খুলনার বুনো প্রাণীদের মধ্যে ছিল বাঘ, চিতাবাঘ, গণ্ডার, বুনো মহিষ, বন্য শুকর, বনবিড়াল, হরিণ, সজারু, ভোঁদড় এবং বানর। এই সমস্ত প্রাণীগুলোই সুন্দরবনের দক্ষিণে অধিকাংশ এলাকাতেই দেখা যেত, কিন্তু উত্তরের দিকেই এদের সংখ্যা বেশ কম ছিল। গণ্ডারের দেখা বেশ ভালই মিলত তখন, ১৭২৭ সালে আলেক্সান্ডার হ্যামিল্টন সুন্দরবনে গণ্ডারের প্রাচুর্য সম্পর্কে লিখেছিলেন “ 'গণ্ডারের জিভ' এক বিরল জিনিস কারণ যে কোন শত্রুর পতন ঘটাতে পারলেই সে এমন পরিষ্কার করে চেটে দিত যে হাড়ের উপরে কোন চামড়া আর মাংস থাকত না।” এমনকি ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত মালঞ্চ এবং রায়মঙ্গল নদীর মোহনা পর্যন্ত গণ্ডার আর হরিণে পূর্ণ ছিল, ভূমির সবখানে তাদের পদচিহ্ন দেখা যেত। স্থানীয় শিকারিদের কারণে গণ্ডার এবং বুনো মহিষ উভয়ই প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
বাঘের সংখ্যা এখনো ব্যতিক্রমভাবে উজ্জল, তাদের অনেকে নরখাদক হয়ে আতঙ্ক ছড়াত। ৩০ বছর আগে স্যার জেমস ওয়েস্টল্যান্ডের বিশাল এলাকা জুড়ে ত্রাস ছড়ানো একটা বিশেষ বাঘ সম্পর্কে রিপোর্টে লিখেছিলেন “এমন কোন সপ্তাহ ছিল না যেখানে অন্তত একজন বা দুইজন মানুষ ঐ বাঘের হাতে নিহত হত না। এবং সবাই-ই তার সম্পর্কে জানত। মনে হচ্ছে তার জীবন বেশ আনন্দময়ই ছিল। একদিন সে এক ইংরেজের নৌকায় এসে তার গাড়িচালকদের শিকার করে নিয়ে যাচ্ছিল, ইংরেজটি তার উপর গুলিবর্ষণের সময় বন্ধুকটি বিস্ফোরিত হয়, ফলে বন্দুকধারীই বরং আহত হয়, বাঘটি নিরাপদে চলে যায়। আরও একবার বাঘটি আরেক শিকারির সামনাসামনি হয় যে বাঘটিকে শিকারের জন্য অপেক্ষায় ছিল কিন্তু এইবারও গুলি বাঘটিকে স্পর্শ করতে পারে নি। অবশেষে মোরেলগঞ্জের মিস্টার মোরেল বাঘটিকে শিকার করেন, যে অনেক অপেক্ষার পর একটি লোহার খাঁচায় বাঘটিকে বন্দী করতে সক্ষম হন। গুলিতে অবশ্য বাঘটিকে সামান্যই আহত বলে মনে হচ্ছিল, সে বরং খাঁচাটিকেই বারবার আক্রমণ করতে থাকে ভয়াবহ রোষে, যদিও তার তর্জন-গর্জন দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে আসলে গুলির আঘাত বেশ ভয়ানকই ছিল।”
এই বিশেষ পশুটি, যে কিনা প্রশস্ত নদীতে শিকারের খোঁজে সাঁতরে বেড়ায়, তার ভয়ে জঙ্গলের প্রবেশ করা প্রতিটি মানুষ তটস্থ থাকে। কোন কাঠুরেই বনে প্রবেশ করত না যদি না তাদের সাথে কোন ফকির থাকত, স্থানীয়রা মনে করত এই ফকিরেরা বাঘ এবং অন্য প্রাণীদের উপরে জাদু বিস্তার করতে পারে। কাজ শুরুর আগে সেই ফকির তার দলের সকল কাঠুরেকে একত্র করে, বনের কিনারে একটা জায়গা পরিষ্কার করে কয়েকটি তাবুর মত কুঁড়ে প্রস্তত করত, যেখানে সে নানা ধরনের মূর্তি রাখতো, যাদের উদ্দেশ্যে পূজা দেওয়া হত। সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে সেবারের অভিযানটি বাঘমুক্ত বলে মনে করা হত এবং প্রতি কাঠুরে কাজ শুরু আগে কিছু না কিছু অর্পণ করত, যার মাধ্যমে মনে করা হত সে এবার বনে নিরাপদে কাজ করতে পারবে। যদি এর মাঝেও বাঘ কাউকে তুলে নিয়ে যেত সেই ক্ষেত্রে ফকির চম্পট দিত এবং তখন কাঠুরেরা এই এলাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে পতাকা দিয়ে রাখত অন্যদের সাবধান করার জন্য।
