১৩ বছরের অ্যামি সড়ক দুর্ঘটনায় মাকে হারিয়ে নিউজিল্যান্ড থেকে চলে আসে পৃথিবীর অপর প্রান্তে কানাডার অন্টারিওতে তার বাবার সাথে থাকার জন্য। সদ্য মা-হারা বিষণ্ণ কিশোরী কারো সাথেই ঠিকমত আর মানিয়ে চলতে পারে না, নতুন বন্ধুত্বও হয় না কারো সাথে। তার বাবা আবার একজন শখের বৈমানিক ও ভাস্কর। এর মাঝে তাদের বাড়ীর কাছে নির্মাণকর্মীরা একটা ছোট বন ধ্বংস করে ফেলে বুলডোজার দিয়ে গাছ উপরে ফেলে, এবং সেখানে ঘুরতে যেয়ে ছোট্ট অ্যামি ১৬টি রাজহাঁসের ডিম ( Canada Goose) পায়, যেগুলো হাঁসের বাসার গাছটি উপরে ফেলায় যত্রতত্র পড়ে ছিল।
শুরু হয়ে যায় সিনেমার আসল ঘটনা, পরম মমতায় অ্যামি সবগুলো ডিম নিয়ে আসে তাদের মুরগীর খামারের ইনকিউবেটরে। এবং সেগুলো থেকেই ক’দিন পরেই বেরিয়ে আসে তুলতুলে ১৬টি ছানা! ছানারাও পৃথিবীতে এসে একমাত্র প্রাণী হিসেবে অ্যামিকেই দেখেছে, তাদের মস্তিস্কে ইমপ্রিন্ট হয়ে গেছে যে এই মেয়েটিই তাদের বাবা-মা, যা এক সাধারণ প্রাকৃতিক ব্যাপার বুনোহাঁসদের জন্য। কাজেই অ্যামিকে ঘিরেই এখন রাজহাঁসের ছানাদের জগত। এবং তখন পর্যন্ত অ্যামি কাউকেই কিছু বলে নি এই ব্যাপারে, কারণ সে কারো উপরেও ভরসা করতে পারছিল না।
এক পর্যায়ে বাবা জেনে যায় হাঁসছানাগুলোর ব্যাপারে, তখন খামারঘর থেকে নিজেদের বাড়িতেই নিয়ে যান উনারা সবগুলোকেই। মনমরা অ্যামির মাঝে উৎসাহের বান দেখে বাবা মনে মনে ঠিক করেন যে ভাবেই হোক এই হাঁসের ছানাগুলোর সঠিক যত্ন নিবেন তিনি এবং এর ফলেই হয়তো তার মেয়ে স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।
কিন্তু ছানারা বড় হতে হতে দেখা যায় অন্য নানা সমস্যা! একে তো তারা বুনো পাখি , এবং কানাডার মত দেশে বন্যপ্রাণীর ব্যাপারে আইন অত্যন্ত কড়া, তাই পুলিশেরা একাধিকবার ঘুরে যায় তাদের বাড়ি হাঁসের ছানাদের উদ্ধার করার জন্য, পরে নানা কারণে সিদ্ধান্ত হয় আপাতত ছানারা অ্যামির হেফাজতেই থাকবে।
এখন মুশকিল বাঁধল অন্য জায়গায়, শীত প্রধান কানাডায় তো এই রাজহাঁসেরা সারা বছর থাকে না, শীতকালে তারা পরিযায়ন করে পাশের দেশ আমেরিকার দক্ষিণে চলে যায় এবং সেখানে শীতকাল কাটিয়ে ফের প্রজনন ঋতুতে ফিরে আসে কানাডায়। এই পথ পরিক্রমা চলেছে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এবং বাবা-মা হাঁসের সাথে যেতে যেতে রাজহাঁসের ছানারা প্রথমবারেই বুঝে যায় যে কিভাবে পরিযায়ন করতে হয়, পথে কী কী সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়, কিভাবে রাস্তা চিনতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু এই ১৬ রাজহাঁসের ছানার কী হবে? যদি তারা প্রকৃতিতে স্বাভাবিক ভাবে বড় হতে চায়, বংশ বিস্তার করতে চায় তাহলে অবশ্যই পরিযায়ন করতে হবে, কিন্তু তাদের পথে চেনাবে কে সেই হাজার হাজার মাইল দূরের শীতকালীন উষ্ণ অঞ্চলের। আবারও এগিয়ে এলো অ্যামি, জানালো সে আল্ট্রালাইট বিমানে করে উড়াল দিবে সেই দূর গন্তব্যে উদ্দেশ্যে আর রাজহাঁসেরা তাকে অনুসরণ করে ঠিকই উড়ে যাবে সাথে সাথে, সাথে সঙ্গী হিসেবে অবশ্যই বৈমানিক বাবাও থাকবেন। পরিকল্পনা হল তারা আমেরিকার উত্তর ক্যারলিনা অঙ্গরাজ্যের পরিচিত একজনের দায়িত্বে আছে এমন এক পাখিরালয়ে যাবেন ( Bird Sanctuary), কিন্তু সেখানে যেতে হবে ১ নভেম্বরের আগেই, নতুন সেখানেও নির্মাণ কোম্পানি একটা উপকূলীয় ভবন প্রকল্পের কাজ শুরু করবে।
