১৯৭২ সালের মে মাসে পল্লীকবি জসীম উদদীন তৎকালীন পশ্চিম জার্মানি যান, ন্যাশনালী নামের এক প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণে তিনি সেখানের গেলেও মূল কারণ ছিল সেখানে থাকা তাঁর দুই পুত্র ও নাতিদের সাথে দেখা করা। এক পর্যায়ের উনার স্ত্রীও যেখানে তাঁর সঙ্গে যোগ দিতে আসেন, এবং স্বামী ও স্ত্রী দুইজনেই আলাদা আলাদা ভাবে সেই স্মৃতি নিয়ে বই লিখেন। পল্লীকবির ‘জার্মানীর শহরে বন্দরে’ ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয় এবং বেগম মমতাজ জসীম উদদীনের ‘ জার্মানীর কিল শহরে’ একই বছরে প্রকাশিত হয়। কিন্তু সেটার গল্প পরের বার, আজ পশ্চিম জার্মানির শহরে বন্দরে কবির অভিজ্ঞতা নিয়েই সামান্য কথাবার্তা।
বইয়ের শুরুতেই এক চমকপ্রদ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন পল্লীকবি, তাঁর সাথে বিমানে ডেনমার্কের চিত্রপরিচালক আলমার টিপ কোমার আলাপ হয়। যিনি টানা দুই মাস ঢাকা থেকে বাংলাদেশের বহু শিশুদের আঁকা অনেক ছবি সংগ্রহ করে দেশে নিয়ে যাচ্ছিলেন। যাদের প্রায় সবাইই পথশিশু। জনাব টিপ কোমার ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশের এইসব ছিন্নমূল শিশুদের নিয়ে তিনি একটি সর্বাঙ্গসুন্দর চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন। বাংলাদেশের আঁকা অনেকগুলো ছবি তিনি পল্লীকবিকে দেখিয়েও ছিলেন। সেই সাথে রিকশার পিছনে যে পেইন্টিং থাকে তেমন ৫০টা পেইন্টিং তিনি ডেনমার্ক নিয়ে যাচ্ছিলেন প্রদর্শনী করবেন বলে। এবং তিনি আবার ঢাকা আসবেন বলে জানিয়েছিলেন।
কারো কি জানা আছে এই বিষয়ে? সেই শিশুদের আঁকা ছবি নিয়ে কোন চলচ্চিত্রের? ডেনমার্কে থাকা কেউ খবর নিতে পারবেন?
প্রথমেই কবি কীল শহরে পুত্রদের সাথে মিলিত হলেন, কিন্তু ক’দিন থেকেই বেশ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে বেশ কদিন টানা ছিলেন বিশেষ অপারেশনের জন্য, এরপর সুস্থ হয়ে জার্মানি ভ্রমণ শুরু হয়।
এখানে একটা ঘটনা বেশ চিত্তাকর্ষক বলে উল্লেখ করে রাখলাম, পল্লীকবির চতুর্থ পুত্র খুরশীদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যায়ামাগারে যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা গ্রহণ করে এবং ফরিদপুরে যেয়ে মুক্তিসেনাদের সঙ্গে কাজ করে। এরপরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের তিনি ভারতে যান, সেখান থেকে যুদ্ধ করতে যাবার সময় কোন কারণে তাঁর হাত ভেঙে যায়। ডাক্তার ব্যান্ডেজ করে দিয়ে বলেন যে অল্প সময়ে সেই হাড় জোড়া লেগে যাবে। তখন নিউইয়র্কে অবস্থানরত কবির মেয়ে হাসনা ( এখনের হাসনা মওদুদ) খুরশীদ মুক্তিযুদ্ধে গেছে এই খবর পাকিস্তানীরা পেলে পরিবারের সকলের জীবন বিপন্ন হবে বিশেষ করে পল্লীকবি কোথায় লুকাইবেন এই কথা চিন্তা করে হলেও আমেরিকাতে যাবার জন্য বিমানের টিকেট পাঠিয়েছিলেন। যদিও খুরশীদ দেশের যুদ্ধ ফেলে আমেরিকায় যেয়ে জীবন রক্ষা করা হেয় মনে করতেন কিন্তু ভাঙা হাত ও বোনের যুক্তিতে আমেরিকা যাত্রা করেন, কিন্তু পথিমধ্যে তাঁর বড় ভাই জামালের ওখানে জার্মানিতে থামেন, যেখানে তাঁর হাড়ের সফল অপারেশন সম্পন্ন হয়। এখানের কবির সাথে তাঁর ফের দেখা।
এরপরে কবি বার্লিন, মিউনিখ, আল্পসের নানা অঞ্চল, ব্ল্যাক ফরেস্ট ইত্যাদি ভ্রমণের সময় সেখানের বিখ্যাত জাদুঘরগুলো, অপেরা, কৃষকের খামার ইত্যাদি উপভোগ করেন।
পরবর্তীতে কবির সাথে মনিকা নামে এক জার্মান তরুণী অনুবাদক হিসেবে যোগ দেন, যার সাথে কবি জার্মান সমাজ বিশেষ করে তরুণ- তরুণীর সম্পর্ক নিয়ে জানতে বেশ আগ্রহী ছিলেন
কবি – আচ্ছা বলো তো মনিকা, শুনিয়াছি এদেশের কলেজে, বিশ্ব-বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা জোড়ায়-জোড়ায় চলে। তোমার কি তেমনি ছেলেবন্ধু আছে?
