প্রেমে ও সংগ্রামে পাবলো নেরুদা

তারেক অণু এর ছবি
লিখেছেন তারেক অণু (তারিখ: রবি, ১২/০৭/২০২০ - ৬:২৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পাবলো নেরুদা একই সাথে বাঙালি সমাজে চরম জনপ্রিয় অথচ প্রায় অপরিচিত। মানে কবি হিসেবে তাঁর সুনাম পাঠক মাত্রই জানেন, তাঁর সৃষ্ট কিছু গনগনে অবাক স্তবক সকলেরই মুখে শোভা পায় কিন্তু এক জীবনে যে প্রায় অসম্ভব সাড়ে তিন হাজার পৃষ্ঠা কবিতা তিনি পৃথিবীকে দিয়ে গেছেন, এবং যে পাবলো নেরুদার নির্বাচিত কবিতার সাম্প্রতিক প্রকাশিত সংকলনটি ১৫০০ পাতার ( পৃথিবীর আর কোন কবির নির্বাচিত কবিতা হাজার পাতা পেরিয়েছে বলে জানা নেই!), সেই নেরুদা এখনো বাঙালি মহলে আনকোরা, অপরিচিত, অজানা এক কবি।

ঠিক তেমনই তিনি আমাদের কাছে অজানা এক সচেতন মানুষ হিসেবে, আদর্শবান রাজনীতিবিদ হিসেবে, মহাসাগরের শঙ্খ সংগ্রাহক হিসেবে, পাখিপ্রেমী হিসেবে, মুখোশ সংগ্রাহক হিসেবে, একজন খাঁটি নিসর্গী ও অকৃত্রিম অ্যাডভেঞ্চারার হিসেবে।

পাবলো নেরুদার বৈচিত্রময় মহাজাগতিক জীবনকে একটা নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় আটানো তাঁর কবিতার মতই অসম্ভব। তবুও আজ পর্যন্ত নেরুদাকে নিয়ে বাংলা যে কয়টা বই লেখা হয়েছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বইটি লিখেছেন অধ্যাপক আলী আনোয়ার, ‘ পাবলো নেরুদা প্রেমে ও সংগ্রামে’ শিরোনামের এই অসাধারণ বইটি ২০০৪ সালে প্রকাশ করে সাহিত্যপ্রকাশ। ২০০ পাতার বইটির অন্যতম আকর্ষণ নানা ঘটনার ফাঁকে ফাঁকে নেরুদার প্রায় অজানা বেশ কিছু কবিতার অনুবাদ এবং তাঁর নোবেল পুরস্কার ভাষণ।

১৯০৪ সালে জন্ম হলেও ১৯১০ হচ্ছে কবির জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বছর, কারণ এই বছরেই তিনি লিখিত ভাষার জগতে প্রবেশ করেন। স্কুল জীবন শুরু হয়। দুই চোখে ভরে নির্নিমেষ দেখা বিস্ময়গুলো যেন আঁকুপাঁকু করতে থাকে শিশুকবির পেন্সিল থেকে কাগজে এসে প্রাণ পাবার জন্য। আর শুরু হয় তাঁর নিসর্গ অভিযান- দূরের তুষার ছাওয়া আন্দিজ, বাড়ির বৃষ্টি, শনশনে কনকনে হাওয়া, মহাসমুদ্র, মেঘ, রঙিন পতঙ্গ থম মেরে থাকা শূন্যতা সবই কবির কাছে বিস্ময় ও কবিতা লেখার বস্তু। সেই সময় নিয়ে লিখছিলেন।

‘ প্রকৃতি আমাকে উম্মাতাল করে দিল। পাহাড়ের খাঁজে পাখি, ঘুঘু পাখির ডিম, গুবরে পোকা ও অন্যান্য পোকা দেখে আমি মুগ্ধ- নীল, কালো, চকচকে মসৃণ, বন্দুকের নীলচে ব্যারেলের মত রঙ। পোকাদের অমন নিখুঁত সুষম বিন্যাস দেখে আমি একেবারে চমৎকৃত। "

