১৭৬৫ সালের কাহিনী! এর আগে বাঙলার কোন মানুষ সমুদ্রে তিমির বর্ণনা দিয়েছিল কি? জীবন্ত ডোডো পাখির? বা ব্রিটিশ জাদুঘরের? আফ্রিকায় হাতির দাঁত শিকারের? উড়ুক্কু মাছের? দূর মরিশাস দ্বীপের? স্কটিশ হাইল্যান্ডের? মন্ত্রমুগ্ধের মত পড়ে গেলাম এই অসামান্য দেড়শ পাতার বইখানা, বাংলা মুলুকের কোন মানুষের বিলেতযাত্রা নিয়ে রচিত প্রথম ভ্রমণকাহিনী! সেই সাথে আছে স্কটল্যান্ড, ফ্রান্স, মরিশাস, মাদাগাস্কার, উত্তমাশা অন্তরীপ, সেকালের সমুদ্রযাত্রার ( নানা প্রজাতির মাছ, তিমি, পাখির বর্ণনা) বিবরণ। এটাকে শুধুমাত্রা ভ্রমণকাহিনী বলা দায়, এটি ইতিহাস আশ্রিত স্মৃতিকথা, সেকালের ইংল্যান্ডের সামাজিক জীবনের খুঁটিনাটি জানার অসামান্য দর্পণ, আরও দারুণ ব্যাপার যে বইটি সরাসরি ফার্সি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডঃ এ, বি, এম হবিবুল্লাহ, বইটি মুক্তধারা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮১ সালে। সেই সংস্করণের প্রচ্ছদই পোষ্টে আছে।
বলা হয়ে থাকে শিক্ষিত ভারতবর্ষীয়দের মধ্যে যারা ইউরোপ ভ্রমণ করে ভ্রমণ-কাহিনী লিখে গেছেন, নদীয়া জেলার পাঁচনুর গ্রামের মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দীন তাঁদের মধ্যে সর্বপ্রথম। মূলত কাহিনীটি ফার্সী ভাষায় রচিত, যার নাম ছিল ‘শিগার্ফ-নামা-এ-বিলায়েত’। বইটি কখনো ছাপা হয়নি এবং এর নকল করা পাণ্ডুলিপিও খুব বেশি নেই। ১৮২৭ সালে ক্যাপ্টেন জ়ে, ই, আলেকজাণ্ডার এর ইংরেজী অনুবাদ করেন। কিন্তু তা ছিল নেহাত সংক্ষেপিত এবং সেই ইংরেজী অনুবাদটিও দুস্প্রাপ্য। ঢাকার হাকিম হাবিবুর রহমান তার সম্পাদিত উর্দু মাসিক পত্রিকা ‘যাদু’তে সেই পান্ডুলিপির বিষয়ে সর্বপ্রথম দৃষ্টি আকর্ষন করেন ১৯২৩ সালে। পরে ক্যাপ্টেন আলেকজাণ্ডারের ইংরেজী অনুবাদের ভিত্তিতে আলতাফ হোসেন নামের এক ভদ্রলোক ‘স্টেটম্যান পত্রিকায় মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দিনের উপর পূর্নাঙ্গ একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। ১৯৩৪ সালে স্টেটম্যানের সাথে এক সাক্ষাৎকারে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ কয়েকটি মূল পাণ্ডুলিপির অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করেন। পরবর্তীতে ব্রিটিশ লাইব্রেরীতে ফার্সী পাণ্ডুলিপির তালিকাভুক্তির করার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডঃ এ, বি, এম হবিবুল্লাহ শিফার্গ-নামা-এ-বিলায়েতের সন্ধান পান। তাঁর বদৌলতেই বইখানা আমরা পড়তে পারছি আজও।