মনিকা – কেন থাকিবে না? আমারও একজন ছেলেবন্ধু আছে। আমরা দুজন এক ঘরে এক বিছানায় রাত্রে শয়ন করি।
[b]কবি- এতে তোমাদের কোন নিন্দা হয় না?
মনিকা- নিন্দা কে করিবে? সবাই তো প্রায় আমাদের মতো। তবে বুড়োদের কথা আলাদা।
কবি – তোমার বাবা-মা এজন্য তোমার উপর রাগ করে না?
মনিকা – কেন করিবেন? বাবাও আমার ছেলেবন্ধুকে জানেন। মাঝে মাঝে তাকে সঙ্গে লইয়া আমাদের বাড়ি যাই।
কবি- আচ্ছা তোমরা বিবাহ করিয়া ঘর-সংসার বাঁধিবে কবে?
মনিকা – এখনই তো সম্ভব হইবে না। আমরা দুজনই পড়াশুনো করতেছি। পরে যখন উপার্জন করব তখন বিবাহের কথা।
কবি- বলো তো তোমার যৌনকামনাকে কি মনে কর?
মনিকা- প্রকৃতির তাড়নায় আমরা যা কিছু করি আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা তা স্বাভাবিক বলিয়াই মনে করে। এখনকার হেলেনের জন্য কোনো ট্রয় নগর ধ্বংস হয় না। তবে এ কথা সত্য যার-তার সঙ্গে যৌনসম্পর্ক হয় না। দুজনের মধ্যে ভালোবাসা থাকা চাই। এই ভালোবাসা ভালোলাগা কোন অর্থের বিনিময়ে হয় না।
কবি- শুনিতে পাই যে ছেলেমেয়েদের মধ্যে যৌনসম্পর্ক হইলে তাহাদের ভিতর হইতে যত রকমের স্বপ্নালুতা উবিয়া যায়। তা যদি সত্য হয় তোমাদের সম্পর্ক টিকিয়া থাকে কোন শক্তিতে।
মনিকা- স্বপ্নালুকে আমরা বড় স্থান দেই না। এটা ভঙ্গুর, ঠুনকো জিনিস। যৌনমিলন যখন শেষ হইয়া যায় তখন ভিতর থেকে যৌনআকর্ষণ ছাড়া আরও অনেক আকর্ষণের উদয় হয়। তাহাই আমাদিগকে একত্র করিয়া রাখে। এই ধ্রুন যখন ছেলেমেয়ে হয়, ঘর-গৃহস্থালি হয়, তখন স্বামী-স্ত্রীর অপর সম্পর্ক।
এরপর নানা কথা চলতে থাকে, প্রেম, বিরহ, সংসার, ডিভোর্স ইত্যাদি নিয়ে, কিন্তু কবির প্রশ্নর কেন্দ্রবিন্দু থাকে মূলত একটাই কথা “ যে মেয়ের বিচ্ছেদ ঘটল’ তার আবার নতুন করে বয়ফ্রেন্ড পেতে সমস্যা হবে কিনা।‘ জানি না কেন উনার মাথায় এই ব্যাপারেই কৌতূহল ছিল, কিন্তু পশ্চিমে ঘুরতে যাওয়া অনেকেই এই ব্যাপারে মাথা ঘামিয়েছেন বা এখনো ঘামান, যেমন সমরেশ মজুমদার তাঁর আমেরিকা ভ্রমণের বইতে এই প্রশ্নই করেছেন, এবং অপকটে পল্লীকবির মতো লিখেও গেছেন।
পরে কবে নানা সময়ে হাইডেলবার্গ, ফ্রাঙ্কফুর্ট, ষ্টুটগার্ট, বন, কলোন নানা স্থানে ভ্রমণের ফাঁকে ফাঁকে একধিক কলেজে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ এবং তাঁর বন্ধুবৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে নিয়ে বক্তৃতা দেন।
যদিও পূর্ব জার্মানির প্রতি উনার কৌতুহল দেখে এক দিনের জন্য বিশেষ অনুমতির ব্যবস্থা করা হয়েছিল কিন্তু পরে উনারা খারাপ আবহাওয়ার কারণে সেই যাত্রা করতে পারেন নাই।