নেরুদার এই চমৎকৃত হবার ক্ষমতা, এবং উচ্ছাস ভরে নানা মেটাফোরে সেটাকে পাঠকের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা আমরণ সঙ্গী ছিল। মাত্র ১৯ বছর বয়সে ১৯২৩ সালে নেরুদার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ক্রেপুসকুলারিও ( সান্ধ্য পংক্তিমালা )প্রকাশিত হয়, যা হাতে নিয়ে উচ্ছসিত তরুণ লিখে যান-

“ কবি তখনো তাঁর স্বপ্নের বিহ্বলতায় কাঁপছেন। অনুভব করছেন তুরীয় আনন্দ যা জীবনে একবারই আসে, তাঁর নিজের হাতের তৈরি প্রথম সামগ্রী থেকে যে উৎসারিত। এটা এমন এক মুহূর্ত যা আর কখনো ফিরে পাওয়া যাবে না। কবি যেন একজন কারিগর, কবিতা যেন তাঁর নিজের হাতে তৈরি একটা জিনিস, যেন একটি চিনামাটির পাত্র, একটি কাঠের টুকরোয় খোদাই করে নিপুণ কারুকাজ, গনগনে আগুনের তন্দুর থেকে বের করে আনা একটি রুটি।“

ঘরের আসবাবপ্ত্র, ঘড়ি, গায়ের স্যুট বেঁচে ও বন্দক রেখে প্রকাশ করা প্রথম বইটির শেষ কবিতায় লিখেছিলেন,

“ এই শব্দরাজি আমি নির্মাণ করেছি
আমার রক্ত দিয়ে, আমার বেদনা দিয়ে
নির্মিত এই শব্দরাজি।
এবং আমি বুঝি, বন্ধুরা আমার, সবই বুঝি।
আমার কণ্ঠে কেমন করে অন্য কণ্ঠ মেশে
আমি বুঝি, .... তাও বুঝি। "

এর পরপরই প্রকাশিত হত “কুড়িটি প্রেম ও একটি হতাশার গান”, তরুণ কবিকে নিয়ে হৈ চৈ পড়ে গেল সারা দেশে, তাঁর এই বইটির কিছু লাইন না জানাটাও দস্তুর মত লজ্জার বলে মনে করা হত পাঠক মহলে। এখনো নেরুদার এই বইটি সমানে সমাদৃত, সারা পৃথিবীতেই সেই ২১ কবিতার কিছু কবিতা মানুষ এখনো সোচ্চার কণ্ঠে আবৃত্তি করে
( যার একটি রবি ঠাকুরের তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা)।

“আমি তোমার সঙ্গে ঘুমিয়েছি
স্বপ্নের জগৎ থেকে জেগে উঠেছে
তোমার মুখ, আমায় দিয়েছে পৃথিবীর স্বাদ
সমুদ্র-জলের স্বাদ, সমুদ্র-গুল্মের স্বাদ
তোমার জীবনের গভীরতার স্বাদ,
ভোরের শিশিরে ভেজা-
যেন সমুদ্র থেকে এসেছে এসব
যে সমুদ্র আমাদের চারদিকে।“

প্রেমের সন্ধান পাওয়া, প্রেমকে হারিয়ে ফেলা, সেই উত্তাল মুহূর্তগুলোর স্মৃতিচারণ করা এবং নারী নিসর্গকে সমান্তরাল ভাবে কল্পনায় রাখা, এই ছিল মূল উপজীব্য বইটির, এবং পরিণত বয়সের নেরুদার লেখাতেও এই কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণই ছিল।