এই এলাকার বন কাটা অনেক বেশি কঠিন ছিল বনের ঘনত্বের কারণে। এমনও প্রায়ই হত যে শিকারি বুঝতে পারত ঘন বনের আড়ালে কোন না কোন বাঘ উল্টো তাকে অনুসরণ করছে। সুন্দরবনে ১৯০৫-০৬ সালে অন্তত ১০১ জন মানুষ এবং ১৯০৬-০৭ সালে ৮৩ জন মানুষ বাঘের শিকার হয়েছিল। শিকার হওয়া মানুষের সংখ্যা কমাতে সরকার পশুর নদীর পূর্বের দিকে প্রতিটি বাঘ মারতে পারলে ৫০ টাকা এবং নদীর পশ্চিমের প্রতিটি বাঘের জন্য ১০০ টাকা করে পুরষ্কার ঘোষণা করেছিল।
মানুষখেকো বাঘের এত প্রাচুর্যের কারণ হিসেবে বর্তমান সহকারী বন সংরক্ষক স্যার হেনরি ফ্যারিংটন, যিনি আগে সুন্দরবনের দায়িত্বে ছিলেন, লিখেছিলেন- “এর কারণ সম্ভবত স্থানীয় শিকারিদের গুলি, তারা যে বারুদ ব্যবহার করত তাতে বাঘ মরার বদলে আহত এবং বিরক্ত হত বেশি। এবং স্থানীয়দের বিপুল সংখ্যক হরিণ শিকারও যে বাঘকে মানুষ আক্রমণ করতে বাধ্য করেছে তাতে সন্দেহ নেই, কারণ বনে যথেষ্ট সংখ্যক চিত্রল হরিণ থাকলে বাঘ কোন না কোন ভাবে নিজের খাবার ঠিকই জোগাড় করে নিত এবং তা মানুষের সাথে সংঘর্ষে না যেয়ে। এমনকি নরখাদকে পরিণত হওয়া বাঘও কম ক্ষতিকর হত যদি সেখানে প্রচুর হরিণ থাকত। এবং একটা ব্যাপার কৌতূহল জাগাবার মত যে, যে সমস্ত জনপদে স্থানীয় শিকারিদের আনাগোনা বেশি সেখানেই নরখাদক বাঘের দৌরাত্ম সবচেয়ে বেশি।” প্রমাণসহ এই যুক্তিগুলো খতিয়ে দেখার পরও বোঝা যায় অন্তত গত দুইশ বছর ধরে সুন্দরবনের নরখাদক বাঘের কথা মানুষ জানে।
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে বার্নিয়ার (Bernier) এই প্রসঙ্গে লিখেছিলেন “এই ভূ-খণ্ডের অনেক জায়গাতেই নামা খুব ঝুঁকিপূর্ণ, নৌকা নিয়ে বনে প্রবেশ করলে খুব বেশি খেয়াল রাখা উচিত যে রাতে যেন নৌকাটি একটি গাছের সাথে বাঁধা হয় এবং তীর থেকে কিছুটা দূরে যেন অবস্থান করে, কারণ প্রায়ই কেউ না কেউ এভাবে বাঘের শিকার হয়। এই হিংস্র প্রাণীরা নৌকায় চুপিসারে প্রবেশ করতে অতি দক্ষ, যখন সবাই ঘুমিয়ে থাকে, এরা তার মাঝ থেকে শিকার তুলে নিয়ে যেতে পারে!সাধারণত তাদের শিকারে পরিণত হয় স্থানীয় মাঝি, যে কিনা দলের সবচেয়ে স্থূলকায় ব্যক্তি।” উল্লেখযোগ্য যে সুন্দরবনে বাঘকে ‘শেয়াল’ বলে।
