ঘন পাহাড়ি বনের মাঝে চলে গেছে পিচ ঢালা রাস্তা। এমনটা বোধ হয় সারা দেশে একমাত্র বারৈইয়ারঢালা বনেই আছে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের অদূরেই অবস্থিত এই বনের মধুখাইয়া ট্রেলে শুরু হয়েছে পিচ ঢালা পাহাড়ি রাস্তা, জানা গেল এককালে দূরের হাজারিখিল পর্যন্ত সংযোগ রক্ষা করতে সেটি, তারপর কালপরিক্রমায় পাহাড়ি ঢল এবং নানা কারণে রাস্তাটি জায়গায় জায়গায় ভেঙ্গে অকেজো হয়ে পড়ে, এবং মানুষের মন ও সড়ক বিভাগের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যায়।
কিন্তু বন বিভাগের লোকেরা এবং সেই সাথে আমাদের মত ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো পাখিপ্রেমিরা ঠিকই জানে এই রাস্তার হদিস, যার উচ্চতম স্থানে দাঁড়ালে দূর সমুদ্রে অতিকায় মাছের পেটির মত সন্দ্বীপ দেখা যায়, আর দুপারেই গাছে ও ঝোপে যে কোন সময় দেখা মিলতে পারে বিরল কোন পাখির আর পাহাড়ের পাথুরে চাতালে দেখা মেলে দুর্লভ বুনোছাগলের।
ঝরা পাতা বিছিয়ে রয়েছে সমস্ত বনতল, হাঁটার সময় মচমচ শব্দে বোঝা যাচ্ছে শীতের বাতাসের রেখে যাওয়া তান্ডবের লীলাখেলা। কিন্তু বসন্ত এসে গেছে, এখন সময় গাছেদের নতুন পোশাক পরবার। বনের পাখি পর্যবেক্ষণ এবং গণনার একটি অংশ হিসেবে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের দুই সদস্যের দলের (সায়েম চৌধুরী এবং আমি) সঙ্গে যোগ দিয়েছেন স্থানীয় বন বিভাগের কর্মকর্তা এবং ক্রেল অফিসের কর্মকর্তা।
পিচ ঢালা রাস্তায় প্রথম বাক ঘুরতেই মনে হল নিচের এক ঝোপে অল্প আগুন লেগে গেছে, সেই আগুনে সোনালি-লাল ফুলকি আবার স্থান পরিবর্তন করছে প্রতি মুহূর্তে। তারপর দেখা গেল আসলে ঝোপে মাঝে খুনসুটি করছে বনমোরগ আর মুরগী! শেষ বিকেলের রোদে বনমোরগের উজ্জল চকচকে পালক যেন আসলেই পরিণত হয়েছে প্রজ্জলিত অগ্নিশিখায়। অনেক দূরে বিধায় ছবি তোলায় সুবিধার হল না, প্রেমঘন জুটিকে তাঁদের মত থাকতে দিয়ে চড়াই পেরোতে থাকলাম সবাই নিবিষ্ট মনে।
দারুণ লাল ফুল ফুটেছে কয়েকটা গাছে, তার মাঝেই মধু খেয়ে বেড়াচ্ছে হরেক জাতের পাখি, বিশেষ করে বড়মালা-পেঙ্গাদের ডালে ঝুলে ঝুলে মধুর সন্ধানে আক্রোবেটিক কসরত দেখার মত। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল লাল লাল ফুলের মাঝে যেন বিশাল হলদে-সাদা পাপড়ির ফুলেরা উড়ে বেড়াচ্ছে। ছিল বেগুনী-মৌচুষী, হলদে পালক-কালো মাথার কালামাথা-বেনেবৌ।
পাতার নিচের মর্মর শুনে দেখি অতি সন্তর্পণে আত্নগোপনে যাবার চেষ্টারত গিরগিটি জাতীয় প্রাণী স্কিঙ্ক। চার পা বাকিয়ে, লেজ নাড়িয়ে যেন পারলে মাটির ভিতরেই সেঁধিয়ে যেত। কারণ আছে অবশ্য, খানিক আগেই এক তরুণ তিলা-নাগঈগলকে দেখেছিল তীক্ষ চোখে শিকার খুঁজতে।
মাটি ফুঁড়ে উঠেছে বিঘত খানেক লম্বা মোলায়েম সবুজ রঙের উদ্ভিদ, তার মাথায় আবার গোলাপি রঙের ফুলের মুকুট। গাছ চিনতে না পারার দুঃখ আজও গেল না, অচিরেই ঘুচে যাবে তেমন লক্ষণও দেখছি না, তবে বনে আসলেই সেই দুঃখ প্রকট থেকে প্রকটতর হয়।