এভাবে অধ্যাপক আলী আনোয়ার সুললিত ভাষায় পাল তুলে দেন নেরুদার জীবন সমুদ্রে, যেখানে একে একে আসতে থাকে নানা তরঙ্গের মত ঘটনা- কবির বিশ্ববিদ্যালয় জীবন, বিক্ষুদ্ধ স্বদেশভূমি, চিলির দূতাবাসে চাকরি নিয়ে নেরুদার দুই বছর বার্মার রেঙ্গুনে থাকা, এরপর শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুরের একঘেয়ে বিচ্ছিন্ন জীবন, প্রথম বিবাহ ও বিচ্ছেদ, স্বদেশে ফেরা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাঁর একের পর এক কবিতার বইগুলো।

সময়ের সাথে সাথে নানা অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিকোণের প্রভাব রয়েছে যাদের ছত্রে ছত্রে। বিশেষত মেক্সিকো এবং পেরু ভ্রমণের সময় সেখানে প্রাচীন সব সভ্যতার অনন্য নগরীগুলো দেখে উচ্ছসিত নেরুদার কলমে সুমহান মহাকালের নির্জনতা থেকে জেগে উঠতে থাকে সেই প্রাচীন জাতিসত্ত্বা, যাদের প্রতি ল্যাতিন আমেরিকা ঋণী, এবং অবধারিত ভাবেই আসে দখলদার স্প্যানিশ বাহিনীর নিষ্ঠুরতা ও রক্তগাঁথা গল্প। মেক্সিকো থাকার সময়ই নেরুদা কূটনীতিকের চাকরির পদে ইস্তফা দিয়ে দেশে ফিরে আসেন এবং সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবল ভাবে অংশ নিয়ে দেশের নানা জনসভায় কবিতা পড়তে থাকেন জনতার মহাসমুদ্রের সামনে। সাধারণ মানুষের কাছে সঞ্জীবনী সুধা হয়ে গিয়েছিল নেরুদার সেই সব কবিতা যাকে তারা লোকগান বানিয়ে ফেলেছিল।

ফলে সরকারের কোপানলে পড়েন নেরুদা , হুলিয়া জারি করার হয় তাঁর নামে, দুর্গম পথে গোপনে দেশ ছাড়েন তিনি, বেশ ক’বছর ল্যাতিন আমেরিকার নানা দেশ ও ইউরোপের নানা নগরে কবিতা পড়া চলতেই থাকে তাঁর পুলিশের হুশিয়ারি উপেক্ষা করে। এখানেই তাঁর জীবনে নোঙ্গর হিসেবে আসেন চিলির বান্ধবী মাতিলদে উরুশিয়ে, যাকে নিয়ে ইতালির নির্বাসিত জীবনে তিনি রচনা করেন বিশ্বখ্যাত ‘ভালোবাসার একশ সনেট’, অল অ্যাবাউট লাভ, দ্য ক্যাপ্টেন’স ভার্সেস। এই সময়ের রচনায় ছিল প্রেমের জোয়ার, সারা বিশ্বে আজ প্রেমের কবি হিসেবে নেরুদার যে খ্যাতি তার অন্যতম কারণ সেই সময়ের রচনাগুলি, যার অধিকাংশের কেন্দ্রবিন্দু ছিলে মাতিলদে।

অসহায় অবরুদ্ধ নির্বাসিত জীবন নিয়ে নেরুদা লিখেন,

“নির্বাসন যেন একটি গোলক
একটি বৃত্ত, একটি পরিধি
যার চারপাশ দিয়ে নিরন্তর হেঁটে চলা।
তুমি দেশের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছ,
অথচ সে আলো তোমার আলো নয়।
রাত্রি নেমে আসে, অথচ তারারা তোমার পরিচিত নয়।
তুমি নতুন ভাইদের আবিষ্কার কর অথচ তারা তোমার রক্তের নয়
তুমি যেন এক বিভ্রান্ত অশরীরী।
যারা তোমায় এত ভালোবাসে
তাদের কেন আরো ভালবাসতে পার না?”