সুন্দরবন এবং আশেপাশে নতুন গড়ে ওঠা মানববসতির চারপাশের জঙ্গলে চিতাবাঘের সংখ্যাও প্রচুর, তারা সাধারণত গবাদিপশু এবং অন্যান্য প্রাণী শিকার করে বেঁচে থাকে। সম্প্রতি খুলনা শহরের প্রান্তে একটি চিতাবাঘ দর্শন দিয়েছিল, এবং একটি তিন পা–ওয়ালা গরু মারতে সক্ষম হবার পর মানুষেরা তাকে তাড়িয়ে দেয়। বন্য শুকরের প্রাচুর্য অনেক এবং তারা শস্যের প্রভুত ক্ষতিসাধন করে। হরিণেরাও নভেম্বর এবং ডিসেম্বর মাসে ধান পুরোপুরি পাকার আগে বেশ ক্ষতিসাধন করে যাদের মধ্যে আছে চিত্রল হরিণ, মায়া হরিণ এবং প্যারা হরিণ, যদিও চিত্রল হরিণের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
সুন্দরবন এবং এই অঞ্চলের বড় বড় জলাভূমিগুলোতে যে সমস্ত পাখি দেখা যায় তাদের মধ্যে নানা জাতের রাজহাঁস, হাঁস, সারস, বনমুরগি, কাদাখোঁচা পাখি, বাতাই এবং জলচর পাখি। এছাড়া উল্লেখ করার মত পাখি হচ্ছে দুই জাতের মদনটাক, নানা জাতের ঈগল, শকুন্, চিল, বাজ, প্যাঁচা, ঘুঘু, টিয়া, বেনেবৌ, ফুটকি, বাটান, কাঠঠোকরা, বক, বগা, তুলিকা, সৈকতপাখি, ছোট এবং বড় চামচঠুটি, গগনবেড়, মানিকজোড় ইত্যাদি।
নদী এবং জলাভূমিগুলো কুমিরে পূর্ণ ছিল, বিশেষ করে মধুমতি এবং ভৈরব নদীতে, এবং সুন্দরবনে কুমিরের সংখ্যা এটি বেশি ছিল যে বাঁশ বা কাঠ ঘেরা জায়গা ছাড়া কোথাওই গোসল করা নিরাপদ ছিল না। যদিও এই সাবধানতা প্রায়শই কোন কাজে দিত না। রাতের বেলা কুমিরের স্থলভাগে প্রবেশ করে আক্রমণের অনেক ঘটনা সকলের মুখে মুখে ফিরত। সকালের সাধারণত কোন হতভাগ্য মহিলার করুন পরিণতি জানা যেত মাটির উপর টানা-হ্যাচড়ার দাগ দেখে। অনেক বছর আগে একদল দাগি আসামিকে আরও দূরের কারাগারে পাঠাবার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে সাক্ষাতের জন্য রাখ হয়েছিল। কারাগারের রক্ষি দিয়ে সেই ৫০ বন্দীকে নদীর ধারে সারা বেঁধে দাড় করানো হয়েছিল কিছু পরীক্ষার জন্য, এই সময় নদীতে থেকে একটি কুমির উঠে এসে এক আসামির পা ধরে মুহূর্তের মধ্যে কেউ সাহায্য করার আগেই নদীর গভীর টেনে নিয়ে যায়। বড় খালের হাঙরও খুব দুর্লভ কিছু ছিল না।
নদী এবং প্রায় সকল জলাশয়েই মাছের প্রাচুর্য ছিল। সবচেয়ে বেশি যে দামি মাছগুলো ধরা পড়ে তারা হচ্ছে নানা ধরনের Mugli, Polynemus এবং বিখ্যাত ভেটকি। সুস্বাদু তোপসে পাওয়া যায় পশুর নদীতে এবং মধুমতীতে ইলিশ। সত্যি বলতে সুন্দরবনই সমস্ত বাংলায় মৎস্য সম্পদে সবচেয়ে সম্পদশালী অঞ্চল, যার জন্যই খুলনা শহরের মাছের সরবরাহ কোনদিনই ব্যহত হয় না। যদিও ভিতরের নানা নদীতে মাছ পাওয়া যায়, কিন্তু নানা কারণে খালের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বিশেষ করে গঙ্গার পানি বেড়ে যাওয়ায় প্রায়ই মাছের সরবরাহ কমে যায়। এখন সেখানে নিয়মিত জোয়ার-ভাটা হয় এবং পানি সবসময়ই ঈষৎ লোনা, যার জন্য কার্প জাতীয় মাছেরা এই জলভাগ ত্যাগ করেছে এর মাঝেই।
