পচা এক গাছের গুঁড়ি পড়ে আছে আলগোছে। তার যেদিকটা সূর্যের আলোর নিয়মিত পরশ পায় সেই অর্ধেকে ঘন সবুজ নরম শ্যাওলার রাজত্ব, কিনারের দিকে সবুজ থেকে হলুদে পরিণত হয়েছে তারা। গুড়ির এক দিকে জল-বাতাসের নিয়মিত আক্রমণে খসে খসে পড়েছে ছাল-বাকল, সেখানে আবার নব প্রাণে গজিয়ে উঠেছে বর্ণিল সব ফাঙ্গাস। ব্যাঙের ছাতার সৈন্যরা উঁকি দিয়েছে জায়গায় জায়গায়, আর এক খোঁড়লের জলে দেখলাম ব্যাঙাচির দল।
যে মরা কাঠ দেখলে ইট-কাঠ-পাথরের মাঝে বড় হওয়া আপনি কোনদিন দুইবার তাকাতেন না, এখানে এক চিলতে অবারিত প্রকৃতির মাঝে একটি মরা গাছের পরিত্যক্ত গুঁড়িতে জীবনের এত রূপে সৃষ্টি সুখের উল্লাস দেখে ভাববেন আর কী কী বিস্ময় ছড়িয়ে আছে চারপাশে।
বান্দরবানের দুধপুকুরিয়া-ধোপাছড়ি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের ধোপাছড়ি বিটের একাধিক ট্রেইলে আমাদের যাওয়া হয় বেশ নিয়মিত বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের পক্ষ থেকে বনের পাখি পর্যবেক্ষণ এবং গণনার জন্য। সেখানেই প্রথম প্রবেশ করেছিলাম নারনিয়ার মত এই অবাক ক্যানিয়নে। পাহাড়ি ঝিরি ধরে এগোতে এগোতে বিশাল সব গাছ আর রঙিন সব পাখিদের ভুবনে।
দুই দিকে পৃথিবীতে আটকা পড়েছে উচুনিচু টিলার নিয়মিত বাঁক খাওয়া সমান্তরাল ধারায়। একাধিক মাইল হাঁটার পর ঠা ঠা রোদ্দুরের মাঝে আরামদায়ক আঁধারের ছোঁয়া শরীরে লাগতেই কিছুটা চমকে উঠে দেখি দুই দিকে বেশ উঁচু পাথুর মাটির দেয়াল, উপর থেকে জায়গায় জায়গায় বিন্দু বিন্দু জল গড়িয়ে পড়ছে নিয়মিত ধারায়, সবখানেই গজিয়ে উঠেছে গুচ্ছের সব উদ্ভিদের দল, আবার ক্যানিয়নের উপরে দুই দিক থেকে ডাল বাড়িয়ে চাঁদোয়া বানিয়ে দিয়েছে বনস্পতিরা।
এমন এক ডালে বসেই আজ সকালে আচ্ছাসে আমাদের উপর বিরক্তি দেখাল এক পুরুষ উল্লুক। মিশমিশে কালো পুরুষটি তার উল্টো বর্ণের সাদাটে নারীটিকে হয়ত খুনসুটিতে মেতেছিল, ঝিরির জলে আর শুকনো পাতার চাদরে আমাদের পায়ের আওয়াজে বিরক্ত হয়ে হু হু হু ইয়া হুয়া হুঙ্কার ছেড়ে জুল জুল করে লম্বা লম্বা হাত দিয়ে ডালে ঝুলে তাকিয়ে রইল আমাদের দিকে, নারী উল্লুকটি চলে গেলে পাতার আড়ালে। একাধিক বন্ধুর কাছে শুনেছি বেশি বিরক্ত হলে উল্লুকপ্রবর নিজের হাতের তালুতে পায়খানা করে সেই মহামূল্যবান বস্তুতি গোলার মত মানুষের দিকে ছুঁড়ে মারে! সেই আশঙ্কায় নয়, বরং তাদের একা থাকতে দেবার মানসেই ছবি তোলায় ক্ষান্ত দিয়ে চললাম অপর দিকে।
জায়গায় জায়গায় জল জমে পুলের মত তৈরি হয়েছে, কোথাও ব্যাঙ ডিম ছাড়ে, কোথাও বা মশা, সেই সাথে আছে ক্ষুদে ক্ষুদে মাছ। বুনো ফুল ঝরে পড়ে অপার্থিব সব রঙ তৈরি করেছে প্যাঁচপ্যাঁচে কাদাতে, যার জন্ম যেন এ ভুবনে নয়, বরং রংধনুর অপর প্রান্তের দেশে। এক জায়গায় আলতো পড়ে থাকে নীল নীল ছোঁয়া দেখে ভেবেছিলাম খানিক আগেই যে একজোড়া নীলপরি পাখিকে স্নান করতে দেখেছিলাম তাদের পালকের নীলই লেগে গেল কিনা আমাদের জন্য শুভেচ্ছা স্বরূপ কে জানে!
