আর্জেন্টিনার সন্ধ্যা

তারেক অণু এর ছবি
লিখেছেন তারেক অণু (তারিখ: শুক্র, ০৭/০৮/২০১৫ - ২:৩৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্লাতা নদীর ঘোলাজলে কোন কিশোর ছেঁড়া সাদা পাল তুলে ডিঙ্গি নিয়ে পাড়ি দিচ্ছিল না সেই সন্ধ্যায়, তবুও গোধূলি লগ্নে যখন আলো-আঁধারের জাদুময়তার সুষম কারসাজিতে থিরথির কেঁপে ওঠা মুহূর্তে পদ্মাপারে কৈশোর কাটানো একজনের চোখে প্লাতাকে মনে হল দু-কূল ছাপানো একটা সত্যিকারের নদী! যেমনটা মনে হয় বর্ষার পদ্মা, মেঘনা, যমুনা দেখলে।

IMG_7894

আসলেই এশিয়ার বাহিরে নদীর এমন প্রমত্তা রূপ প্রথম দেখলাম আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সের শহরতলী টাইগ্রিস এলাকায় যেখানে এক কালে কয়েক মাস বসবাস করেছিলেন নদীপ্রেমিক বিশ্বপ্রাণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ইউরোপের ছিপছিপে সরু নদীগুলোর ইতিহাস বাঁধানো বাক দেখে দেখে চোখ সয়ে গেছে, বাংলাদেশেও ঘুরে-ফিরে আসা হয় শীতকালে যখন নদীর চরে মাঝে মাঝে মরিচিকার মত চকচকে কিছু দেখে বোঝা যায় শীতের বালু-সাম্রাজ্যে কয়েক জায়গায় জল টিকে আছে বটে, দেখা হয়নি আমাজনের সত্যিকারের বন্যতা, তাই-ই প্লাতার সেই উথাল-পাথাল সর্বগ্রাসী রূপ আসলেই স্তব্ধ করে দিল মুগ্ধতায়। মনে পড়ল অনেক কাল আগে রোম নগরীতে দেখা বার্নিনির পিয়াজ্জায় দেখা সেই অসাধারণ ভাস্কর্যের কথা যার চারদিকে ছিল চার মহাদেশে প্রাণদায়িনী চার নদী- গঙ্গা (এশিয়া), নীল(আফ্রিকা), দানিয়ুব(ইউরোপ) আর প্লাতা (আমেরিকা), আসলেই তো, সেই কালজয়ী শিল্পী তো আর এমনি এমনি আমেরিকার এই নদীকে দেবতার স্থানে বসিয়ে স্তব করেন নি।

নদী তীরে সাথে ছিলেন আর্জেন্টিনার গায়ক বন্ধু মারিয়া, যিনি সাগ্রহে গাইড হয়ে ভিয়া ওক্যাম্পো দেখিয়ে রবি ঠাকুরের নামে রাখা রাস্তা খুঁজে বাহির করার পর এখন নিয়ে চলেছেন তাঁর ডেরাতে। মারিয়ার সাথে পরিচয় বেশ কয়েক বছর আগে ফেসবুকের সুবাদে। মঞ্চে কাজ করেছেন অনেক বছর, মূলত গায়িকা, ঘুরে ঘুরে গান করেন আর্জেন্টিনায়। খুব ইচ্ছে তাঁর অন্তত একবার ইউরোপে এসে জিপসি গান গেয়ে শোনাবার, কিন্তু আটকে গেছেন বিমানভাড়ার চক্করে পড়ে। সেদিন সকালেই সদ্য পরিচিত ব্রাজিলিয়ান বন্ধু ম্যাথিয়াস আমাদের নিয়ে গেছিল এক খোলা পার্কের রেস্তোরাঁয় যেখানে লাঞ্চের সাথে সাথে ট্যাঙ্গো নাচ উপভোগ করা যায় (নিজে নাচা নয়, অন্য নাচ দেখা!)। সেখানেই মারিয়া যোগ দিয়েছিল আমাদের সাথে, মজা করে বলল ”তোমরা সব ছেলে-ছোকরা মানুষ, আমার ছেলেটাই তোমাদের বয়সী হবে, এই বুড়ো মহিলার সাথে আড্ডা দিয়ে কী আর তোমার মজা পাবে এত এত আর্জেন্টাইন স্টাইলিশ লেডিদের ভিড়ে?”
IMG_7576

সেটা ছিল স্রেফ কথার কথা! মহিলা খুব গুছিয়ে চিত্তাকর্ষক ভঙ্গীতে এমন ভাবে জীবনের নানা ঘটনা বলতে থাকেন যে অনায়াসেই যে কোন আড্ডার মধ্যমণি হবার ক্ষমতা রাখেন। এর মাঝেই জানিয়ে রেখেছেন তাঁর ছেলে বাসায় পিজ্জা বানাচ্ছে, আমরা যেন অবশ্যই একসাথে ডিনার করি। সাধারণত যে কোন অঞ্চলের স্থানীয়দের জীবনের সাথে এমন ভাবে পরিচিত হবার সুযোগ থাকলে সেটাকে না বলা বিশাল অন্যায়, কেব আবার এদেশে আসা হবে, এমন বন্ধুবৎসল মানুষ যেচে পড়ে এক কাপ ম্যাতে চা খাওয়াবে কে জানে!

