বইটা পড়ে বেশ ভালো লাগলো, মাত্র ৯২ পাতার বইতে মানুষ, লেখক, পর্যটক আলী সাহেবের অনেক জানা-অজানা তথ্যের বেশ সুচারু সন্নিবেশন। বইটি মূলত দুই ভাগে বিভক্ত, ‘জীবনকথা’ এবং ‘সাহিত্য-জীবন’। বইটিতে প্রথম যে অজানা কিন্তু অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক তথ্য পেলাম তা হচ্ছে বিখ্যাত রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ ও দার্শনিক আবু সয়ীদ আইয়ুব সিলেটে সৈয়দ মুজতবা আলীর সহপাঠী হয়েছিলেন ৭ম শ্রেণীতে! তখন বিশেষ কারণে আবু সয়ীদ আইয়ূবের পরিবার তাকে কোলকাতার বাহিরে পাঠাতে বাধ্য হয়েছিল ( উনাদের নিকটাত্মীয় আবু সয়ীদ আবদুল্লাহ সিলেট আলীয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ছিলেন। )। তাদের এই বন্ধুত্ব আমরণ বজায় ছিল, এবং চিন্তাশীল কিশোর আবু সয়ীদ আইয়ুবের সাথে আলী সাহেবের বন্ধুত্ব নিঃসন্দেহের সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল।
মাত্র ১৩ বছর বয়সেই সৈয়দ মুজতবা আলী সিলেটে থাকাকালীন অবস্থায় লুসাই ভাষা শেখার চেষ্টা করেন এবং আবিষ্কার করেন যে লুসাই ভাষাতে বাংলা বহু শব্দের কোন প্রতিশব্দ নেই। এই প্রয়াসটুকুও প্রমাণ করে পরবর্তীতে বহুভাষাবিদ সৈয়দ মুজতবা আলী একেবারে শুরু থেকে নানা ভাষা নিয়ে কৌতূহল এবং নিরীক্ষণের ক্ষমতা।
এবং ১৫ বছর বয়সেই মেজদাদা সৈয়দ মুর্তজা আলীর সাথে মিলে একটি পত্রিকা বের করতেন যেটির নাম ছিল ‘কুইনিন’!
১৯১৯ সালে সৈয়দ মুজতবা আলীর স্কুলে যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসে বক্তৃতা দিয়েছিলেন যাতে মুগ্ধ হয়ে কিশোর মুজতবা শান্তি নিকেতন যাবার জন্য বাবাকে পিড়াপিড়ি করে রাজি করান সে কথা আমাদের অনেকেরই জানা, কিন্তু যেটা জানা নেয় তা হচ্ছে সিলেট থেকে রবি ঠাকুর তখন ত্রিপুরা গমন করেন এবং ছোট্ট মুজতবা তাকে চিঠি লিখে জানাতে চেয়েছিলেন যে “আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি করতে কী করতে হবে”, এবং তার উত্তরে রবীন্দ্রনাথ স্বহস্তে তাকে আসমানি রঙা খামে আসমানি রঙা দামী প্যাডে ১০/১২ লাইনের একটি চিঠি দিয়েছিলেন। চিঠিটা তাঁর বোন হবিগঞ্জের বাড়িতে বাঁধিয়ে রেখেছিলেন এবং সেই পরিবারে এটি একটি আলোড়নকারী ঘটনা ছিল।
যেটা ছিল না, জাত-পাত-ধর্মের উর্ধে থাকা রবীন্দ্রনাথ শান্তনিকেতনে একটি মুসলিম ছাত্রকে ভর্তি করতে চেয়েও অন্যদের বাঁধায় তা পারেন নি, কিন্তু সৈয়দ মুজতবা আলীর ক্ষেত্রে তিনি কারো সাথে আপস না করে ভর্তি করে নিলেন ( যদিও ১৩২৫র পৌষে ভর্তি হওয়া মুজতবা শান্তি নিকেতনের প্রথম মুসলিম ছাত্র নন, উনার আগে জাফর আলি নামে পূর্ব আফ্রিকার এক ছাত্র সেখানে ভর্তি হয়েছিল।) প্রথম দিকে সৈয়দ মুজতবা আলী ‘শ্রীঅনাথনাথ বসু’ হিন্দু ছদ্মনাম নিতেই বন্ধুকে চিঠি লিখেছেন, এই নাম দিয়েই আশেপাশের মন্দিরে প্রবেশ করতেন। । এবং পরে ১৯২৭ সালে বিশ্বভারতীর প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বাচুভাই শুক্ল এবং মুজতবা ‘প্রথম স্নাতক’ হিসেবে নন্দলাল বসু অঙ্কিত এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাক্ষরিত সনদ লাভ করেন।
এরপরে আমরা সবাইই জানি যে সৈয়দ মুজতবা আলী আফগানিস্তানের কাবুল গিয়েছিলেন, কিন্তু কেন গিয়েছিলেন? এই প্রসঙ্গে আলী সাহেব নিজেই এক চিঠিতে লিখেছিলেন ‘কাবুল গিয়েছিলুম সহজে টাকা রোজগার করে সেই টাকা দিয়ে জার্মানি গিয়ে পড়াশোনা করার জন্য’। কিন্তু কেন জার্মানি? কারণ কোন ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান তখনো বিশ্বভারতীর ডিগ্রীকে স্বীকার করে নি, কিন্তু জার্মানি বিশ্ব ভারতীকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।
সৈয়দ মুজতবা আলী অন্তত ১৫টি ভাষা খুব ভালো ভাবে জানতেন, শান্তি নিকেতনেই তিনি ৫ বছর জার্মান শিখেছিলেন, কিন্তু আমাদের অধিকাংশ মুজতবা ভক্তদের যেটা জানা নেই তা হচ্ছে ১৯৩৪ সালে বিশিষ্ট রেডিওলজিস্ট ডা অজিত বসু নিজের কাছে ইউরোপ যাবার সময় দোভাষী হিসেবে মুজতবাকে সাথে নিয়ে যান এবং তখন ৪ মাসের ইউরোপ পরিক্রমায় তারা ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, চেকোস্লাভাকিয়া ইত্যাদি ঘুরে ভেনিস থেকে মিশরে আলেকজান্দ্রিয়া এসে ট্রেনে করে কায়রো পৌঁছে এগারো মাসের মত সেখানে ছিলেন এবং ১৯৩৫এর বসন্তে জেরুজালেমও গিয়েছিলেন। কিন্তু মিশর নিয়ে তাঁর সুখপাঠ্য জনপ্রিয় ভ্রমণকাহিনী “জলে ডাঙ্গায়” কিন্তু লেখা হয়েছিল ১৯২৯ সালে সেপ্টেম্বরে মুম্বাই থেকে Messagerie Maritimets নামে ফরাসী জাহাজে করে জার্মান রওনা দেবার অভিজ্ঞতা থেকে!
