যদ্যপি আমার গুরু

তারেক অণু এর ছবি
লিখেছেন তারেক অণু (তারিখ: সোম, ২৪/০৮/২০১৫ - ১০:৪১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

IMG_7792

গত কদিনে আমরা বাংলাদেশের টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথারিয়া ঘুরে ফেললাম একটানা। আমরা বলতে দেশের কয়েকজন পাখিপ্রেমী, নিসর্গপাগল। প্রায় সবাই-ই বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সদস্য যারা কালা-তিতিরের খোঁজে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার কাজিপাড়া চা-বাগান হয়ে ধলাভ্রু-কাস্তেছাতারের খোঁজে চলে গেছে টেকনাফ। তবে দলের মধ্যমণি সবসময়ই ছিলেন চিরতরুণ ইনাম আল হক। আজ যার বয়স ৭০ পূর্ণ হয়ে একাত্তরে পড়ল কেবল।

IMG_7501

আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ তাঁর, সেই সাথে জীবনপাত্র উছলে পড়া কৌতূহল। ডানে-বামে ভ্রু-ক্ষেপ না করে হনহন করে পথ মাড়িয়ে চলেছি সকলে, নজর কেবল সামনের দিকে কিন্তু গাছের পচা গুঁড়িতে বৃষ্টির স্পর্শে উঁকি দেওয়া অপূর্ব কমলা রঙের ক্ষুদে ক্ষুদে মাশরুমে ঠিকই নজর যায় তাঁর, যে কোন অচেনা গাছের পাতা, রঙিন ফল, পাহাড়ি ঝিরি দিয়ে ভেসে যাওয়া সুগন্ধি করবী ফুল, ঘাসের দঙ্গলের মাঝে কেঁচো- সবই পায় মুগ্ধতা, ভালবাসা এবং কৌতূহলের পরশ।

IMG_7594

ইনাম আল হক এক বিস্ময় আমাদের সকলের কাছে, তাঁকে বছরের পর বছর এত নিবিড় ভাবে কাছ থেকে দেখার পরও। জগতের যে কোন খুটি-নাটি নিয়ে চমকপ্রদ অজানা সব তথ্য দিয়ে বাকরুদ্ধ করে দেন তিনি আমাদের, এবং সেই জ্ঞানের কথা বলার সময় তাঁর কণ্ঠে অহংবোধ বা সবজান্তার মুন্সিয়ানার ছোঁয়াটুকু থাকে না, থাকে কেবল জানার আনন্দ।

IMG_7480

এই তো গত সপ্তাহে জীবনে প্রথমবারের মত কাপ্তাইয়ের সীতাপাহাড়ে গেছি, ঝুম বৃষ্টি হয়েছে এর মাঝে জল-কাদা ঠেলে ঝিরি-বন মাড়িয়ে পাহাড়ে ওঠার সময় একাধিক জায়গায় পিচ্ছিল কাদাময় ভার্টিক্যাল প্রায় ৮০ থেকে ৯০ ডিগ্রি খাড়া, চিন্তা করছি কী করে উঠব! এই সময় ইনাম ভাই কুড়িয়ে পাওয়া ত্রিশূল আকৃতির একটি গাছের ডাল নিয়ে এসে বললেন এই আমার ক্রাম্পন, এখন গোটা দুই ফুট হোল্ড তৈরি করতে পারলেই আমরা পা রেখে উঠে যাব, এবং তাই-ই হল! ৭০ বছরের তরুণ তরতর করে নিজের তৈরি সেই ঝুঁকিপূর্ণ পথ বেয়ে কাঁধে ইয়া বড় লেন্স সহ ক্যামেরা ও অন্যান্য ভারি বোঝা নিয়ে, খানিকক্ষণ মাথা চুলকে তাঁর অনুসরণ করলাম অবশেষে।

IMG_7800

বাংলাদেশের নানা বনে গত কয়েক মাসে গিয়েছি আমরা, মূলত পাখি দেখা এবং পাখি সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহের কাজে। ইনাম ভাই ব্যথিত হয়ে বলেন বনগুলোর তিরিশ থেকে চল্লিশ বছরের ইতিহাস। বলে চলেন আমাদের অদেখা সেই সম্পদরাজির কথা, যেখানে গাছের ভিড়ে সামনে চলা দায় ছিল, পাখির কূজনে ভরে থাকত চারপাশ।

IMG_8090

কালেঙ্গা বনের অপূর্ব সব প্রাচীন গাছ এবং লজ্জাবতী বানরের স্মৃতিচারণের সাথে সাথে বলেন কাপ্তাইয়ের বড়ছড়ার অসাধারণ সব পাখির কথা যাদের আর দেখা যায় না, পঞ্চগড়ের জঙ্গলের রাতচরা পাখিদের চিরতরে হারিয়ে যাওয়া তাঁকে স্মৃতিকাতর করে, ক্রমাগত বন ধ্বংস, বুনো পরিবেশের মুছে যাওয়া হয়ত কিছুটা বেদনাক্রান্তও করে তোলে, কিন্তু হতাশ হন না তিনি মোটেও। দুধপুকুরিয়ার বনে রাতচরা পাখি দেখে উচ্ছাস প্রকাশ করেন তারা এখনো টিকে আছে বলে, ফটিকছড়ির অরণ্যে বিশালকায় চিতিপেট-হুতোমপ্যাঁচা দেখা গেছে শুনে উল্লসিত হয়ে বলেন এখনো আমাদের অবাক করে দেবার সামর্থ্য রাখে বাংলাদেশের বন।

