অনেক অনেক বছর পর একটি বই পড়লাম যার প্রতিটি লাইন ভাবালো, খুব যে নতুন করে ভাবালো তা নয়, কারণ অনেক অনেক শব্দ-বাক্য-ভাবনা-অভিজ্ঞতায় নিজের স্কুল-কলেজ জীবনের মিল খুঁজে পেতে পেতে যেন সেই জগতে ফিরে গেছিলাম। ক্ষমতা থাকলে বাংলাদেশের ( বিশ্বের সকল দেশেই) প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, সবার আগে অবশ্যই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, তারপর মাধ্যমিক, উচ্চ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষকের পড়ার জন্য বাধ্যতামূলক করে দিতাম, আর তারপরে পড়ার ব্যবস্থা করতাম ছাত্রদের জন্যও।
নিশ্চিত ভাবেই এই বই একবার পাঠ করে উপলব্ধি করলে সে আর আগের মানুষটি থাকে না, অন্তত কিছুটা হলেও আলোর চেতনা জাগ্রত হয় ভিতরে।
ইতালির তুসকানি রাজ্যের ফ্লোরেন্সের কাছেই অবস্থিত এক অখ্যাত গ্রাম বারবিয়ানা। সেই গ্রামেই এক স্কুল ছিল, সেই স্কুলের আট জন ছাত্র মিলে তাদের শিক্ষকদের লিখেছিল কিছু কথা, জীবন ঘষে পাওয়া সেই প্রতিটা শব্দ যেন ভাবায় আমাদের, জানায় অমিত সম্ভাবনার জীবনকে কিভাবে নষ্ট করে ফেলি আমরা ভুল মানুষের ভুল দিক নির্দেশনায়। এই বই নিয়ে মারভিন হফম্যান নামের এক মার্কিন শিক্ষক লিখেছিলেন,
“ সবার আগে আমি সাধুবাদ দিব বারবিয়ানার ছেলেদের। ১৯৬০ সালে উচ্চারিত এই ছেলেদের কথা আজও অনুরণিত হয়ে চলেছে সারা আমেরিকা জুড়ে, তথা সারা পৃথিবী জুড়ে। দুঃখের কথা। কারণ, সেই ছেলেরা যে সমস্যাগুলোকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলি লিখেছিল সেসব সমস্যা একইভাবে পৃথিবীর সমস্ত পড়ুয়াকে আর শিক্ষকদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কিন্তু ছেলেদের কণ্ঠস্বরের দিক থেকে গৌরবের কথাও বটে। তারা কী অসাধারণ গভীরতায় সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করেছিল সে কথা ভাবলে আশ্চর্য হতেই হয়।“
লোরেনজো মিলানি নামের এক রোমান ক্যাথলিক পাদ্রী জীবনের প্রথম থেকেই চেষ্টা করছিলেন জনগণের স্কুল প্রতিষ্ঠা করার, প্রত্যন্ত বারবিয়ানা গ্রামে বদলি হয়ে গেছে তিনি শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা ‘অশিক্ষিত’ আর নিপীড়িত মানুষের ‘সার্বভৌম ব্যক্তিত্বে’ পরিণত করতে যারা স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারবে, নিজেদের মনের চিন্তা প্রকাশ করতে পারবে এবং সেই চিন্তার সমর্থনে বিতর্ক চালাতে পারবে। যুদ্ধবিরোধী চিন্তা প্রচার করায় উনার নামে মামলা রজু করে ইতালির সরকার এবং মামলা চলা অবস্থায়ই মাত্র ৪৪ বছর বয়সে মিলানি মারা যান, সেই সময়ের মাঝেও তাঁর একাধিক বই নিষিদ্ধ করেছিল সরকার ধর্মদ্রোহ, যুদ্ধবিরোধিতা ইত্যাদি নানা কারণে!