৪৬ বছর বয়সে সৈয়দ মুজতবা আলী বিয়ের পিড়িতে বসেন এবং বাসর রাতে নববধূকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন মরক্কো চামড়ায় বাঁধানো তাঁরই লেখা অতি বিখ্যাত বই ‘দেশে-বিদেশে’। যদিও তাদের দাম্পত্য জীবন ছিল ২৩ বছরের কিন্তু খুব অল্প সময়ই তারা একসাথে কাটিয়েছিলেন, দুইজন দুই দেশের নাগরিক (সৈয়দ মুজতবা আলী ভারতের , স্ত্রী রাবেয়া খাতুন পূর্ব-পাকিস্তানের) , সেই জন্য পারিবারিক জীবন বলতে যা বোঝায় তা আসলে আলী সাহেব কোনদিনই পান নাই, তাইই জীবন সায়াহ্নে বারবার বলতেন “ জীবনে আমি কয়েকটা ভুল করেছি। প্রথম হলোঃ বিয়ে করে, দ্বিতীয়ত ঃ বেশী বয়সে বিয়ে করে, তৃতীয় ঃ বউ-ছেলেদের সঙ্গে না থেকে। ‘
এভাবে নানা পাতায় উঠে এসেছে তাঁর বিচিত্র নানামুখী জীবনের টুকরো টুকরো ঘটনা, প্রতিটা বই লেখার পিছনের কাহিনী। অদ্ভুত ভাবে রবি ঠাকুরের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র মুজতবা রবি ঠাকুরের মৃত্যু পর্যন্ত মাত্র ৫টী প্রবন্ধ লেখা হয়েছিল! পরে নিজের লেখা নিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন ‘কুকর্ম করে মানুষ জেলে যায়, আমিও কুমতলব নিয়ে লেখক হয়েছিলাম।‘ এবং সেটি আর কিছু নয়, কেবল অর্থের জন্য। উনার সেরা সেরা সকল লেখক এবং অনেক অমুজতবীয় লেখাও একটা মাত্র কারণে তিনি লিখতেন, অর্থ উপার্জনের জন্য। সারা জীবনে অসংখ্যবার চাকরি পরিবর্তন করা দুহাতে টাকা খরচ করা, নানা কারণে বছরের পর বছর মদের আশ্রয় নেওয়া আলী সাহেব টাকার অভাবে ভুগে লিখেওছেন
“ আমার বড় কষ্টে দিন যাচ্ছে। মানুষ after all পশু। একটু খেতে চায়। সেই বা কোথায়?”
বইটি প্রকাশ করেছে ভারতের সাহিত্য একাদেমি, প্রথম প্রকাশ ২০১০ সালে,
দাম ৪০ ভারতীয় রূপী।
লেখক প্রশান্ত চক্রবর্তীকে বিশেষ ধন্যবাদ এমন সুন্দর সন্নিবেশনের জন্য। উনি ডক্টরেট করেছেন সৈয়দ মুজতবা আলীর সাহিত্যের উপরে।
মন্তব্য
মুজতবা আলী বেশ স্মার্ট ও স্টাইলিশ একজন লোক ছিলেন। ১৫ টি ভাষা জানতেন - ব্যাপারটি কেমন যেন মিথের মত মনে হয়। আমি নিজে ৫/৬ টি ভাষা জানি, একেবারেই দফারফা অবস্থা শিখতে গিয়ে। বেসিক লেভেল কয়েক ডজন ভাষার শেখা সম্ভব, কিন্তু একে তো বিবেচনায় আনা দরকার না।
মুজতবা আলির সবগুলো বই পড়ে ফেলা অতীব দরকার বলে মনে হয়।
তার ভাই সৈয়দ মুর্তাজা আলীর বইগুলো সহজলভ্য নয়, খুব দরকারী কিছু বই একবার খুজে পাই নি। অণু ভাই, নামটা ঠিক করে দেন।
সৈয়দ মুর্তাজা আলী হবে বলছেন?
অবশ্যই উনার সব লেখার পড়ে ফেলা জরুরী, এবং বেশ কিছু লেখা বারবার পড়া যায়
facebook
হ্যা অণু ভাই, সৈয়দ মুর্তাজা আলী হবে।
এই মানুষটাকে স্বচক্ষে দেখেছিলাম ভাবতেই অবাক লাগে!!!!
(একটু নেইম-ড্রপিং করলাম, মাফ করে দিয়েন! )
****************************************
আপনার আলীক্ষার আলেখ্য তো তাহলে একখান বকেয়া আছে।
নেইম-ড্রপিং করতে গিয়ে একি জালে ফেঁসে গেলাম রে বাবা! কেউ বলে আলেখ্য চাই, কেউ চায় লেখ্য, আবার কারও দাবি আস্ত বই!!! হা হা হা!!!!
