ভারতের এলাহাবাদের এক ছোট শহরের বাসিন্দারা প্রতি সকালেই মুখে টিপে হাসে জজ সাহেবের ছেলেকে দেখে, আর সব দিনের মতই পোষা বাদর শাহনাজ খানকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে সে, এই বয়সী আর দশটি ছেলের মত খেলায় মেতে বা হিন্দি সিনেমা দেখা দিন কাটায় না সে, বরং এলাকার যত পশু-পাখি সব যেন তাঁর প্রাণের দোসর, নতুন কোন প্রাণী দেখার মাঝেই যেন তাঁর জীবনের সকল আনন্দ।
-এভাবেই নিজের কৈশোরকে বর্ণনা করছিলেন বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির গত তিন দশকের কাণ্ডারি ডঃ আসাদ রাহমানি। বাংলাদেশে শকুনের জন্য সরকারিভাবে নিরাপদ এলাকা (সেফ জোন) ঘোষণা উপলক্ষে ঢাকা এসেছিলেন নভেম্বরে, আর ২৪ নভেম্বরের তাঁর সন্মানে দেওয়া বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের এক আড্ডায় ঝুলি খুলে ধরেছিলেন তাঁর পূর্ণ জীবনের, বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার।
স্কুল জীবনের শেষ পরিক্ষায় অঙ্কে ৯৬% নাম্বার পেলেও স্কুলের পরপরই বেশি করে ঝুঁকলেন বায়োলজির দিকে, জীব বিজ্ঞানের সাথে সেই যে গাঁটছড়া বাঁধলেন তা চলছে আজও সাবলীল ভাবে। জীবনের এক পর্যায়ে চিঠি লিখলেন বিখ্যাত পাখিবিদ সালিম আলীর কাছে, উত্তর পেলেন কদিন পরেই, তাও আবার সালিম আলীর সাথে কাজ করার আমন্ত্রণ পেয়ে! ব্যস, বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটিতে যোগদান করলেন সালিম আলীর জুনিয়র সহকর্মী হিসেবে, এবং তারই পদে অধিষ্ঠিত হয়ে প্রতিষ্ঠানটি আগলে রেখেছেন প্রায় তিন দশক। সালীম আলীর সাথে অসংখ্যবার ভ্রমণে গেছেন নানা পশু-পাখির খোঁজে, বললেন মৃত্যুর একদিন আগেও তাঁর সাথে ফোনালাপ হয়েছিল পাখিবুড়োর। একইভাবে তিনিও মনে করেন যে গোলাপি-মাথা হাঁস এখনো পাওয়া যেতে পারে মায়ানমারে।
জীবনের প্রথম উপার্জন দিয়ে ১৯৭১ সালে একটি টাইপরাইটার কিনেছিলেন আসাদ রাহমানি ৯০০ রূপী দিয়ে, কারণ লেখালেখির দিকে তাঁর ছিল ভীষণ ঝোঁক। এ পর্যন্ত অন্তত ৩০০টি আর্টিকেল প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রাণিজগৎ ও পরিবেশ নিয়ে নানা পত্রিকায় এবং আমাদের উপহার দিয়েছেন ১৭টি মূল্যবান বই।
নিরলস ভাবে চেষ্টা করে চলেছেন জনগণকে পরিবেশ নিয়ে সচেতন করে এঁকে রক্ষায় উদ্ভুদ্ধ করে তুলতে। পেয়েছেন মেম্বর অফ অনারসহ অসংখ্য সন্মাননা। কিন্তু আসল তৃপ্তি পেলেন ২০১৩ সালে, কারণ ২০১২ সালে সারা বিশ্বে প্রকাশিত হয়েছিল নাগাল্যান্ডে প্রায় দেড় লক্ষ আমুর শাহিন হত্যার ঘটনা। খুদে এই শিকারি পাখি উত্তর-পূর্ব ভারতের নাগাল্যান্ডের কয়েকটি সরু উপত্যকার মধ্য দিয়ে পরিযাজনের সময় স্থানীয় শিকারিদের হাতের যথেচ্ছ খুন হবার ঘটনায় কেঁপে উঠেছিল সারা বিশ্ব। তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজে নেমে পড়েন আসাদ রাহমানি, কথা বলেন নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী, ভারতের পরিবেশমন্ত্রী থেকে শুরু করে গ্রাম্যশিকারি এবং নাগাল্যান্ডের স্কুলগামী বাচ্চাদের সাথে। তাদের বোঝাতে সক্ষম হন কেন এই শিকার চলতে দেওয়া যাবে না, কেন রক্ষা করতে হবে আমুর শাহিনকে, এবং কিভাবে আমুর শাহিনের পরিযায়ীকালীন যাত্রা দেখার জন্য আকৃষ্ট করা যাবে পর্যটকদের, ফলে লাভবান হবে স্থানীয়রা। সেই সাথে মিডিয়া, এন জিও, স্থানীয় সরকার- আলোচনায় বসলেন। সকলের সাথে প্রকৃতি সংরক্ষণ সবসময়ই একটি দলবদ্ধ কাজ বলেন মনে করেন তিনি, সেই মোতাবেকই কাজ করে মাত্র এক বছরের মধ্যেই এই বিপুল হত্যাযজ্ঞ প্রায় সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ করতে সক্ষম হয় সকলে মিলে। এখানেই তাঁর সন্তুষ্টি।
