গনগনে দুরন্ত আবেগ এবং আফসোস নিয়ে লিখে গেছেন তিনি, রাশান জাতিকে নিজেদের নিয়ে এক রোমান্টিক ইমেজে দেখতে শিখিয়েছিলেন তিনি, এবং এখনো তাদের সবচেয়ে প্রিয় কবির নাম- পুশকিন।
কিংবদন্তীর ট্র্যাজিক হিরোদের মতই অ্যালেক্সান্ডার সের্গেইয়েভিচ ১৮৩৭র ২৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায় তাঁর অন্যতম সেরা কবিতা ‘ইউজেন ওনেজিন’ সে এক ভবিষ্যৎদ্রষ্টার ভবিষ্যৎবাণীকে বাস্তবে নিয়ে আসলেন। রাশিয়ার সেরা কবির দেহের গভীরে একটি বুলেট গেঁথে গেল। সেন্ট পিটার্সবার্গের সীমানাতেই এক বরফে জমাট খালের পাড়ে স্ত্রীকে অপমান করার কারণে এক ফরাসী লোকের সাথে তিনি ডুয়েল লড়ছিলেন।
সঙ্গীরা তাকে পাঠকক্ষের সোফায় ধরাধরি করে শুইয়ে রাখলো। টেলিগ্রাফের টরে -টক্কার মাধ্যমে চিকিৎসকেরা ততক্ষণে জানিয়ে দিচ্ছেন যে এই ক্ষতের আড়ালে মৃত্যুই আছে।
রাশিয়ায় নানা ধরনের শাসকেরা আসে এবং যায়, কিন্তু কোন ব্যক্তি, সে দণ্ডমুণ্ডের অধিকর্তা জার হোক বা সেনাপতি , অবশ্যই লেনিনতো নয়ই, পিটার দ্য গ্রেটও নয়, আর কেউই পুশকিনের মতো কালজয়ী অটুট শ্রদ্ধা পায় নাই। ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কোর ( যারা ওপরে শাসকেরা বেশ ক্রুদ্ধই ছিলো) একটা লাইন ধার করে বলা যায়, “ রাশিয়ায় কবিরা শুধু কবি নয়, তারা আরও মহত্তর”। রাশিয়ায় কোন জেফারসন বা লিংকনের মত ফিগার না থাকায় ( এবং কম্যুনিজমের কারণে কোন ঈশ্বরও না থাকায়) কবিরাই হয়ে ওঠেন জাতির শিক্ষক, আত্মার আলোকস্তম্ভ। যার কারণে স্ট্যালিনের আমলে অনেককেই নির্বাসনে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল।
পুশকিনও তো আকণ্ঠ গরল পান করেছেন আজীবন, নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছেন, ডুয়েলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেলেন- যা তাঁর অমরত্বকে একটা দন্ধময় ছাপের মধ্যে রাখে। লেডিকিলার আর পাকা জুয়াড়ির তকমা তাঁর ব্যক্তিত্বকে যেমন বহুমাত্রিক করেছে, তেমনই তাঁর লেখায়ও যোগ করেছে নানা উপাদান।
দেড়শ বছর পরেও মানুষ আনন্দের জন্য পুশকিন পড়ে, পড়ে দৈনন্দিন জীবন থেকে মুক্তিলাভের জন্যও। কম্যুনিস্ট আমলে হাজারো লোক ওনেজিনের ৫৬০০ মূর্ছনাময় ছন্দবদ্ধ লাইনে ভরসার আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিল।
মোটের উপরে, রাশান সংস্কৃতিতে বিনয়ের প্রতিমূর্তি এবং সামান্য অদ্ভুতুড়ে স্বভাবের মিশেলে গড়া মানুষটির চেয়ে মহত্তর কোন ভিত্তিপ্রস্তর নেই, এবং তিনি বেঁচেছিলেন মাত্র ৩৭ বছর।
যদি বর্তমান ডামাডোলের মধ্যে পুশকিন থাকতেন, আমার মনে হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময় তিনি সমস্ত সত্ত্বা ঢেলে ডেমোক্রাটদের পক্ষে কাজ করতেন। আগস্টে যখন সেনাবাহিনীর ট্যাংক প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলেতসিনের প্রাসাদে তোপ দাগার প্রস্ততি নিচ্ছিল, মনে হয় পুশকিন সেখানে থাকলে বেশ করে ভাষণ দিতেন তাদের বিরুদ্ধে।