IMG_7835
টাইগ্রিসে গান গাচ্ছে মারিয়া

ট্রেন ধরে প্লাতার তীর থেকে আমরা যখন মারিয়ার বাড়িতে পৌঁছেছি ততক্ষণে আঁধার জাকিয়ে বসতে শুরু করেছে শীতকালের আর্জেন্টিনায়। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ফ্ল্যাটবাড়ি, বসার ঘর বাদে দুটো কামরা, একটা বারান্দা, ক্ষুদে রান্নাঘর এই নিয়েই থাকেন বাড়ির বাসিন্দারা। মারিয়া আর তার ছেলে কামি ছাড়া আছেন মারিয়ার বয়ফ্রেন্ড গুস্তাভো এবং বেশ কয়েকটি বেড়াল! গুস্তাভো নিজেও একজন সঙ্গীতশিল্পী, দারুণ হাসিখুশি মানুষ। প্রথমেই বললেন”আমার গুস বলে ডাকলেই হবে, দেখতে বুড়ো হলেও মনেপ্রাণে কিন্তু আমি খুবই তরুণ”, তার পরপরই দিলেন প্রাণখোলা হাসি। তাদের তুলনাই বরং কামিকেই বেশ অন্তর্মুখী লাজুক মনে হল।

IMG_7844
কামি এবং মারিয়ার সাথে আমি

বিশাল দেশ আর্জেন্টিনা, ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে আলাদা আলাদা সংস্কৃতির মতই নানা ধরনের সঙ্গীতের আকরভূমি, কোট-টাই পরা ট্যাঙ্গো যেমন আছে, তেমনই আছে ঘোড়ার পিঠে জীবনভর দাবড়ে চলা গাউচোদের বিস্তীর্ণ প্রান্তরের বুনো সুর। গুস্তাভো আবার ট্যাঙ্গো মিউজিকের কড়া সমালোচক, তাঁর কথা হচ্ছে- সারা বিশ্বে আর্জেন্টিনার সঙ্গীত বললেই মানুষ ট্যাঙ্গো বুঝে, ট্যুরিস্টদের জন্য এখানের পাবে পাবে ট্যাঙ্গো বাজানো হয়, কিন্তু ট্যাঙ্গো মোটেও বুয়েন্স আয়ার্সের স্থানীয় সঙ্গীত নয়। গুস্তাভোর যে ব্যান্ডগ্রুপ আছে তারা সেই স্থানীয় আদি মেঠো সুরেরই চর্চা করে নানা জায়গায়।

IMG_7842
মারিয়া, গুস্তাভো, কামি এবং তাদের বেড়ালেরা

আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বিখ্যাত খাবার অবশ্যই গরুর মাংসের স্টেক, কিন্তু সেদিন দুপুরেই এক প্রস্থ স্টেক হয়ে যাওয়ায় রাতে হালকা কিছু খাবার কথা ছিল, সেই হিসেবে সব্জি দিয়ে পিজ্জা বানিয়ে ছিল কামি, সাথে চা। খেতে খেতেই এক অপ্রিয় প্রসঙ্গ নিয়ে কথা উঠল, তা হচ্ছে “ সমগ্র ল্যাতিন আমেরিকায় আর্জেন্টিনা পরিচিত একটি বর্ণবাদী জাতি হিসেবে। সরাসরি ইংরেজ, জার্মান এবং ইতালিয়ান অভিবাসীরা বর্তমান আর্জেন্টাইনদের পূর্বপুরুষ হওয়ায় একটা শ্বেতাঙ্গ সুপিরিয়র জাতির পরিচয় নিয়ে এক ধরনের আত্মঅহংকারে ভুগে আর্জেন্টাইনরা।” এইটা অবশ্য ল্যাতিনের যে কোন ফুটবল দলে দিকে তাকালেই বোঝা যায়, মেক্সিকো থেকে শুরু করে কলম্বিয়া, প্যারাগুয়ে, পেরু, বলিভিয়া, ব্রাজিল যে কোন ফুটবল দলে যেখানে নানা বর্ণের খেলোয়াড় আছে (শ্বেতাঙ্গ এবং অশ্বেতাঙ্গ, এবং অবশ্যই স্থানীয় ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভূত) সেখানে আর্জেন্টিনায় কেবল যেন শ্বেতাঙ্গদেরই মেলা। এই কথায় সাথে সাথে সমর্থন জানালেন মারিয়া এবং গুস্তাভো, বললেন মনে মনে এমন একটা ঠুনকো অহমিকা নিয়েই বড় হয় আর্জেন্টাইনরা, ভাবে আমরা ইউরোপিয়ান মহান জাতি, ল্যাতিনের অন্য যে কোন জাতির বা দেশের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর। এমনতর চিন্তা খুবই লজ্জাজনক।