দেশের ফেরার কয়েক বছরের মধ্যে একেবারে নতুন আঙ্গিকে নেরুদা বিশ্ব সাহিত্যকে উপহার দিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতার বইগুলোর একটি “ Ode to common things’ ।কেউ কোনদিন এই জিনিসদের নিয়ে এত হৃদয়ছোঁয়া ভাষায় কবিতা লিখে নি। আটপৌরে, অপাংক্তেয় সব জিনিস আপাতদৃষ্টিতে, তাদের নিয়ে একেকটা মহাকাব্য রচনা করে গেছেন পাবলো নেরুদা। প্রথমেই লবণ নিয়ে কবিতা শুধু একবার পড়েই দেখুন, বুঝতে পারবেন এই কথার যথার্থতা।

‘লবণের প্রতি গান’

এই উপত্যকার
লবণদানিতে
আমি দেখেছি লবণ গান গায়।
আমি জানি তোমরা বিশ্বাস করবে না,
কিন্তু সত্যি,
লবণ গান গায়,
এই লবণ উপত্যকার আবরণ,
লবণ-
গান গায়।
মাটি কার কণ্ঠ রুদ্ধ করে
কিন্তু সে গান গায়।
যখন প্রথম লবণের কণ্ঠ শুনি
ঐ গভীর
নির্জনতার মধ্যে-
পরিব্যপ্ত মরুভূমির মধ্যে
আমি কেঁপে উঠেছিলাম।

আন্তোফাগাস্টার কাছে
ঐ সমগ্র লবণের প্রান্তর
কথা বলে,
ভাঙা ভাঙা গলা,
বেদনা-ভারাক্রান্ত
কিন্তু গান।

এখানে পাথুরে লবণের
এই নিজস্ব খনিতে
এই পাহাড়ি গুহায় দেখি প্রোথিত আলো
যেন একটি বিচ্ছুরিত আলোর ক্যাথেড্রাল,
যেন ঢেউগুলো ফেলে গেছে একটি অনন্য স্ফটিক।
পৃথিবীর সমস্ত টেবিলে তারপর
লবণ তোমার তনিমা
ছড়ায় উজ্জল চূর্ণিত আলো।

প্রাচীনকালের সমুদ্রগামী জাহাজে
ভাঁড়ারের রক্ষক ছিলে তুমি,
তুমি অভিযাত্রী সমুদ্রের,
ক্বচিৎ উম্মোচিত সফেন অজানা রাস্তায়
বয়ে নিয়ে গেছ বস্তুর ভার অনন্য উজানে।
সমুদ্রের উচ্ছিত জলকণা এসে মধ্যরাতে চুমু দিয়ে গেছ
তার লবণাক্ত স্বাদ তোমারও জিহ্বায়।
তাই বুঝি প্রতিটি লোকমায়
আমরা পাই সমুদ্রের স্বাদ,
লবণদানির সামান্য আন্দোলনে
ছড়িয়ে পড়া ক্ষুদ্রতম লবণকণায়
মিশে থাকে শুধুমাত্র প্রাত্যহিক শুভ্রতা নয়
থাকে অনন্ত অনিকেত স্বাদ।‘

এই সব মহাকাব্যই রচিত করেছেন তিনি চেয়ার, টেবিল, পেঁয়াজ, আপেল, টম্যাটো, রুটি, আলু ভাজা, চামচ, সাবান, কাঁচি, মোজা, বেহালা, গীটার, ডিকশনারী, কুকুর, বেড়াল, বিছানা, ফুল, চা-বাক্স ইত্যাদি নিয়ে। মোট ২৫টি কবিতা, যেন ২৫টি মহাকাব্য। ( এখানে অবশ্য লেখক কয়েক কিস্তিতে লেখা ২৫০ কবিতার কথা বলেছেন যেটা নিয়ে আমি নিশ্চিত না, বা ছাপাখানার ভূতের কাজও হতে পারে)