সময়টা পলাশী যুদ্ধের এক দশকের মধ্যে। ১৭৬৫ সালে, বকসার যুদ্ধের পর লেখক রাজা তৃতীয় জর্জের কাছে দিল্লীর সম্রাট শাহ আলম কর্তৃক প্রেরিত দূতের অন্যতম সদস্য হিসাবে ইংল্যান্ড যান। বক্সারের যুদ্ধে অযোধ্যার নবাব সুজা-উদ-দৌলা, সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম, এবং মীর কাসিমের সম্মিলিত বাহিনী ইষ্ট ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর বাহিনীর কাছে পরাজিত হলে এলাহাবাদে শান্তি চুক্তির জন্য সকল পক্ষকে ডাকা হয়। এই সময় ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর দায়িত্বভার হাতে নিয়ে লর্ড ক্লাইভ দ্বিতীয়বারের মত বাংলাদেশে আসেন।
কলকাতায় সেই শান্তি চুক্তি করার সময় সম্রাটের একজন ফার্সী ভাষায় দক্ষ লোকের প্রয়োজন পড়ল। আর ভাগ্যের টানে লেখক ক্যাপ্টেন সুইনটনের সাথে ইংল্যান্ডগামী জাহাজে চড়ে বসেন। কিন্তু যাত্রা শুরুর সাত দিন পর ক্যাপ্টেন তাকে জানায় যে, লর্ড ক্লাইভ তার কাছ থেকে চিঠিটি নিয়ে গেছেন এবং পরের বছর সম্রাটের কাছে তিনি স্বয়ং উপহার সহ চিঠিটি পেশ করবেন। মূলত এটা ছিল একটি প্রতারণা, ক্যাপ্টেন মুন্সীকে জানিয়েছিলেন যে ক্লাইভ তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। দেড় বৎসর অপেক্ষা করেও লেখক সেই চিঠির সন্ধান পান নি। যা হোক ভ্রমণের পরপরই এই বইটা লেখা হয় নি, বরং প্রায় ১৫ বছর পর এটি লেখা হয়, যার প্রেক্ষাপট লেখক নিজেই বলেছেন
“হিজরী ১১৯৯ (১৭৮৪ খ্রীঃ) সনে। যখন এই দিন লেখক অতিমাত্রায় উদ্বিগ্ন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিল, চারিদিকের বিশৃঙ্খলায় যখন সে দুর্দশাগ্রস্থ এবং তার মন অশান্ত ও তার চিন্তাশক্তি লুপ্তপ্রায় হয়ে গিয়েছিল, তখন বন্ধুদের পীড়াপীড়িতে অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে (এই বৃতান্ত) লিখতে বাধ্য হয়।“
এবং সেখানে মির্জা ইতিসামুদ্দীন জানিয়েছিলেন যে কেন তিনি এই অসামান্য স্মৃতিকথা লিখছেন-
“এ যুগের বিচক্ষণ ও দক্ষ ব্যক্তিদের যেন অবিদিত না থাকে যে ভাগ্যক্রমে এই অধমকে চাকরি ব্যপদেশে ইংল্যান্ড যাত্রা করতে হয়েছিল। সমুদ্রে ও নানা দেশে যে আশ্চর্য ঘটনা ও বৈশিষ্ট সে লক্ষ্য করেছে তার বিবরণ অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক হবে তাতে সন্দেহ নাই।“
১১৮০ হিজরীর শওয়াল মাসের ৯ তারিখ, বাংলা ১১৭০ সালে ১৩ মাঘ হিজলীর ঘাটে মসিয়ে সোরভিল
(Courville)- এর জাহাজে তাদের যাত্রা শুরু হয়। আমাদের মনে রাখতে হবে একজন মুন্সী বিধায় লেখক সাধারণত রাষ্ট্রীয় রীতিনীতি, সামাজিক আচার আচরণ ও ব্যবসায়ী পণ্য নিয়েই বেশি আগ্রহী ছিলেন, এবং বইতে এই বিষয়গুলোরই উল্লেখ বেশী। তিনি উল্লেখ করেছেন এক থান মলমল কাপড় যা বাংলাদেশে দশ টাকায় কেনা হতো, ইয়োরোপে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ থাকায় বিক্রি হতো।