বইটির প্রথম লাইনগুলো তুলে দেবার লোভ সামলাতে পারছি না,
প্রিয় স্যার,
আমাকে আপনার মনে পড়বে না। আমার নামও নিশ্চয় আপনি ভুলে গেছেন। আপনি আমাকে আর আমার মতো অনেককে অনেকবার ফেল করিয়েছেন।
আমি কিন্তু আপনার কথা অনেক ভেবেছি, আপনার মতো শিক্ষকদের নিয়ে চিন্তা করেছি। যে অচলায়তনটিকে আপনার ‘স্কুল’ বলেন তার আসল চেহারা দেখেছি। সেইসব ছেলেমেয়েদের কথা আমার মাথায় ঘুরে বেড়িয়েছে যাদের আপনারা ফেল করিয়ে কলে-কারখানায় আর মাঠে ছড়িয়ে দেন, আর বেমালুম ভুলে যান তাদের কথা।
এইই শুরু, এর পরে উঠে আসে একে একে নানা অবহেলা, শোষণ, বঞ্ছনার কথা। যেখানে এই ছাত্র তার শিক্ষকদের বলতে বাধ্য হন,
‘আপনাদের সংস্কৃতির ব্যাপারটাই এই, আপনারা মনে করেন আপনারাই গোটা দুনিয়া।‘
সেই লেখক ছাত্রের কথা আছে, যে শিক্ষক হয়ে মাঝে মাঝে ক্লাস ইচ্ছা করে সামান্য ভুল করে সমস্ত ছাত্রদের কাতারে নিজেকে সামিল করে খুব সুন্দর করে সবাইকে নিয়ে গুছিয়ে ক্লাস শেষ করতেন, আর সেই সাথে নিজেদের শিক্ষকদের অথর্ব শিক্ষা পদ্ধতির তুলনাও করেছেন। পরীক্ষা নিয়ে সরাসরি বলেছেন
“পরীক্ষা ব্যাপারটাই, জানেন, তুলে দেওয়া উচিত। আর যদি পরীক্ষা নিতেই হয় তাহলে অন্তত সুবিচার যাতে হয় সেটা দেখা উচিত। খামোখা কঠিন প্রশ্ন করে ছাত্র ঠকানোর প্রবণতা যেন না থাকে পরীক্ষকের। ছাত্ররা তো আর শত্রুপক্ষ নয়!
তবু আপনারা কঠিন কঠিন প্রশ্ন করে অবান্তর সমস্যা সাজিয়ে ছাত্রদের বিপদে ফেলেন। কেন করেন এমন? ছাত্রদের ‘ভাল’-র জন্য?
এভাবেই তারা ঝরঝরে ভাষায় বলে গেছিল ধনী সমাজের সন্তানের প্রতি শিক্ষকদের পক্ষপাতিত্ব, গরীবের সন্তানকে সরাসরি তার বাবার সামলেই বলা ‘এর মাথায় কিছু নেই্, ওর দ্বারা কিছু হবে না’’, কোচিং ব্যবসার বিরুদ্ধে মতামত, এমন অনেক অনেক অনেক কিছু।
শিক্ষক বন্ধুরা, আপনার অন্তত বইটা পড়ুন। আপনাদের ছাত্র-ছাত্রীরা কিছুটা হলেও শুধুই ভালো ছাত্র না হয়ে আলোকিত মানুষ হবার দিকে এগিয়ে যাক।
( ১৯৬৭ সালে বইটি ইতালিতে প্রকাশিত হয় ‘লেটার টু এ টিচার’ ( লেত্তেরা আ উনা প্রোফেসোরসা) ।
বাংলায় সলিল বিশ্বাসের অনুবাদে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে কোলকাতার বাউলমন প্রকাশন থেকে।
বাংলাদেশের বাতিঘর সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে কিছুদিন আগে, মলাটমূল্য রাখা হয়েছে ৩০০ টাকা।
বাতিঘরকে ধন্যবাদ এই অসাধারণ বইটিকে প্রকাশ করার জন্য। )
মন্তব্য
পড়ার ইচ্ছা আছে।
পড়ে জানিয়েন কিন্তু
facebook
কেন যে এই অদ্ভুত সিস্টেম পৃথিবীতে। এমন যদি হতো, ছাত্ররা যে যার মত গল্পের বই বেছে নেবে আর বছর শেষে সেখান থেকেই প্রশ্ন করা হবে, এটা বাধ্যতামূলক, তারপর বাকি ব্যাপার স্যাপার। জীবনের প্রথম পনের বছর আলো মাখা বই পড়লেইতো দুনিয়াটা আরেকটু ভালো হয়, ভালোবাসার ভাইরাস ছড়ায়।
খারাপ না, খুব তো লাভ হচ্ছে এখনের অবস্থায়, খামোখা ইঁদুর দৌড়ে সামিল হওয়া ছাড়া
facebook
এ প্রচ্ছদটার শিল্পী কে?