এর মাঝে ক্ষুদের অ্যামির আল্ট্রালাইট চালানো চলতে থাকে, কিন্তু দেখা যায় যে ইগর নামের রাজহাঁসটি আঘাত পাবার কারণে উড়তে অক্ষম, তাকে নিজের সাথে ককপিটে বেঁধে নিয়েই অ্যামি আর তার বাবার যাত্রা শুরু হয়।
সে এক অসামান্য অ্যাডভেঞ্চার, ১৫ টি রাজহাঁস অনুসরণ করতে থাকে দুই দরদী মানুষকে। এর মাঝে কানাডা-আমেরিকান সীমান্তে অবস্থির আমেরিকান বিমান বাহিনী এক ক্যাম্পে তারা অবতরণ করতে বাধ্য হয় তেল নেবার জন্য, যা পরবর্তীতে শাপে বর হয় সবার জন্য, কারণ অবৈধ ভাবে আকাশ পথে সীমান্ত পেরোবার জন্য আরেকটু হলেই তাদের উপরে আক্রমণ চালানোর নির্দেশ দিতে যাচ্ছিল বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা, তার বদলে ১৬টি রাজহাঁস সহ এক কিশোরী ও তার বাবা উড়ালের কাহিনীর শুনে উপস্থিত সকলেই আপ্লুত হয়ে পড়েন এবং সকল টিভি চ্যানেল ও খবরের কাগজের গুরুত্ব সহকারে অ্যামিদের খবরটি প্রচার করা হয়, সারা আমেরিকায় তারা রাতারাতি পরিণত হয়ে নিসর্গী বীরে।
এই পরিচিতি পথে তাকে অনেক সাহায্য করে, একেবারে অচেনা লোকেরা সাহায্য করে অযাচিত ভাবে, রাজহাঁসদের উড়ে যাবার পথে নানা শহরে লোকজন ভিড় করে তাদের স্বাগতম জানায়।
অন্যদিকে নর্থ ক্যারোলিনায় সেই পাখিরালয় ধ্বংস করার জন্য নির্মাণ কোম্পানির লোকজন বুলডোজার নিয়ে এসেও হাজার হাজার লোকের প্রতিবাদে থেমে যেতে বাধ্য হয়। ৫০ কিলোমিটার দূরে থাকতেই বাবার আলট্রালাইট নষ্ট হয়ে গেলে অ্যামি একা একায় তার রাজহাঁসদের নিয়ে উড়ে চলে বাকি পথটুকু। বাবা হিচ হাইক করে গন্তব্য আসেন, তার কিছুক্ষণ পরেই নিরাপদে রাজহাঁসদের নিয়ে অ্যামি এসে নিরাপদে অবতরণ করেন সেই পাখিরালয়ে, হাঁসেরা চলে যায় সেখানের হ্রদে চরতে।
শুরু এক এক নতুন ইতিহাস! সম্পূর্ণ সত্যি কাহিনীর উপরে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাই ১৯৯৬ সালে এবং সারা বিশ্বে মানুষের মন জিতে নেয়। অ্যামি চরিত্রে অভিনয়কারী অ্যানা প্যাকুইন রাতারাতি তারকায় পরিণত হন। ১ ঘণ্টা ৪৭ মিনিটের চলচ্চিত্রটি এখনো পাখিপ্রেম ও নিসর্গ সংরক্ষণের সচেতনতার এক অনন্য দলিল হিসেবে বিবেচিত।
মন্তব্য
গল্পটা মনে হয় দৃশ্যের ভেতরেই।
আপনার লেখাটা ছবি দেখাচ্ছিল না,
বরং ছবির ভেতরে নিয়ে যাচ্ছিল।
দেখে ফেলেন ভাই, আগে দেখা না থাকলে।
facebook
দেখে ফেলতে হবে ছবিটা। আগ্রহ জাগিয়ে দিয়েছ পুরোপুরি। ছবিগুলো ভাল সঙ্গত করেছে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
বাহ, দেখেই জানিয়েন
facebook
ছবিটা (বাংলা ডাবিংএ) দুরন্ত টিভিতে মাঝে মাঝেই দেখায়। বাচ্চাকে নিয়ে একাধিকবার দেখা হয়ে গেছে।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
ডাবিং কেমন করেছে ভাই?
facebook
মূল ইংরেজিটা এখনও দেখা হয়নি, তবে বাচ্চাদের জন্য করা ডাবিং মন্দ হয়নি।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
এরকম দারুণ একটা ছবির কথা সুন্দরকরে জানানোর জন্যে ধন্যবাদ
এ নিয়ে চলচ্চিত্র হয়েছে জানা ছিলনা। ন্যাটজিও বা ডিসকভারিতে এই কাহিনি দেখেছিলাম মনে হয়।
দুনিয়ার সকল স্যাপিয়েন্স এমন মানুষ হতে শিখুক। আমিন।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নতুন মন্তব্য করুন