মালদ্বীপের বর্ণনায় তিনি জানিয়েছেন কী করে সেখানের মানুষের কড়ি আহরণ করে। জীবন্ত অবস্থা শুক্তিগুলি তারা ফাঁদে ফেলে মেরে ফেলে এবং শুকিয়ে পরিষ্কার করে বাজারে চালান দেয়, যা অনেক দেশেই মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
মরিশাস দ্বীপে পৌঁছে ঈদের জামাতে তিনি চাঁটগার একজন সারেং এবং হুগলী, ভেল্লোর ও শাহপুর নিবাসী সাতজন মুসলিম খালাসির দেখা পান যারা সকলেই সেই দ্বীপ দেশে বিয়ে করে সন্তানের পিতা হয়ে সেখানের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গিয়েছিল।
মরিশাসে থাকার সময় তাঁর লেখায় নানা মাছের বর্ণনা পাওয়া যায়,
“ দ্বীপের কাছাকাছি নানা রকমের মাছ পাওয়া যায় যা তারা বর্শা ও জাল দিয়ে ধরে। বাংলাদেশের মতো কোন মাছ আমি এখানে দেখিনি তবে এক রকম মাছ দেখলাম যার রং আমাদের কই মাছে মতো, কিন্তু মুখটা বেশ বড় ও খোলা। আর এক রকম মাছ আছে পুঁটি মাছের মতো, সাদা রং, মাঝে মাঝে লাল ফোঁটা, মুখ বড়, খেতে বেশ সুস্বাদু। বোয়াল ও খলসের মত কিছু মাছও দেখা যায়। এই গুলিও খাদ্য হিসেবে অতি উত্তম।‘
আবার মরিশাস থেকে মাদাগাস্কারের পথে সেন্ট লুই দ্বীপে ( এখন নাম রিইউনিয়ন আইল্যান্ড) সাগরের কাছিমদের নিয়ে বলেছেন,
“ সামুদ্রিক কচ্ছপও দেখলাম, প্রায় দুই তিন মণ ওজন। জ্যোৎস্নারাতে যখন কচ্ছপগুলো ডিম পাড়ার জন্য শুকনো ডাঙ্গায় বালুতে আসত, সেই সময়ে জাহাজের গোরা খালাসিরা ফাদ পেতে তাদের ধরত। এক একরাতে তাদেরকে ৪০/৫০টা কচ্ছপ ধরতে আমি দেখেছিলাম, তার একটা মাংসই জাহাজের সমস্ত যাত্রীর জন্য যথেষ্ট হতো।“
এই দ্বীপেই এক অদ্ভুত পাখির কথা বলেছেন তিনি, কেন যেন যা এখন বিলুপ্ত কিন্তু সেই সময়ের মরিশাসের ডোডো পাখির কথা মনে করিয়ে দেয়-
“এখানের অনেক বড় বড় পাখি দেখলাম যার মাংস খাওয়া চলে। পাখীগুলির কোন বাসা নাই, কেননা সেখানে বাসা করার মত কোন ঘাস পাতা বা গাছপালা নাই। উঁচুনিচু টিলার কোণে বা পাথরের আড়ালে তারা থাকে। পাখিগুলো মনে হলো আগে মানুষ দেখেনি কিম্বা মানুষের হাতে কষ্ট পায় নি, তাই মানুষকে তারা একধরনের জন্তু মনে করে কাছে আসে। আজকাল অবশ্য জাহাজের যাতায়াতে মানুষ দেখছে, কিন্তু মনে হয় যেন তারা আত্মরক্ষা করা শেখেনি, কেননা দেখলাম জাহাজের লোকরা তাদেরকে ধরার চেষ্টা করলে পাখিগুলো চিৎকার করে ডানা ঝাপটে ও ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে তাদেরকে আঘাত করতে থাকল বটে, কিন্ত পালাল