কাশ্মীরের শালের খ্যাতি সারা জগত জুড়ে, সাধারণ পশমিনা চাদর নয়, সান্তুষ নামের সেই অতি সুক্ষ পশমের বয়নের শৈল্পিক কারিগরি, যা আরাধ্য অনেকের কাছেই। ইতিহাস বলে মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের বর্ণনায় জানা যায় তাঁর বাবা আকবরের একটি সান্তুষ শাল ছিল, যেটা নিয়ে বিখ্যাত ফরাসী রত্ন ব্যবসায়ী ট্যাভার্নিয়ের বেশ ক’লাইন লেখার সাথে সাথে উল্লেখ করেছিলেন যে এটা তিব্বতের এক ধরনের বুনো ছাগলের পশম, মোঘলরা একে বলত টূজ। নেপোলিয়ন তার স্ত্রী জোসেফিনার জন্য এটি সংগ্রহ করেছিলেন বিপুল মূল্যে, গত দুই দশক ধরেই একটি ভালো সান্তুষ শালের মূল্য ছিল ২০ হাজার ডলার। অন্যদিকে ফার্সি ভাষায় ‘সান্তুষ’ মানে উলের রাজা । কিন্তু কী দিয়ে তৈরি হয় এই শাল? প্রাণীর পশম বোঝা যায় কিন্তু কোন প্রাণী?
এই প্রশ্নের আর উত্তর মেলে না! অনেকেই অনেক কথা বলেন, কিন্তু দিনের শেষে শতাব্দী প্রাচীন ব্যবসায়ীরা বলেন যে সিল্ক রুটের সময় থেকেই তিব্বত ও চীনের বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে এই পশম আসে কাশ্মীরে, এখানেই নানা কারখানায় এই শাল বোনানো হয়, এবং পশম ব্যবসায়ীরা বলেন যে তিব্বতের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে এক হরিণ বা ছাগল জাতীয় প্রাণী যে ঝোপগুলোতে বিশ্রাম নিতে আসে সেখানে এইসব লোম পড়ে থাকে, এবং অতি দুর্গম সেই এলাকা থেকে পশমগুলো সংগ্রহ করে কাশ্মীর অবধি নিয়ে আসা অতি দুঃসাধ্য বলেই সান্তুষ শালের দাম অত্যন্ত বেশী।
এই কথায় চালু ছিলো। এই কয়েক দশক আগেও।
এর মাঝে পৃথিবীর সেরা ফিল্ড-বায়োলজিস্ট ও নিসর্গ সংরক্ষনবিদ কিংবদন্তী জর্জ শ্যলার এলেন তিব্বতের নিসর্গ রক্ষায় কাজ করতে, তিনি আবিষ্কার করলেন এক ঝানু গোয়েন্দার মত যে কাশ্মীরে বাজারে যে প্রাণীর পশম বিক্রি হচ্ছে তার উৎস আসলে হিমালয়ের ঢালের অপর দিকে, তিব্বতের বহুল পরিচিত প্রাণী তিব্বতি অ্যান্টিলোপ যা চিরু নামে পরিচিত। এবং সেগুলোর পশম মোটেও প্রাকৃতিক ভাবে ঝরে পড়া না, বরং পালে পালে শিকার চালিয়ে হত্যা করা সেই চিরু হরিণের চামড়া সংগ্রহ করে, মূলত গলার কাছের পশম গুলো দিয়েই সান্তুষ তৈরি হয়। আর বন্দুক ও গুলির আবিষ্কারের পর এখন চিরুদের খুন করাও সহজ হয়ে গেছে অনেক। কাঁচা পয়সার ঝনঝনানিতে তিব্বতে আস্তানা গাড়া নতুন সব ভিনদেশীদের মদদে স্থানীয় যাযাবররাও যোগ দিয়েছে সেই হত্যার মোচ্ছবে। কিন্তু একটা রহস্য সকলেরই অজানা, যে এই চিরু হরিণের মূল প্রজনন স্থান কোথায়! সবার আগে এই ব্যাপারে পদক্ষেপ নিলেন জর্জ শ্যলার, ভাবলেন ব্যবসায়ি ডাকাতদের আগেই সেই এলাকা খুঁজে বের করে তা সংরক্ষিত ন্যাশনাল পার্কের আওতায় নিতে পারলেই হয়ত রক্ষা পাবে বিপন্ন প্রাণীটা! এই বইটা গত ৪০ বছর ধরে চলে আসা সেই অসাধারণ অভিযানের গল্প, এক অতিমানবের নিসর্গ রক্ষার ক্রুসেডের কাহিনী আর তিব্বতের গাঁথা।