একটু গলা খাঁকারি দিয়ে সসংকোচে নিজের সব জারিজুরি ফাঁসপূর্বক স্বীকারোক্তি দিচ্ছি এখানে। সৈয়দ মুজতবা আলী মারা গেছেন ১৯৭৪ সালে। তাই আমি তাকে যখন দেখেছি তখন আমি আক্ষরিক অর্থে দুগ্ধপোষ্য শিশু না হলেও তার থেকে খুব বেশি দূরে ছিলাম না। ঐ বয়সে মুজতবা আলী কি চিজ তা বোঝার ক্ষমতা আমার হয়নি। আমি তখন বড়জোর রাতে মায়ের বুকে লেপ্টে তার মুখ থেকে ঠাকুরমার ঝুলি, ঠানদিদির থলে বা রুশদেশের উপকথার গল্পগুলি শু্নতে-শুনতে ঘুমুতে যাই। সোনার-কাঠি/রূপার কাঠি, অচিনপুরি, রাজকুমারি ভাসিলিসা বা বাবা ইয়াগা কে বললে হয়তো চিনতে পারতাম তখন, কিন্তু মুজতবা আলী? নৈব নৈব চ। হা হা হা! তাকে দেখেছিলাম এবং সেই স্ন্যাপশট বা ক্ষণচিত্ররূপী স্মৃতিটা মনে আছে সম্পূর্ণ অন্য কারনে - যা শুনলে এখন অনেকেরই অট্টহাসির উদ্রেক হবে। আমারও হয়। কিন্তু এনিয়ে বই দূরে থাক, এক লাইনের বেশি কোনো লেখ্য বা আলেখ্য লেখার কিছুই নাই। তো সেটা এখানেই বলে দেই।
মুজতবা আলীর মৃত্যুর আগে তার ধানমন্ডির বাসায় গিয়েছিলাম মায়ের সাথে। সে সময় তিনি বাসার ড্রয়িং রূমে বসে আছেন - এটুকুই মনে আছে - তার বেশি কিছু না। কোনো কথা হয়েছিল কিনা সেসব কিছু মনে নেই। তো এটুকুই বা কেন মনে আছে এতদিন? এটা একটু সন্দেহজনক। সত্যি জেনুইন মেমোরি নাকি মায়ের মুখে শুনে-শুনে পুনর্নির্মিত স্মৃতি আমি নিশ্চিত নই। তবে এটা মনে আছে, ঐদিন ওনার বাসার যাওয়ার আগে মগবাজার বা শান্তিনগর বা এরকম কোথাও সে সময় "Shade" নামের শিশু-কিশোর-তরুনদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় ও ফ্যাশনেবল একটা দোকান থেকে দুর্দান্ত একটা শার্ট কিনেছিলাম - যা আমার মনে হয় আমাকে সাঙ্ঘাতিকভাবে ইম্প্রেস করেছিল। সম্ভবত ১০০-টা বৃদ্ধ মুজতবা আলীর চেয়েও বেশি। হা হা হা। তো এই শার্ট কিনেই মুজতবা আলীর বাসায় গিয়েছিলাম। পুরো রাস্তা বোধহয় নতুন শার্টের গন্ধ শুঁকতে-শুঁকতেই গিয়েছিলাম। অথচ পরে বাসায় ফিরে এসে দেখি আমার ঐ অসম্ভব প্রিয় চক্রাবক্রা নতুন এবং তখনো প্যাক করা শার্টটা আর সাথে নেই। পথে কোথাও হারিয়ে ফেলেছি। তখন মনে হয়েছিল ওটা বোধহয় আলী সাহেবের বাসাতেই ফেলে এসেছি। আম্মা খোঁজ নিয়ে জেনেছিলেন যে ওটা ঐ বাসাতেও পাওয়া যায়নি। কিন্তু আমার কেন জানি বদ্ধমূল বিশ্বাস হয়েছিল আমি ওটা ঐখানেই ফেলে এসেছি। এই ঘটনায় অর্থাৎ ঐ শার্ট-বিয়োগ ব্যাথা বা বিচ্ছেদ-যন্ত্রণায় আমি এতটাই কাতর হয়ে পড়েছিলাম যে ঐ দুঃখ আমার দীর্ঘদিন যায়নি। তো আসলে, বুড়ো আলিজা / মুজতবা নন, আসলে ঐ শার্ট-ট্রাজেডির কারনেই হয়তো পুরো বিষয়টা আমার স্মৃতিতে থেকে গেছে - এবং শার্টের সূত্র ধরে হয়তো মুজতবার ঐ ক্ষণচিত্রও। পরে হয়তো আম্মার কথাবার্তাও হয়তো আমার এই ক্ষণস্মৃতির পরিপুষ্টি সাধণ করে থাকতে পারে। তো এই হচ্ছে ঘটণা। সবাইকে হতাশ করে তাই বলতেই হচ্ছে -- এই গল্পে মহান সৈয়দ মুজতবা আলী নন - সামান্য একটা শার্টই হচ্ছে আসল নায়ক। মুজতবা বড়জোর সাইড-কিক। হা হা হা
এইই হচ্ছে পুরো ঘটনা। আমার আর কিছু বলার নেই।
****************************************
ব্যাপারটা আরো জমতো যদি সেই চক্রাবক্রা পিরানখান কষ্টেসৃষ্টে পরা আলীসাহেবের কোনো কালদষ্ট ছবি বাজারে চলে আসতো।
এরকম একটা গল্প লিখতে এখন হাত চুলকাচ্ছে।
হা হা হা... লিখে ফেলুন! সবচেয়ে ভাল হয় যদি উইয়ের্ড, হরর বা সাইন্স ফ্যান্টাসি ঘরাণার কিছু হয়। আর তিনটাকেই যদি একসাথে পাঞ্চ করতে পারেন - তাহলে তো কথাই নাই!!! অনেকদিন আপনার এইধরণের গল্পগুলি পাচ্ছি না!