না। এগারটি আহত পাখিকে জাহাজে নিয়ে আসা হল। এই লেখকও গোরাদের কাছ থেকে দুটি পাখি চেয়ে জাহাজে নিয়ে আসে এবং মুহম্মদ মুকীব যে পরিচারক তার সাথে ছিল সে পাখি দুটিকে জবাই করে পরিষ্কার করে গরম মসলা ও ঘি দিয়ে অতি যত্নের সাথে পাক করল। কিন্তু মাংসটা কিছুতেই সিদ্ধ হল না এবং দুর্গন্ধও গেল না। অগত্যা না খেতে পেরে আমরা সে রাঁধা মাংসটা পানিতে ফেলে দিলাম। গোরারা কিন্তু পাখিগুলোকে আগুনে পুড়িয়ে নিয়ে মহানন্দে খেতে লাগলো।‘
মুশকিল হচ্ছে লেখক একবার উল্লেখ করেন নি যে পাখিগুলো উড়তে সক্ষম বা অক্ষম ছিল কিনা। অক্ষম হলে যে ডোডো, তাতে কোন সন্দেহ নাই। অন্যদিকে মরিশাসের প্রতিবেশি এই রিইউনিইয়ন দ্বীপে একসময়ে ডোডোদের থাকার কথা প্রচলিত থাকলেও এখানে কোন ফসিল পাওয়া যায় নাই, বা সন্দেহতীত ভাবে প্রমাণিত হয় নি। বিলায়েতনামা ইংরেজিতেও অনূদিত হয়েছে, ভাবছি সেটা সংগ্রহ করে দেখব এই পাখি সুলুক উদ্ধার করা যায় কিনা। কাছের বন্ধু হেলেন এক বছর থেকে আসলো রিইউনিয়ন দ্বীপে, সেও জানালো যে দ্বীপবাসীরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে ও গর্ব অনুভব করে সেই ডোডোদের জন্য, কিন্তু সেও কোন প্রমাণের কথা জানাতে পারল না। এই বইটা হয়তো গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে!
আরেক ধরনের মাছের বর্ণনা দিয়েছেন উনি, আমার ধারণা সেগুলো ডলফিন বা পরপয়েজ, কারণ পরে বলছি,
“ এক রকম মাছ আছে ঠিক শুকরের মতো দেখতে, তার পা আছে। ইংরেজরা একে বলে হগ ফিশ। তাদের ভাষায় শুকরকে হগ ও মাছকে ফিশ বলে। মাছটি কালো ও আঁশহীন। এই রকম হাজার হাজার মাছ, বিষম আমোদে বুনো হরিণের মতো জাহাজেড় পিছনে লাফ-ঝাঁপ মেরে সাঁতার কেটে বেড়ায়। ঘোড়ার পিছনে ধাবমান সহিসের মত মহাউল্লাসে তারা জাহাজের ডাইনে বায়ে ও পিছনে পিছনে চল্লিশ-পঞ্চাশ ক্রোশ পর্যন্ত অনুসরণ করে। যখন হাজার হাজার মাছ এক সাথে লাফ মারে তখন ঝড়ের মতো শব্দ হয়। সে এক কৌতুকময় দৃশ্য। একজন গোরা সৈন্য এই রকম একটি মাছকে লাঠি দিয়ে যখন করে ধরে ফেলে। আগুনে ঝলসে নিয়ে আমরাও একটা মাছ খেলাম। অতি বিস্বাদ আর দুর্গন্ধ লাগলো”
- লেখকের বর্ণনা পড়েই সন্দেহ লেগেছিল যে উনি ডলফিন জাতীয় প্রাণীর ফ্লীপারকে পা ভেবে ভুল করেছেন, এবং যে আচরণের বর্ণনা দিয়েছেন তা ডলফিনদেড় সাথেই যায়। নেটে ঘেটে দেখি ওয়েলস এবং আইরিশ ইংরেজিতে ডলফিনদের যে নামে ডাকা হতো তার অর্থ আসলেই সাগরের শুকর, Sea Pig, আবার জার্মান ভাষায় সাগর শুকর বা শুক্র-মাছ থেকে পরপয়েজ শব্দটি এসেছে। নিঃসন্দেহে এটি সাগরের স্তন্যপায়ী জলজ প্রাণীর দল। আশা কড়ি পরের সংস্করণে সেটি উল্লেখিত থাকবে।