11350569_1072968862734808_1483144621523196703_n

সব বিষয়ে কথা হয় আমাদের- পাখি, পরিবেশ, বাংলাদেশ ছাড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, বায়রন, কিটস, ভ্যান গগ, রেনোয়া, এডমুন্ড হিলারি থেকে বিশ্বের নানা অঞ্চল ও তাদের সমাজ ব্যবস্থা ছাড়িয়ে মহাবিশ্বের ডার্কম্যাটার পর্যন্ত। কথা হয় মানে আমরা মুগ্ধ শ্রোতা কেবল, মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে জেনে নেবার চেষ্টা করি সেই বিষয় নিয়ে।

অথচ নিজের জীবনের এক শিক্ষণীয় ঘটনার কথা বলেছিলেন যা প্রতিনিয়ত মনে রাখার মত, কোন এক খাল পেরোবার সময় দেখেন সেই ডিঙ্গি নৌকায় মাঝি নেই, গ্রামের লোকেরা যে যখন যায় সে-ই তখন বৈঠা বেয়ে অপর পারে নৌকা রেখে যায়। তো নৌকা বাইতে এককালে ভাল পারলেও অনেক বছরের অনভ্যাসের ফলে তিনি সেদিন একটু উল্টো-পাল্টা নৌকা চালিয়ে অপর পারে পৌঁছালেন, সেখানে ছাগল চরানো রত এক বৃদ্ধা তাঁর উদ্দেশ্যে বললেন “এত বড় বুইড়া ব্যাটা হইছে, দাড় টাও বাইতে জানে না!”

এই গল্প বলেই ইনাম ভাই বলেছিলেন,”আপনারা আমাকে অনেকে অনেক কিছুই মনে করেন কিন্তু দেখুন সেই বৃদ্ধার কাছে আমি এক বুইড়া ব্যাটা যে দাড়টাও বাইতে শিখি নাই এবং সে কিন্তু ঠিক। হয়ত আমরা সবাই-ই জীবনে কারো না কারো কাছে এমন অক্ষম বুইড়া ব্যাটা।”
সেই কথাই আমি অবাক হয়ে ভাবি যে মানুষ খামোখা কেন অহংকার করে! কে সামান্য বিষয় নিয়ে নিজেকে অহেতুক বড় ভাবে অন্যদের চেয়ে।

তবে নিজের একটা বিশাল দুর্বলতা নিয়ে বলেছিলেন ইনাম ভাই এক বিরল মুহূর্তে, সেটি হচ্ছে বাংলাদেশ ছাড়া উনি থাকতে চান না। বিশ্বের ছয় মহাদেশ, পাঁচ মহাসাগর ঘোরা হয়ে গেছে তার, বছর চল্লিশ আগেই যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কিছুদিন ছিলেন উচ্চশিক্ষার জন্য, কিন্তু বাংলাদেশের বাহিরে থাকবেন এই চিন্তা কোনদিনই আশ্রয় দেন নি মনে। ভুবন ভ্রমিয়া শেষে তাই নিজ ভূমেই ফিরেছেন বারংবার এবং দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন আমার কাছে বিশ্বের সুন্দরতম অঞ্চল হচ্ছে বাংলাদেশ।

11036077_1164372866922352_677936612856387489_n

ইনাম ভাইয়ের মধ্যে যে এক কৌতূহলী শিশু বাস করে তার প্রমাণ আমি পাই প্রতিনিয়তই, মনে আছে উত্তর মেরু ভ্রমণের সময় সেখানের রাশান পাইলট আর বেস ক্যাম্পের লোকজনের তাঁবুতে ঢুঁকে বেশ আড্ডা জমিয়ে ফেলেছিলেন যারা ইংরেজির একটি শব্দও জানত না ঠিক যেমন ইনাম ভাই রাশান জানতেন না! কিন্তু তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারে খুশি হয়ে তারা সাইবেরিয়ার গ্রামে হাতে তৈরি জুতা অপূর্ব এক জোড়া জুতা ‘সালিঙ্কা’ উপহার দিয়েছিল।

DSC_2389
(এই পোস্টে ব্যবহৃত সকল ছবিই এই বছরে তোলা , কেবল এটি ২০০৭ সালে উত্তর মেরু অভিযানের সময় তোলা)

সেই একই কৌতূহল আবারও দেখি যখন ইনানির কোন কিশোরের কাছে তিনি পাঠ্যবই চেয়ে নিয়ে তা নিয়ে প্রশ্ন করেন।
IMG_8961