সব্যসাচী হাজরা
facebook
নোরা রসি ও টম কোল এর অনুবাদে বইটার ইংরেজী অনুবাদ পড়েছিলাম। যেহেতু নিজে শিক্ষক ছিলাম, তাই খুব নাড়া দিয়েছিলো। এতটাই যে, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের ‘নিষ্ফলা মাঠের কৃষক’ বইটার সাথে মিলিয়ে আরেকবার পড়েছিলাম। বেশ একটা ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ পাবার মতো ব্যাপার হয়েছিলো। মনে আছে বেশ কিছু পাঠ-প্রতিক্রিয়াও নোট করেছিলাম। ট্রেনের কামরায় ফেলে আসা ঠোঙার মতো, কোথায় সেসব হারিয়ে গেছে। আর সেগুলো নেহাতই কাঁচা লেখা হয়েছিলো বলেই আজ মনে হচ্ছে।
মূল সমস্যাটা আমার কাছে মনে হয়েছে যে, আমাদের (আসলে ইংরেজদের চাপিয়ে দেয়া) শিক্ষা-ব্যবাবস্থাটি বেশ অনেকটা শিল্প-বিপ্লবের কারখানাগুলোর আদলে তৈরি। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের কাছে কারখানার মালামাল তৈরির প্রোডাক্ট-চেইনের মতো। একদিক দিয়ে কাঁচামাল (অশিক্ষিত মানবসন্তান) ঢুকবে আর আরেকদিক দিয়ে ফিনিশড প্রোডাক্ট (ডিগ্রিধারী, দক্ষ মানবসম্পদ) হয়ে বেরিয়ে আসবে। সব মাপে, আকারে, গুণে সমান। মানুষের মেধাবৈচিত্র, তার চিন্তার বিভিন্নতার সৌন্দর্য, মানবিক বিকাশের বহুমুখী ধারণা সেখানে একেবারেই অনুপস্থিত। শুধু আছে নিয়মের লেফট-রাইট, পরীক্ষার জুজু আর রেজাল্টের চাপে সৃজনশীলতার বিনাশ। এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে, সৃজনশীল পদ্ধতির নামে দেশে যে উচ্চমার্গীয় রসিকতা চলছে, তা বোঝার ওপর শাকের আঁটি।
তারেক অণুকে আন্তরিক ধন্যবাদ, বইটির বাংলা অনুবাদের খোঁজ দেবার জন্যে। লেখার কথা নতুন করে কিছু বলার নেই। আমি আপনার সাবলীল লেখার একনিষ্ঠ ভক্ত। সুন্দর পোস্টের জন্যে এই সুযোগে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গেলাম।
স্বরূপ-সন্ধানী
------------------------------------
অন্ধকারে সব-চেয়ে সে-শরণ ভালো
যে-প্রেম জ্ঞানের থেকে পেয়েছে গভীরভাবে আলো।
ধন্যবাদ ভাই, সুন্দর ফিডব্যাকের জন্য। আপনিও একটা রিভিউ লিখতে পারেন কিন্তু নতুন অনুবাদটা পড়ার পর
facebook
কি যে বিপদে ফেলেন!! এমন এমন সব বইয়ের কথা বলেন না খুঁজে, না পড়ে থাকাই যায়না। স্কুলে ছিলাম অগামার্কা ছাত্র এই বইটা তাই পড়তে ইচ্ছে করছে এবং নির্ঘাত পড়েই ফেলবো।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
এটা সহজেই সংগ্রহ করতে পারবেন ভাই, পড়ে জানিয়েন
facebook
ছোটবেলা থেকে ইস্কুলে শাস্তির বিভিন্ন রূপ দেখেছি। আর তাই কিছু শিক্ষকের ক্লাস ছিল মূর্তিমান বিভীষিকা। খুব সামান্য কারণেও ওনাদের মেজাজ বিগড়ে যেত। তাদের আসার সময় হলেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে যেত। আ এই বয়েসে এসে তাদের যোগ্যতা এবং বুদ্ধিমত্তা নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগে। সময় যদিও খারাপ তবু যোগাড় করতে হবে যেভাবে হোক। আর আপনার লেখা নিয়ে কি-ই বা বলবো। আপনার সব লেখাই পড়া। ধন্যবাদ।
হেমন্ত শিশির
অনেকেই না জেনে অনেক ছাত্রের জীবন স্রেফ ধ্বংস করে দিয়েছে
facebook
১। হুম, পড়তে হবে দেখছি।
২। তোত্তোচ্যান বইটার কথা মনে পড়ে গেল।
৩। আমার "শিক্ষাজীবন" শুরু হয়েছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নার্সারি স্কুলে। রাশেদা খালেক, দীপিকা মজুমদার আর সালমা জুবেরী এঁরা ছিলেন আমার শৈশবের শিক্ষক, প্রথম শিক্ষক। কোবাইয়াশি মশায়ের স্কুলের চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না সেটা। স্কুলটি বোধহয় এখন আর টিকে নেই, ২০০৫ সালের দিকে গিয়েছিলাম। শৈশবের খোলনলচে-মানুষ কিছুই খুঁজে পাই নি।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নার্সারি স্কুল, কী কন মিয়াঁ এতদিনে! এটা তো আমার স্কুল কলেজ! দীপিকা কাকী আমার মায়ের মতো, রাজশাহী আসলে নিয়ে যাব নি উনাদের বাসায়। সালাম জুবেরি চাচী আমার বাল্য বন্ধু নাবিলের মা, আর রাশেদা চাচীও শুভ ভাই, নিক্কন আপুর মা। মানে ক্যাম্পাসেই ছিল জীবনের স্বর্ণালী ১০ বছর। স্কুল আছে, কিছুটা চেঞ্জ, এখন আবার নতুন ভবন তোলা হচ্ছে কাজলা গেটের সাথেই
facebook
নতুন মন্তব্য করুন