পরবর্তী জীবনে জারের ব্রজমুষ্ঠির আটুনিতে পুশকিন তাঁর মুক্ত দর্শন প্রকাশ থেকে কিছুটা সরে আসতে বাধ্য হন। যদি তাঁর জীবনীলেখক স্টেলা আব্রামোভিচ মনে করেন পুশকিন জীবনে এক লাইনও লিখেন নি, যা তিনি অন্তর থেকে বিশ্বাস করতেন না। সদ্য কম্যুনিজমের ঘেরাটোপ থেকে বের হওয়া রাশিয়ানদের জন্য এটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ সত্য, তেমনই গুরুত্ববহ তাঁর লেখা প্রতিটি লাইন।
যে ভবনে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, এখনো সেখানে তাঁর স্মরণে রাশিয়ানরা অশ্রুত্যাগ করে। ট্যুর গাইড ওলগা বলে যাচ্ছিল, “ ৪৬ ঘণ্টা তিনি ব্যথায় নীল হয়ে ছিলেন। বন্ধু এবং ডাক্তারেরা তাঁর সাহস ও ধৈর্যশক্তিতে হতবাক হয়ে গেছিল। দরজায় খবর লেখা ছিল “ এর রোগী যেকোন সময় পরপারে যাবে”। এবং যখন ওলগা বলে যে ‘জার নিকোলাস কবি পুশকিনের শেষকৃত্য সেন্ট আইজ্যাকের ক্যাথেড্রালে পালনের অনুমতি দিবে না’, তখন সবাই বিস্ময়ে ঘৃণায় বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।
আহত কবির শেষশয্যায় হাজার হাজার মানুষ যেতেই থাকে, জার প্রথম নিকোলাস ভীত হয়ে ভাবেন জনসম্মুখে কোন শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হলে দেখা গেল তা গণবিদ্রোহে পরিণত হতেও পারে। এই কবিকে যথেষ্ট অত্যাচার করেছে এই জার আর তার গুপ্তপুলিশ বাহিনী যারা তাকে ‘ সকল সংস্থার শত্রু’ বলেই অভিহিত করত। জার পুশকিনের লেখায় সেন্সর চালিয়েছে, পিছনে গুপ্তচর লাগিয়েছে। আর জানা যায় পুশকিনের স্ত্রী নাতালিয়া, যাকে রাশিয়ার শ্রেষ্ঠতম সৌন্দর্য বলা হতো, যার জন্যই পুশকিনের প্রাণঘাতী ডুয়েল অনুষ্ঠিত হয় সেই ফরাসীর সাথে, তার উপরেও জারের কুনজর ছিল।
এই বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি ( গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার মতে) শোনা গেল রাশিয়ান অর্থোডক্স শেষকৃত্যের স্তোত্র মিলিয়ে পুশকিন স্মরণে গান গেয়েছে, সেই সেইন্ট আইজ্যাকে না, কিন্তু সেই সময়ের যা আস্তাবল ছিল যেখানে জার পুশকিনের শেষ যাত্রার যাবতীয় আচার পালনের অনুমতি দিয়েছিল
কম্যুনিস্ট আমলে গির্জাদের আস্তাবলে পরিণত করে, সমস্ত স্মারক খুলে নিয়ে অফিসে পরিণত করা হয়েছিল। অবশেষে গত বছর ব্যুরোক্রাটরা এগুলো হস্তান্তর করে, এবং ১৯২০ সালের পর এই প্রথম পুশকিনকে সঠিক স্থানেই স্মরণ করা হচ্ছিল।
সেন্ট পিটার্সবার্গের এক বাগিচায় নাম না তরুণী আমার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রেখেছিল, ‘ অ্যামেরিকায় পুশকিনের মতো কেউ আছে?, উত্তরে আমার ‘না’ শুনে সে বড়ই দুঃখবোধ করছিল আমাদের জন্য।
কয়জন আমেরিকান লেখক মিলে একজন পুশকিন হয়? অনেকজন!
