“জনগোষ্ঠী হিসেবে লেপচাদের ইতিহাস হল সেই চিরকালীন হঠে যাবার, হারিয়ে যাবার গল্প। ব্রিটিশরা আসার আগে দার্জিলিঙের জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড় ছিল লেপচাদের। পাহাড়ের প্রকৃতির সঙ্গে, এই প্রকৃতির বীজ ফুল পাতা জীবজন্তু পোকামাকড় জল ও পাথরের সঙ্গে ওদের যে নিবিড় সম্পর্ক ছিল, তা ধরা আছে ওদের রংরিং ভাষায়। প্রায় প্রতিটি জীব ও উদ্ভিদপ্রজাতির নির্দিষ্ট নাম রয়েছে, রয়েছে আলো হাওয়া ও জলের ভিন্ন ভিন্ন মেজাজ ও গড়নের জন্য বিশেষণ, যা অননুবাদ্য।
ঘটনা এটাই যে, ওদের এই আশ্চর্য ভাষাকে- যাকে ভাষাপন্ডিতেরা বলেছেন পৃথিবীর প্রাচীনতম জীবিত ভাষা- বলা হয়েছে অশুদ্ধ, অনুন্নত। সেই ভাষাভাষী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ওদের নাম ; লেপচা, বা লাপচে - অর্থাৎ যারা অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলে। ভাষাটা হারিয়ে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র জলেরই অসংখ্য চিত্রকল্প।“
- পরিমল ভট্টাচার্যের অবশ্যপাঠ্য বই ' দার্জিলিং' থেকে এই অসাধারণ লাইনগুলি ঘুরপাক খাচ্ছিল দার্জিলিং- কালিম্পং আসার পর থেকেই। এই অঞ্চলের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী লেপচারাই, তাদের প্রথমে ব্রিটিশ, পরে ভারতীয় নানা জাতিগোষ্ঠী একে একে কোণঠাসা করে নিজ ভূমেই পরবাসী বানিয়ে রেখেছে। আর তাই কালিম্পং আসার পর থেকেই ভ্রমণসাথী মোশাররফ ভাই ও সজীব ভাইকে তাগাদা দিয়ে আসছিলাম এখানে ‘লেপচা’ জাদুঘরে যাবার জন্য।
গাড়ির চালক আবার এখানে কোন দিন যান নি, কোন পর্যটক নাকি এখানে যাবার সুলুক সন্ধান করেন নি, তাই বেশ খানিকটা পাহাড়ি পথে নাকানিচুবানি খেয়ে, বার দুই একটি পাকদন্ডী ধরে উঠানামা করে অবশেষে এক ইট বিছানো চত্বরে গাড়ী থামলো, সাথে দ্বিতল সাদা ভবনের গায়ে গাঢ় নীলে লেখা ‘ পদ্মশ্রী সোনাম শেরিং’-এর লেপচা জাদুঘর!
তাহলে ঘুরে ঘুরে হলেও ঠিক জায়গায় আশা গেল অবশেষে। গটগট করে সিঁড়ি বেয়ে জাদুঘরের গেটেও যাওয়া হল, কিন্তু সেটি তালাবন্ধ! কী ব্যাপার? জাদুঘর আজকে খোলার কথা সকাল ১০টায়, ইন্টারনেটে এগুলো তথ্য যাচাই করে তবেই না এসেছি এত দূরে, এতটা আগ্রহ নিয়ে। সাথেই লেপচা ছাত্র-ছাত্রীদের ডরমিটরি। সেখানে উপস্থিত দুইজন জানালো যে জাদুঘরের গাইড একটু অসুস্থ, তিনি দুইটার আগে আসবেন না! শুনেই আমাদের মাথায় হাত, কারণ সেদিন আমি আর সজীব ভাই সিকিমের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেও, মোশাররফ ভাই ফিরে যাবেন শিলিগুড়ি হয়ে বাংলাবান্ধা দিয়ে বাংলাদেশে, তাই সময় খুবই কম। দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাবে না কোনভাবেই!
সেই লেপচা ছাত্রদের খুব অনুরোধ করে বললাম সেই অবস্থা বুঝিয়ে, এবং সেই সাথে বললাম দূরের বাংলাদেশ থেকে এসেছি তাদের জাতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েই, তারা যেন আমাদের আগ্রহের মূল্যটুকু রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুতেই তাদের মতের পরিবর্তন ঘটে না, সেই একই কথা, আজ দুপুরের আগে কিছুই হবে না!