বিলগুলোও মাছের রাজ্য। বৃষ্টির সময় অনেক জাতের মাছ এখানে দেখা যায় এবং শুকনো মৌসুমে এদের সবাই আশ্রয় হিসেবে বিলগুলো কাজ করে। তবে প্রচুর জলজ গাছ থাকার জন্য জালের মাধ্যমে মাছ আহরণ করা এখানে সহজসাধ্য কাজ নয়। এই জলভাগের পানি স্থির হবার কারণে কার্প মাছের জীবনের জন্য এই জায়গা খুব একটা সুবিধের নয়, বড় জাতের মাছগুলো সাধারণত নদীর সন্ধানে বিল ত্যাগ করে চলে যায়। কিন্তু কই, মাগুর, শিং ইত্যাদি মাছের জন্য বিলই আদর্শ স্থান। পলি পড়ে নদীর ক্রমশ ভরাট হয়ে যাওয়া এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে কৃষিজমি বাড়তে থাকায় মৎস্যক্ষেত্রের উপরে বিশাল চাপ পড়ছে। বাড়ির পুকুর গুলোতেও বেশ ভাল মাছ পাওয়া যায় কারণ নদীর তীর ছাড়া ভিতরে অন্য কোথাও পুকুর খনন ছাড়া মাটির বাড়ি নির্মাণ সম্ভব নয়, কাজেই পুকুর ছিল সর্বত্র।
(১৯০৮ সালে খুলনার জেলা নিয়ে গ্যাজেটর সংকলন করেন জনাব এল এস এস ওম্যালি, সেখানের Fauna অংশটি এখানে দুর্বল বাংলায় দিলাম। দুষ্প্রাপ্য গ্যাজেটরটি জোগাড় করে দেবার জন্য লেখক-গবেষক মাহবুব সিদ্দিকীকে অনেক ধন্যবাদ। আমরা চাই এভাবেই দেশের প্রতিটি জনপদের হারিয়ে যাওয়া কাহিনী উঠে আসুক নতুন প্রজন্মের কাছে। আপনি কি দায়িত্ব নেবেন যে অঞ্চলে আছেন অন্তত সেখানের গল্প শোনানোর? )
অন্য জেলার বুনোপ্রাণীর ইতিহাস
মন্তব্য
খুলনায় গন্ডার নাই; কিন্তু গন্ডার মারার ইতিসাহ নিয়ে 'গাঁড়ামারা' জায়গটা টিকে আছে এখনো
কোন জেলায়, কোন থানায় গো দাদা?
facebook
দারুণ! টাইম মেশিনে করে ঘুরে এলাম যেন। 'বাঘমারা' নামেরও কিছু যায়গা আছে দেশের অনেক স্থানেই। কত যে গল্প-ইতিহাস লুকিয়ে আছে এসব নামের পিছনে।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
বাগমারা অনেকেইখানেই আছে, তবে ইদানিং মনে হয় তার কয়েকটার পিছনে আছে মেছোবাঘ, বাংলার বাঘ নয়!
facebook
facebook
গণ্ডার তৃণভোজী। সে মরা জানোয়ারের হাড্ডি চাটবে কেন?
খটকা এইখানেই!!!!! জানি না এমন কেন লিখলেন! ইনার মিনিং আছে হয়ত!
facebook
ঠিক কী লিখেছিলেন ভদ্রলোক? একটা স্ক্রিনশট বা ছবি দেওয়া যাবে?
ব্যবস্থা করছি-
facebook
'প্রায়' শব্দটি কিছুটা কনফিউজড করল।
ফকির এবং পূজা- বিভ্রমের মত শোনালেও এরকমটা সেসময় হওয়া আসলে বিচিত্র ছিল না, দুই ধর্মের মিশ্রনের এরকম অনেক নমুনা ইতিহাস বইতেই পাওয়া যায়।
সবশেষে অণু ভাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমাদের হারিয়ে যাওয়া জনপদের সমৃদ্ধ ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে দেশকে ভালবাসতে এবং দেশের ঐতিহ্য সংরক্ষনে নিশ্চিতভাবেই উদ্বুদ্ধ করবে।
।।।।।।।
অনিত্র
মূল লেখাটা যখন লেখা হয়েছিলো, তখনও কিছু গণ্ডার আর মহিষ অবশিষ্ট ছিলো।
এখন গেছে গা!
facebook
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
facebook
facebook
যথারীতি অসাধারণ লেখা
নতুন মন্তব্য করুন