নাগাল্যান্ডের ঘটনা এই পোস্টে বিস্তারিত আছে
ভারতের ভিতরে সবসময়ই ছোটাছুটি করছেন এপ্রান্ত থেকে ঐ প্রান্তে, পেশাগত কারণে এবং মনের টানে। সেই সাথে ভ্রমণ করেছেন বিশ্বের নানা অঞ্চল। এশীয় দেশগুলোর মাঝে ভূয়সী প্রশংসা করলেন দঃ কোরিয়া এবং তাইওয়ানের, বললেন ঐ দেশগুলোতে আছে ভালো রাস্তা এবং চমৎকার বন, আর আমাদের আছে খারাপ রাস্তা আর মৃতপ্রায় বন। আমাদেরও চেষ্টা করতে হবে প্রকৃতিকে অক্ষুণ্ণ রেখে তবেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার চেষ্টা করা।
সময়ের সঠিক ব্যবহারের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন আসাদ রাহমানি, জানা গেল সকালে প্রাত্যক্রিয়া সারার সময়ই খবরের কাগজ পড়ে ফেলেন, টয়লেটের সময়টুকুরও ব্যবহার করার জন্য। সেই সাথে এক ফাঁকে গলা নামিয়ে বিয়ে না করার কারণ জানালেন চিরকুমার মানুষটি, “আসলেই আমার সময়ই ছিল না পরিবার গঠনের”। নিজেকে সর্বভুক এবং স্বল্পহারী দাবী করে বললেন বিশ্বে যে কোন কিছু খেতে আমি রাজী আছি যদি সেটা সেই দেশের আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ না হয়!
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের পাখি এবং পাখির আবাসের উপর গুরুত্বপূর্ণ বই লিখলেও উনি আসলে প্রাণীজগতের সবকিছু নিয়েই অত্যন্ত উৎসাহী এবং কৌতূহলী। সেই সাথে খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে বললেন শিশু এবং তরুণদের মাঝে পরিবেশ নিয়ে ভালবাসা জাগানোর কথা। নিজেও যে কোন সুযোগ বেড়িয়ে পড়েন ছাত্রদের সাথে নানা গবেষণায়, এমনকি তাঁর বাড়িতেও প্রায়ই কোন না কোন ছাত্র অবস্থান করে প্রয়োজন হলে।
আড্ডার এক পর্যায়ে অনেক দশক আগের তাঁর সাথে কাজের নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোকপাত করে ঢাকা বিশ্ব-বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ আনোয়ারুল ইসলাম। বাংলাদেশে এটিই ছিল আসাদ রাহমানীর প্রথম ভ্রমণ, কিন্তু আবারও ফিরে আসার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন কাজপাগল, অতি বিনয়ী মানুষটি, যিনি সাক্ষাৎকার নিতে চাই শুনে প্রথমেই বলেছিলেন, “ শুনো হে, মানুষ হিসেবে আমি কিন্তু খুবই লাজুক। সাংবাদিকদের প্রায়ই বলি আমাকে যেন ইমেইলে প্রশ্ন পাঠায়, তাতেই সঠিক উত্তর দিতে পারি ভেবে চিন্তে!”
মন্তব্য
আসাদ রাহমানিকে স্যালুট।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
ডাবল স্যালুট পাবার মতই মানুষ
facebook
ওনার বইগুলো অনুবাদের ব্যবস্থা করা যায় না, অণুদা?
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
করা তো দরকারই!
facebook
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
খবর কী ফোটনদের?
facebook
এইসব কি বুইলছে গো? রঙ নাম্বার!
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
facebook
চমৎকার।
শুভেচ্ছা
facebook
জেনে ভালো লাগল এরকম 'পাখিপাগল' একজন সম্পর্কে।
"পরিযাজনের সময় স্থানীয় শিকারিদের হাতের যথেচ্ছ খুব হবার ঘটনায় কেঁপে উঠেছিল সারা বিশ্ব।" এটা 'খুন' করে ফেলুন
ধন্যবাদ
facebook
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
নতুন মন্তব্য করুন