****************************************
আহা আহা, সে বেশ হয়
facebook
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
আপনার ওই ক্ষণিক স্মৃতিটাও বাঁধিয়ে রাখার মতো। শার্ট হারানোটাই শাপে বর হয়েছে।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
একদম
facebook
সৈয়দ মুজতবা আলীতে বুঁদ হয়েছিলাম সেই ১৯৮০ সালে ক্লাস সেভেন থেকে। স্কুল লাইব্রেরী থেকে তাঁর দেশে বিদেশে নেবার জন্য যে আহাজারি করেছিলাম, এখনো তাঁর রচনাসমগ্র কেনা হয়নি বলে সেই আহাজারি রয়ে গেছে। যদিও তাঁর সব উল্লেখযোগ্য পুস্তক আলাদা ভাবে কেনা ও পড়া হয়েছে এবং হচ্ছে। মুজতবা আলী হলেন সেই দুর্লভ লেখকদের একজন যার অন্তত দশটি বই আছে দশবার পড়েও কিছুদিন পর নতুন লাগে। পঞ্চতন্ত্র আমি তিরিশ বছর ধরে পড়ছি, এখনো পড়ি। দেশে বিদেশের কথা নাইবা বললাম।
আরেকটি তথ্য যাচাই করতে চাই। মুজতবা আলী কখনো পূর্ব পাকিস্তানে আসেননি। তাঁর 'বাংলাদেশ' বইটি পড়ে সেটাই মনে হয়েছে। অর্থাৎ দেশ ভাগের পর তিনি পশ্চিমবঙ্গেই থেকে গেছেন, কখনো পূর্ব পাকিস্তানে আসেননি। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরই এসেছেন। যদি ব্যাপারটা সত্যি হয় তাহলে মুজতবা আলীর অনন্য আরেকটি বৈশিষ্ট্য হয়ে থাকবে। যিনি বৃটিশ আমল থেকে সরাসরি বাংলাদেশ আমলে এসে পা দিয়েছেন বাংলাদেশে।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
সৈয়দ মুজতবা আলী পূর্ব পাকিস্তানে শুধু যে এসেছেন তাই না - সম্ভবত অসংখ্যবার এসেছেন। এমনকি শুধু তাই না - এখানে চাকরি পর্যন্ত করেছেন। প্রথমেই বহুবার আসার কারনটা বলি। আলী সাহেব ভারতে থেকে গেলেও তার স্ত্রী ও দুই সন্তান পূর্ব পাকিস্থানে চলে এসেছিলেন বা থেকে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ পরিবারের একজন ভারতে আর বাকিরা পূর্ব পাকিস্তানে। আমার জানা মতে ভারতে ওনার কোনো ২য় সংসার ছিল না। সুতরাং আমি অনুমান করি পরিবারের সাথে, স্ত্রী সন্তানের সাথে পারিবারিক সময় কাটাতে উনি সম্ভবত নিয়মিতই ঢাকা / সিলেটে আসতেন। আমার উপরের কমেন্টেই উল্লেখ করেছি - ধানমন্ডির খুব সম্ভবত ২ নং সড়কে ওনার বাড়ি ছিল। অনন্য বা বিরল বৈশিষ্ট্য যদি বলতেই হয়, তাহলে হয়তো এটাকেই বলা যায় যে - দেশবিভাগের পর আর কোনো বাঙালি লেখকের কথা আমার জানা নেই যার ক্ষেত্রে পরিবারের কর্তা সারা জীবন এক দেশের নাগরিক আর স্ত্রী-সন্তান আরেক দেশের!! আমি এরকমই জানি। ৭১-এর পরে উনি কোনো এক সময় দেশে এসেছিলেন বটে এবং এখানেই মৃত্যুবরণ করেছেন - কিন্তু উনি শেষ পর্যন্ত "বাংলাদেশের" নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন বা নজরুলের মত করে পেয়েছিলেন কিনা আমার জানা নেই। আমি যদ্দুর জানি উনি সবসময়ই ভারতীয় পাসপোর্টধারী ছিলেন। তবে এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই।
আর চাকরি? বাংলা উইকিপিডিয়া লিখছে --
এর সাথে আমি আরেকটা তথ্য যোগ করতে পারি। কোথায় পড়েছিলাম এখন আর মনে নেই, তবে এক কালপ্রিটের মুখে শুনেওছিলাম। বগুড়ার ঐ কলেজে পড়ানোর সময় তার বিরুদ্ধে নাকি তৎকালীণ স্থানীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী বা তাদের ছাত্র-শাখা তাকে ঐ কলেজ থেকে (এবং সম্ভবত পাকিস্তান থেকেই) বিতাড়ণ করার জন্য ব্যাপক তোলপাড় ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। খুব সম্ভবত তার রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবির পক্ষে বক্তব্য বা তাঁর র্সামগ্রিক ভাবে তৎকালীণ পাকিস্তানের পশ্চিমাংশের আরোপিত ভাবাদর্শ ও রাজনীতির বিপক্ষ অবস্থান এর কারন। স্পেসিফিক ইস্যুটা কি ছিল এখন মনে পড়ছে না। তবে তারা সফল হয়েছিল। তিনি পাকিস্তান ছাড়তে বাধ্য হন। ৯০-এর দশকে এই ঘটনা আমি সেই সময়ের এক সংস্কৃতিমনা (!!) অত্যুগ্র মৌলবাদীর কাছ থেকেও শুনেছিলাম। সে আমাকে বেশ রসিয়ে-রসিয়ে এই ঘটনার (কিভাবে মুজতবাকে তাড়ানো হল) বর্ণনা দিচ্ছিল এবং হাসতে-হাসতে জিহ্বা দিয়ে চুক-চুক করতে করতে ফেইক দুঃখ প্রকাশ করছিল।
****************************************
সঠিক। মুজতবা আলী পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক লেখা ৪৭ থেকেই লিখে আসছেন, মোগলরা যেরকম বাংলা বাদ দিয়ে ফার্সি চালাতে পারেনি সেরকম পাকিস্তানও উর্দু চাপাতে পারবেনা এরকম বিশদ উদাহরনসহ প্রবন্ধ আর ভাষন তিনি বগুড়াতে জয়েন করার আগে থেকে লিখে/বলে আসছেন, সেইটা নিয়ে স্থানীয় মোল্লারা এন্টি উর্দু ইজিকোল্টু আন্টি পাকিস্তান তকমা তাক করে দেয়। মুজতবা আলীর ভাইকেও এই গাড্ডডায় ফেলে এরা। মুজতবা আলী পরে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান।
..................................................................
#Banshibir.
