‘সত্যজিৎ আর ঋত্বিকের মধ্যে তফাতের কথা সবাই বলেন কিন্তু এদের মধ্যে কতটা যে মিল সেটা কেউ বলেন না। ওঁরা একই জেনারেশনে বিলং করতেন, একই ধরনের আশাবাদ, একই মানবিকতায় বিশ্বাসী। সত্যজিৎ-ঋত্বিকের প্রতিটি ছবিই শেষ হয় আশাবাদে।‘
অভিনয়ের নানা চরিত্রের সন্ধানেই যেন জীবনটা দীর্ঘ জীবন কাটিয়ে দিলেন ওমর অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, নানা আঙ্গিকে দেখেছেন বারবার নিজের অভিনীত চরিত্রগুলোকে, দেশে-বিদেশের চলচ্চিত্রে-মঞ্চে হাজারো জনের অভিনয় দেখেছেন, তুলনা করেছেন, নিজেকে আরও পরিণত করেছেন, দ্বিধাহীন চিত্তে বলেছেন, “ শেষ পর্যন্ত জীবনবোধের উৎকর্ষের বিচারেই তো অভিনেতার বিচার হয়। তাই শেষ বিচারে অভিনেতার চেহারা, গলা, অঙ্গিভঙ্গি মনোহারিত্বের চেয়ে, তাঁর অভিনয় কতটা জীবনের কাছাকাছি, কতটা জীবন থেকে নেওয়া এই প্রশ্নটাই অনেক বড় হয়ে যায়।"
‘চরিত্রের সন্ধানে’ গত কয়েক দশকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চলচ্চিত্র বিষয়ক নানা লেখার সংকলন, প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৪ সালে, দেড়শ পাতায় ক্ষুদে বইতে নানা স্মৃতিচারণমূলক লেখায় উনার অভিনয় জীবনের শুরু, মঞ্চে শিশির ভাদুড়ির অসামান্য অভিনয় দেখে কিভাবে উৎসাহ পেয়েছিলেন অভিনেতা হবার, কিভাবে তাঁর সাথে একই মঞ্চে অভিনয় করেছিলেন এই সব গল্পের ফাঁকে ফাঁকে উঠে আছে কিভাবে অপুর সংসারের অপু থেকে তিনি অশনি সংকেতের গঙ্গাচরণ হয়ে ওঠেন। কিন্তু নিজের অভিনীত প্রিয় চরিত্র কোনটা এই কালজয়ী অভিনেতার?
সেই প্রসঙ্গে নিজের প্রিয় নানা চরিত্রের কথা বলে যান তিনি, যে প্রতিটা চরিত্রের সাথে জড়িয়ে থাকে দেশ-কাল-ইতিহাসের বিশেষ আবহ। মনে করতেন নিজের সেরা কাজটা হয়তো আরও করা হয় নি, একদিন হবে। অভিনীত চরিত্র আর ভিতরের মানুষের টানাপোড়নে লিখেছিলেন,
“ এমনি একজন পেশাদার চলচ্চিত্রাভিনেতা আমি। আমার সম্ভাবনা আমার অভিনয় করার ক্ষমতা, আমার শ্রম আমি বিক্রি করি- এই আমার পেশা। কিন্তু এই শ্রম বেশিরভাগ বাঙালির সংগ্রাম সংগঠনে কোনো কাজেই আসে না। কারণ আমার শ্রম আমার সৃষ্টিশীলতা যারা কেনে তারা আমার বাসনা, আমার মানসিকতা, আমার আদর্শকে কেনা না। তারা আমার কাছ থেকে আমার অভিনয় করার ক্ষমতাটুকু নিষ্কাশিত করে নেয় এবং তদ্দ্বারা ব্যবসা করে। অতএব, এক সুদীর্ঘ বিচ্ছিন্নতার জন্ম হয় আমার ব্যক্তিত্ব ও আমার স্বাভাবিক বৃত্তিগুলোর মধ্যে। আমার ভাবনা ও আমার কাজের মধ্যে দূরত্ব দুস্তর হয়। ছায়া দীর্ঘতর হয় আমার ও বেশিরভাগ দেশবাসীর মধ্যে। তাদের সত্যিকারের যে জীবন সেখানে আমার কাজ কোনও কাজেই আসে না।“
এখানে শুধু একজন অভিনেতা নয়, একজন যুগন্ধর, সচেতন, মানবতাবাদী মানুষকে আমরা খুঁজে পাই যিনি নিজেকে দহনের মাঝেই ব্যবচ্ছেদ করে সামাজিক দায়বদ্ধতার করা সচেতনতার আলোকে নিজেকে ঋদ্ধ করে চলেছেন, শেষ দিন পর্যন্তও।
নিজের পছন্দের কথা জানিয়েছেন যে সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে চার্লি চ্যাপলিনকেই মানেন তিনি, এবং যে সমস্ত অভিনেত্রীদের সাথে কাজ করেছেন তাদের মধ্যে ‘সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়’ শ্রেষ্ঠ। উনার আদর্শ শিশির ভাদুড়িকে নিয়ে লম্বা আলোচনা আছে।
সৌমিত্রর বড্ড ঝোঁক ছিল কারা অন্যের অনুকরণ না করে সম্পূর্ণ দেশী ভঙ্গীতে অভিনয় ঢেলে দিচ্ছেন সেটা লক্ষ্য রাখা, তাই জাঁদরেল অভিনয় কিন্তু হলিউডি অনুকরণ বলে তাদের চেয়ে তুলসী চক্রবর্তীর দেশী অভিনয়কে অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন, লিখেছেন তাঁর জীবন কথা। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, তপন সিংহ, মনোজ মিত্র প্রমুখ নিয়ে স্মৃতিচারণের সাথে সাথে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন বাংলা সিনেমায় নতুন শক্তিশালী অভিনেতা উঠে আসছে না কেন, সিনেমা ও থিয়েটার জগতের সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে।
অভিনেতার পাশাপাশি মানুষ হিসেবেও যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কতটা সচেতন ছিলেন তার প্রমাণ উনার এই লেখাগুলো।
বইটি প্রকাশ করেছে কলকাতার সপ্তর্ষি প্রকাশন, দাম ১৫০ ভারতীয় রূপী।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন