চারিদিকে মৃত্যুর চেয়েও হিম এক নীরবতা। বিশাল বিস্তীর্ণ ধবধবে সাদা করাল এক জগতে ডানা মেলে আছে যে শূন্যতা তাকে ভেদ করার সাহস কারো নেই, এমনকি সূর্যের আলোও তা পারে না বছরের অর্ধেক সময় জুড়ে, সেখানে টিমটিমে জীবন এবং প্রদীপ্ত আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রোজনামচা লিখে চলেছেন এক সিংহপুরুষ। এক যুগ ধরে চালিয়ে আসা অভিযানের পর অভিযানের লক্ষ্য অবশেষে পূরণ হয়েছে তাই, কিছুদিন আগেই সঙ্গীদের নিয়ে এক ভয়ংকর বরফ মহাদেশের বিশেষ সেই স্থান, ভৌগোলিক দক্ষিণ মেরু, কুমেরু বিন্দুতে পা রেখেছন তিনি, যদিও সেখানে যাবার পর জানতে পারলেন যে তাদের নরওয়েজিয়ান প্রতিদ্বন্দ্বী রোয়াল্ড অ্যামুন্ডসেন এক মাস আগেই দক্ষিণ মেরু পৌছেছিলেন প্রথম মানুষ হিসেবে। হতাশা নেমে এসেছিল স্কটের দলে, যদিও বা মেরু পৌঁছানো গেল কিন্তু ২য় দল হিসেবে! এখন সামনে আবার সুদীর্ঘ পথ, ফিরতে হবে তাদের জন্য অপেক্ষাকারী জাহাজে। কিন্তু শারীরিক সক্ষমতার শেষটুকুও খরচ করে ফেলেছেন তারা, এর মাঝে শুরু হয়েছে ভয়াবহ তুষারঝড় ব্লিজার্ড। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আচ্ছে মৃত্যুশ্বাপদ। স্কটের দুই সঙ্গী আত্মহত্যা করল এই অসহ্য অবস্থার ইতি টানার জন্য। বাকিদের নিয়ে এগোতে থাকলেন আমাদের ইতিহাসের ট্রাজিক হিরো রবার্ট স্কট, যাকে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর মানুষ অনেক বেশি স্মরণ করবে প্রথম কুমেরু বিজয়ীর চেয়েও। আশ্রয় শিবির থেকে কয়েক মাইল দূরে বাকি দুই সঙ্গী চলে গেলেন মরণসাগর পাড়ি দিয়ে। যোগ্য নেতার মত স্কট চাইলেন অকুতোভয় সঙ্গীদের কথা, অজানা ছোঁয়ার বুক ভরা আবেগের কথা, রক্তে আগুন ধরানো অ্যাডভেঞ্চারের উত্তাল নেশার কথা সারা বিশ্বকে জানিয়ে যেতে। বহু বছরের রোজনামচা লেখার অভ্যাস তাঁর, মেরু অভিযানে এসে তাতে সাময়িক বিরতি ঘটলেও ভাটা পড়ে নি।
লিখলেন তিনি মৃত্যুর শীতল স্পর্শকে অবহেলায় অগ্রাহ্য করে ‘and the end cannot be far,, আমার কোন ক্ষোভ নেই, জেনেশুনেই আমরা এইসব ঝুকি নিয়েছিলাম। একমাত্র ভাগ্যের কাছে নতিস্বীকার করা ছাড়া কারো বিরুদ্ধে কোন অভিযোগও নেই।’ আঙ্গুলের জোর শেষ হয়ে আসছে, ঘোলাটে হয়ে আসছে চাহনি, অনেক কষ্টে ঘষে ঘষে লিখলেন আধুনিক জগতের ট্রাজিক হিরো ‘It seems a pity, but I do not think I can write more. R. SCOTT’.
আজ ২৯ মার্চ ২০১৬, স্কটের মৃত্যুর ১০৪ বছর পর এক মেঘলা সকালে তার রোজনামচা পড়ছি আলগোছে, ভাবতে ইচ্ছে করছে কী চলছিল অকুতোভয় চির রোমান্টিক মানুষটির মনে। মায়ের কাছে তার লেখা শেষ চিঠির আবেদন ছুঁয়ে যায় প্রবল আবেগে, বুকের কাছে দলা পাকিয়ে ওঠে কষ্ট। স্ত্রীকে অনুরোধ করেছিলেন একমাত্র সন্তানটিকে যেন প্রকৃতি নিয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়, যার ফলশ্রুতিতে আমরা পেয়েছিলাম প্রাতঃস্মরণীয় প্রকৃতিবিদ পিটার স্কটকে (WWF-এর প্রতিষ্ঠাতা।), সেই প্রজ্ঞার জন্য তাকে ধন্যবাদ দিই। কিন্তু মন থেকে কিছুতেই মুছে যায় না প্রবল ঠাণ্ডা বাতাসে যখন মুখের চামড়া ছিড়েখুঁড়ে ফেলছে, মৃত্যু থেকে এক চুল দূরে বসে কিভাবে একজন মানুষ দাতে দাতে চেপে লিখে যাচ্ছেন এক সফল মানুষের জীবনগাঁথা। সব থেমে যায়, সব মুছে যায়, কিন্তু এমন কীর্তি অম্লান।
স্যালুট স্কট, তোমার জীবন দান আমাদের আজও উদ্দীপ্ত করে অজানার মুখোমুখি হতে, বুড়ো পৃথিবীর সমস্ত অলিগলি খুঁড়ে সকল রহস্যের সন্ধান পেতে, আর একটাই যে ক্ষুদ্র জীবন তাতে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে।
মন্তব্য
আরও একবার অনুপ্রানিত হলাম , পৃথিবীটা কে জানবার জন্য । বিনম্র শ্রদ্ধা।
শুভেচ্ছা
facebook
কিছু মৃত্যু দুরন্ত জীবনের গল্প বলে। হার না মানুষ গুলোই বলতে পারে
স্কটের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশের হার না মানা মানুষ গুলোর প্রতিও শ্রদ্ধা।
সোহেল ইমাম
facebook
ক্লাস ফাইভে প্রথম পড়েছিলাম স্কটের মেরু অভিযাত্রার কথা, আবারও মনে করিয়ে দিলেন, ভালো লাগলো লেখাটি পড়ে
গুডরিডস
হু, স্কুল জীবনের হিরো
facebook
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নতুন মন্তব্য করুন