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর উনিশশো সাতচল্লিশ সালেই (৩০শে ডিসেম্বর) সিলেটে এক বক্তৃতায় তিনি সাবধান বাণী উচ্চারণ করে বলেছিলেন- জোর করে উর্দু চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে বাংলার জনগণ পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ ঘোষণা করবে এবং পাকিস্তান টিকবে না। এ কারনে পাকিস্তান সরকার এবং উর্দুপন্থী গোষ্ঠী তাঁর প্রতি বিরূপ ছিল।
১৯৪৮ সালে বগুড়ায় এক সাহিত্যসভায় তাঁকে আমন্ত্রিত অতিথি করে নিয়ে আসা হয়, সেখানে তিনি তাঁর পাণ্ডিত্যপুর্ণ বক্তৃতায় সকলকে মন্ত্রমুগ্ধ করে তোলেন। এরপর বগুড়ার একদল শিক্ষক ও ছাত্র কলকাতায় গিয়ে অনেক অনুরোধ করে তাঁকে বগুড়া আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষের পদ গ্রহন করতে রাজী করিয়ে নিয়ে আসেন। বগুড়ায় এসে স্বভাবতই তিনি শুধু অধ্যক্ষ্যের চাকুরিতে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলেন না, সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ সহ নানা প্রগতিশীল কাজে ব্যপৃত হয়ে পড়লেন। কিন্তু এই মুক্তমনা প্রগতিশীল মানুষটিকে অপছন্দ করার মত মানুষও সেখানে ছিল, তারা শুরু থেকেই তাঁর বিপক্ষে অবস্থান গ্রহন করে, নানা কুৎসা রটনা ও ক্ষোভ বিক্ষোভের মাধ্যমে তাঁর জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে, বগুড়াতেই একসময় যেমনটা করেছিল ডঃ মুহম্মাদ শহিদুল্লাহ ক্ষেত্রে। এসময় কলেজের প্রকাশিত বার্ষিকীতে ভাষা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটি নিবন্ধ ছাপা হয়। এ ছাড়া তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ 'পূর্ব পাকিস্তানের রাস্ট্রভাষা" কলকাতার চতুরঙ্গ পত্রিকায় ছাপা হয়। এ সকল কারনে সরকার তাঁর উপর খড়গহস্ত হয়ে ওঠে এবং তাঁর কাছে কৈফিয়ত তলব করে এবং বলা যায়, তিনি গ্রেফতারের সন্মুখীন হন। বগুড়ায় তিনি অবস্থান করতেন সেখানকার তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও তাঁর মেঝ ভাই সৈয়দ মুর্তজা আলির বাসায়। এ সকল ঘটনায় তিনিও সরকার ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর কোপানলে পড়ার মুখে পড়েন। এমতাবস্থায় সবকূল রক্ষহা করার জন্য সৈয়দ মুজতবা আলি পালিয়ে কলকাতায় চলে যেতে বাধ্য হন।
আলীসাহেব ভারতেও খুব শান্তি পাননি। সম্ভবত '৬৫-এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর তাঁর পেছনে গোয়েন্দা পুলিশ লাগে এবং প্রচুর জ্বালাতন (বাসা তল্লাশি) করে। ইন্দিরা গান্ধীর সরাসরি হস্তক্ষেপে সম্ভবত এই নিগ্রহ থামে।
এই প্রঙ্গে একটা ইন্টারেস্টিং লেখা পেলাম হঠাৎ। অনেকে আগ্রহী হতে পারেন ভেবে এখানে কপি-পেস্ট মেরে দিলাম পুরোটাঃ--
বিঃদ্রঃ এই লেখায় বলা হচ্ছে আলীসাহেব "বাংলাদেশ স্বাধীন হলে সেখানে নাগরিকত্ব পান।" এটা কি কেউ কনফার্ম করতে পারবেন?
****************************************
সৈয়দ মুজতবা আলীর সাহিত্যিক দানের (লিগেসি বলতে চাই, এর বাংলা জানি না) কথা বলতে গিয়ে সৌম্যদীপ গোস্বামী এতকিছু ফেলে 'আনন্দ-দিয়ে-যাওয়া-কুট্টি'দেরই খুঁজে পেলেন শুধু? সৈয়দ সাহেব কি শুধুই রসিকতা দিয়ে আসর মাতানো মানুষ? খুবই বিরক্ত হলাম এটুকু পড়ে। অনুদার সম্পাদক আর আনপড় প্রদায়করাই মুজতবাকে নতুন করে কবর দেবে দেখছি।
খুব বাজে ভাবা টানা উপসংহার, খুবই বাজে ভাবে।
facebook
আমি আসলে বলতে চেয়েছি তিনি স্থায়ীভাবে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেননি। বেড়াতে এসেছেন কয়েকবার। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরই তিনি স্থায়ীভাবে চলে আসেন। তিনি যখন ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে আসেন তখনকার বিষয় নিয়ে লিখেছিলেন তাঁর একটি স্মৃতিচারণে। সেখানে তিনি বলছেন, "আমি এদেশে ১৯৪৭ সালে একবার 'পূর্ব পাকিস্তান' দেখতে আসি এবং ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৭০ সাল অবধি পারিবারিক কারণে প্রতি বৎসর দুয়েকবার এসেছি এবং প্রতিবারই একটানা কয়েক মাস কাটিয়ে গেছি"।( পৃষ্ঠা ১৭, 'বাংলাদেশ', সৈয়দ মুজতবা আলী)
বগুড়ার কলেজে চাকরী বিষয়ে উইকিভুক্ত তথ্যের সুত্র কী জানি না। তিনি নিজের বইতে সেরকম কিছু বলেননি।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
সুতরাং আমার অনুমানটাই ঠিক দেখা যাচ্ছে। আপনার উদ্ধৃতি থেকেই ওনার ভাষ্যেই জানা যাচ্ছে যে ১৯৫১ থেকে ৭০-এর মধ্যে ১৯ বছরে - বছরে ২ বার করে ধরলে - উনি অন্তত ৩৮ বার পাকিস্তানে এসেছেন!! এবং "প্রতিবারই একটানা কয়েক মাস কাটিয়ে গেছি"!! তাহলে আর উনি এখানে আসেননি কেমনে বলা গেল? বরং বলতে হয় উনি পূর্ব পাকিস্তানের জীবদ্দশার অন্তত ৫০% সময় এখানেই অতিবাহিত করেছেন!!! এটাকে যদি স্থায়ী বলা না যায়, তাহলে ওনার ভারতবাসকেও কি আদৌ স্থায়ী বলা যায়?? তাহলে উনি কোথায় স্থায়ী ছিলেন? ভাল প্যাঁচ লেগে গেল তো!!! হা হা হা.. *
উইকির তথ্যটা ভুল না। আরও বহু জায়গায় এর উল্লেখ আছে। আমি এই মুহূর্তে এর রেফারেন্স দিতে পারছি না, তবে উপরে সত্যপীর আর আব্দুল্লাহ এ.এম. ভাই আরও বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন এ বিষয়ে এবং তাদের সূত্র সম্ভবত ভিন্ন এবং বাংলা উইকির ঐ একটা বাক্যাংশের চেয়ে সম্ভবত অনেক বিশদ ও নির্ভরযোগ্য। তবে আমি আমার আগের মন্তব্যে যেমন উল্লেখ করেছি - যদ্দুর মনে পড়ে একজন প্রত্যক্ষদর্শীর মুখেই এই ঘটনার বিবরণ শুনেছি। শুনেছি ৯০-৯২ সালের দিকে একজন ৬০-৭০ বছর বয়সী ব্যক্তির কাছে যার বাড়ি ঐ অঞ্চলেই ছিল। সুতরাং এই ঘটনায় তার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার - এমনকি জড়িত থাকারও সমূহ সম্ভাবণা আছে মুজতবার বিরোধী পক্ষের রাজনীতির অনুসারী হিসেবে। মুজতবা হয়তো তার ঐ বইতে এটা উল্লেখ করতে ভুলে গেছিলেন বা হয়তো তিক্ত প্রসঙ্গটা উল্লেখ করতেই চাননি।
--------------------------
* সিরিয়াসলি নিয়েন না - একটু ফান করলাম। তবে আমার যুক্তিটা একদম ফেলনাও হয়তো না, কি বলেন?