’সে আমাদের কাছে আসা শুরু করে সেই শৈশবের দোলনার ঝুলন্ত জগত থেকে , মায়েদের মুখে, আমাদের দোলনায় দোলা শুরুই হয় পুশকিনের রূপকথাকে সাথে নিয়ে’। নাট্যকার ভিক্তর লেগেনটভের মতে আমাদের তরুণেরা তাদের হৃদয়েশ্বরীদের উদ্দেশ্যে যে কবিতাগুলি পড়ে, সবই পুশকিনের লেখা। আমাদের জীবনের সব অবস্থায় এই ‘কবি’ জোরালো অবস্থান করেই থাকেন।
পুশকিনের অধিকাংশ রচনাই যেন হাঁসের মোলায়েম পালক দিয়ে আঁকা, যেখান আবার দিপ্যমান প্রখরতার উপস্থিত স্পষ্ট। বিশাল কলেবরের উপন্যাস ‘ইউজেন ওনেজিন’ ছাড়া আছে ঐতিহাসিক নাটক বরিস গদুনভ আর ৭০০র মতো কবিতা। পরবর্তীতে তিনি গদ্যের দিকে ঝুঁকে ‘বেলকিনের গল্প’ লেখা শুরু করেন- এমনকি ইতিহাসও।
তাঁর ক্ষুদে উপন্যাস ‘ ক্যাপ্টেনের কন্যা’ যে কোন ভাষায়ই বেশ সুখপাঠ্য, কিন্তু ঠাসবুনটের অষ্ট বর্ণের লাইন মেনে তাঁর কবিতার সুর ও ছন্দের যথার্থ অনুবাদ করা অতি দুরূহ কাজ। যে কারণে তাঁর কবিতা ইংরেজিতে প্রায় দেখায় যায় না। ভাষা ও কবিতা বিশারদ ডার্টমাউথের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর ওয়াল্টার আর্নট সেই বিরল অনুবাদকের একজন, এই লেখার অধিকাংশ অনুবাদই তাঁর করা।
ইন্দ্রিয়প্রেমী, খিস্তিখেউড়ের আশ্রয়, কৌতুকবোধে পরিপূর্ণ সব দিক থেকেই পুশকিন অতি যথার্থ। তাঁর কাছেই রাশিয়ান ভাষা এক অজানা সুর খুঁজে পেল, এই সমৃদ্ধ ভূমিতেই জন্ম নিল গোগল, দস্তয়েভস্কি, তলস্তয় ও অন্যান্যরা যারা প্রত্যেকেই পুশকিনের রচনা থেকে অনুপ্রাণিত। মুসসোর্গস্কি তাঁর ‘গদুনভ’ থেকে দারুণ রাশান ওপেরা বানিয়ে ফেললেন, চাইকোভস্কি বানালেন ওনেজিন। রাশিয়ায় গ্লিঙ্কা, রিমস্কি-কোর্সাকোভ, র্যাচমানিনফ সহ নানা সুরকারেদের পুশকিনের সৃষ্টি দ্বারা অনুপ্রানিত হয়ে অন্তত ২০টি ব্যালেড, অপেরা ও অন্যান্য কাজ তৈরি করেছেন।
লেনিনগ্রাড নামটিই আমার চিরপরিচিত, কিন্তু গত শীতে দেখা হল Sankt Petersburg এর সাথে, আসলে সেন্ট পিটার্সবার্গের এটাই প্রাচীন নামের বানান, এই নাম তার নগরে আবার ফিরে এল ১৯৯১ সালে। সারি সারি স্তম্ভের সুদৃশ্য ভবনগুলোর অনেকগুলোই দেখা যাবে পুশকিনের চেনা, যদিও তিনি হয়তো এগুলোর জরাজীর্ণতায় কুঁকড়ে যাবেন বেদনায়। যদিও তাঁর জন্ম মস্কোতে ১৭৯৯ সালে, কিন্তু রাজকীয় কলেজে সে যোগদান করেছিল তা ছিল সেন্ট পিটার্সবার্গের এক শহরতলীতে, যে অংশের নাম এখন তাঁর নামেই রাখা হয়েছে ‘পুশকিন’।