আর অভিভূত হয়ে পড়লাম তিমির বর্ণনা –
“ সামুদ্রিক হাঙরের কথা আমি আগে শুনেছিলাম, এখন তা সচক্ষে দেখলাম। ভারতবাসীরা এটিকে হাঙর বলে, কিন্তু তা ভুল। ইংরেজি ভাষায় এটিকে Whalefish বলে। তার শরীরের আয়তন দুটি প্রকাণ্ড হাতির সমান কিংবা তার চেয়েও বেশী, তার গলাও হাতির মতো। তার নাসিকা হাতির শুঁড়ের মতো কিন্তু দৈর্ঘ্যে আরও ছোট এবং তার নাস্রারন্ধ মাথার উপরে। প্রত্যেক বার শ্বাস নেবার সময় তার গলায় পানি প্রবেশ করে ও শ্বাস ত্যাগ করার সময় সেই পানি ফোয়ারার মত নিঃসরিত হয় ও খেজুর গাছের সমান উঁচু হয়ে উঠে ও প্রায় আধ ক্রোশ দূর থেকে তার আওয়াজ শোনা যায়। খাবারের লোভে ও জাহাজ দেখার জন্য মাছগুলি জাহাজের আশেপাশে ঘোরে, কখনোবা পানির তলায়, কখনো বা উপরে। তাদের এত প্রচণ্ড শক্তি যে একটু আঘাতেই জাহাজ ভেঙ্গে দিতে পারে। তিমি মাছ দেখলেই ভয় লাগে।“
কেপ অফ গুড হোপ বা উত্তমাশা অন্তরীপে তিনি আফ্রিকার অধিবাসীদের বর্ণনা দেন, বিশেষত তাদের সুঠাম দেহের বেশ সুনাম করেন,সেই সাথে কী করে তারা হাতিদের তাড়া করে ফাঁদে ফেলে মেরে ফেলে তাদের দাঁতগুলি কেটে বিদেশি বণিকদের কাছে বিক্রি করতো সেই বিবরণ দেন। এরপর দীর্ঘ যাত্রা শেষে উনারা ফ্রান্সে পৌঁছান, এবং নানা নাটকীতায় কাস্টমসের কারণে কিছুদিন আটকে গেলেও অবশেষে লন্ডনে পৌঁছান।
আমরা সাধারণতই ইউরোপীয়দের চোখে বাঙলার বর্ণনা পড়ি, কিন্তু এই অসামান্য গ্রন্থে আমরা বাঙলা মুলুকের এক অধিবাসীর চোখে বিলেতের সেই সময় ও সমাজকে দেখার দুর্লভ সুযোগ পাচ্ছি এখনো। উল্লেখ্য যে এর আগে চাটগাঁ ও জাহাঙ্গীরনগরের ( ঢাকা) খালাসী ছাড়া এই রকমের পোশাক আশাক পরা কোন মুন্সি এর আগে বিলেতে যায় নাই, ফলে মুন্সি রাস্তায় বের হলেই টাকে দেখার জন্য বেশ ভিড় জমে যেত, এবং অনেকেই তাকে ভারতবর্ষের কোন নবাব না নিতান্তপক্ষে নবাবের ভাই বলে মনে করত। রাস্তাঘাটে অনেক মহিলা তাকে My dear Kiss me বলে দুষ্টুমি করত। যে কারণে ক্যাপ্টেন সুইন্টনের বেশ খাতির বেড়ে গিয়েছিল বিলেতের নানা মহলে, কারণে নবাবের ভাইকে নিয়ে যে বিলেত ঘুরতে আসে সে নিশ্চয়ই ভারতবর্ষে কেউকেটা কেউ হবে, এইম্ন ধারণা লোকমনে ছিল। ক্যাপ্টেনও সেই জন্য যত দিন পারা যায় মুন্সীকে কাছে রাখতে চেষ্টা করেই গেছেন। তারা লন্ডনে প্রথমে উঠেছিলেন Hay Market এলাকার Coventry Street এর বাড়িতে।