তখন কিছুটা জোর গলাতেই খানিকটা কৃত্রিম রাগ মিশিয়ে বলতে বাধ্য হতে হল যে যদি জাদুঘর খোলা নাই রাখা সম্ভব হয় তাদের অবশ্যই উচিত ছিল সেটা ওয়েবপেজে জানানো। আর আমাদের গাইড লাগবে না, যেন শুধু চাবিটি এনে দরজা খুলে দেওয়া হয়, আমরা নিজেরাই টিকেট কেটে দ্রুত জাদুঘরটি দেখে ফিরে যাবো। সেই সময় এক ছাত্র মিনমিন করে বলল, আসলে গাইডের বয়স তো ৯৬ বছর, আজ তাঁর শরীরটা একটু খারাপ, এটুকু বোঝার চেষ্টা কর!
৯৬ বছর! সেকি উনিতো জীবন্ত ইতিহাস! আমাদের আগ্রহ যেন ঘি দিয়ে নেভানোর চেষ্টায় আরও দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল! নাহ, এই জাদুঘর উনার হাতেই গড়া, পারলে দেখা করতেই হবে! ফের ফোন দেওয়া হল, এবার উনি জানালেন, আচ্ছা, এত আগ্রহ যখন বিদেশীদের তারা যেন এসে চাবি নিয়ে যাই।
চললাম সেই দুই লেপচা তরুণের সাথে আমরা পাহাড়ের নিচের বাংবসতি গ্রামে, ভদ্রলোক শুনলাম প্রতিদিন এই রাস্তা হেঁটে হেঁটেই যেয়ে জাদুঘর খোলেন! অবশেষে সেই গ্রামে যেয়ে কয়েক বাড়ি পরেই দেখি এক মাটির বাড়ীর দাওয়ায় বসে সৌম্য দর্শন হাস্যমুখি এক ভদ্রলোক দাড়ি শেভ করছেন, বেশ সেকেল আমলের রেজার দিয়ে চোস্ত ভাবে! ইনিই সোনাম শেরিং ( যাকে সবাই থিকুং বা দাদু বলে ডাকে)। বিহ্বল হয়ে পা ছুঁয়ে প্রণাম করে প্রথম প্রশ্ন করলাম, দাদু তোমার বয়স কি আসলেই ৯৬?’, উনি এক গাল হাসি দিয়ে বললেন, না না, আমি তোঁ মোটে ৯৪ !
সেখানে প্রায় আধা ঘণ্টা থিকুং ও উনার স্ত্রী আমমিত তামসাংমু অনেক গল্প করলেন লেপচা ভাষা ও মানুষদের নিয়ে, তারপর আমাদের অবাক করে ধোয়া পোশাক পরে এসে বললেন চলো তোমাদের জাদুঘরটা ঘুরিয়েই দেখায়, এত আগ্রহ দেখাচ্ছ! উনি বাংলা কয়েকটা শব্দ জানেন, ইংরেজিও মোটামুটি, কিন্তু চোস্ত হিন্দি বলেন। তাঁর স্ত্রী জানালেন প্রতিদিন ভোরে উঠেন থিকুং গ্রামের সবার বাড়ীর সামনে দিয়ে হেঁটে বেড়ান, খোঁজখবর নেন তারপর নাস্তা করে উপরের দিকে ঠুক ঠুক করে হেঁটে হেঁটে পাহাড় পেরিয়ে তাঁর জাদুঘরে যান!
আমাদেরও নিয়ে গেলেন সেই অনন্য জাদুঘরে, যা আসলে উনার একক সংগ্রহশালা গত অনেক অনেক দশকের! ভিতরে ঢুঁকে দেখি থিকুং অতি বিখ্যাত মানুষ, সেই জওহরলাল নেহেরু থেকে শুরু করে আব্দুল কালাম হয়ে মমতা বন্দোপাধ্যায় সকলেই তাকে কোন না কোন খেতাব দিয়েছেন এবং সেই ছবিগুলো সযত্নে সংরক্ষিত আছে। তখনই নিশ্চিত হলাম যে উনিই আসলে ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব পদ্মশ্রী প্রাপ্ত ব্যক্তিটি!
অথচ কী এক মাটির মানুষ! আমাদের নিজের হাতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন লেপচা জাতির নানা নিদর্শন, ইতিহাস, সঙ্গীত, মৃৎ শিল্প, পোশাকের।
এবং তারপর আমাদের অবাক করে দিয়ে চেয়ারে বসে একের পর এক বাজিয়ে শোনালেন অন্তত ২৫টি নানা জাতের বাদ্যযন্ত্র! কোনটি বাঁশী, কোনটি গীটার জাতীয়, কোন কোনটি আবার একদম খাঁটি আদিবাসী যন্ত্র, বাঁশের তৈরি! আহা, সে কী সুর! পাহাড়ের রিনরিনে সুরে যেন হৃদয় ভিজে যায়, ৯৪ বছরের লেপচা জাদুকর সেই ঘরের মধ্যে অপার্থিব সুরের ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করে যেন হিমালয়কে নিয়ে আসেন হৃদয় গভীরে, চোখ বন্ধ করলেই স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারি তুষার ছাওয়া পথে ইয়াক নিয়ে চলতে চলতে লেপচা রাখালের সুর, সাথে পাখির ডাক, বাতাসের শনশন!