৩৬০ পাতার এই তিব্বতি মহাকাব্য প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে, তিব্বতের বারংবার যাত্রা, সেখানে আক্ষরিক অর্থেই অজানার উদ্দেশ্যে তিন দশকের গবেষণা, প্রায় কিংবদন্তীর এক স্থান খুঁজে পাবার চেষ্টা করা কোন রকম দিক নির্দেশনা ছাড়া, সেই কাহিনী সুললিত ভাবে বয়ান করেছেন নিসর্গের কবি জর্জ শ্যলার। লেখক ছাড়াও পাঠক হিসেবে তিনি অনন্য, তিব্বতে নানা অভিযান নিয়ে নানা ভাষায় যত বই লেখা হয়েছে, যেগুলো ইংরেজি ও জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়েছে, সবগুলোই পড়েছেন তিনি। এবং গত কয়েক শতাব্দীর সেই বইগুলোর রেফারেন্স টেনেছেন স্থানে স্থানেই। তাই বইয়ের শেষে কয়েক পাতায় উল্লেখিত বইগুলোর নামের যে তালিকা দেওয়া আছে তা তিব্বত ও হিমালয়ে অভিযান নিয়ে আগ্রহীদের জন্য এক মূল্যবান সংগ্রহ।
১৯৮০ দশকে যখন এই তিব্বতি চিরু মারার হিড়িক পরে যায়, এবং যার জন্য এর পশমের শাল নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন নিসর্গ সংরক্ষণবিদ বিজ্ঞানীরা তখন দুঃখজনক ভাবে কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আব্দুল্লাহ বলেছিলেন কাশ্মীরে সান্তুষ নিষিদ্ধ আমার লাশের উপর দিয়েই করতে হবে।
বইয়ের এক জায়গায় জর্জ শ্যলার উত্তর আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গদের বাইসন শিকারের বিভীষিকাময় কিছু তথ্য দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে চিরুদের যদি রক্ষা না করতে পারি আমরা, এদের অবস্থাও এই রকমই বিলুপ্ত হবে। আর চিরু ছাড়া তিব্বতের এই অবারিত প্রান্তর কোন সময়ই একরকম থাকবে না। এই প্রসঙ্গে একজন খাঁটি জীবন বিজ্ঞানির মতো জর্জ শ্যলার তিব্বতের যাবতীয় প্রাণী চিরু, পাইকা নামের মারমোট, শেয়াল, তুষার চিতা, ভালুক, গাধা ইত্যাদির ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য এবং পরিবেশে ভূমিকা প্রমাণ সহ তুলে দিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে বলেছেন, এবং সেই সাথে সেখানের সরকারের অনেক হঠকারী সিদ্ধান্তে বিষ প্রয়োগে বিশেষ জাতের প্রাণী হত্যার যুক্তিপূর্ণ সমালোচনা করে বলেছেন, সেই প্রাণীগুলো না থাকলে ভূমিক্ষয়, ঘাস মরা থেকে শুরু করে যাবতীয় ধ্বংসের পথে এগোবে তিব্বত।