****************************************
একটা নির্ভরযোগ্য সূত্র অবশেষে পেয়েছি আমি! সৈয়দ মুজতবা আলীর বড়ভাই সৈয়দ মুর্তজা আলী ও ভ্রাতুষ্পুত্র সৈয়দ রেজা আলীর লেখা "মুজতবা কথা"-য় আলীসাহেবের বগুড়াবাসের অনেক কথাই আছে। বইটা আমি পড়িনি, কিন্তু এটাকে তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহার করে আরেকজনের একটা লেখা পরলাম যেখানে এর উল্লেখ ছিল তথ্যসূত্র হিসেবে। মুর্তজা আলী মুজতবার বগুড়াবাসকালীণ এসব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী, কারন তিনি ঐ সময়েই বগুড়া জেলার "প্রশাসনিক প্রধান" (ডিসি?) ছিলেন এবং কলেজ অধ্যক্ষের বাসভবন না থাকায় মুজতবা বড়ভাইর সরকারি বাসভবনেই উঠেছিলেন। মুজতবার সূত্রে তার বড়ভাই মুর্তজাকেও জড়ানো হয় সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার অভিযোগে। তাঁকে একপদ ডিমোশন দিয়ে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় চট্টগ্রামে। ফলে তিনি এইসব ঘটনার চাক্ষুস সাক্ষী এবং নিজেও ভুক্তভোগী ছিলেন। এসব কথাই তার বইয়ে এসেছে।
****************************************
লেখা চাই সেই নিয়ে
facebook
চাই, চাই, লেখা চাই।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
এই বইটা ই-বই হিসেবে পাওয়া গেলে বেশ হয়।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
মানুষ তার হৃদয়, তার চিন্তাশক্তি, তার আশা-আকাঙক্ষা, তার শোকনৈরাশ্য দিয়ে বিরাট ব্রহ্মকে আপন করে নিয়ে কত রূপে দেখেছে তার কি সীমা-সংখ্যা আছে? ইহুদিরা দেখেছে যেহোভাকে তার রুদ্ররূপে, পারসিক দেখেছে আলো-আঁধারের দ্বন্দ্বের প্রতীক রূপে, ইরানি সুফী তাকে দেখেছে প্রিয়ারূপে, মরমিয়া বৈষ্ণব তাকে দেখেছে কখনও কৃষ্ণরূপে কখনও রাধারূপে, আর ক্যাথলিক তাকে দেখেছে মা-মেরির জননীরূপে।
Köln শহরের বিরাট চার্চের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার পথে কতবার সৈয়দ মুজতবা আলীর বলা এই কথাগুলি আওড়ে গেছি!
রাজর্ষি
আমার পড়া সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রথম বইটা মনে হয় জলে-ডাঙায়। আবু সয়ীদ আইয়ূবের সাথে বন্ধুত্বের বিষয়টা নিয়ে আরো একটু বিস্তারিত কোন বইয়ে পাওয়া যাবেকি? একেবারে শৈশব থেকে বন্ধুত্বটা বজায় থাকলে চমকপ্রদ অনেক তথ্য জানার আছে এই সম্পর্ক নিয়ে।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
এই বইতেই প্রথম জানলাম ভাইয়া, সত্যি বলতে এর আগ পর্যন্ত এটাই জানতাম না
facebook
আলি সাহেবের সাথে আমার প্রথম যোগাযোগ কিশোর বয়সে, ক্লাস নাইনে পড়ার সময়, তাঁর সুবিখ্যাত বই 'দেশে বিদেশে' এর মাধ্যমে। এই বইয়ের একটি অধ্যায় 'প্রবাস বন্ধু' নামে আমাদের বাংলা পাঠ্য ছিল, তার শুরুটা এখনও মনের মধ্যে গেঁথে আছে- "বাসা পেলুম কাবুল থেকে আড়াই মেইল দূরে খাজামোল্লা গ্রামে"। সে সময় আর কী কী আমাদের পাঠ্য ছিল, তার সব কিছু এখন আর মনে নেই, কিন্তু পরিস্কার মনে আছে প্রবাস বন্ধু'র কথা। সেটা পড়তে গিয়েই জানলাম তা আসলে 'দেশে বিদেশে' নামক একটি বইয়ের অংশবিশেষ, অতঃপর স্কুলের লাইব্রেরীতে খুঁজে পুরো বইটাও পড়েছিলাম।
আহা, প্রিয় বই! সবচেয়ে প্রিয় বাংলা বই।
facebook
খুব ছোটবেলা থেকেই দেখতাম বাসার তাকে তিনটে বই -জলে ডাঙায়, পঞ্চতন্ত্র আর সবনম। জলেডাঙার সেই পুরোন প্রচ্ছদ স্ফিংস, পিছনে পিরামিড আর পাশে ধুসর রঙের জাহাজ। তখন সবে বই পড়তে শিখেছি, বড়দের বই মনে করে ধরতাম না। অনেকপরে যখন স্কুলের পাঠ্যবইয়ে লাঞ্চিয়ন, পন্ডিতমশাই ইত্যাদি গল্প পড়ে হেসে খুন হয়েছি তখন বুঝেছি কত মজার একজন লেখকের লেখা এতদিন ধরে না পড়ে ফেলে রেখেছি। তারপর আর দেরি করিনি। মনে আছে অনুর পরিব্রাজক হয়ে ওঠার আগে কথায় কথায় ওকে মুজতবা আলীর কথা বলাতেই হাস্যজ্জ্বল হয়ে উঠতো ওর মুখ। মনে হয় প্রিয় লেখক বলে কিনা । বুক রিভিউ খুব ভালোগলো বন্ধু !