কিন্তু তরুণ কামি বলে বসল, সে এবং তাঁর বন্ধুরা মনে করে আর্জেন্টাইনরা আসলেই বেটার রেস অর্থাৎ জাতি এবং তার কারণ সম্পূর্ণ ঐতিহাসিক। কিছু বলে ওঠার আগেই তাঁর মা বেশ একটা তির্যক বকুনি দিয়ে ছেলেকে শাসন করলেন এমন বোকার মত মন্তব্যের জন্য। সেই সাথে এও বললেন যে নানা দেশের মান্সুএর সাথে মিশলে তোমার কখনোই মনে হবে না যে বিশ্বে শ্রেষ্ঠ জাতি বলে আসলেই কোন জাতি আছে।

নতুন বন্ধুদের সাথে আবার জীবন-নদীর বন্দরে দেখা হবে কিনা কে জানে, বেশ রাত পর্যন্ত তাই চায়ের পর চাএর সাথে গল্প চলল গান, বই, প্রাণী, মানুষ, রবীন্দ্রনাথ আর আমাদের জীবন নিয়ে। তাই করতে যেয়ে ফেরার সময় দেখি রাত ১০টা বেজে গেছে। বুয়েন্স আয়ার্সের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির খুব একটা সুনাম শুনি নাই কোনদিনই, বিশেষ করে তেমন এলাকায় ভুলে চলে গেলে ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া খুব নৈমিত্তিক ঘটনা। মারিয়া একবার বলল সে না হয় গুস্তাভো আমাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারে (আসলে বারবার বলেছিল পুরো পরিবারটিই যেন তাদের সাথে রাতে আড্ডা দিয়ে পরদিন ভোরে বন্ধুদের কাছে যায়, কিন্তু পরের দিনের প্ল্যান করা হয়ে গেছে, আবার সেই রাতেরও, তাই ফিরে যাওয়াটাই সমীচীন ছিল), জোর করে শুধু একটা ট্যাক্সি করে দিতে বললাম। ট্যাক্সি চালক ইয়া হোঁৎকা মত এক গুণ্ডা ব্যাটা। মনের মাঝে শঙ্কা- এই ব্যাটাই আবার হাইজ্যাক করবে না তো পথের মাঝে গাড়ি থামিয়ে। ড্রাইভারের আসনের পিছনে ঝোলানো আইডি কার্ড থেকে তার নাম পড়লাম- “দিয়েগো”।

সাথে সাথেই ভাঙা ভাঙা স্প্যানিশে বললাম, “আরেহ তোমার নাম দিয়েগো, এইটা তো বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পরিচিত নাম।”

সে খুব অবাক এবং খুশি হয়ে বলল, তাই? কিন্তু কেন?

উত্তর দিলাম- কারণ দিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা

সাথে সাথেই ট্যাক্সি-চালক দিয়েগো দাঁত বাহির করে মাথা দুলিয়ে বলল তাতো হবেই, দিয়েগোকে কে না চেনে। চিন্তা কর না অ্যামিগো, তোমাকে ঠিকঠাক মত পৌঁছে দিব হোটেলে, এই দিয়েগোর উপর আস্থা রাখ।

নিশ্চিন্তে গা এলিয়ে দিলাম পিছনে আসনে, টাক্সির বাইরে দূরে তখন সোডিয়াম আলো পড়েছে কোন এক জলরাশিতে, হয়ত প্লাতা নদীতেই।


মন্তব্য

স্যাম এর ছবি

টানা চারদিন একঘরে কাজ করে একটু খোলামেলা কোথাও মন টানছিল। লেখাটা সাহায্য করল, ধন্যবাদ আবারও।
প্রথম ছবিটায় পানির রঙটা খুবই কিরকম যেন! দূষনের মাত্রা বেশি? না আলোর কারণে?

তারেক অণু এর ছবি

পলির জন্য, মোহনার কাছাকাছি বলেই শুনেছিলাম, খাঁটি ঘোলা জল।

ঝিঁ ঝিঁ পোকা এর ছবি

চলুক

তারেক অণু এর ছবি

আপনি কি সুইডেনে থাকা ঝি ঝি পোকা?

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

আহা দিয়েগো! আহা লা-প্লাতা!! (আহা ইকথিয়ান্ডর!!!) চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

তারেক অণু এর ছবি

আহা

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক
আহ, আপনার লেখাগুলো গোগ্রাসে গিলি আর ভাবি, আদৌ কি কভু এইসব জায়গায় যাওয়ার সুযোগ হবে? মন খারাপ

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

তারেক অণু এর ছবি

হবে নিশ্চয়ই-

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।