অতি সুদর্শন পাখি লালমাথা-কুচকুচি ডেকে ওঠে জমাট নীরবতাকে চিরে, গাছের গুড়ির উপরে আমরা বসে পড়ি সে লাজুক প্রাণকে দেখার আশায়। ফিসফিস করে আমি বলে পাশে বসা বন্ধু সায়েমকে, ‘Each timei visit here, I have a feeling that there is a big surprise waiting in this canyon’ চোখে স্বপ্ন নিয়ে সায়েম বলে উঠে ‘May be someday we,ll see a Clouded Leopard here ’। অসম্ভব নয় এই নির্জনতায় একটি আমচিতা বা মেঘবরণ চিতাকে দেখার জাদুদৃশ্য বাস্তবে রূপ নেওয়া।
আস্তে আস্তে পা টিপে এগোয়ে নীরবতাকে সযত্নে জিইয়ে রেখে, সরু এক গাছের ডালে দেখি গায়ক পাখি শামা জুটি তুমুল সঙ্গমে লিপ্ত, তার কয়েক মুহূর্ত পরেই পুরুষ শামাটি উড়ে অন্য ডালে বসে এতই বিভোর হয়ে উপর পানে তাকিয়ে রইল যে আমরা যে তার লেজের ডগায় দাড়িয়ে ছবি তুলছি সেটাকে পাত্তাই দিল না। আজকের বনসাথী ওমর শাহাদত বলে উঠল ‘যে কাজ করে আসছে বেশি ক্লান্ত মনে হয়! অথবা আনন্দিত।’
চমকপ্রদ এই বুনো করিডোর, কখন যে কার দেখা মিলবে, কেউ বলতে পারে না। আবার যে চমকগুলো চলতে আছে সবার অলক্ষে সেগুলোর তাৎপর্য আর রঙ জীবনের মতই ঘটনাবহুল। এর মাঝে সপ্তবর্ণা চকচকে পিচ্ছিল ত্বকের সরীসৃপ স্কিঙ্ককে দেখলাম একটা ঝরা পাতা নিচে সেধিয়ে যেতে, যেন তাতে আড়াল করা সম্ভব এর বিচ্ছুরিত অস্তিত্ব। গুবরে পোকা কোন এক হরিণের গোবর নিয়ে গোলা পাকাতে পাকাতে ব্যস্ত, আমাদের দেবার মত সময় তার জীবনে নেই। জানা-অজানা সমস্ত রঙের মিশেল উড়ে চলেছে প্রজাপতির পাখায়।
জীবনের এই মেল্টিং পট থেকে ফেরার পথে দেখলাম একটি ভেঙ্গে পড়া বা কাটা ডাল থেকে অবিরল ধারায় অশ্রু পরে মিশে যাচ্ছে মাটি, জলে, বাতাসে। বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল, সামনের বছরও এমনই জীবনের কোলাহল নিয়ে সরব থাকবেতো জনবহুল বাংলাদেশের নীরব এই কোণটি !
প্রেমিকার স্তনের মোহনীয় দৃঢ়তা হারিয়ে যায় সময়ের ছোবলে, কিন্তু ধোপাছড়ির অবাক ক্যানিয়নের চলমান জীবনের অপেরা চলতে থাকবে হয়ত আরও হাজার বছর, যদি আমরা একটু যত্নবান হই একে রক্ষা করতে। সেটা করতে কোন আলগা পরিকল্পনার দরকার নেই, দরকার শুধু এলাকাটিকে তার মত থাকতে দেবার।
মন্তব্য
চরম উদাস'দা বাংলাদেশে আইল কবে? তাও আবার ভাবীরে লইয়া!