চ্যাং ট্যাং মরুভূমির ঊষর ভূমিতে জর্জ শ্যলার স্মৃতি চারণ করেছেন তাঁর শৈশবের, ২য় বিশ্বযুদ্ধ কবলিত জার্মানিতে কিভাবে একজন বালক বড় হচ্ছিল এবং সেখান থেকে আমেরিকান মায়ের সাথে আমেরিকা চলে গেছেন কৈশোরেই এবং নিসর্গী হিসেবে কিভাবে বেড়ে উঠলেন সেই নিয়ে আত্মবিশ্লেষণ মূলক অসাধারণ লেখা। আড়ালের মানুষ বলে খ্যাত জর্জ শ্যলার মিডিয়া এড়িয়ে চলেন বলে তাঁর সম্পর্কে জানার খুব একটা উপায় নেই, বিশেষ করে তাঁর মনোজগৎ ও জীবনবোধ নিয়ে, তাই এই দুই অধ্যায় খুব মূল্যবান যেখান জর্জ শ্যলার নিজের জীবনের সাথে কিভাবে সারা বিশ্বের তাবৎ বিপন্ন প্রাণীকুলকে জড়িয়ে তাঁদের রক্ষায় লড়াইতে নেমেছেন নিভৃতচারী দূত হিসেবে সেই আলোকময় জগত নিয়ে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।
এরপর তিব্বত, চীনের অন্য রাজ্য, তাজিকিস্তানের পামির, আফগানিস্তানের কাবুল ইত্যাদি স্থানের বর্ণনা এবং স্থানীয় সরকারের সাথে বারবার বসে কিভাবে বিশ্বের অন্যতম বড় নিসর্গ সংরক্ষণ এলাকা গঠনের অসম্ভব কাজ সংঘটিত হল তার বর্ণনা।
এবং বইয়ের শেষ পর্যায়ে ১৯৮৫ প্রথম বুনো চিরু দেখার পরে কিভাবে তিনি সেই আরাধ্য জায়গা, চিরুদের প্রজননভূমি আবিষ্কার করলেন এবং সেটাকে সংরক্ষিত অঞ্চল বলে ঘোষণা করালেন সেই অসাধারণ আশা জাগানিয়া গল্প।
আর শেষ পর্যন্ত আছে নিসর্গ নিয়ে জর্জ শ্যলারের ট্রেড মার্ক জাদু মাখা বিবরণ, পাতার পর পাতা পাহাড়, চারণ ভূমি, হিমবাহ, উম্মুক্ত আকাশ, বরাবরের মতই উনি আবারও মুন্সিয়ানার ছাপ রেখেছেন।
বইয়ের শেষে জর্জ শ্যলার হাজার বছর আগে তিব্বতি বাউল মিলেরেপার লেখা অপূর্ব নিসর্গী কবিতাটির সাথে যেন একাত্মতা ঘোষণা করছেন আমাদের সবাইকেই আহ্বান জানিয়ে,
“তুষার, পাথর আর পর্বতেরাই আমার সম্পদ।
বরফগলা নদীই আমার পানীয় জল।
হরিণ, মেষেরাই আমার চারণ পশু।
তুষার চিতা, বুনো কুকুর, নেকড়েরাই আমার রক্ষী।
হনুমান, বানর, ভালুকেরা আমার খেলার সাথী।
গায়ক-দামা, ঈগল, শকুনেরাই আমার বাগানের পাখি।
যদি ভালো লাগে আসলেই, চলে এসো।“
মন্তব্য
চিরু হরিণের মতো জগত সংসার থেকে সকল প্রানী বিলুপ্ত হলেও ফারুক আবদুল্লাহদের কিছু যায় আসে না।
কিন্তু আপনার সেই লাদাখে পশমিনা পশুদের পাল দেখার কথা মনে পড়ে গেল ভাই
facebook
আশরাফুল মাখলুকাতের আবদার বলে কথা...
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
হ
facebook
নতুন মন্তব্য করুন