এবার মুন্সির বয়ানে আমরা সেন্ট পলের ক্যাথেড্রাল, ওয়েস্ট মিনিস্টার গির্জা ও অ্যাবের সমাধিস্থলের কথা জানতে পারি, সেই সাথে অনুসন্ধিৎসু মানুষটাকে ব্রিটিশ জাদুঘরে ঘুরে নানা পাথর, ঝিনুক, মাছ, পাখি, মিশরীয় মমি ইত্যাদির বর্ণনার মাঝে Tiger fish নামে সাগরের এক মাছের ৫ হাত লম্বা শিঙ্গের কথা আছে, যা সম্ভবত নারহোয়েল তিমির দাঁত!পরে মুন্সীর সাথে এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা বিস্ময়মানব স্যার উইলিয়াম জোন্সের মোলাকাত হয়, যার ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে যেয়ে অনেক আরবি, ফার্সি, তুর্কী বইপুস্তক দেখেন এবং একটি চিঠি অনুবাদ করে দেবার মাধ্যমে তাদের একসাথে কিছু কাজের সূচনা ঘটে।
বিলেতের মানুষ ও সমাজ নিয়ে মুন্সির মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে রবার্ট ক্লাইভের দ্বারা এমন প্রতারণার শিকার হয়েও সাধারণত তাদের ভালো দিকগুলোর কথায় উল্লেখ করেছেন,
“নিজেদের কৃতিত্ব বা শৌর্যবীর্য নিয়ে দর্প করা ইংরাজদের চরিত্র-বিরুদ্ধ। যারা এ রকম করে তাদেরকে ওরা নিন্দনীয় মনে করে। কখনো যুদ্ধের কথা উঠলে কোনও অধিনায়ক, যে সুকৌশল ও বীরত্বের বলে যুদ্ধ করেছে, সে যুদ্ধের কেবল বস্তুতান্ত্রিক একটা বর্ণনা দিয়ে যাবে, নিজের ভূমিকা মোটেই উল্লেখ করবে না। সে মজলিশের কেউ যদি অধিনায়কের প্রশংসা বা তার কৃতিত্বের কথা বলতে থাকে, তা হলে সে অধিনায়ক অত্যন্ত অপ্রতিভভাবে নিজের পায়ের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে চুপ করে বসে থাকে, আর লজ্জায় ঘামতে থাকে। তাদের সম্মুখে তারিফ করা ইংরাজরা পছন্দ করে না। কেউ এ রকম করলে ওরা তাকে খোশামুদে মিথ্যাবাদী মনে করে। এ জন্য এদের মধ্যে খোশামদ করার রীতি নেই। সব দেশে খোশামদ ও আত্মভরিতাকে বুদ্ধিমান লোকেরা ঘৃণ্য মনে করে; কেননা তা কাপুরুষ ও নীচ প্রকৃতির লোকের কাজ। কিন্তু হিন্দুস্তানের সেপাই ও সর্দাররা আজকাল আস্ফালন ও চাটুকারিতাকে গৌরবের একমাত্র উপজীব্য বলে মনে করে। যেমন, কেউ যদি অতি কষ্টে ও বহু চেষ্টার পর একটা শৃগাল মারে তাহলে সে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করতে থাকে – আজ আমি এক বিরাট সিংহ শিকার করেছি, আর বীরত্বব্যঞ্জক অঙ্গভঙ্গি করে, বুক ফুলিয়ে গোঁফে তাও দিতে থাকে, আর এমন ভাব দেখায় যে অন্য কারও সাহস তার সমতুল্য নয়, এমনকি মহাবীর রুস্তমও তার কাছে বালক মাত্র।“
এবং সেই সাথে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন সেই দেশের শিক্ষা বিস্তারের দিকে মনোযোগকে,
