লাওয়াছড়ার বনের এক সরু ঝিরির দুই ধারে নিরব বসে আছি আমরা, আমরা বলতে মানবসঙ্গী কেবল বন্ধু সায়েম চৌধুরী যে ৪০ গজ দূরে ঝিরিটি যেখানে বাক নিয়ে বনের গহনে সেধিয়ে গেছে সেই কোণে বসে অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছে এক বিরল পাখির, যার নাম লম্বাঠোঁট-দামা। অত্যন্ত লাজুক আমাদের এই পালকওয়ালা বন্ধুটি, টানা কয়েক ঘণ্টা মূর্তির মত নট নড়নচড়ন অবস্থা থাকলে হয়ত আমাদের কৃপা করে সে বেরোতেও পারে ঝিরির জলের আশেপাশে খাবারের সন্ধানে বা নিছক বনবিহারে, সেই আশাতেই কাক ভোর থেকে ঠাই বসে আছি ঝিরির দুই বাঁকে দুই জন, যাতে অন্য দিকে সে খুনসুটিতে ব্যস্ত থাকলেও যেন নজর না এড়িয়ে যায়।
নিরব আমাদের নিয়ে প্রকৃতির সরবতা যেন বাড়তেই আছে সূর্যের আলো বাড়ার সাথে সাথে। ঝিরির জল বয়ে চলেছেই নিরবিচ্ছিন্ন Moonlight Sonataর মত টুংটাং ধ্বনি তুলে, স্বচ্ছ অগভীর জলের নিচে সোনারঙা মোটা দানার মাটি দেখা যায়, জায়গায় জায়গায় ডাল পাতা পড়ে তৈরি করেছে নানা প্রাকৃতিক স্থাপত্য, পচে গলে গেছে গাছের বাকল, তাতে গাছের ভিতরের ডালের রঙ, শরীরে গজিয়ে ওঠা শ্যাওলার সাথে মিলে তৈরি করেছে বাঙময় ক্যানভাস।
টুকরো টুকরো ভাঁট ফুলের মত ফুলকি দেওয়া রাতের আকাশের তারারা যেন দল বেঁধে বিশ্রাম নিচ্ছে ঝিরির জলে এবং কাঁদায়, আলগা অবহেলায় আলগোছে ঘুমের মাঝেই যেন দুলে দুলে অবস্থান পরিবর্তন করছে এই সফেদ বিস্ময়েরা, ঠিক যেমন করে ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর আকাশের অনন্ত নক্ষত্রবীথি। নানা জাতের পাখির কলকাকলি জানান দিচ্ছে বনের সরব আত্মার অস্তিত্বের, গোটা দুই অ্যাবটের-ছাতারে পাশ দিয়েই উড়ে গেল রঙধনু আবিরের স্মৃতি ছড়িয়ে।
ঝিরিতে এক চলমান ছায়া দেখেই ভীষণ চমকে উপর দিকে নজর দিলাম কোন শিকারি পাখি দেখায় আশায়, তার বদলে চোখে পড়ল বাতাসে খসে পড়ে একটা বড়সড় পাতা, লাল-খয়েরি বিস্ময়টি কেমন যেন দুলে ঘুরে ভাসতে ভাসতে তার ছায়াটির উপরে নোঙর করল কয়েক মুহূর্তের মাঝেই কিছু অসীম ভাল লাগার মুহূর্তের জন্ম দিয়ে, তার পরপরই শুরু হল তরতর করে পল্লব-তরীর জলকেলি।
এদিকে পায়ের কাছেই রগড় শুরু করেছে পিঁপড়ের দল, লম্বা লম্বা পায়ে খাবার সংগ্রহের পর যাত্রা শুরু করেছে ডেরার দিকে, দলছুটদের শায়েস্তা করার জন্য সৈনিক পিঁপড়েদের তদারকি এই দেখার মত দৃশ্য বৈকি। যদিও তা কিছুটা ম্লান করে দিল গোটা দুই প্রজাপতি, সারা পৃথিবীর সমস্ত বিষণ্ণতাকে দূরে ঠেলা উজ্জল রঙ পাখায় নিয়ে সেটাকে সূর্যকিরণে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে। দূর পৃথিবী থেকে ভেসে এল মায়া হরিণের ঘেউ ঘেউ শব্দ, মাঝারি আকৃতির জন্তু ছুটে গেল বনের মাঝে দিয়ে তার পরপরই, ভাবলাম বুনোশুয়োরই হবে নিশ্চয়ই। এই তল্লাটের স্থায়ী বাসিন্দা উল্লুকেরা তখনো গলা সাধা শুরু করে নি।
বাংলার এক নির্জন বনের চলমান ঝিরির এই রূপ যে দেখেনি, পৃথিবীর আধখানা মুখই তার এখনো অজানা।
আমরা সাক্ষী হয়ে থাকি এই নিরবতার মাঝেও চলমান সরব কাব্যগাথার।
মন্তব্য
আপনি ইদানিং এতো কম লেখেন কেন?
হরিণ যে ঘেউ ঘেউ করে ডাকে তা জানতাম না।
ঘেউ করে বলেই তো ইংরেজি নাম বার্কিং ডিয়ার। লিখতে চাই প্রতিদিন, কিন্তু যে সমস্ত জায়গায় থাকি সেখানে ল্যাপ্টপে চার্জ দিতে পারি না বলেই যত সমস্যা।
facebook
ইংরেজি নামও জানতাম না!
