স্মিতহাস্য মুখে লেপ্টে মুঢ় দেবতা তাকিয়ে আছেন নির্নিমেষে, তাঁর পাথুরে অভিব্যক্তি বোঝার ক্ষমতা একমাত্র ঈশ্বর নির্মাতাদেরই ছিলো। জন্মলগ্নের পর থেকেই শতাব্দীর পর শতাব্দীর ধরে সকলের বিস্ময় উদ্রেক করে আসছেন তারা, যখন ঘন জঙ্গলের আবরণ সরিয়ে পাদপ্রদীপের আলো এসে পড়ল চরণতলে তখন তো তকমা এঁটে গেল বিস্মের অষ্টম আশ্চর্যের। সেই থেকে এখনো চলছে লাখো লাখো মানুষকে প্রতিবছর স্রেফ পাথুরে চাহনি দিয়েই বিস্ময়ের পাথর করে দেবার ধারা।
জি ঠিকই ধরেছেন, বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্য খ্যাত আমাদের গ্রহের সর্ববৃহৎ উপাসনালয় কম্বোডিয়ার আংকর ভাটের কথাই বলছি, বিশেষ করে বেয়্যন মন্দিরের ২১৬টি অবলোকিত ঈশ্বরের কথা। চলুন, বিস্ময়বোধে আক্রান্ত হয়ে আসুন খানিকের জন্য বা মুগ্ধতায় ডুবে সারা জীবনের জন্য, সঙ্গী হিসেবে আছেন একমাত্র আইভরি কোস্ট ফেরৎ ব্লগার সুমাদ্রি দা, বন্ধু দ্বৈপায়ন পাল এবং আপনি স্বয়ং।
চির চেনা এই স্থাপত্য, অসংখ্য বইয়ের মলাটে ছাপা ছবি, কত রহস্য এদের নিয়ে! প্রতি স্তম্ভে চার দিকে চারটি করে একই ধাঁচের সুবিশাল মুখ, প্রায় আটশ বছর ধরে টিকে আছেন তারা অজর, অমর, অক্ষয়, অব্যয় হয়ে। কারা এরা? কেন এভাবেই আছে হাজার বছর ধরে?
আংকর ভাটের বিশ্বের বৃহত্তম মন্দির, স্বাভাবিক ভাবেই এর আছে অনেক শাখা-প্রশাখা। যে কারণেই এখানে টিকেট বিক্রিয় হয় ১ দিন, ৩দিন এবং ৭ দিনের, যদিও ৭ দিন যথেষ্ট নয় আংকর ভাটের সবগুলো মন্দির দেখার জন্য। পর্যটকদের কাছে প্রধান আকর্ষণ থাকে মূল মন্দির কমপ্লেক্স, দানবাকৃতির প্রাচীন গাছের মন্দির এবং এই অবলোকিত ঈশ্বরের মেলা, ব্যেয়ন। অন্যগুলোর কথা অন্য দিনের জন্য তোলা থাক, আজ শুধু আমরা ঘুরব ব্যেয়ন মন্দিরের ভিতরে-বাহিরেই।
বুদ্ধ ধর্মের অনুসারী রাজা ৭ম জয়বর্মণ আটশ বছর আগে তাঁর রাজধানী আঙ্কর থমের কেন্দ্রবিন্দুতে রাষ্ট্রীয় উপাসনালয় হিসেবে ব্যেয়ন মন্দিরের নির্মাণ কাজে হাত দেন। অনেক খেমের ইতিহাসবিদদের মতে ব্যেয়ন মন্দিরের সবগুলো মাথা রাজা জয়বর্মণের মুখমণ্ডলের আদলে গড়া, জনই নিজেকে দেবরাজ বলে মনে করতেন। সমগ্র মন্দিরে ২১৬টা সুবিশাল মুখ, শীতল হাসি নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে আপনার দিকে! জঙ্গলের শতাব্দীময় অপার্থিব নির্জনতার মাঝে সারি সারি দৈত্যকার একই দর্শন মুখগুলি কেমন একটা অলৌকিকতার জন্ম দেয় যেন, মনে হয় রাতের বেলার এখানে ঘুম ভাংলে কি ২১৬টা মুখ এক সাথে আদেশ দিয়ে উঠবে গম্ভীর স্বরে, নাকি মুখের ভুতুড়ে হাসি মিলিয়ে যার নতুন কোন অনুভুতির আগমনে? পণ্ডিতদের মতে এই মুখগুলো বুদ্ধর আরেক রূপ অবলোকিত ঈশ্বর বা লোকেশ্বর, কিন্তু আদল দেওয়া হয়েছে রাজা জয়বর্মণের।