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
আপনার ফাইন হবে! চউ দার ছবিতে তো ওরাং ওটাং!
facebook
হুমম। ক্যান, ৫২ রোল ওরাংওটাং-এর হলে ৫৩ রোল উল্লুকের হতে পারে না? যাউক গা-
এবার ফাইন মাপ? নাকি মোকাররম ভবনে গিয়ে সিইও'র কাছে তোবা কত্তে হপে?
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ওরাং ওটাং মানে কিনা বনের মানুষ, আর চরম উদাস হচ্ছেন মাটির মানুষ, কিন্তু রসে ভরা!
facebook
রস শুনলেই রস+আলো'র কথা মনে পড়ে!
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
বাহ!
দুইটা কথা -
১। ফাঙ্গাস না বলে মাশরুম বললে মনে হয় ব্যাঙের ছাতার উপর জাস্টিস করা হয়। জানেনই তো, ব্যাঙের ছাতাটা ফাঙ্গাসের ফ্রুটিং বডি- মানে মাশরুম।
২। আমাদের মত ট্রপিকাল দেশে যে কী পরিমান জৈববৈচিত্র আছে সেটা কোন শীতপ্রধান দেশে গেলে হাড়ে হাড়ে বোঝা যায়। ব্যাঙ গবেষক সাজিদ আলি যেসব ব্যাঙ নতুন প্রজাতি হিসেবে সনাক্ত করেছেন সেগুলি একেবারেই বাসার পাশের ব্যাঙ। তাইলে এমন অরণে্যর পরিবেশে না জানি কত প্রাণ অসনাক্ত হয়ে পরে আছে! এদেরকে সনাক্ত করা জরুরী।
আশঙ্কা হয় পাহাড়ি ঝিরির অনেক মাছ বিজ্ঞানের কাছে আবিষ্কৃত হবার আগেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
নানা ধরনের প্রাণী বিশেষ করে পতঙ্গদের নিয়ে কাজ সব শুরু হচ্ছে, নিউ টু সায়েন্স পাবার কথা দলে দলে !
facebook
আপনাদের সঙ্গে কি জীবের নমুনা সংগ্রহের জিনিসপত্র সঙ্গে আছে? আপনারা একটা বেশ ইন্টারেষ্টিং জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন, যাদের হাতের কাছে নমুনা। দেশী-বিদেশী গবেষণাদলগুলি, যারা জীব সনাক্ত করতে পারদর্শী, তাদের সাথে যোগাযোগ ঘটানো যায়। আপনাদের কেউ কোন বিশেষধরনের (যেমন মাছ, বা পোকা, বা সরীসৃপ) জীবগুলি সনাক্ত করতে আগ্রহী হলে আমাকে জানাবেন। যিনি গবেষণায় অংশ নেবেন তার বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক প্রকাশনাও হতে পারে।
পোকা, মাছ, সরীসৃপ, উদ্ভিদ ইত্যাদি নিয়ে কয়েকটা গ্রুপ কাজ করছে, আমার খুব ডিটেইল জানা নেয় তাদের সম্পরকে। আপনার প্রস্তাবটা আমার পরিচিতদের জানিয়ে রাখব, আশা করি অন্যরাও দেখবেন এখান থেকে-
facebook
অরণ্যের ঘ্রাণ। আপনি ছাড়া কে এমন করে এনে দেবে।
সোহেল ইমাম
বাবুডাইং চলেন একদিন-
facebook
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
facebook
দ্রোহীর ছবিটা সুন্দর হইছে...
হায় হায়! দ্রোহ কই পাইলেন আবার!
facebook
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
লেখা কুতায়?? কাকার একদিন নিয়ে লেখা দেন-
facebook
'আমার দেখা একজন মাসুম ভাই'- এই শিরোনামে লিখবো ভাবতাছি। লিখলেই বেস্টসেলার!!!
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
ঈমানে? লিইখা ফালান, প্রকাশক খুঁজে বাহির করব আমরাই-
facebook
ছবিগুলান ফাস্ক্লাস!
..................................................................
#Banshibir.
, লেখা নিয়া ছিলা দিলেন নাকি বুঝলাম না
facebook
খামাকা ডরান ক্যান? আরো দশখান পোস্ট ছাড়েন লেখা নিয়া কমেন্ট দিতেছি।
..................................................................
#Banshibir.
প্রতিবার আপনার লেখা পড়ি আর ভাবি, মৃত্যুর আগে এতকিছুর স্বাদ নিয়ে যেতে পারব তো?
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
নতুন মন্তব্য করুন