নেরুদার কবিতা বারবার দিকপরিবর্তন করেছে, কিন্তু অফুরান আত্মবিশ্বাসী কবির শব্দের সাগরে কোনদিন ভাটা পড়ে নই, নিজেকে নিয়ে বলেছেন

‘আমি এতোটাই প্রবল ভাবে বেঁচেছি,
যে তোমরাই জোর করে ভুলে যেতে চাবে কোনো দিন,
ব্ল্যাকবোর্ড থেকে মুছে ফেলবে আমার নাম।
কিন্তু আমার হৃদয় তো সচল থাকবে চিরকাল।
আমি নীরবতা চাই বলে
ভেব না, ভেব না আমি মারা যাব
উল্টটাই দেখো সত্যি হবে,
বেচেই থাকব বহুকাল।

বাঁচবো এবং বাঁচবো এবং বাঁচতেই থাকবো।

১৯৬১ সালে ‘কুড়িটি প্রেম ও একটি হতাশা’র গান বইটির ১০ লক্ষতম কপি সংস্করণ প্রকাশিত হয়, যা এর আগে কোন কবির জীবদ্দশায় হয় নি। একে একে বিচ্ছিন্ন গোলাপ, শীতের বাগান, সমুদ্র ও ঘণ্টাধ্বনি এবং কিছু ব্যর্থতা কাব্যগ্রন্থের পর নেরুদা দেন আরেক মাষ্টারপিস The Book of Question, সদা কৌতুহলী কবি যেন শব্দ বুননে সর্বোচ্চ মুন্সিয়ানা দেখিয়ে উজাড় করে দিলেন নিজের যত ভাষ্য মাত্র এক কি দুই লাইনের সব প্রশ্নে। ১৯৭১ সালে সাহিত্যে নোবেল গ্রহণ করলেন তিনি, দিলেন হৃদয় নিংড়ানো এক ভাষণ।

কিন্তু এর মাঝে দেশে একাধিক অস্ত্রোপচার ও নির্বাসিত জীবনের যন্ত্রণা ছাপ ফেলে ছিল জীবনে। চিলির রাষ্ট্রপতি পদে নিজে না দাঁড়িয়ে যে পদটিতে দাঁড়াবার জন্য অনুরোধ করেছিলেন দীর্ঘদিনের সহকর্মী সালভেদর আয়েন্দেকে, যে আয়েন্দের ছিলেন ভোটে নির্বাচিত বিশ্বের প্রথম বামপন্থী রাষ্ট্রপতি, তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত জেনারেল পিনোশের সেনাবাহিনীর ক্যু-র মাধ্যমে হত্যা করে বিশ্বে এক কলংকের ইতিহাস শুরু করে,যা চিলিতে চালু থাকে আরও দীর্ঘ ৩০ বছর। নেরুদা তখন অসুস্থ, তাকে সেনাবাহিনী হাসপাতালে অবরুদ্ধ করে রাখে, প্রায় একা। তাঁর বাড়ি তছনছ করা হয় তাঁর, ধ্বংস হয়ে অনেক সৃষ্টি। মেক্সিকো তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে আগ্রহ দেখায়, কিন্তু কবি আর স্বদেশভূমি ছাড়তে চান নি। এর মাত্র ৪ দিন পরেই ১৯৭৩র ২৩ সেপ্টেম্বর তিনি অনন্ত যাত্রা শুরু করেন ( অনেকেই সন্দেহ করেন যে তাকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করে ছিল সামরিক বাহিনী, এই ক’বছর আগেও যে আলামত সংগ্রহের জন্য ফের কবির সমাধি খনন করা হয়েছিল।)