বনে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরির সাথে তাঁর দেখা এবং উনার বাড়িতে আপ্যায়িত হবার কথা কৃতজ্ঞতা ভরে স্মরণ করে কবি বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত জার্মানি যেভাবে আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়িয়ে উন্নত দেশের কাতারে অংশ করে নিয়েছে, সেই ভাবেই বাংলাদেশও যুদ্ধ পরের ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়ে ঠিকই বিজয় কেতন উড়াতে পারবে।
সবার শেষে কবি নিজের লেখা দুই লাইন শোনান-
‘ নানার বরণ গাভীরে ভাই একই বরণ দুধ,
আমি জগত ভরমিয়া দেখিলাম একই মায়ের পুত!
‘জার্মানীর শহরে বন্দরে’ ১৯৭৫ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়, পলাশ প্রকাশনীর সংস্করণ এখনো বাজারে সুল্ভ। দাম ২৫০ টাকা। প্রচ্ছদ হাশেম খান।
বইটি ভ্রমণ কাহিনী হিসেবে মনে দাগ কাটে নাই, কিন্তু সদ্য পরাধীনতা থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি দেশের অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে পশ্চিম জার্মানির বেশ অনেক জায়গা ভ্রমণের বর্ণনা নিঃসন্দেহে কৌতূহলদ্দীপক। সেই সাথে কবির কৌতূহলী মনের প্রকাশ আসলেই প্রশংসার দাবীদার যে কারণে তিনি যে কোন পেশায়, বয়সের মানুষের সাথে মিশতে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন বিধায় এমন একটি রোজনামচা জাতীয় বই লিখতে পেরেছিলেন।
মন্তব্য
অনেকটাই আমাদের অবদমিত কামনা-বাসনার বহিঃপ্রকাশ, কিছুটা অপরিচিতের প্রতি আকর্ষণ, আর কিছুটা পশ্চিমাদের তুলনায় আমাদের সনাতন পরিবার কাঠামো কতটা শক্ত- এই আত্মশ্লাঘা থেকে এধরণের প্রশ্ন জন্ম নেয়।
হতেই পারে, কিন্তু উনি যে অপকটে লিখে গেছেন সেটাও ভালো, যে কারণে জানতে পারলাম
facebook
আমি যখন ক্লাশ ফাইভ কিংবা সিক্সে পড়ি তখন একটি ম্যাগাজিনে হাসনা জে জসিমউদ্দিনের ছবি দেখি। ম্যাগাজিন টা ঝকঝকে সুন্দর কাগজের ছিল, তেমনি দেখতে ভালো আর স্টাইলিশ ছিল হাসনা। ছোট আমি প্রায়ই দেখতাম ছবিটা আর ভাবতাম ওর মতো একদিন আমিও বিদেশে পড়তে যাবো।
বহু পরে জেনেছি উনি মওদুদের ওয়াইফ। জেনে মনটা বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
( কেন মন খারাপ করলেন আপু, কেন! কেন !)
কবি সাহেবের স্ত্রীও সেই সময়ে জার্মানি গিয়েছিলেন, এবং খুব ছোট একটা বই লিখেছিলেন সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে। দেখি চেষ্টা করব সেটার রিভিউ লিখতে
facebook
এমন অকপটে বলতে পারেন বলেই হয়তো কবি-রা "কবি" অনু'দা।
হিমিকা
হয়তো, হয়তো!
facebook
নতুন মন্তব্য করুন