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
আলীসাহেবের মূল গল্পটার নাম পাদটীকা। স্কুলপোড়োদের জন্যে এটার খণ্ডিত সংস্করণটার নাম পণ্ডিতমশাই কেন রাখা হলো, কে জানে? সম্ভবত স্কুলঘরে হাহা-হিহি ঠেকানোর জন্যেই। যারা দেশে বাচ্চাদের বাংলা সাহিত্য পড়ানোর ছক কাটেন, তারা ফুটনোটের প্রচলিত বাংলা শব্দটা শেখানোর চমৎকার এক সুযোগ থেকে ছাত্রদের যেমন বঞ্চিত করলেন, তেমনই এক শব্দে গল্পের এমন মোক্ষম নামকরণের উদাহরণ আর কৌশলটাও তাদের সামনে থেকে সরিয়ে নিলেন।
পাদটীকা গল্পটার শেষ দুই স্তবকও সম্ভবত পণ্ডিতমশাইতে গায়েব, যেখানে পুরো গল্পটা এক শিশুতোষ চপল জগৎ থেকে পাঠককে এক টানে একজন দরিদ্র মানুষের অপমানের প্রাবল্যের সামনে দাঁড় করায়।
দেশে যারা ছাত্রদের জন্যে গল্প বাছেন, তাদের প্রতি অনুরোধ, তারা চটুল গল্প পড়াতে চাইলে আগাগোড়া চটুল গল্প বিনা শব্দক্ষয়ে পাঠ্য বইতে ঢোকান। বাংলা সাহিত্যের মহৎ কীর্তিগুলোকে এভাবে কসাইয়ের মতো কেটেকুটে রস নষ্ট করে পড়ালে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
বাংলাদেশের পাঠ্যবই নিয়ে হুমায়ূন আজাদ চমৎকার একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন।
আমাদের দেশে পাঠ্যবই সঙ্কলন এবং সম্পাদনার দায়িত্বে থাকেন সাধারণতঃ আমলা এবং মহা-/ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেসব শিক্ষক যারা সাহিত্যিক (অথবা গবেষক) হিসেবে মোটের ওপর ব্যর্থ। একারণে আমাদের পাঠ্যবইগুলিও তথৈবচ। কার মনে আছে নিম্ন-মাধ্যমিকের বিজ্ঞান বইতে "এসো নিজে করি" নামের সেই বিভীষিকার কথা? বিজ্ঞানের মৌলিক ধারণা এবং প্রত্যয়গুলির ব্যাখ্যা না দিয়ে কিছু পরীক্ষণ দিয়ে বই ভর্তি থাকত। পরীক্ষণগুলির শেষে কিছু প্রশ্ন থাকত, অথচ বইতে সেসব প্রশ্নের কোন উত্তর পাওয়া যেত না। আর বিভিন্ন কারণে শ্রেণীকক্ষে যেহেতু এই পরীক্ষণগুলি করান হত না, প্রশ্নগুলির উত্তরের জন্য় আমাদের উচ্চতর বিজ্ঞান বই খুঁজতে হত। আমার তো এখনও মনে আছে যে সপ্তম/অষ্টম শ্রেণির বিজ্ঞান পরীক্ষার জন্য আমি উচ্চ মাধ্যমিকের বই পড়ে প্রস্তুতি নিয়েছি!
পশ্চিমের বিজ্ঞান পাঠ্যবইয়ের নকল করে লেখা আমাদের এই বিজ্ঞান বইগুলির সম্পাদক ছিলেন ডঃ শাহজাহান তপন। তিনি নিজেকে দাবী করতেন বিজ্ঞানী হিসেবে, অথচ তাঁর পি এইচ ডি ছিল শিক্ষার ওপরে। তিনি প্রমাণ যে শিক্ষার ওপরে পি এইচ ডি একটি হাস্যকর বস্তু। প্রাকৃতিক/সামাজিক বিজ্ঞানের কোন মৌলিক বিষয়ের ওপর পি এইচ ডি করার সামর্থ্য/সুযোগ যাদের হয় না, তারা যায় শিক্ষা, সাংবাদিকতার মত হাঁসজারু বিষয়ে পি এইচ ডি করতে!
এটা একটা চরম বর্ণবাদী, কূপমন্ডুক, মনুষ্যত্বের অবমাননাকারী, ঘৃণ্য এবং বলাই বাহুল্য - মিথ্যা বক্তব্য। তাও কিনা আবার সৈয়দ মুজতবা আলীর মত একজন মহৎ ও অসাধারণ প্রতিভাবান ব্যক্তিত্বকে নিয়ে লেখা একটা পোস্টে - যিনি কিনা নিজেও মন্তব্যকারীর যুক্তি অনুসরণ করলে একটা "প্রাকৃতিক/সামাজিক বিজ্ঞানের কোন মৌলিক বিষয়ের ওপর পি এইচ ডি" করতে অসমর্থ "হাঁসজারু" একটা বিষয়ে পিএইচডি নামক "হাস্যকর বস্তু"-তে অভিষিক্ত ততোধিক হাস্যকর একজন প্রাণী!!!!(এই যুক্তির সিঁড়িতে আসলে মুজতবা আরও অনেক খারাপ বিষয়ে পিএইচডিধারী - হাঁসজারু বললে বোধহয় কমই বলা হবে!!)!!!!
আমি এইরকম মনুষ্যত্বের অবমাননা ও বিমানবিকায়নকারী, ডিহিউম্যানাইজিং ঘৃণ্য বর্ণবাদী বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং মডুদের কাছে এইরকম মন্তব্যের অপসারণ বা উপযুক্ত পদক্ষেপ দাবি করছি। ধন্যবাদ!