“বিলাতে উচ্চশ্রেণীর লোকের পুত্র-কন্যার শিক্ষা দেওয়ার রীতি হিন্দুস্তান ও বাঙলার ধনীদের মত নয় যে শিক্ষক ও ওস্তাদকে বেতন দিয়ে নিজ গৃহে নিযুক্ত করা হবে, ছেলেমেয়েরা গৃহের বাইরে যাবে না যাতে তাদের উপর কুনজর না পড়ে কিম্বা ভূত-প্রেতের দৃষ্টি লাগে, কিম্বা বিদেশে অসুখে পড়ে। ইংল্যাণ্ডের অভিজাতদের রীতি হিন্দুস্তানের বিপরীত। আমীর বা উজীর ইত্যাদি হওয়া সত্ত্বেও এরা নিজ পুত্রকন্যাদেরকে দূর দূরান্তের শিক্ষালয়ে পাঠিয়ে শিক্ষকের হাতে তাদেরকে সোপর্দ করে দেয়। …….যদিও বিলাতের লোকদেরকে নিজ সন্তানদেরকে বিদ্যাশিক্ষার জন্য দূরদেশে পাঠিয়ে তাদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করে বলে বাঙলার লোক দোষারোপ করে থাকে, কিন্তু বিচার করে দেখলে মানতেই হবে যে সন্তানের প্রতি কঠোরতা অবলম্বন করে বিলাতের পিতামাতা পরম বন্ধুর কাজই করেন, যাতে তারা বিদ্যা ও শিল্পে সুশিক্ষিত হয়ে সারা জীবন সুখ-স্বাচ্ছন্দে কাটাতে পারে। পিতামাতার যে স্নেহমমতা সন্তানকে বিদ্যাশিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে তা তার পক্ষে শ্ত্রতা ও নিষ্ঠুরতা বই আর কিছু নয়।“
এবং এমন একটি বিষয়ের তিনি অবতারন করেছেন যা গত ২৫০ বছরে খুব একটা পরিবর্তিত হয় নি,
“বিলাতের শিক্ষক ও পণ্ডিতেরা কঠিন শাস্ত্রের এমন সহজ ও সরল পুস্তক রচণা করে থাকে যে জ্ঞান, বিজ্ঞান ও শিল্পের প্রারম্ভিক শিক্ষার্থীদের কোন অসুবিধা হয় না। আর মুদ্রিত পুস্তকের প্রাচুর্য এত বেশী যে কেউ যদি প্রত্যেকটি শাস্ত্র ও বিদ্যার উপর লিখিত দশ হাজার করে বই কিনতে চায়, তা এক দোকান থেকেই পাওয়া যেতে পারে। তাছাড়া বহু পুস্তক অত্যন্ত সস্তা, হিন্দুস্তানে শাহনামার একটা বই কিনতে হলে কয়েক’শ টাকা লাগবে, বিলাতে কিন্তু সেই বই দশ-বারো টাকাতেই পাওয়া যায়।‘
তবে বইয়ের বিশাল অংশ জুড়ে আছে ধার্মিক কিন্তু উদারচিত্ত মুন্সী বিলেতের খানাদানা, মহিলাদের বিয়ে করা আমন্ত্রণ উপেক্ষা করা, সর্বোপরি সেই দেশে থেকে উচ্চ বেতনে পার্সি শিক্ষাদান উপেক্ষা করে কেন দেশের টানে তিনি ফিরে এলেন সেই সমস্ত কথা,
“আমি বাঙলাতে বিশ বৎসর কাটিয়েছি, মুসলমানদের আচার-ব্যবহার আমার বেশ দেখা আছে, কারণ আমি নবাব ও আমীরজাদাদের সঙ্গে একত্রে পানভোজন করেছি। দেখতাম, মুসলমান আমীর ও আভিজাত্যরা প্রকাশ্যে মুসলমানদের সামনে মদ্যপান থেকে বিরত থাকত, বলত, ‘আমরা মদ্য পান করি না’। কিন্তু মজলিশ তকে অভ্যাগতরা উঠে যেতেই সাকীর হাত থেকে মদের পাত্র নিয়ে একাধারে পান করে যেত, আর বলত, ‘মদ অত্যন্ত ভাল জিনিষ, এর মত নেয়ামত পৃথিবীতে আর নাই। শরীয়তে মানা আছে বলে অনভ্যস্ত লোকের সামনে মদ্যপান করা দূষণীয় বটে, কিন্তু গোপনে আড়ালে এক আধটুকু পান করাতে আপত্তি নাই’।‘