ডাইরিতে লিখেন তাহলে। পরে সময় বুঝে টাইপ করে বা কাউকে দিয়ে করিয়ে নিয়েন।
সমাজে আপনার লেখার একটা আলাদা গুরুত্ব আছে; এই ব্যাপারটাতে নিশ্চয়ই আরো অনেকে একমত হবে। আমি আরকি আপনাকে জানাইলাম। (এই অংশের উত্তরে বিনয় দেখানোর প্রয়োজন নাই )।
অনেকদিন পর লিখলেন ভাইয়া। বরাবরের মতোই মচমচা।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
দেখি যদি আরেকটু নিয়মিত লিখতে পারি। ধন্যবাদ
facebook
ছবি কই?
বর্ণনাটা মনে লাগলো অনেক।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
ছবি দিলাম না, মনের পর্দায় ফুটে থাকুক বরং সেটা
facebook
বর্ণনাটা দারুণ! মাঝেমধ্যে এমন ছবিছাড়া পোস্টই দিয়েন। কল্পনায় দেখার সুযোগ থাকে।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
চেষ্টা করব, শুভেচ্ছা
facebook
বাহ! আমিও এবছর জানুয়ারীতে লাউয়াছড়া ঘুরে এসেছি। ছিলাম ঐ রাস্তাতেই আরও কিছু দূরে - কেরামতনগরে। এটাও মচৎকার জায়গা - লাউয়াছড়ারই একরকম এক্সটেনশন। বন-লেক-টিলা-বুনো পশুপাখি - হরিন-বানর-শুকর-শেয়াল সবই আছে। দুইবার বুনো শুকরের সামনে পড়েছিলাম - আমার এক সঙ্গী দোয়া-কালাম পড়তে পড়তে অস্থির। শুকর দেখলে নাকি পড়তে হয়। আরেকবার ইয়া মোটা মোটা লেজ খাড়া করে কি যেন একদল ল-ম্বা সারি বেঁধে কুচকাওয়াজ করতে করতে যাচ্ছিল সামনে পাহাড়ের খাঁজ ধরে। সন্ধ্যার ঝাপসা আঁধারে বুঝিনি শেয়াল না নেকড়ে। এখানে কি নেকড়ে আছে? রাতের বেলা কত রকমের ডাক - আমি অবশ্য বেশির ভাগই চিনিনা। আরও কিছু দূরে মাধবপুর লেক আর তাকে ঘেরা পাহাড়-টিলাগুলিও চমৎকার। খাসিয়াদের ছবির মতো সাজানো পল্লী "কালিঞ্চি পুঞ্জি"-টাও দারুন লেগেছে - পাহাড় পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠার পথে বনটাও দারুন। হাম হামের পথে 'কলাবাগান' (?) ছাড়িয়ে অল্প কিছুটা গিয়েছিলাম। এটাও দারুন লেগেছে। এই পুরো অঞ্চলটাই দারুন লাগে।
বাংলার চিপাচুপায় এমন কত নির্জন নিরব সৌন্দর্য্য আর সরব কিন্তু অশ্রুত কাব্যগাথা লুকিয়ে আছে, সেকথাই ভাবি। প্রার্থণা করি এসব যেন আমরা শেষ করে না ফেলি।
****************************************
অবস্থা খারাপ, খুব বেশি খারাপ
facebook
শুনেছি সিলেট অঞ্চলের টিলাফিলা কেটে সমান করে নাকি সমানে বাড়িঘর তৈরি হচ্ছে?
****************************************
চট্টগ্রামেও-
facebook
আপনার "অনু" নামের সাথে বিবরণীর দারূন প্রভাবিত। ছবি থাকলেও কল্পনায় ক্যানভাস তৈরীতে একটুও সমস্যা হচ্ছে না।
এ্যানি মাসুদ
facebook
কবিতা লেখা শুরু করলেন ক্যান? ছবি কই? বর্ণনা কই?
মস্করা কইরেন না তো দাদা
facebook
গাথাকার যে, সে-তো কবিই! মস্করা হবে কেন?
****************************************
এতোদিন কুথায় ছিলেন, হে?
..................................................................
#Banshibir.
বনে পাহাড়ে হাওড়ে-
facebook
সাক্ষী থাকা চলতে থাকুক।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
facebook
প্রকৃতির মধ্যে থেকে একটা খসে পড়া পাতার মত লেখাটা দুলতে দুলতেই চোখের সামনে, কি বলতে চায়? এসব ভাবতে ভাবতেই একটা অন্যরকম অনুভব দিয়ে শেষ। কোন বিল, হাওর, জঙ্গল থেকে উড়ে আসা কিসের এই দীর্ঘশ্বাস? ভাই লিখছেননা অনেক দিন, জঙ্গল থেকে হলেও লিখেন।
সোহেল ইমাম
জঙ্গলে কম্পুতে চার্জ পাবো কোথায়?
facebook
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
facebook
লেখাটা পরছিলাম আর চমৎকার কিছু ছবি দেখার মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। লেখা শেষ হয়ে গেল, কিন্তু ছবি আর এলো না। ভাল করে আবার খুঁজে দেখলাম লেখার মধ্যেই রয়ে গেছে ছবিগুলো! চমৎকার!
ধন্যবাদ
facebook
ছোট কিন্তু বেশ লেখা, বরাবরের মতোই।
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
facebook
ছবি চাই
ছবি চাই
-আকাশ মামুন
সব কিছুর ছবি তুলতে নেই
facebook
সুন্দর ছবির মতন লেখা। মনে পিপাসা তৈরী করে। আশা করি ঘন ঘন আরও অনেক লেখা পাবো এমন। ভালো থাকবেন।
চেষ্টা করব, শুভেচ্ছা
facebook
নতুন মন্তব্য করুন