মন্দিরের ভেতরে বিস্ময় ভরা সম্ভ্রম নিয়ে ঢুকতেই অন্তত এক ডজন মুখ মাথার উপর থেকে রাজকীয় ভঙ্গিতে, শাসনের অভিব্যক্তি আর খানিকটা মানবতার মিশেল দেওয়া হাসি নিয়ে তাকাল। প্রাচীন কারিগরেরা এমন দক্ষতার সাথে নির্মাণ করেছে যে বিশাল মন্দিরের প্রায় যেঁ কোন স্থানে দাড়লেই বারোটার মত অবলোকিত ঈশ্বরের আপনের উপরে খানিকটা ঝুঁকে নজরদারি করবে। প্রতি স্তম্ভেই এক কেন্দ্র থেকে চার দিকে চারটি মাথা বাহির হয়ে আছে, অপূর্ব নির্মাণশৈলী দেখিয়ে নিখুঁত ভাবে কাটা পাথর খন্ড একের পর এক বসিয়ে তৈরি করেছিলেন ৫৪টি মুন্ডুস্তম্ভ, এবং যেনে শিহরিত হবেন যে আংকর ভাটের ঠিক কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে আছে এই ব্যেয়ন মন্দিরই! বলা হয়ে থাকে এই মন্দির নির্মাণের সময় খেমের সাম্রাজ্যে ৫৪টি রাজ্য ছিল, তাই প্রতিটি স্তম্ভ এক একটি রাজ্যের প্রতীক।
ভোর ৫টায় সূর্য ওঠার আগের আমরা আঙ্করে প্রবেশ করলেও তার কেন্দ্রস্থলে আসতে আসতে প্রায় সকাল দশটা। মন্দিরের ভিত্তিতে প্রায় ১.২ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রাচীরে অবিশ্বাস্য ১১,০০০ ফিগার খোঁদাই করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ১২শতকের কম্বোডিয়ার দৈনন্দিন জীবন, যেখানে জেলের মাছ শিকার থেকে শুরু করে সৈন্যদের লেফট-রাইট, পশু-পাখি কিছুই বাদ যায় নি।
কিন্তু এতকিছুর পরও ব্যেয়ন মন্দিরের আসল আকর্ষণ তার ভেতরে, যেখানে প্রবেশের সাথে সাথে মনে হল লাফ দিয়ে কম্পিউটার গেমসের জগতে লারা ক্রফটের সাথে প্রবেশ করেছি আমরা, তেমনই পাথুরে সরু সরু কানাগলি, মোড়ে মোড়ে অবলোকিত ঈশ্বর, পাথুরে জানালা দিয়ে তাকালেও মূক ঈশ্বরই নজরে আসে।
স্বপ্নের স্থান ছোঁয়ার একটা অদ্ভুত মাদকতা আছে, তাতে পৌঁছাবার পর এখন তো আর কিছুই বাকী রয়ল না এমন ধরনের উল্লাসময় হাহাকারের চেয়ে বরং আসলেই এসেছি কিনা সেই বিস্ময়বোধের শরবিদ্ধ হয়ে কাটিয়ে দেয়া যায় অন্যভুবনের অনন্য মুহূর্তগুলো। আমরা তিন ভবঘুরেও উদভ্রান্তের মত চিরচেনা মূর্তিগুলো দেখে যাচ্ছি মনের পিপাসা মিটিয়ে, ঘুরে ঘুরে কানাগলি হয়ে ফিরছি একই চাতালে, তারপরও মুগ্ধতার বেশ কাটে না, কাটবার কথাও না! হয়ত আজ থেকে এক যুগ পরে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে দাড়িয়ে এখানের স্মৃতিচারণ করে ভাবব, ‘আসলেই গিয়েছিলাম তাহলে ব্যেয়নের মন্দিরে! যাহ্, সেখানে কেউ যেতে পারে নাকি! সে তো থাকে কেবল বইয়ের পাতায় আর কল্পলোকে।“
রূপকথার রাজ্যের রং আরও বাড়াতেই যেন হাজির হল অপ্সরার দল! অপূর্ব সুন্দরী কম্বৌজ রমণীরা স্বর্গের নর্তকী অপ্সরাদের অনুকরণের সুদৃশ্য পোশাক আর ঝলমলে বিশাল মুকুট পরে দাড়িয়ে আছে, সাথে আছে রামায়ণের পৌরাণিক চরিত্র হনুমানও। তারা খুব সামান্য পয়সার বিনিময়ে পর্যটকদের সাথে ছবি তুলে স্মৃতিকে আরেকটু স্মরণীয় করার জন্য।
সেই কর্তব্য করার সময় তাদের হাতের নানা মুদ্রা লক্ষ্য করতে করতেই শুনলাম আমাদের কম্বোডিয়ান গাইড কও-এর চিল চিৎকার! মূল কথা হচ্ছে কও জানতে চাচ্ছে আমরা কি সারাদিন এই মন্দিরের কাটিয়ে দেব নাকি বিশাল গাছের ত্য ফ্রোম-এও যাব!