রাজধানীতে তিনি হাজার পাঁচেক খানদানি বংশের লোকদের সাথে বড় হবার সাথে সাথে ফরাসী বনে যাচ্ছিলেন। সেই যুগে ফরাসী ভাষা, সাহিত্য এমনকি ফ্রেঞ্চ ওয়াইন ছিল সংস্কৃতির পরাকাষ্ঠা। বাবার গ্রন্থাগারে ভলতেয়ার এবং রুশোকে খুঁজে পাওয়া পুশকিন রাশিয়ার আগেই ফরাসী পড়তে শিখেছিলেন, পরে লিখতে শিখেছিলেন দুই ভাষাতেই।
উঁচু সমাজে কবিতা শখের মতো। কিন্তু আলেক্সান্ডার সের্গেইয়েভিচ পুশকিন ছিল এক দুরন্ত প্রতিভা, লেখা প্রকাশ শুরু হয়েছিল ১৪ বছর বয়সে। অন্যদের মাঝে কোঁকড়া চুল, মুখ, কিছুটা কৃষ্ণবর্ণের ছোঁয়া , চওড়া চোয়ালের জন্যও নজর কাড়তেন তিনি, নিজেকে উল্লেখ করেছিলেন সত্যিকারের এক বনমানুষ হিসেবে।
তাদের পারিবারিক কিংবদন্তী বিশ্বাস করলে জানা যায় পুশকিনের মায়ের দাদা ছিলে আব্রাম নামের এক ইথিওপিয়ান রাজকুমার যাকে তুর্কীরা বন্দি করে এনেছিল। তবে নিদেনপক্ষে সত্যটা হচ্ছে কৈশোরেই আব্রামকে কন্সট্যান্টিনোপল ( ইস্তাম্বুল) থেকে পিটার দ্য গ্রেটের জন্য উপহার হিসেবে নিয়ে আসা হয়। পিটার তাকে শিক্ষাদীক্ষা দেন, এবং আব্রাম জেনারেল পদে উন্নীত হয়। পুশকিন তাঁর কালো চামড়ার পূর্বপুরুষের ব্যাপারে অত্যন্ত গর্ব বোধ করতেন, এবং তাঁর উদ্দাম আবেগের উৎস হিসেবেও সেই পূর্বপুরুষদের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলেন।
১৮১৭ সালে কলেজের শিক্ষা শেষ করে এক সরকার কর্মচারীতে পরিণত হবার দ্বারে পৌঁছান তিনি তখনো তাঁর জুয়া আর অভিনেত্রীদের ব্যাপারে আসক্তি দেখা দেয় নাই। যদিও অকেজো বস্তুর মতই সেন্ট পিটার্সবার্গ নগরীর মধ্য দিয়ে বয়ে চলা যুগসন্ধিক্ষণের বাতাসে ঠিকই পাল তুলে দিলেন। কিছু কিছু খানদানি বংশের লোকেরা মিলে এক সিক্রেট সোসাইটি গঠন করেছিল যার নাম দ্য ইউনিয়ন অফ ওয়েলফেয়ার, যাদের পরিকল্পনা মাফিক একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র কায়েম করে ভূমিদাসপ্রথার বিলোপ করা করা, যাতে রাশিয়ার সাড়ে চার কোটি লোকের অর্ধেকের ভাগ্যই পরিবর্তিত হয়ে যেত।
তরুণ পুশকিন লিবারেলদের সাথেও ঘনিষ্ঠ ছিলেন কিন্তু অতি ঝকঝকে বা অতি প্রগলভ হবার জন্যই কিনা, তাকে গুপ্ত সংবাদগুলো জানানোর মত ভরসা করা হতো না। যদিও অনেকেই তাঁর কবিতা বিশেষ পছন্দ করতো, যেখানে ভূমিদাসত্বের উল্লেখ ছিল , যেমন Liberty থেকে
Oh, kings, you owe your crown and writ
To Law, not nature’s dispensation;
While you stand high above the nation,
The changeless Law stands higher yet.