সেই সাথে ভারতবর্ষে পুরুষকুল যে সাবালক হলেই যে কোন উপায়েই বিবাহ করতে ব্যগ্র হয়ে থাকে, এবং বিবাহের জন্য দরকার হলে বিশাল ঋণ করে পরে সারা জীবন কর্য চুকায় অথবা দূর দেশে যেয়ে কাজ করে সেই ঋণ শোধ করতে বাধ্য হয় সেটার উল্লেখ টেনে, বাল্যবিবাহকে উপহাস করে তার সাথে বিলেতের যুবাদের প্রথমে জীবন গড়ে, নিজের পায় দাঁড়িয়ে, দেশ-বিদেশ ভ্রমণ শেষে চল্লিশ বছর উপনীত হয়ে বিবাহ করার রীতিকে সাধুবাদ দিয়েছেন।
"আর ভারতবর্ষের ব্যাপার দেখলে দুঃখে ও লজ্জায় মন ভরে ওঠে। এ দেশে পিতামাতা অল্প বয়সেই পুত্রের বিবাহ দিয়ে দেয়। অন্যথায় সাবালক হয়ে পুত্র নিজেই সর্বাগ্রে বিবাহ করবে। যদি তার পেশা বা চাকরি থেকে যথেষ্ট আয় হয়, না তাঁর তেমন অর্থসঙ্গতি থাকে ত ভাল, নচেৎ সে নানা চেষ্টায় ও কষ্টে টাকা ধার করে আজীবন ঋণী থাকবে, আর ন্যত আত্মীয়স্বজন প্রতিবেশীর কাছে ভিক্ষা করে কিংবা খয়রাত গ্রহণ করে বিবাহের খরচ সংগ্রহ করবে; বিবাহ করাকে পৃথিবীর আর সমস্ত কাজের মধ্যে এরা সবচেয়ে জরুরী বলে মনে করে। এর পরে ঋণ পরিশোধ করতে তাকে জীবিকার অন্বেষণে দুরান্তে যেতে হয়, এক দেশ থেকে অন্য দেশে ঘুরে বেড়াতে হয়, এক মাস, এক বৎসর কিম্বা কখনও বহু বৎসর পর সে গৃহে ফিরে স্ত্রীর সঙ্গে বাস করতে পারে।"
বোঝা যায় অতিমাত্রায় ভোজনরসিক এবং আমোদপ্রিয় পেটমোটা ভারতীয় রাজপুরুষদের চেয়ে অভিযানপ্রিয় এবং শরীরচর্চা অনুরাগী ইংরেজদের জীবনযাপন তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল ভালো ভাবেই। সেই সাথে রাজা মাত্রেই যে বিলেতে সর্বেসর্বা না, রাজা চাইলেই যে কাউকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারেন না এই জিনিসগুলোও তাকে আকৃষ্ট করে ছিল।
উল্লেখ মুন্সী সেই ক্যাপ্টেনের সাথে স্কটল্যান্ডের এডিনবরার বাড়িতে যান, এবং স্কটল্যান্ডে হাইল্যান্ড ও নানা গ্রামে ভ্রমণ করেন, এবং ইংরেজ ও স্কটদের মধ্যকার রেষারেষি কিছুটা তুলে আনতে সক্ষম হন। আসলে এই বইখানা সেকালের ইংল্যান্ডকে বুঝতে এখনো যথেষ্টই মূল্যবান।
( ইংল্যান্ডের আঁকা মুন্সীর চিত্রকর্ম)
মন্তব্য
Courville এর লিপ্যন্তর বাংলায় কুরভিল (কুঘভিল লিখলেও দোষ ধরা কঠিন)। সোরভিল একেবারেই নয়।
বইটার প্রচ্ছদ আমাকে বেশ টেনেছে, একটু পরপর এসে দেখে গেলাম। বেশ বলিষ্ঠ সারল্য আছে। একটু খুঁজে দেখলাম, বইটার প্রচ্ছদকার মোহাম্মদ ইদ্রিস। তিনি আমাদের জাতীয় প্রতীকের শাপলা অংশটুকুর নকশাকার সম্ভবত।
সম্ভবত, আরেকটু খবর নিতে হবে উনাকে নিয়ে।
facebook
রিইউনিয়ন আইল্যানডের পাখি টা সমভবত: রিইউনিয়ন সলিটেয়ার। ডিটেইলস এখানে : https://en.wikipedia.org/wiki/R%C3%A9union_ibis
হতে পারে, এটিও বিলুপ্ত! আসলে ফার্সি বইতে যদি জানা যেত যে পাখিগুলো উড়তে পারত নাকি পারত না, তাহলেই রহস্যের সমাধান হয়ে যেত।
facebook
নতুন মন্তব্য করুন