অগত্যা চট জলদি কিছু দৃশ্য ফ্রেমবন্দী করে আবার টুক-টুক (বেবি ট্যাক্সি ধরনের যান) চেপে চললাম আংকরের অন্য প্রান্তে, যেখানে আছে শতাব্দী প্রাচীন দানব গাছেরা, যে গল্প শোনাব খুব জলদিই আরেক সন্ধ্যায়।
মন্তব্য
১১,০০০ পাথরে খোদাই করা ফিগার আর ২১৬ টা বিশাল মুখ ? কত বছর লেগেছিলো ?
এই প্রথম নীল রঙয়ের হাফপ্যান্ট পরিহিত কাউকে অপ্সরীদের মাঝে বসে অভয়মুদ্রা দেখাতে দেখলাম।
ভালো থাকবেন,অণুদা। পোস্ট ভালো লেগেছে।
এক রাজার জীবনেই তৈরি হয়েছিল বলে পড়েছিলাম।
হাফপ্যান্ট পরে অপ্সরা এলাকায় যাবার মাজেজায় আলাদা
facebook
ভালো লাগলো
দানব গাছের ছবি ও গল্প শুনার অপেক্ষায় রইলাম
আসিতেছে-
facebook
আমিও...
এতো মূক ঈশ্বর লইয়া আমি কী করিব?
ভালো লাগলো অনেক।
আরেক সন্ধ্যাটা আসুক তাড়াতাড়ি।
স্বয়ম
উনি জবাব দিক
facebook
বিশাল ফাঁকি হইছে। আরো বিস্তারিত লিখতে হবে।
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
আপনিই বুঝলেন
facebook
এটাও ঘোরা হয়ে গেল! খুব ভাল।
পাশ থেকে মূর্তির ছবিটা জব্বর হয়েছে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
পুরা জায়গায় জব্বর
facebook
চলুক!
চলবে -
facebook
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
facebook
এই অসাধারণ জায়গাগুলোয় আমি কবে যেতে পারবো?
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
তুমি চাইলে কালকেই যাইতে পার!
facebook
বুদ্ধ ধর্ম না তো, বৌদ্ধ ধর্ম।
লেখা এত পিচ্চি ক্যাঁরে ?? ফাঁকিবাজি করলে হপে?
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
এত্তু করলাম আর কী !
facebook
রাজা সপ্তম জয়বর্মণের আমলে লোকে খাইতে পিনতে পারত কিছু? নাকি রাজার হুকুমে দুইশ ষুলো মাথা বানাইতে গিয়া রাজ্যের সবাইর হালুয়া টাইট?
..................................................................
#Banshibir.
রাজার শখ, জনগণ টাইট- নতুন কী !
ঐ মিয়াঁ ইনবক্সে বার্তা দিছি মোঘল ইতিহাসের একটা ব্যাপার নিয়ে, জলদি জানান
facebook
মন ভরে নাই ছবি দেখা ও লেখা পড়ে।
ছবিও কম, লেখাও কম
হুম,,, আরও সময় দিতে হবে-
facebook
আহা, এ জনমে কী আর দেখা হবে আমার! আপনার ছবিও লেখা পড়েই আপাতত শখ মেটাই।
বহু সময় বাদে তোমার লেখা পড়লাম। ভাল লেগেছে...
আশা করি ভালো আছো অণু
ডাকঘর | ছবিঘর
নতুন মন্তব্য করুন