পাহাড়ের কিনার ঘেঁষে বেশ একটা পায়ে চলা পথ তৈরি হয়ে গেছে, বোঝা যায় মানবসন্তানদের আনাগোনা ভালই আছে, আর দুই ঢালেই নেমে গেছে নানা জাতের গাছ, মিলেছে নিচের উপত্যকার কিনারে।
এমন এক ঢালে সন্ধ্যার খানিক আগেই দেখা মিলল এক ঝাঁক কালা-মথুরার, একদা অতি সুলভদর্শন এই পাখি এখন শিকারিদের অত্যাচারে বিরল থেকে বিরলতর হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। মুরগী/ফেজ্যান্ট জাতীয় পাখিটির কালো পালকের পুরুষের হারেমে ম্রিয়মান কয়েকটি নারী মথুরা নজরে আসলো খানিকের জন্য। এই সময়ই আমাদের উপর বিরক্ত হয়ে খ্যাঁক খ্যাঁক করে গাছের দাল পরিবর্তন করে বসল কয়েকটি বানর! কী আজব! তাদের অস্তিত্বের খবর যে জানতামই না এইটা বুঝি সহ্য হয় নি শাখামৃগদের।
গোলাপি মেঘের আভা জানিয়ে দিল গোধূলি এসেছে, বাংলাদেশের এমন শান্ত নিরব গোধূলি যে কী ভাল লাগে তা যদি আঁকতে পারতাম গদ্যে-কবিতায়? বন-বিহার আজকের মত সাঙ্গ, এমন সময় সায়েম পথের শেষে মানুষের অযথা প্রয়োজনে গজিয়ে ওঠা এক পানবরজের বাঁশের চালে বসে থাকে ক্ষুদে এক পাখির দিকে লেন্স তাক করে ছবি তুলে যেতেই থাকল, যতক্ষণই না পর্যন্ত একজোড়া ঝগড়ুটে বাংলা-বুলবুল যেতে সেই সুদর্শন পাখিটিকে বরজছাড়া করেই ছাড়ল!! চিন্তিত ভাবে ছবিগুলো দেখে, সাথেই গাইড ঘেঁটে পূর্ণিমার চাঁদের উজ্জলতা এক মুখ হাসি দিয়ে চারপাশের বনে ছড়িয়ে সে জানাল সেই ক্ষুদে পাখিটি ছিল অতি বিরল নীলকপালি-গির্দি (Blue-fronted Redstart) এবং যা আমাদের দুইজনেরই লাইফার, অর্থাৎ জীবনে প্রথম দেখা। বাংলাদেশে লাইফার দেখার চেয়ে আনন্দের বিষয় খুব কমই আছে পাখিপ্রেমিদের কাছে।
ধন্যবাদ বারৈইয়ারঢালার বন, দেখি কাল ভোরে আর কী কী চমক রেখেছ আমাদের জন্য।
মন্তব্য
আপনার পোস্টের ছবিগুলো সব সময়েই দারুণ প্রাণবন্ত। অনেকদিন পরে আপনার লেখা পড়লাম। ঘুরাঘুরি, লেখালিখি দুই-ই চলুক।
লেখাও হচ্ছে অনেক দিন পরপর যে
facebook
লেখা শুরুর প্রথম ছবিটা শঠিফুলের দেখে মজা লাগলো। আমার খুব প্রিয় এই ফুল। জংলা ফুল রাস্তার ধারেই হয় তাই আদর নাই। রংপুরে অনেক দেখেছি, রাজশাহীতে নেই তাই দেখেই মজেছি। ভালো লাগলো প্রকৃতির খোলা বাতাসের এক ঝলক আপনার লেখার মধ্যে দিয়ে। নীলকপালিটার ছবিটা উপরি পাওনা।
সোহেল ইমাম
ধন্যবাদ ভাই, আপনার পরের লেখার অপেক্ষায় আছি
facebook
প্রকৃতি কে খুব কাছ থেকে অনুভব করলাম। খুব ভালো লিখেছেন।
- রীনা আচার্য্য
ধন্যবাদ
facebook
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
আসিতেছে-
facebook
প্রীত হইলাম
-আকাশ মামুন
facebook
চমৎকার, চমৎকার।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
শুভেচ্ছা
facebook
......
এ্যানি মাসুদ
facebook
আপনি এর পরেরবার পাখি খুঁজতে এদিকে আসলে আমারে নক কইরেন। এই জায়গাটা দেখে লোভ লাগতেছে যাবার জন্য।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আমাদের হঠাৎ সব প্ল্যান হয় তো, জানানোর চেষ্টা করব-
facebook
নতুন মন্তব্য করুন