়ে পথে না আসলে তা দেখা অসম্ভব বলা চলে, এর মাঝে মনোজ জানালো তারা গতকালই দুইটা বাঘ দেখেছে। কাজেই আশা ছাড়ার কোন কারণ নেই! এর মাঝেও দেখা মিলল বেশ কটি গণ্ডারের, আর প্রায় শখানেক বারশিঙ্গা হরিণের। তবে সবচেয়ে বেশি খুশী হলাম বিশালকায় এক জোড়া রাজধনেশ দেখে, আকাশের রাজা অসাধারণ পাখিটি আমাদের দেশে আজ বিলুপ্তির মুখোমুখি, কিন্তু ভারতে নানা কার্যকরী ব্যবস্থা বাস্তবায়নের ফলে আগের চেয়ে অনেক উন্নতি ঘটেছে রঙ ঝলমলে পাখিটির সংখ্যার! আর কাল সন্ধ্যায় আমরা যোগ দিচ্ছি হর্নবিল ফেস্টিভ্যালে, কাজেই তার আগ মুহূর্তেই অসাধারণ পাখিটিকে দেখে সবাই বেশ উল্লসিত,

10565036_10154883587465497_8154881560621825366_n

এবং সেটি আরও খুশীতে পরিণত হল বিশেষ ধরনের লম্বা ঠোঁটের শকুন ও তার বাসা দেখে!

20703_10154883595415497_8254927569243773525_n

দেখা হল আরও অনেক পাখি, কচ্ছপ, গুইসাপ, বানর ইত্যাদির সাথে, কিন্তু সেই গল্প অন্য দিন হবে। ইতিমধ্যেই ২ ঘণ্টার জিপ সাফারি হয়ে গেছে আড়াই ঘণ্টার কাছাকাছি , এখান থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে নাগাল্যান্ডের সীমান্ত শহর ডিমাপুর! সেখান পৌঁছাবার কথা দুপুরে, কিন্তু মনে হচ্ছে সন্ধ্যায় পৌছাতে পারলেই এখন খুশী থাকতে হবে!

রহস্য ঘেরা কিংবদন্তীর রাজ্য নাগাল্যান্ড, মহাভারতের অন্যতম নায়ক অর্জুন নির্বাসনে থাকা কালে এইখানে নাগ রাজকুমারী উলুপীর পাণিগ্রহণ করেন বলে উল্লেখ আছে, সম্ভবত অনেক শত বছর ধরেই এখানে আদিবাসীদের প্রতীক বা টোটেম হিসেবে সাপ বা নাগ ব্যবহৃত হয়ে আসছে, তাই এর নামও নাগাল্যান্ড। ডিমাপুরে পৌছাতে পৌছাতে প্রায় আঁধার, কেবল প্রাচীন রাজবাড়ীর সামান্য অংশ এবং স্থানীয় বাজারে অন্য অনেক কিছুর সাথে পোকা ভাজা ও ছোট ব্যাঙ বিক্রি দেখে সোজা হোটেলে।

10404464_10154883526810497_3810972310491803160_n

কাল ভোরে যাত্রা শুরু হবে নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমার উদ্দেশ্যে, এবং হর্নবিল ফেস্টিভ্যালে যোগ দিব কালকেই। যদি নেট পাই তাহলে দেখা হচ্ছে---

আগের পর্ব


মন্তব্য

মেঘলা মানুষ এর ছবি

ছবিগুলো অসাধারণ (যথারীতি)!
শেষের ছবিটা রুচিবর্ধক না রুচি নাশক চিন্তিত

অতিথি লেখক এর ছবি

আহা, মুক্ত রাজধনেশ! হাসি
হরিণের ভেংচি টা চোস্ত! দেঁতো হাসি

আমার বন্ধু রাশেদ

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

আপনি পারেনও রে ভাই। গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

ছেলেটা তার জীবনটাকে উপভোগ করে ছিবড়ে করে দিল হাসি

সচল জাহিদ এর ছবি

চলুক চলুক চলুক


এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

রিক্ত আমি শূন্য আমি দেবার কিছু নাই,
আছে শুধু হিংসেগুলো, দিয়ে গেলাম তাই।

বাইদ্যওয়ে, তন্ময়রে একটা সিঙ্গেল হাতি দেওয়া যাইতো না! চোখ টিপি

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

তানিম এহসান এর ছবি

হুমম, আগের মতই, সচল খুললেই নীড়পাতায় সবার উপরে আলাদা আলাদা লেখা কিন্তু আপনার পোস্ট অনড়! দেঁতো হাসি বহুদিন পর সময় নিয়ে সচলে বসেছি, মজা লাগলো।

নাগা সংস্কৃতি’র উপর একটু আলোকপাত করলে আপনের জন্য আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- বরাদ্দ দেয়া হবে- মোহিতো!

“গণ্ডার পালার জিনিস না! সেটি স্বাধীন থাকবে, ইচ্ছামত গুঁতোবে! নাহলে কিসের গণ্ডার!” চাল্লু -- আপনি খালি বন নিয়ে ভাবিতেছেন মনে হয়, চাইরপাশে পচুর গণ্ডার চোখ টিপি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।