সামরিক সরকার নেরুদার শোকযাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। শোকস্তব্ধ জনগণ তাদের বাড়ির ছাদে, বারান্দায় চাতালে জড়ো হলেন, দূর থেকে কবির প্রতি তাদের শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য এবং কফিনবাহী আত্মীয়স্বজনের ছোট্ট গ্রুপটির সাথে একাত্নতা প্রকাশের জন্য। দু’একজন করে যোগ দিতে লাগলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছোট্ট গ্রুপটি একটি বিশাল মিছিলের রূপান্তরিত হলো সমস্ত নিষেধাজ্ঞা এবং পাহারারত কনভয়ের ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে। যখন তাঁর নিরাভরণ কালো কফিনটি নামানো হচ্ছে তখন অকস্মাৎ ভিড় ঠেলে শোকের প্রহারে দীর্ণ এক তরুণী বেরিয়ে এলো এবং তাঁর কালো পোশাকের তলা থেকে একটি টকটকে লাল গোলাপ বের করে আনলো যেন হৃদয়ের রক্তক্ষরিত এক ফুল, রাখলো সেটিকে কফিনের ওপরে, তাঁর ভালোবাসার শেষ অর্ঘ্যরূপে।

পাবলো নেরুদা ছিলেন আজীবন এক বিদ্রোহী – কবি, নেতা, প্রেমিক, নিসর্গী এবং সর্বোপরি মানুষ হিসেবে। সেই মানুষ নেরুদাকে কিছুটা বুঝতে চাইলে, জানতে চাইলে ‘পাবলো নেরুদা প্রেমে ও সংগ্রামে’ এক অবশ্যপাঠ্য বই। আর সেই জীবন গদ্যের ফাঁকে ফাঁকে যথার্থ স্থানে অসংখ্য কবিতার স্বাদ এই বইটিকে দিয়েছে এক অনন্য মাত্রা।

(আজ কবির জন্মদিন, এই লেখাটি তাঁর প্রতি মুগ্ধতার নৈবদ্য।
আর এই লেখাটি তোমার জন্য। )

ছবি: 
07/07/2011 - 11:39অপরাহ্ন

মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ইয়ে...এ..এ
আমি প্রথম।
শুভ জন্মদিন প্রেমের কবি। নেরুদার কথা যখনি আমার মনে পড়ে তখন একই সাথে দুটি কথা মনে উদয় হয়।
প্রথমটা হলো, কবি বার্মায় আসার পর কবির যে ডাচ্ তরুণীর সাথে প্রেম হয়েছিল সে কথা। সে পেয়েটার বন্য প্রেমের রূপ দেখে কবি ভয় পেয়ে গেছিলে। পরে চাকরি ছেড়ে কাউকে না জানিয়েই পালিয়ে আসেন। ওই বন্য মেয়েটিকে যেন আমি কল্পনায় দেখতে পাই। আর দ্বিতীয় যেটা মনে আসে তা হলো, সালভাদর আলেন্দের মৃত্যুতে কবি যে আঘাত পেয়েছিলেন। অনু'দা আপনার লেখা কতটা পছন্দ করি তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। তবে আজ এই অনন্য বইটির সংবাদ পেলাম আপনার মাধ্যমে। পড়েঈ মনটা চনমন করে উঠেছে। কোন ভালো বইয়ের কথা শুনলে যে আনন্দ হয় তা বোধহয় আর অন্য কিছুতেই হয়না। অনেক ধন্যবাদ অনু'দা। এরকম একটা পোস্টের জন্য।

তারেক অণু এর ছবি

বইটা আশা করি সংগ্রহ করতে পারবেন। শুভেচ্ছা

অতিথি লেখক এর ছবি

ওহ্,নাম দিতে ভুলে গেছি। আমি
হিমিকা

তারেক অণু এর ছবি

ধন্যবাদ হিমিকা

জে এফ নুশান এর ছবি

তারেক অণু, খুব চমৎকার হয়েছে কবির প্রতি আপনার মুগ্ধতার এই নৈবদ্যটি। আর আলোচিত বইটা পড়ারও প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি।

তারেক অণু এর ছবি

ধন্যবাদ, সংগ্রহ করতে পারলে পড়ে জানিয়েন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।