****************************************
আপনার এই আপত্তিকর যুক্তি ধরে বাংলাদেশের প্রায় সকল বিষয়ের পিএইচডিধারীদের মাঝে কারো না কারো আকামের উদাহরণ টেনে সেই বিষয়ে উচ্চতর গবেষণাকে 'হাস্যকর' ডাকা যাবে। আপনার কাছ থেকে আমরা বরাবরই সুচিন্তিত মন্তব্য পেয়ে আসছি; এবার থমকে গেলাম।
শিক্ষার যত ধাপ ওপরে ওঠা যায়, ততই তো 'হাঁসজারু'ত্ব বাড়তে থাকে, তাই না? শিক্ষার নানা শাখার মধ্যে অন্তঃপ্লাবন না ঘটলে আজ পৃথিবী অন্যরকম হতো।
আমি আমার আগের মন্তব্যকে সমর্থন করে প্রতিমন্তব্যে দুটি বিষয় নিয়ে আসবো। বলাবাহুল্য, মন্তব্য প্রকাশ করা বা না করা কর্তৃপক্ষের এক্তিয়ার।
১. শিক্ষকতার সুবাদে গত প্রায় এক দশক ধরে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষায় পি এইচ ডি-ধারীদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয়েছে। এই শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা শ্রেণীকক্ষে পড়ান না; তারা সাধারণতঃ হয়ে থাকেন নীতিনির্ধারক এবং প্রশাসক। এদের কাজ হল কিভাবে শ্রেণীকক্ষে পড়াতে হবে, সেই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের নসিহত করা। যেহেতু এই শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা নিজেরা কোন বিষয়েই বিশেষজ্ঞ নন, তাদের নসিহতগুলি শেষ পর্যন্ত বহিরাঙ্গকে গুরুত্ব দেয়, ইংরেজিতে যাকে বলতে পারি form over content। কিন্তু ফর্ম আর কন্টেন্ট খাপে খাপে মিলছে কিনা, এবং/অথবা তাদের পরামর্শ মোতাবেক প্রশিক্ষণ পদ্ধতি পরিবর্তন করার পরে শিক্ষার্থীদের পারফর্মেন্সের কোন উন্নতি হচ্ছে কিনা, সেই ব্যাপারে তাদের মাথাব্যথা থাকে না (অন্ততঃ আমার চোখে পড়েনি)। যে প্রশিক্ষণ পদ্ধতি প্রাথমিক বা মাধ্যমিক পর্যায়ে কার্যকর, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সেই প্রশিক্ষণ পদ্ধতি কতটুকু কার্যকর, বা আদৌ কার্যকর/ প্রয়োজনীয় কিনা – এসব প্রশ্নের কোন সদুত্তর এই শিক্ষায় পি এইচ ডি-ধারীদের কাছ থেকে পাইনি। সুতরাং, এই শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতামতের প্রতি আমার কোন শ্রদ্ধা বা গুরুত্ব নেই।
২. সৈয়দ মুজতবা আলী পি এইচ ডি করেছিলেন তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের ভিত্তি যে বিষয়গুলি (ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, ইতিহাস, ইত্যাদি), সেগুলির দৃঢ় দার্শনিক এবং বৌদ্ধিক ভিত্তি আছে। অন্যদিকে হাঁসজারু বিষয়গুলির দার্শনিক এবং বৌদ্ধিক ভিত্তি নড়বড়ে। যেহেতু শিক্ষার কথা বলেছিলাম, একাডেমিক বিষয় হিসেবে শিক্ষার প্রাথমিক ভিত্তি মনোবিজ্ঞান; আরও সঙ্কীর্ণভাবে বলতে গেলে শিশু মনোবিজ্ঞান (যদিও শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা এখন দাবী করেন যে সব কিছুই নাকি তাদের ভিত্তি)। মনোবিজ্ঞানের দার্শনিক- বৌদ্ধিক ভিত্তি কতটুকু সবল, সেব্যাপারে একবিংশ শতকেও বিতর্ক (https://www.psychologytoday.com/us/blog/theory-knowledge/201601/the-is-psychology-science-debate) চলছে। অন্যদিকে দর্শন বা ইতিহাসের দৃঢ়তা নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। আমি একমত যে জ্ঞানের যত উচ্চপর্যায়ে যাওয়া যায়, মৌলিক বিষয়গুলির মধ্যে তত বেশী সংলাপ এবং আন্তঃপ্লাবন হয়। কিন্তু উচ্চতর পর্যায়ের সেই বিষয়গুলিকে আমি হাঁসজারু বলব, যেগুলির মৌলিক বিষয়ের ভিত্তি দুর্বল। এবং শিক্ষা আমার মতে সেরকম একটি বিষয়।
পাদটীকাঃ গয়রহ ব্যবহার করলে “বর্ণবাদ” শব্দটা অর্থ এবং গুরুত্ব হারায়।
আলী সাহেবের লেখাগুলির কতটা পড়া হলনা সেই আফসোস ঘোচাতে গতবার দেশে থাকতে একেবারে সব বই কিনে ফেলার মানতে গিয়েছিলাম দোকানে। গিয়ে দেখলাম, ও রচনা সমগ্র কিনতে পারলেও বয়ে আনতে পারব না। সেই দুঃখটা চাড়া দিল এই লেখাটা পড়ে।
বাংলা সাহিত্যের যা পড়তে চাই সেসব যতদিনে ই-বই হয়ে আসবে, ততদিন বাঁচব বলে ভরসা হয়না!
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
আহারে, তাও পড়তে থাকেন, সেটাও মন্দ না
facebook
কুইনিনের সংখ্যাগুলোর কি হল? কোনও সংকলন প্রকাশিত হয়েছে কি?
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
খবর পাচ্ছি না ভ্রাত, কিছু জানতে পারলে জানায়েন
facebook
অজানা কিছু জানতে পারলাম।
শুভেচ্ছা
facebook
কৈশোরে সৈয়দ মুজতবা আলীর লুসাই ভাষা শেখার চেষ্টার বিষয়টি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছি। কারণটা সিলেটে লুসাই জাতির মানুষ কী পরিমাণে বাস করেন/করতেন সেটা ভেবে। মণিপুরী/বিষ্ণুপ্রিয়া, খাসি, বা পাত্র ভাষা হলে নির্দ্বিধায় মেনে নেয়া যেতো। এই তথ্যটির ব্যাপারে কারো অন্য কোনো রেফারেন্স জানা থাকলে সেটি জানানোর জন্য অনুরোধ করছি।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
নতুন মন্তব্য করুন