নিজের শত ব্যস্ততার মাঝে আমাদের জন্য অপূর্ব সব বই লিখে চলেছেন, ডিজাইনও করেছেন বইগুলোর নিজে নিজেই,

11146326_462125410603395_7914033405429230694_n

বাংলাদেশের ডাকবিভাগের জন্য বেশ কয়েকটি পাখি ডাক-টিকেটের জন্য আলোকচিত্র দেয়া থেকে শুরু করে ডিজাইন করেছেন কিন্তু মূল কাজটি তিনি করে চলেছেন সবার অলক্ষ্যে তা হচ্ছে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রকৃতির প্রতি উৎসাহিত করে তুলে, তাদের পাখিপ্রেমী এবং গবেষক বানিয়ে।

IMG_9204

ইনাম ভাই যে শুধু আমাদের নিয়ে দেশ-বিদেশের বনে নিয়ে পাখি চেনাচ্ছেন তাইই নয়, প্রায় ২০ বছর ধরে তাঁর বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে উনারই প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতি মাসের আড্ডা, ঠিক যেখানেই জন্ম পর্বতারোহীদের ক্লাব বিএমটিসির এবং বাংলাদেশের এভারেস্ট জয়ের স্বপ্নের।

IMG_2805

আজকের ব্লগে আমি অনেক কথায় লিখতে পারি কারণ জানি ইনাম ভাই সেটা কোনদিনই পড়বেন না, বিশেষ করে গুরু শব্দটা তিনি মোটেও পছন্দ করেন না, কেউ তার ক্ষেত্রে ব্যবহার করুক তা তো নয়ই। তাই-ই তো আমার ২য় ভ্রমণ কাহিনী সংকলন ‘পথ চলাতেই আনন্দ’র উৎসর্গ পত্রে আমি লিখেছি-

পিতৃপত্রিম বন্ধু
এবং
মেরু-মরু-বন-পর্বত- সাগর-হাওড়-নদী--জাদুঘর-গ্রন্থাগার-হ্রদ
উত্তর মেরু থেকে হিমালয় হয়ে বঙ্গোপসাগরের অতল সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড
সবখানের সহ-অভিযাত্রী

ইনাম আল হক

I have known nobody who have so much to give,
Combined with so much generosity in giving it.

IMG_0116

সুস্থ ভাবে মনের আনন্দে শতায়ু হোন ইনাম ভাই। আপনার কাজের মাধ্যমেই আমরা স্বপ্ন দেখি মানুষের মত মানুষ হবার। শুভ জন্মদিন!!

IMG_9200

(ইনাম ভাই সম্পর্কিত আরও বেশ কিছু ব্লগ পাবেন এই লিঙ্কে)


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

“এত বড় বুইড়া ব্যাটা হইছে, দাড় টাও বাইতে জানে না!”

চলুক

কিন্তু মূল কাজটি তিনি করে চলেছেন সবার অলক্ষ্যে তা হচ্ছে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রকৃতির প্রতি উৎসাহিত করে তুলে, তাদের পাখিপ্রেমী এবং গবেষক বানিয়ে।

নিজের কথা বলতে পারি, রাস্তা দিয়ে চলতে-ফিরতে এখন এত পাখি চোখে পড়ে যে অবাক হই! পাখিগুলো আগেও ছিল, হয়ত আরও বেশী করে ছিল, কিন্তু আমার চোখ খুলেছে দেরীতে, আর এই খুলে দেয়ার কাজটি প্রায় একাই করেছে 'পাখিদেরও আছে নাকি মন' বইটি।
'পাখিদেরও আছে নাকি মন' বইটি পড়ে শুধু পাখিদেরই চিনিনি, সঙ্গে একজন অসামান্য মানুষকেও চিনেছি, এত এত হতাশা, বঞ্চনা, অন্ধকারের মাঝেও যিনি প্রাণশক্তি যুগিয়ে যান আলোক রেখা হয়ে!
।।।।।।।
অনিত্র

তারেক অণু এর ছবি

'পাখিদেরও আছে নাকি মন' বাংলা ভাষায় একটি অদ্বিতীয় বই।

অতিথি লেখক এর ছবি

শুভ জন্মদিন ইনাম স্যার। স্যারের সান্নিধ্য না পাওয়ার দুঃখটা থাকছেই। মন খারাপ

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

তারেক অণু এর ছবি

দেখা হবেই, চলে আসেন বার্ড ক্লাবের আড্ডায়

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

তারেক অণু এর ছবি
শান্ত এর ছবি

উনারা বাংলাদেশের গর্ব। শতায়ু হউন।

__________
সুপ্রিয় দেব শান্ত

তারেক অণু এর ছবি

সেটাই আশা করি

স্বপ্নসতী এর ছবি

চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

গুছিয়ে লেখার সাথে মানানসই ছবি গুল মুগ্ধ করে। এত ভালো ছবি কিভাবে তোলেন!
-----------------------
ইচ্ছে মত লিখি
http://icchemotolikhi.blogspot.in/

অনার্য তাপস এর ছবি

তাঁর প্রতি রইলো জন্মদিনের শ্রদ্ধাপূর্ণ শুভেচ্ছা।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।