আজকের রাশিয়ায় এই কবিতাটি যে সর্ব সত্যের প্রতীক। লিবারেল সাংবাদিকরা পুনরায় জেগে ওঠা রাশিয়ার মানবকল্যাণ বোধসম্পন্ন এক সরকারের কথা বলতে গেলে এই লাইনের উদ্ধৃতি দিবেনই । ১৯৩০র দিকে স্ট্যালিনের আমলেও প্রোপাগান্ডা হিসেবে এই শব্দমালা ব্যবহার করা হয়েছিল, এমন ভাবে যাতে মনে হয় যে পুশকিন বেঁচে থাকলে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পক্ষেই ঝাণ্ডা উড়াতেন ।
অন্য অনেক কবিদের মত সহজেই সহজবোধ্য হতেন না। পুশকিনপ্রেমী ইগর নেমিরভস্কি যিনি আমাকে পিটার্সবার্গে কবির স্মৃতি সন্ধানে সঙ্গী হয়েছিলেন, জানালো- ‘পুশকিন ছিলেন ভীষণ জটিল এক মানুষ, এতই সমৃদ্ধ যে তাকে দিয়ে যে কোন কিছুই করিয়ে নেওয়া যেত’।
এখনকার সোভিয়েত পরবর্তী ব্যপক বিক্ষুদ্ধ সময়ে রাজনীতিবিদরা পুশকিনকে তাদের লোক বলেও দেখাতে চাচ্ছেন। গত শীতে এই নগরীতেই এক র্যালিতে কম্যুনিস্টদের পুশকিনের উদ্দেশ্য প্রার্থনা করতে শুনলাম সোভিয়েত দেশকে নতুন করে সাজানোর জন্য। পুশকিন নিজেও সাম্রাজ্য নিয়ে গর্ববোধই করতেন, পোল্যান্ডে ১৮৩০-৩১ এ সংঘটিত এক বিদ্রোহকে দমানোর জন্য রাশানদের নেওয়া নিষ্ঠুর দমননীতি তিনি সমর্থনই করেছিলেন।
রাশিয়ার করা সেন্সরের মধ্যে থাকা জার্নালের জন্য ‘লিবার্টি’ ছিল বড্ড আক্রমণাত্নক, যদিও এর কপি ঠিকই উচ্চ সমাজে হাতে হাতে চলে যায়, এবং অবশ্যম্ভাবী ভাবেই টা যেয়ে পৌঁছায় স্বয়ং জারের হাতে! ফলস্বরূপ দক্ষিণে নির্বাসিত কবি বর্তমানে মলদোভার রাজধানী সিসিনাউ থেকে লিখেন-
As , Kishinev, your thrice-damned town!...
Your guilty roofs of filthy brown
Shall feel the Lord’s wrath crashing down.
যদিও এই তরুণ জিনিয়াস প্রবল ভাবে জয়ী হিসেবেই আবির্ভূত হলেন পিছিয়ে পড়া সেই কালে ও জনপদে।
পুশকিনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ‘রুশলান ও লুদমিলা’ রাশানদের আনন্দে ভাসিয়েছিল । ছন্দবদ্ধ এই লোকগাঁথায় কিংবদন্তীর উপস্থাপন ছিল অভিনব ও সাহসিকতাময় , যা ভরে ছিল জাদুমায়া আর যুদ্ধময় নাইটদের নিয়ে।
সিসিনাউ, সেই সময়ে যার নাম ছিল কিসিনেভ, সেখানে এই নির্বাসিত ২১ বছরের কবিকে দেখা হয়েছিল নজর কাড়ার জন্য হা পিত্যেশ করা এক চাল্লু ছোকরা হিসেবে, যে বয়স্কদের অপমান করে, অদ্ভুত সব পোশাক পরে, মাথায় লাল টুপী এমনকী এক তুর্কী ফেজ টুপিও চাপায় সে।
এবং নিজের সন্মানবোধের ব্যাপারে পুশকিনের ছিল টনটনে জ্ঞান, যা তিনি কবর পর্যন্ত দেখিয়েছিলেন। হাঁটার সময়ে ৯ কেজির লোহার লাঠি হাতে নিয়ে ঝুলাতে ঝুলাতে হাঁটতেন, যদি তাঁর মহান সন্মানকে রক্ষা করতে যে কোন সময় এর প্রয়োজন হয়!