এমন অভিজ্ঞতা জীবনে হয়না সহসা, দুই দিন আগে রোদ ঝলমলে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে যে পরিমাণ মুগ্ধ হয়েছিল, এই জীবন্ত ইতিহাসের সাথে সময় কাটিয়ে যেন আরও বেশি আনন্দ লাভ হল, মনে হল তীর্থযাত্রার সমান মোক্ষলাভ করে তবেই ফিরে যাচ্ছি আমরা, আর সাথে সারা জীবনের মত এই লেপচা শব্দ ও সুরের জাদু নিয়ে।
থিকুং নিজে একজন কবি ও গীতিকার, তাঁর লেখা লেপচা ভাষার বই আছে যেখানে ২০০র অধিক গান আছে, বইখানা পরম আগ্রহ ভরে সংগ্রহ করলাম উনার সাক্ষরসহ, এবং বললাম উনাকে অবশ্যই ১০০ বছর বাঁচতেই হবে, তখন আমরা আবার আসব তাকে দেখতে, আর এই অপূর্ব গান শুনতে!
পদ্মশ্রী সোনাম শেরিং লেপচাকে প্রশ্ন করেছিলাম, কেন এই জাদুঘর বা সংগ্রহ গড়ে তোলার স্পৃহা কেন আসলো তাঁর মধ্যে? উনি নিষ্পাপ হাসি দিয়ে বললেন, এক সময় তিনি খেয়াল করলেন তাদের জীবনযাত্রা খুব দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, এবং লেপচারা অনেকেই আগের জীবনের অনেক নিদর্শন অবহেলায় ফেলে দিচ্ছিল, তাঁর মনে হল ভবিষ্যতের জন্য এই নিদর্শনগুলো সংগ্রহ করে রাখা দরকার, এই ভাবেই কয়েকজন লেপচা শিকারির জিনিস দিয়েই তাঁর সংগ্রহ শুরু, যা এখন পরিণত হয়েছে একটি জাতির সবচেয়ে সমৃদ্ধ সংগ্রহশালায়!
উনার সাথে থাকা সম্পূর্ণ সময়ই ছিল জাদুবাস্তবতায় ভরা যেন! কল্পলোকের এক জাদুকরের মতো ইতিহাস আর সুরের আলো দিয়ে আমাদের সামনে জ্বালিয়েছিলেন সুন্দর জীবনের আগুন! হে মহামানব সোনাম শেরিং লেপচা, আপনাকে শত কোটি প্রণাম, এই জীবন ভর মহান উদ্যোগ জারি রাখার জন্য, সবার সামনে উদাহরণ সৃষ্টিকারি প্রাণচাঞ্চল্যের জন্য। আপনার জন্য ভালোবাসা, আশা করি শত বর্ষে আপনি এমনই থাকবেন!
( প্রিয় মোশাররফ ভাই ও থিকুং)
( এই লেখাটি কিছুদিন আগে লিখেছিলাম। দুঃখজনক ভাবে প্রিয় লেপচা দাদু আর নেই আমাদের মাঝে, এই বছরের ৩০ জুলাই উনি দেহত্যাগ করেন। কালিম্পং গেলে অব্যশই উনার গড়ে তোলা লেপচা জাদুঘরে যাবেন)
মন্তব্য
সম্পূর্ণ নতুন একজন মানুষ সম্পর্কে জানতে পেরেছি বলে ভালো লাগছিল। কিন্তু শেষে এসে মন খারাপ হয়ে গেল। উনি আর নেই। ধন্যবাদ অনু'দা।
আঘ্রাণ প্রান্তর
আমিও জানতাম না, খুব আশা করে ছিলাম যে আবার দেখা হবে। আশা করি উনার সংগ্রহশালা টিকে থাকবে
facebook
নিশ্চয়ই যাব। ধন্যবাদ এই লেখাটির জন্য
গুডরিডস
জানিয়েন যাবার আগে, ঐ অঞ্চলে অনেক কিছু দেখবার আছে, রবীন্দ্রনাথের বাড়িসহ
facebook
কি অসাধারণ ইতিহাস! ওঁনার লিগ্যাসি বহমান থাকুক যুগ যুগান্তর ধরে! বলছিলেন উনি ই গাইড জাদুঘরের, এখন কি অবস্থা জানেন কি?
অর্ণব
লেপচা ছাত্ররা কেউ চালাবে আশা করি। ফের ওদিকে গেলে দেখতে যাব
facebook
নতুন মন্তব্য করুন