ডুয়েল লড়া বেআইনি হওয়া সত্ত্বেও ফি’বছরই ডজনখানেক ডুয়েল হয়েই যেত। এক ঝড়ো তুষারময় দিনে পুশকিনের সাথে কর্নেল সেমিওন স্ট্রারভের সাথে মুখোমুখি দেখা হয়েই গেল! সেই ঝামেলা শুরু হয়েছিল এক বল নাচের আসরে, স্ট্রারভের অফিসাররা চেয়েছিল একটা যুগলনাচের বাজনা বাজুক, পুশকিন চেয়েছিলেন এক মাজুরকা! ব্যস, অপমানিত কাউকে না কাউকে তো হতেই হলো। তাই সন্তুষ্টির প্রয়োজনও দেখা দিল।
রাশিয়ান নিয়মে প্রতিপক্ষেরা একে অপরের দিকে আগাতে আগাতে যে কোন সময়ই গুলি ছুড়তে পারে। তুষারের কারণে দেখতে না পাওয়ায় দুই জনেরই গুলি মিস হয়ে যায়। তারা আবারও গুলি ভরে একে অপরের উদ্দেশ্যে গুলি ছুঁড়েন এবং আবারও মিস হয়। পুশকিন পরের বারের জন্য প্রস্তত ছিলেন, কিন্তু অন্যরা জানালো যে গুলি ভিজে গেছে, তাই আপাতত ক্ষান্ত দিতে হবে!
কিংবদন্তী বলে এই বদমেজাজি রগচটা মহাকবি অন্তত ৬বার ডুয়েল লড়তে গেছিলেন! কিন্তু কোনবারই স্ট্রারভ ছাড়া কারো উদ্দেশ্যে গুলি ছোড়েন নি, তাঁর বদলে শান্ত ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে প্রতিপক্ষে গুলি বর্ষণের অপেক্ষা করতেন, হয়তো ইচ্ছে করেই কারো খুনি হতে চাইতেন না! একবার তো তিনি বেরি খেয়ে বিচিগুলো থুঃ থুঃ করে সেই জুয়াচোরের উপরে ছিটিয়েছিলেন, যে তাকে তাঁর নাগালের মধ্যে পেয়ে খুনই করতে গেছিল! পুশকিন নিজেকে সাহসী শুনতে পছন্দ করতেন বা হয়তো জীবন-মৃত্যুর কিনারে দাঁড়াবার রোমাঞ্চ উপভোগ করতেন, সবসময়ই।
লেখা- মাইক এডওয়ার্ডস
(ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে ১৯৯২র সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত)
চলবে-
মন্তব্য
পুশকিনের একটা গল্প একসময় অনুবাদ করেছিলাম। সেটার মধ্যেও এইসব ডুয়েল / গোলাগুলি ছিল!
****************************************
বাহ, লিংক আছে? কোথায় প্রকাশ করেছিলেন?
facebook
হাহা -- তখন মনে হয় নেটই ছিল না বাংলাদেশে, লিঙ্ক থাকবে কোত্থেকে! সাপ্তাহিক একটা পত্রিকায়, নব্বইয়ের দশকের কোনো এক সময় বোধহয়। তবে, নেটে সার্চ করতে গিয়ে গল্পটার একটা ইংরেজি অনুবাদ পেয়ে গেলাম এখানেঃ https://www.bartleby.com/195/8.html ।
****************************************
কিশোরবেলায় বিটিভিতে দেখেছিলাম পুশকিনের "ষ্টেশনের ডাকবাবু" নাটকটি। দিনকয়েক একেবারে আপ্লুত হয়ে ছিলাম।
বাংলা অনুবাদে "ক্যাপ্টেন দুহিতা" নামে তার একটা উপন্যাস / উপন্যাসিকাও পাওয়া যায়। অমুবাদক সম্ভবত মোবারক হোসেন খান।
****************************************
১৮৩৭ হবে না?
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
হ্যাঁ, ঠিক করে দিলাম, ধন্যবাদ
facebook
নতুন মন্তব্য করুন